শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
৯৭০. পানি-রুটি এবং মানব এক তো নহে দুই জাতের
খাদ্য হয়ে এরাই অভিন্ অংশ বনে মানবদের।
৯৭১. পরস্পরে ভিন্ন তবু দেখলে মিলন দুই জাতের
ভাববে তখোন কোথাও বা কোথাও আছে মিল তাদের।
৯৭২. ভিন্নজাতের প্রতি যদি হয় হৃদয়ের আকর্ষণ
সাদৃশ্য তার আছে কোথাও এ জন্যই টানছে মন।
৯৭৩. তুল্যতা তো আসল নহে, ধার করা এই তুল্যতা
ধারের জিনিস রয়না সদা, এটাই জেনো সার কথা।
৯৭৪. পাখিরা যায় উড়ে সেথায় ব্যাধেরা শিস দেয় যখন
পায় না যখন স্বগোত্রীয় উল্টো ফিরে ধায় তখন।
৯৭৫. মরিচিকায় পানি ভেবে ধায় সে দিকে তৃষ্ণাতুর
পানি যখন পায় না হোথা, যায় সে ছুটে আবার দূর।
৯৭৬. মিসকিনেরা নকল টাকা পেয়ে লাফায় আনন্দে
বিজ্ঞজনে দেখায় যখন লজ্জিত হয় তখন সে।
৯৭৭. নকল সোনা যেন তোমায় ভ্রান্তি জালে না আটকায়
বক্র ভাবন-চিন্তা যেন ফেলেনা গভীর কূয়ায়।
৯৭৮. আসছে বয়ান সামনে এখন দিমনা এবং কালিলার
গ্রহণ করো শিক্ষা কিছু বয়ান থেকে কিস্সাটার।
৯৭৮. শিক্ষা আছে অন্তরালে, তেমন কিছু গল্পে নাই
প্রচলিত গল্প পুরান, হয়ত তুমি শুনছ তাই।
সিংহ ও খরগোশের গল্প
মনোরম এক বিশাল বন। সেখানে বাস করত নানা জাতের বন্য প্রাণী। মনের আনন্দে বিচরণ করত তারা। সহসা ঘটল মহাবিপদ। এক ভয়ঙ্কর সিংহ হানা দিল সেই বনে। সে প্রতিদিন ঝাপিয়ে পড়ে শিকার করত নির্বিবাদে। ভীত সন্ত্রস্ত পশুরা একদিন পরামর্শ সভায় মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিল যে, এভাবে তারা আর প্রাণ ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকবেনা। তার চেয়ে বরং প্রতিদিন একটি পশুকে পাঠাবে সিংহের আহার হিসাবে। সিংহ ও আর পাইকারী ভাবে হয়রান করবেনা তাদেরকে। লটারির মাধ্যমে যে দিন যে পশুর নাম উঠবে তাকেই স্বেচ্ছায় গিয়ে হাযির হতে হবে সিংহ-সমীপে। সিংহের কাছে তারা নিয়ে গেল এই প্রস্তাব। অনেক যুক্তি তর্কের পর সিংহ রাযি হল তাদের প্রস্তাবে। তদানুযায়ী সিংহের আহার হতে প্রতিদিন হাযির হতে লাগল একেক পশু। অবশেষে একদিন এল খরগোশের পালা। প্রতিবাদ করল খরগোশ এই যুলুমের। পশুরা চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে পাঠাতে চাইল তাকে। সে বলল, সবর কর তোমরা। আমি এমন এক উপায় বের করব যাতে আমিও রক্ষা পাই, আর তোমরাও রক্ষা পাও এবং এই বনে নিরাপদ থাকে আমাদের বংশধররা। অবশেষে অনেক বিলম্ব করে সে উপস্থিত হল সিংহের দুয়ারে। বিলম্ব দেখে সিংহ তো ক্ষেপেছিল দারুন ভাবে। খরগোশকে দেখে ভয়ঙ্কর গর্জনে জিজ্ঞাসা করল বিলম্বের কারণ। ভীত কাতর কণ্ঠে খরগোশ আরয করল, জাহাঁপনা আমি আমার এক বন্ধুসহ আসছিলাম আপনার সমীপে। পৌঁছেও যেতাম যথা সময়ে কিন্তু পথিমধ্যে পথ আগলে দাঁড়াল আপনারই মত আর এক সিংহ। কী বলব সে বন্ধুর কথা! সে আমার চেয়ে অনেক নাদুশ নুদুশ ও দেখতে সুন্দর! সে আমাদের ভক্ষণ করতে উদ্যত হল। তাকে বললাম আপনার কথা। অনেক অনুনয় বিনয় করলাম ছেড়ে দিতে কিন্তু কিছুতেই রাযী হল না সে। অবশেষে আমার বন্ধুকে তার কাছে জিম্মি রেখে আপনার সমীপে হাযিরা দিয়ে আবার তার কাছে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে সে রাযী হল। জাঁহাপনা! আমার অপরাধ আপনি ক্ষমা করুন। চলুন! দেখুন ঐ সিংহকে এবং হত্যা করুন তাকে। নইলে পথিমধ্যে কূপের ধারে অবস্থানকারী ওই সিংহকে এড়িয়ে কোন পশুই আর পৌঁছতে পারবেনা আপনার দরবারে।
খরগোশের কথা শুনে ভয়ংকর গর্জন করে উঠল সিংহ। সক্রোধে সে বলল: এই বনে আমি ছাড়া কে আবার রাজা! কে সেই দুঃসাহসী দুরাচার। এখনই ভাঙব তার ঘাড়। চল্্, দেখিয়ে দে তাকে। খরগোশ চলল আগে আগে পিছে তার সিংহ। অবশেষে সে পৌঁছল বনের মধ্যকার এক গভীর কূপের কাছে, স্বচ্ছ টলটলে যার পানি। একটু দূরে থাকতেই সে বলল, ওই গুহায় আছে সেই বেয়াদব সিংহটা আমার খুব ভয় হচ্ছে, আপনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঐ গুহার দিকে তাকান। ওখানে তাকে এবং সেই প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে দেখতে পাবেন। সিংহ এগিয়ে গেল। কটমট করে তাকাল কূপের ভেতরে। সেখানে নিজ প্রতিবিম্ব দেখে মনে করল ঐতো সেই প্রতিদ্ব›দ্বী দুশমন। দাঁত মুখ খিচিয়ে সে গর্জে উঠল। সাথে সাথে গর্জে উঠল ঐ দুশমনও। তবে রে! ঝাপিয়ে পড়ল সে কূপমধ্যকার সিংহের উপরে, নিমজ্জিত হল এবং ধ্বংস হয়ে গেল।
প্রতারক ধোকাবাজরা কী ছলে মানুষকে বরবাদ করে তাই দেখিয়েছেন মাওলানা এ গল্পের মধ্য দিয়ে।
মসনবী :
৯৭৯. এক মনোরম উপত্যকায় চরত হরেক পশুর পাল
হোথাকার এক গিরি-গুহায় সিংহ ছিল এক ভয়াল।
৯৮০. সিংহ হঠাৎ হামলা করে মারত পশু, করত ভোজ
এমনি রূপে হামলা, আহার চলছিল তার প্রতিরোজ।
৯৮১. এই বিপদে পশুরা সব করল মিলে এ নির্ণয়
রইবেনা আর এমনি তারা সারাক্ষণই সিংহ-ভয়।
৯৮২. বরং তারা একটি পশু সিংহে দিবে প্রতিরোজ
করবেনাকো হামলা সে আর সেটাই বসে করবে ভোজ।
প্রস্তাবনা নিয়ে গেল সিংহ-পাশে একটি দল
বলল : রাজন! মানুন এটা পাব উভয় এর সুফল।
চেষ্টা ছাড়াই এ রূপ আহার আপনি পাবেন প্রতিদিন
চরব মোরাও স্বাধীন সুখে উপত্যকায় শঙ্কাহীন।
সিংহ বলে : মেনে নিলাম, ভুলিস না এ অঙ্গীকার
প্রতারণার শিকার আমি হয়েছি রে বারম্বার।
প্রতারিত অনেক আমি হয়েছি লোকের কথায়
সাপ বিছাদের দংশনেতে মরছি বিষের যন্ত্রণায়।
ভেতর থেকে ‘নফস’- ক্ষতির চেষ্টা চালায় নিরন্তর
হাজার অরির চাইতেও তার প্রতারণা ভয়ঙ্কর।
মোমিন কভু এক বিবরে দেয় নাকো পা দোস্রা বার
স্মরণ রেখে চলি আমি এই উপদেশ মোস্তফার।
বনের পশুদের চেষ্টার উপরে তাওয়াক্কুলের অগ্রাধিকার দান
বলল তারা : দিন ছেড়ে এই সাবধানতা, হে আমীর
সতর্কতায় হয়না বদল নির্ধারিত যে তকদীর।
বাড়ে কেবল দুঃখ-জ্বালা সতর্কতায়- তদবিরে
তাওক্কুলে* অটল থাকুন আস্থা রেখে তকদিরে*।
চাইনা লড়া ভাগ্য-সাথে যতই থাকুক শক্তি ঢের
শত লড়াই লড়লেও শেষ-বিজয় হবে তকদিরের।
পড়ে থাকুন খোদার রাহে অচল হয়ে মুর্দাবত
গযব যেন না হয় নাযিল প্রভাত-প্রভুর অকস্মাৎ।
সিংহের চেষ্টা ও তদবির কে তাওক্কুলের ওপর অগ্রাধিকার দান
সিংহ বলে : হয় যদিও দিক-দিশারী তাওয়াক্কুল
কাজও করে যেতে হবে, এই কথাই কন রাসূল।
এই কথাটি খোদার রাসূল বলে দিছেন পরিষ্কার
তাওয়াক্কুলের সাথে সাথে লও বাধিয়া উট তোমার।
খোদার প্রিয় বন্ধু সে জন যে জন করে উপার্জন
তাওয়াক্কুলের দোহাই পেড়ে অলস না হও বৎসগণ।
খোদার ’পরে ভরসা কর, কাজও কর কায় মনে
কেবল কাজই শেষ কথা নয়, ভরসাও চাই তার সনে।
শ্রম দিয়ে যাও সাধ্যমত, সফলতার পথ এটাই
শ্রমে বিমুখ অলস জনের ভাগ্যে কোনো নেই ভালাই।
বনের পশুদের পুনঃ তাওয়াক্কুলকে অগ্রাধিকার প্রদান
বলল, উপায় উপকরণ তারাই করে অন্নেষণ
ছোট ছোট লোকমা যথা গ্রহণ করে রুগ্নজন।
খোদার ’পরে ভরসা সম মহাউপায় কিছুই নাই
খোদায় পুরো সমর্পনই শ্রেষ্ঠ উপায় জানবে তাই।
এক বিপদে বাঁচতে কেহ অন্যতে হয় গ্রেফতার
বাঁচতে গিয়ে সর্প থেকে মুখে পড়ে আসদাহার।
মানুষ বাঁচার বুদ্ধি করে, নানা পথের নেয় উপায়
রক্ষা কবচ ভাবছে যাকে, জীবন-ঘাতক তাই ই হয়।
শত্রু ভয়ে বন্ধ ফারাও করেছিল গৃহ দ্বার
অথচ সে জানত না যে, ঘরের মাঝেই শত্রু তার।
যেই মূসাকে মারতে করে লক্ষ শিশুর জীবন নাশ
সেই মূসাই সমাদরে নিজ ঘরে তার করল বাস।
অক্ষিদ্বয়ে জরা তোমার ঠিক ভাবে না দেখতে পাও
বন্ধ কর এই দু’আঁখি, খোদায়ী দিঠি শক্তি নাও।
চক্ষু মোদের, জরাকাতর দিষ্টি মোদের ক্ষীণ ও ভুল
তাঁর আঁখিতে দেখলে তখন দেখতে পাবে আদ্যমূল।
শিশু যাবত রয় অসহায়, শক্ত না হয় হাত-পা তার
তত দিন ওই শিশুর বাহন শক্ত সবল পিতার ঘাড়।
কোমল পায়ে বল ক্ষমতা দেখাতে সে যখন যায়
হয় না সফল বরং অনেক দুঃখ এবং কষ্ট পায়।
দেহ-কারায় বন্দী হওয়ার পূর্বে ছিল প্রাণ আযাদ
সফর ছিল অনন্তে তার, ছিল না এই দুখ বিষাদ।
হুকুম হলো যখন খোদার এখান থেকে যাও নেমে
বন্দী হলাম, ওই অসীমে সফর গেল হায় থেমে!
আমরা সবাই পোষ্য খোদার, আহার করি খাদ্য তার
রাসূল বলেন, সৃষ্টিনিচয় খোদার মহাপরিবার।
আকাশ থেকে পরম দয়ায় বাদল ধারা ঝরায় যে
কাজ ছাড়া কি আহার দিতে পারে না সে সৃষ্টিকে ?
সিংহ বলে : অবশ্যই পারেন, তাহার শক্তি ঢের
তবে তিনি সামনে রেখে দিছেন সিঁড়ি- বান্দাদের।
ধাপে ধাপে পা রেখে তায় ঊর্ধ্বে যাবে, নিয়ম তাই
শক্তি ও বল তারই দেয়া ‘জবরী’ হওয়ার যুক্তি নাই।
আছে দু’পা তবে তুমি লেংড়া হবে কোন্ দুখে
আছে দু’হাত, লুকাবে ক্যান্ ? শক্তি দিবে ক্যান্ রুখে ?
মালিক যখন লাঙল তুলে দেন হাতে তার মজদুরের
বলে দিতে হয় কি তখন কি চাই, কি বা লক্ষ্য এর ?
হাত পা মোদের বেল্চা যথা, কাজ করে যাও লক্ষ্য এই
আল্লা’ই দেন, তবে হাসিল করতে হবে চেষ্টাতেই।
ইচ্ছা এবং ইশারা তাঁর দিছেন ঢেলে এই মনে
সেই ইশারা বাস্তবায়ন করতে হবে প্রাণ-পণে।
ওই ইশারা বাস্তবায়ন করলে ঢেলে প্রাণ ও মন
শ্রমের বোঝা হবে লাঘব, খুলবে ভেদের দ্বার তখন।
শ্রম দিয়ে যাও, শ্রম-সাধনা বাহন তোমার উন্নতির
তামিল করে যাও গো হুকুম, প্রিয় হবে মওলাজির।
নিজকে উপযোগী কর, দাও পরিচয় যোগ্যতার
দীদার লাভের কাজ করে যাও পাবে তুমি তাঁর দীদার।
চেষ্টা ও শ্রম করে যাওয়াই নিয়ামতের ঠিক কদর
‘জাবর’ হওয়া নিয়ামতের নাশুকুরির নামান্তর।
নিয়ামত কে বাড়ান খোদা করলে আদায় শুকরিয়া
নাশুকুরী করলে তখন ওই নিয়ামত যান নিয়া।
গুটিয়ে নিয়ে হাত পা তোমার লাশের সুরত ধরবেনা
যাবত সখা না দেন দেখা ঘুমিয়ে পথে পড়বেনা।
‘জাবর’ তমি ঘুমিও না, ঘুমিও না খবরদার
সেই বিরিখের ছায়া ছাড়া, শাখায় যাহার ফলের ভার।
নিদ্রা যেয়ো লক্ষ্যে গিয়ে স্নিগ্ধ বায়ে সুনির্মল
ঝরবে তোমার পরে তখন সুস্বাদু সুমিষ্ট ফল।
‘জাবর’ মানে- দস্যু-মাঝে নির্ভাবনায় ঘুমোন বেশ
যেই মোরগ অসময় ডাকে সেই মোরগের জীবন শেষ।
তাঁর ইশারার প্রতি যদি দুর্বিনীত, ধৃষ্ট হও
যতোই ভাবো নিজকে পুরুষ, নারী তুমি, পুরুষ নও।
হদ্দবোকা হবে তখন, হারিয়ে যাবে বুদ্ধি তেজ
মগজ বিহীন ওই মাথাটা হয়ে যাবে তখন লেজ।
কৃতঘ্নতা ভারি লাজের, কৃতঘ্নতায় সর্বনাশ
পরিণতি কৃতঘ্নদের- কঠিন আযাব, দোযখ বাস।
ভরসা কর খোদার পরে, কাজও কর পরাণপণ
ভরসাসহ ক্ষেতটা চষো, করো তাতে বীজ বপন।
বনের পশুদের উত্তর
উচ্চস্বরে বলল তারা : সর্বকালে লোভীর দল
চেষ্টা উপায় রাখছে জারী নিরন্তর এ পৃথ্বিতল।
হয়নি কোন কিছু তাদের তদবিরে ও চেষ্টাতে
কেন বলুন, বঞ্চিতই রইল তারা শেষটাতে ?
আদি থেকে কোটি কোটি বনি-আদম এ দুন্য়ার
লোভ-লালসায় মুখ হা করে রইছে যথা আস্দাহার।
পাহাড় গিরি ধ্বংস কত হলো কোশেশ তদবিরে
তার বিবরণ রয়েছে পাক কুরআনে ও তফসীরে।
লাভ সে সবে হয়নি কিছু, সব হয়েছে ব্যর্থ- ছাই
তকদিরে যা লিখা ছিল অবশেষে জুটছে তাই।
ব্যর্থ হয়ে গেছে সকল চেষ্টা ফিকির কাজ সবার
তাই মিলেছে অবশেষে ভাগ্যে ছিল যেমন যার।
চেয়েছে যা পায়নিকো তা চেষ্টাতে কেউ ধরার মাঝ
রয়ে গেছে চির বহাল ভাগ্যলিপি- খোদার কাজ।
চেষ্টা কেবল আশার ফানুস, আকাশ কুসুম কল্পনা
চেষ্টা কেবল তুষ্টি মনের, ঊর্ণনাভের জালবোনা।
হযরত সুলাইমান (আ.)-এর সময় আজরাঈল (আ.)-এর হাত
থেকে এক লোকের প্রাণ-রক্ষার সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার ঘটনা
সম্মানিত স্বাধীনচেতা একটি মানুষ ভোর বেলায়
এলো নবী সুলাইমানের দরবারে তাঁর রাজ সভায়।
ফ্যাকাশে মুখ নীলাভ চোখ, এস্ত ভীত বদন ঘ্রান
হাল দেখে তার ‘কি হয়েছে’ শুধান নবী সুলাইমান ?
বলল : আমি আসার পথে আয্রাঈলে দেখনু ঠিক
কট্মটিয়ে রোষ ভরে সে তাকাচ্ছিল আমার দিক।
‘কি চাও তুমি আমার কাছে’? শুধান তাকে সুলাইমান
বলল : ‘জনাব, আপনি করুন বাতাস কে এ হুকুম দান :
আমাকে সে এখান থেকে পৌঁছিয়ে দিক ভারত ঠাঁই
যেন আমি আয্রাঈলের কবল হতে রক্ষা পাই।
এরূপ মানুষ দারিদ্র ও অভাব থেকে পালায় আর
অলিক মোহ, লোভ লালসার নির্বিশেষে হয় শিকার।
চেষ্টা মানুষ করে বটে কিন্তু সবই হয় বেকার
পালিয়ে বেড়ায় অভাব থেকে, পিছ ছাড়ে না অভাব তার।
হুকুম দিলেন তখন নবী : বাতাস তুমি শীঘ্র যাও
এ লোকটিকে ভারত সীমার গহীন দ্বীপে পৌঁছে দাও।
সাথে সাথে অমনি বায়ূ হুকুম মত করল কাজ
পৌঁছে দিল সোমনাথের নিকটে এক দ্বীপের মাঝ।
দ্বিতীয় দিন বসেন যখন খোদার নবী রাজ সভায়
আয্রাঈলে দেখতে পেয়ে তখন তিনি শুধান তায় :
‘অমুক মুসলমানের পানে কাল আপনি রোষ ভরে
তাকিয়ে ছিলেন কোন্ কারণে ভয় পেল সে যার তরে।
সেই ভয়ে সে ভীত হয়ে ছাড়ল বাড়ি, ছাড়ল ঘর
হয়ে গেল বিবাগী সে, গেল হয়ে দেশান্তর’?
কন্ আয্রাঈল : ক্রোধে নহে, তাকিয়েছিলাম সবিস্ময়
যে জন হেথায়, ভারতে তার কেমনে আজই মৃত্যু হয়!
আল্লা পাকের হুকুম তাহার জান কবযের যেই খানে
শত পাখায় উড়ে যেতে পারবেনা সে সেই খানে।
খোদার হুকুম মতো আমি পৌঁছে ঠিকই হিন্দুস্তান
পেলাম তাকে এবং কবয করে নিলাম তাহার জান।
রক্ষা যেমন পায়নি সে লোক পালিয়ে গিয়ে দূর ভারত
অভাব থেকে পালাবারো তেমনি কারোর নেই তাকত।
সকল কাজই আল্লা’ পাকের ইচ্ছাতে হয় সম্পাদন
নয়ন খোলো, ভেবে দ্যাখো নিদ্রা-বেহুশ মানবগণ।
কোথায় যাব, কৈ পালাব, কৈ সে জাগা, কৈ সে ভিত ?
ছিনে নিব খোদার থেকে বিধ্বংসী- ভাব এ নিশ্চিত।
সিংহের পুনঃ চেষ্টা তদবিরের প্রতি গুরুত্ব প্রদান
সিংহ বলে : ঠিক বলেছ, তবে নবী রাসূলগণ
রননি বসে, জীবন ভরই কাজ করেছেন প্রাণপণ।
জীবন ভরই মুমিন লোকের জিহাদ শুধু, বিরাম নাই
আদি থেকে চল্ছে জিহাদ, তা-কিয়ামত চলবে তাই।
সহ্য করে গেছেন তাঁরা যে দুক্ষু তা বলার নয়
অবশেষে খোদা তাদের দান করেছেন দিগি¦জয়।
তাদের সকল চেষ্টা ছিল সূপূত পুণ্যময়
পুণ্যবানের কার্যাবলী সর্বদাই পুণ্য হয়।
করছে শিকার নভোপাখি, ফাঁদ পেতে নীল নভের গায়
ত্রুটি কিছু থাকলেও তা পৌঁছছে শেষে পূর্ণতায়।
চেষ্টা করে যাওহে সুধী! হক্কে থাকো বরকারার১
অটল থাকো পন্থে সদা নবী-রাসূল, আউলিয়ার।
চেষ্টা-উপায়, কর্ম, সাধন- ভাগ্য সাথে লড়াই নয়
এসব করাও ভাগ্যলিপি- বরাত এসব সুনিশ্চয়।
বিন্দু ক্ষতি হলে কারোর-পথিক হওয়ায় হক্ রাহের
‘খোদার কসম হবেনা তা’ হলে আমি বদ্ কাফের।
পট্টি কেন বাধছ মাথায় ? নাই মাথাতে যখন দুখ
কষ্ট করো কিছুটা দিন, অনন্ত কাল পাইবে সুখ।
ছুটছে যে জন দুন্য়া পিছে কিস্মতে তার অমঙ্গল
সন্ধানী যে আখেরাতের পরিণামে সেই সফল।
সকল কাজই মন্দ অসার দুন্য়া ভোগের, অর্জনের
সকল কাজই শুভ সাধু দুন্য়াদারি বর্জনের।
দুন্য়া-কারার প্রাচীর-গায়ে ছিদ্র করা প্রশংসার
মন্দ ভারি ছিদ্র-ফোকর বন্ধ করা এই কারার।
এই দুনিয়া বন্দিশালা, বন্দি মোরা এই কারার
চেষ্টা করো মুক্ত হতে, ভাঙো দেয়াল জেলখানার।
দুন্য়া হলো ভুলে যাওয়া আল্লাকে, তাঁর প্রেম ও ভয়
দৌলত ও মান, বাচ্চা বিবি- কোনোটাই দুন্য়া নয়।
যে ধন লাগে দ্বীনের কাজে, নেই সে ধনের কোনই তুল
‘খুবই ভালো সেই ধন ও মাল’ বলে গেছেন খোদ রাসূল।
ধ্বংস হবে, মরবে ডুবে, ঢুকলে পানি নৌকাতে
থাকলে পানি নিম্নে তরির, চলবে তরি ঠিকমতে।
রাজত্ব ধন-মোহ থেকে মুক্ত ছিলেন সুলায়মান
তাই নিজেকে করে গেছেন ফকীর বলে আখ্যা দান।
একটি কলস ভেতরে যার বাতাস ছাড়া কিছুই নাই
মুখ বেধে তায় ভাসাও জলে থাকবে ভেসে সর্বদাই।
দরবেশী বাতাসে ভরা যাহার ক্বলব হৃদয় মন
ভব-নদীর উপর সেও ভাসবে সদা সর্বক্ষণ।
খোদা-প্রেমের নিয়ামতে সর্বদাই তুষ্ট যেই
ভব-নদী ডুবাতে তায় পারবেনাকো কিচ্ছুতেই।
বিশ্বজগত এসে গেলেও কবজাতে তার- তুচ্ছ ছাই
খোদা প্রেমের মোকাবেলায় তার কাছে এর মূল্য নাই।
সিল্ মেরে দাও মনের ঘরে, বন্ধ কর দরজা তার
পূর্ণ করো হৃদয়-গেহ তত্তজ্ঞানে খোদ ইলার।
চেষ্টা, ওষুধ, ব্যথা- এসব সত্য- এতে মিথ্যে নেই
করে না যে শ্রমকে স্বীকার, মগ্ন সেও শ্রম-মাঝেই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।