শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
অনেক দিনের জমে থাকা মেঘ সরে আকাশটা আজ স্বচ্ছ। তার বুকে এক ফালি চাঁদ তারাদের ঘিরে আলো ছড়াচ্ছে। আহ্ কি সুন্দর। মানুষের মনটাই কুৎসিত হয়।বাকি সবকিছুর ঘিরে থাকা অন্ধকার কোন না কোন সময় দূর হয়।বাসান্তির মনে দোলা দেয়া প্রেম আজো মানুষের মনে দাগ কেটে আছে। কত বছর আগের ঘটে যাওয়া স্মৃতি আজো যেন মূর্তিয়মান।বিরাজ বাবু কেন ওকে শাস্তি দিল?জাত, মান এগুলোই কি সব! চা বাগানের ছায়া গাছগুলোকে জোৎস্নার,আলোতেও ভূতের মতন দেখাচ্ছে।তাকালে শুধু কালো একটা কি মনে হচ্ছে। চা বাগানের সৌন্দর্য দিনের। রাতাটাকে ভূতুরে করে দেখায়।কালো ঘুটঘুটে অন্ধকার রাজ্য,শুনশান নিরবতা।মাঝে ঝিঝি পোকার ডাক আরো ভয়াবহ ভয়ের সৃষ্টি করে। বড় ছায়া গাছগুলোকে মনে হয় বিশাল বিদঘুটে কালো কালো দৈত্য।
গহীন রাতের বুক চিরে ভেসে আসে অশরীরি আর্তনাদ এক ছোট্ট শিশুর। জন্মের পর যাকে হত্যা করেছিল বিরাজ বাবু।বাসন্তীকে ঐ বট গাছটায় ঝুলিয়ে রেখে তিলতিল করে কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। একটা মানুষও টুঁশব্দটি পর্যন্ত করেনি।সর্দার এর মুখের সামনে দাঁড়ানোর স্বভাব ওদের কারো ছিল না।
সবাই একসুরে বলেছিল-
- হামার সর্দার যা বুইলেছে তাই কুরতে হইবেক।তাহার উপর কথা কুইবে নাকো কেহ।
যত দোষ নন্দঘোষ।সারারাত নাচা গানা আর রঙ্গলীলা করাই তার নেশা।পল্লির কোন বাচ্চা মেয়েও রেহাই পেত না বিরাজবাবুর নষ্ট আঁচড় থেকে। কিশোরী,যবতী,পোয়াতি, বুড়ী কেউ না।সে করে শালিসি! মান্য করে তাকে পল্লির সকলে।কি পরিহাস!
নরায়ন বাইরে থেকে এসে বাগানে চা তোলার কাজ করত।দিন শেষ হলে আবারও চলে যেত।একসাথে বছর খানেক ধরে কাজ করছে বাসন্তিদের দলে।এভাবে ও ঘনিষ্ঠ হয় বাসন্তির সাথে। কত গল্প করে দুজন।কেমন সংসার হবে,কেমন করে ভবিষ্যতে ওরা থাকবে।পরিকল্পনা করে নিজের সাধ্য আর সামর্থ্যকে সঙ্গী করে।
একদিন বাগানে কাজ করতে করতে দুজন ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পরে কাঁধের বোঝা পাশে রেখে। একজন আর এক জনকে স্পর্শ করে একান্তে।জানে না,বুঝে না তার পরিনতি।সেই মূহুর্তে বুঝতেও চায় না তাদের মন।স্বেচ্ছায় সপে দেয় একজন আরেকজনকে।
- হামার এখন কিবহইবেক?
এ প্রশ্নের উত্তর জানে নারায়ন।শুধু বলে
- চিন্তা করিস না আমরা পালাইয়া যাইবেক এখান থাকি দূরত।সেখানে গিয়া সংসার পাতবেক।
ওর ডর লাগছে বিরাজ বাবুকে।বাসন্তী যেন দিনকে দিন ক্ুঁকড়ে যাচ্ছে নিজের মধ্যে। কিছু খাচ্ছে না,বমি হচ্ছে। শরীরটা ভেঙ্গে আসে কাজ করতে ইচ্ছে করে না।শুধু ঘুম পায় তার।রাজ্যের ঘুম যেনো ভর করেছে দুচোখের পাতায়।বাসন্তী একদিন কাজে না আসলে, ওকে না দেখতে পেলে নারায়ন অস্থির হয়ে পরে। বাসন্তির মা টের পেয়ে মেয়েকে বনেদি ওষুধ খাওয়ায় যেন বাচ্চাটা পেটে না থাকে।কিন্তু কাজ হয় না।এভাবে আস্তে আস্তে সকলেই জেনে যায়। বাবুকে বিচার দিয়ে নারায়ণ কে বের করে দেয়া হয়েছে বাগান থেকে। ও স্বেচ্ছায় যেতে চায়নি।বাসন্তীকে সঙ্গে নিয়ে যাবে বলায় ওকে রক্তাক্ত করা হয়েছে মেরে।
তারপর একদিন সর্দার পঞ্চায়েত ডাকল।একঘরে করার সিদ্ধান্ত হল।মা,মেয়েকে একঘরে করে রাখা হল।মিনতির মা লুকিয়ে লুকিয়ে মাঝে মধ্যে খাবার দিয়ে আসে।কাজ করতে দিচ্ছে না বাগানে তাদেরকে। প্রায় উপোস তারা। এদিকে ৮ মাসের পোয়াতি বাসন্তী। পেটের ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে মা মেয়ে বিলাপ করে কাঁদছে একরাতে। মিনতির মা একটু ভাত আর আলুভর্তা, সাথে কচি চাপাতার ভর্তা নিয়ে ওদের ঘরের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু বিধি বাম! একেবারে বিরাজ বাবুর সামনে পরে গেল
- খাওন লিয়ে যাইছিস কেনে?
- হামার সহ্য হইছে না বাবু,ওদের কানদা।
- সহ্য করতে না পারলে তোহাক হামি একঘরে কইরে রাখবেক।
এই বলে মিনতির মাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে।
বাসন্তীর শাস্তি হবে খুব শিগগিরই। সিদ্ধান্ত হলো তাকে চা বাগানের পাশে বটগাছের সাথে বেধে রাখা হবে।প্রচুর বড় বড় লাল পিঁপড়েদের বাসা সেখানে। ওদিকে বাসন্তীর নয় মাস চলছে। যখন তখন প্রসব ব্যথা উঠতে পারে।
ওর মাকে ছেড়ে দেয়া হ›য়েছে। কিন্তু মেয়ের চিৎকার শুনে যেন না যায় কাছে তার জন্য শাসিয়ে দেয়া হয়েছে। শনিবার সকালে ওকে ওখানে বেধে রাখা হয়।ক্ষানিক্ষন পর থেকে শুরু হল বাসন্তির আর্তনাদ। ভারি হয়ে আসে বাতাস,আকাশ।লাল পিঁপড়েদের কামড়ে। কোন খাবারও দেয়া হচ্ছে না। তেষ্টার মরে যাচ্ছে সে।
- তোহাগের পায়ে পরছি।হামাক একটু জল দিবেক তোহারা।
- জল! পাপের শাস্তি বইলে কথা।আবার জল চাইছিস?
রাত এখন গভীর। তাকে চোখে চোখে রাখা হচ্ছে যাতে কেউ ওকে সাহায্য করতে না পারে।এদিকে রাত দুইটায় তার প্রসব ব্যথা উঠে। ব্যথায় আর পিঁপড়েদের কামড়ে ছটফট করছে। কেউ কাছে যাচ্ছে না একবারও। পাষাণ যে তারও তখন মন গলবে।কিন্তু ওর মন গলছে না।ওর মা পায়ে ধরছে সর্দারের।সে ভয় দেখাচ্ছে
- তুই বেশি বকছিস।তোহাকেও বেইধে রাখা হইবেক বেশি বাড়লে।
ভোর পাঁচটার দিকে বাচ্চার কান্না শুনা গেল।
একটি প্রাণীকেও যেতে দেয়া হলনা ওর কাছে। ক্ষানিক পরে বাচ্চার অনবরত চিৎকার শোনা গেল।সবাই বুঝল যে বাচ্চাটাকেও পিঁপড়ে কামড়াচ্ছে। তবুও সর্দারের মন গলল না।বাসন্তী বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ওকে ধরার চেষ্টা করছে কিন্তু ওর হাত বাঁধা। কি করে পারবে?
এক সময় বাচ্চার চিৎকার থেমে নিথর হয়ে গেছে।
বাসন্তী সারা রাত হাওমাও করে কাঁদছে, এক সময় শুধু গোংরানির আওয়াজ শোনা গেল ওর।
পরদিন ওর মা দৌড়ে মেয়ের কাছে গেলো।কি বিভৎস দেখতে লাগছে বাচ্চাটা। শরীরের মাংসগুলো চারপাশে খোবলা খোবলা হয়ে রক্তে ভেসে রয়েছে। চোখ থেকেও রক্ত ঝরছে। মেয়ের বাঁধন খুলে দিতেই বাসান্তি লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। কোন শব্দ করতে পারছে না মুখে। এক সময় তার শরীরও ঠান্ডা হয়ে নিস্তেজ হয়ে গেলো।
মা,বাচ্চার জীবনের যবনিকা ঘটলো।
আজো রাতে বাচ্চার কান্নার শব্দ ভেসে আসে বাতাসে। ভয়ে কেউ ঐ গাছটার তলে যায় না।বাচ্চাটার অশরীরী আত্মা এখনো মনে করিয়ে দেয় মানুষ নামের পশুর নির্মমতার কথা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।