Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মাতৃভাষায় শিক্ষা অর্জনের আবশ্যকতা

আনোয়ার হুসাইন | প্রকাশের সময় : ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০৩ এএম

পৃথিবীর প্রায় দুইশো দেশের মধ্যে প্রায় সাড়ে সাতশো কোটি মানুষ বসবাস করছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এদের মধ্যে ৭১১১টি ভাষা রয়েছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বাংলাভাষার বিকাশ হয়েছে আজ হতে ১৩০০ বছর পূর্বে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানা ১,৪৮,৪৬০ বর্গ কিলোমিটার তার মধ্যে রয়েছে ৬৮ হাজার গ্রাম। ৪৬০ টি উপজেলা। এদেশটিতে প্রায় ১৮ কোটি মানুষের বসবাস। এদের মধ্যে ৯৫% মানুষের মুখের ভাষা হচ্ছে বাংলা ভাষা। ৫% নাগরিকের মধ্যে রয়েছে খাসিয়া, মনিপুরী, চাকমা প্রভৃতি উপজাতি। এদের রয়েছে যার যার নিজস্ব ভাষা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্য। তার মধ্যে সমগ্র দেশে রয়েছে নানান ধরনের আঞ্চলিক ভাষা। সিলেটের স্বতন্ত্র একটি ভাষা ছিল, যে ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। ভারতের আসাম মেঘালয়, শিলং, চেরাপুঞ্জি ইত্যাদি অঞ্চলে সিলেটি ভাষায় সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে। এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে স্কুল কলেজ মসজিদ মাদ্রাসা ইসলামি শিক্ষা সংস্কৃতিতে জড়িয়ে রয়েছে সিলেটের ভাষা। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় সিলেটের মানুষের মাঝে বাংলা ও সিলেটি ভাষা মিশ্রিত হয়ে গেছে। বাংলা ভাষায় বহু ভাষার শব্দের সংমিশ্রণ ঘটেছে। এ মিশ্রণের কারণ হলো এদেশকে শাসন করেছে ইরান, আফগান, আরব, ইংরেজ জাতির লোকজন। অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, বাংলা ভাষায় আরবি, ফার্সি, উর্দু, আফগান, ইংরেজি ভাষার অনেক শব্দ বাংলা ভাষায় মিশ্রিত হয়েছে। মুলত বাংলা ভাষা ছিলো একটা রাজকীয় ভাষা, রাজা বাদশা নবাব সম্রাট সকলের ভাষা ছিল বাংলা ভাষা। চট্টগ্রামের বৃহত্তর অঞ্চল এবং বার্মা নিয়ে ছিল মুসলিম রাজ্য। তার নাম ছিল আরাকান। ইতিহাস থেকে জানা যায় সেই রাজ্যের বিখ্যাত কবি আলাওল বাংলা ভাষায় অনেক কবিতা গ্রন্থ লিখেছেন। শুধু তাই নয় ভারতের মুসলিম সাম্রাজ্যের ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে জানা যায় সম্রাট আকবর বাংলা ভাষা চর্চা করেছেন। তিনি বাংলা ক্যালে-ার অর্থাৎ বাংলা সাল গণনা চালু করেছিলেন। চর্চাপদ হচ্ছে বাংলা ভাষার লিখিত প্রথম নিদর্শন। বাংলা ভাষা চর্চা করেছেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি নজরুল, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জসিম উদ্দিন, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যা সাগর, সৈয়দ মুজতবা আলী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষায় গীতাঞ্জলি লিখে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। ইসলামের দর্শন ইসলামের শিক্ষা সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্যের মধ্যে বিরাট একটা দখল রয়েছে বাংলা ভাষার। এটাকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
২০২২ সালে শিক্ষামন্ত্রীর দেওয়া তথ্যমতে বাংলাদেশে ১৯,১৯৯ টি কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। এই মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মূল ভাষা হচ্ছে বাংলা ভাষা। ওদের মাঝে সুমধুর বাংলা ভাষা চর্চা আরও বেশি করে বিকশিত করতে হবে। পৃথিবীর ৩০ কোটি মানুষের ভাষা হচ্ছে বাংলাভাষা। ব্যবহারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাভাষা পৃথিবীর বুকে একটি মধুর ভাষা হিসেবে পঞ্চম স্থান অর্জন করেছে। শুধু তাই নয়, পৃথিবীতে বহু দেশে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার সন্মান ও স্বীকৃতি দান করা হয়েছে। আফ্রিকার লিওন দেশে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দান করা হয়েছে। শুধু তাই নয় ভারতের পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা, শিলং, মিজুরাম, আসাম, পাকিস্তানের করাচী শহর, বাংলাভাষা দাপ্তরিক মর্যাদা পেয়েছে। এর সাথে বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন প্রায় দেড় কোটি প্রবাসী বাঙালী। তাদের মূল ভাষা হচ্ছে বাংলা। ছেলে মেয়ে স্ত্রী পরিবার পরিজনের সাথে বাংলা ভাষায় কথা বলেন তারা। ইংরেজি, ইটালি, ফরাসী, আরবীসহ ভিন্ন ধরনের বিচিত্র ভাষা হচ্ছে তাদের দ্বিতীয় ভাষা। দেখা যায় বৃটেনের মাটিতে বৃটিশ বাংলাদেশি অভিবাসী রয়েছে প্রায় ৮ লক্ষ। এদের সন্তানেরা মুলত ইংরেজি ভাষায় উচ্চ শিক্ষিত কিন্তু এদের পিতা মাতা ভাই বোনের সাথে এলোমেলো করে বাংলা ভাষায়, সিলেটি বাংলা ভাষায় কথা বলে ওরা। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার, বাংলা লিখতে পারেনা তারা। বাংলাদেশি বংশদ্ভূত বৃটিশ বাংলাদেশি নতুন প্রজন্মের মাঝে বাংলা ভাষা চর্চা এবং শিক্ষা সংস্কৃতির বিকাশ সাধনের কোন পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে না। সরকারি বেসরকারি ভাবে কোন পরিকল্পনা কোন চিন্তা ভাবনা নেই এ মাতৃভাষা সুরক্ষার। গবেষণা করে দেখা যায় বৃটেনের মধ্যে গঁষঃরহধঃরড়হধষ সঁষঃরপঁষঃঁৎধষ ংড়পরবঃু-র বিভিন্ন দেশের লোক রয়েছে। এর সাথে পরিসংখ্যান অনুযায়ী জনসংখ্যার প্রায় অষ্টম বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মূল ভাষা হচ্ছে বাংলা ভাষা, সিলেটি মাতৃভাষা। ইংরেজি হচ্ছে তাদের দ্বিতীয় ভাষা। এজন্য বৃটিশ সরকার তাদের সংবিধানের মধ্যে বাংলা ভাষাকে বৃটিশ বাংলাদেশি কমিউনিটির অষ্টম বৃহত্তর ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দান করেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এ স্বীকৃতির পাশাপাশি স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলা ভাষা শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করেনি বৃটিশ সরকার।এজন্য অদূর ভবিষ্যতে বাংলা ভাষা বৃটেনের বৃটিশ বাংলাদেশি তরুণ প্রজন্মের কাছে কালের পরিক্রমায় যুগের পরিবর্তনে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।
কিন্তু বাংলাদেশের এ বৃহত্তর প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটির মাঝে বাংলা ভাষা এবং বাংলাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতি সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কোন মাথা ব্যথা নেই! বৃটেনে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের নতুন প্রজন্মের মাঝে মাতৃভাষার বিকাশ সাধনের কোনো উদ্যোগ নেই।
বৃটিশ পার্লামেন্টে বৃটিশ বাংলাদেশি চারজন এমপি, স্কটিশ পার্লামেন্টে একজন বৃটিশ বাংলাদেশি তরুণ এমপি এবং আট লক্ষ বৃটিশ বাংলাদেশি কমিউনিটির বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবকবৃন্দ ঐক্যবদ্ধভাবে বৃটিশ সরকারের নিকট দাবি করতে হবে, বৃটেনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলা ভাষা শিক্ষার সুযোগ দেওয়ার জন্য। তা নাহলে বৃটিশ বাংলাদেশি তরুণ প্রজন্মের কাছ থেকে বাংলা ভাষা অচিরেই হারিয়ে যাবে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান হিসেবে, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এটাই সকলের নিকট আবেদন রাখছি। এবং দেশ বিদেশের মধ্যে ইসলামী শিক্ষার সকল প্রতিষ্ঠানগুলোর কিতাবগুলো বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে শিক্ষা দেওয়ার দাবি রাখছি।
১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো বাংলা ভাষাকে মর্যাদা দিয়ে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য যাঁরা জীবন দিয়েছেন তাঁদের সম্মানে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দান করেছে। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একটাই, পৃথিবীতে পাঁচ কোটি মাতৃভাষাকে লালন পালন করা।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, পৃথিবীর প্রায় ৪২ টি মাতৃভাষা চর্চার অভাবে অযতেœ অবহেলায় অন্য ভাষার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে যে কয়টি ভাষা পৃথিবীতে বহুল প্রচলিত রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম ২২টি ভাষার হিসাব নি¤েœ মধ্যে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।
১. চীনা ভাষা - ১২৮ কোটি ৪০ লক্ষ, চীন। (এই সংখ্যাটিতে চীনা ভাষার সব উপভাষা অন্তর্গত)
২. স্পেনীয় ভাষা - ৪৩ কোটি ৭০ লক্ষ, স্পেন।
৩. ইংরেজি ভাষা - ৩৭ কোটি ২০ লক্ষ যুক্তরাজ্য। (জামাইকা ও গায়ানা-র ক্রেয়োলভাষী জনগণকে ধরা হয়নি)
৪. আরবি ভাষা - ২৯ কোটি ৫০ লক্ষ, সৌদি আরব। (এক অঞ্চলের আরবি উপভাষা অন্য অঞ্চলের মানুষের বুঝতে অসুবিধা হয়)
৫. বাংলা ভাষা - ২৮ কোটি ৫০ লক্ষ, বাংলাদেশ ও ভারত।(২০১১ সালে শুমারী অনুযায়ী ভারতে মোট ১০ কোটি বাংলাভাষী রয়েছে এবং ২০১৯ শুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট ১৮ কোটি বাংলাভাষী রয়েছে)
৬. পর্তুগিজ ভাষা - ২১ কোটি ৯০ লক্ষ, পর্তুগাল।    
৭. রুশ ভাষা - ১৫ কোটি ৪০ লক্ষ, রাশিয়া।  
৮. জাপানি ভাষা - ১২ কোটি ৮০ লক্ষ, জাপান।
৯. লাহান্দা ভাষা - ১১ কোটি ৯০ লক্ষ, পাকিস্তান। (পূর্ব পাঞ্জাবের ভাষাকে গণনায় ধরা হয়নি, যে ভাষায় ভারতের প্রায় ২ কোটি ৭১ লক্ষ মানুষ কথা বলে)
১০. জাভানীয় ভাষা - ৮ কোটি ৪৪ লক্ষ, ইন্দোনেশিয়া।    
১১. কোরীয় ভাষা - ৭ কোটি ৭২ লক্ষ, দক্ষিণ কোরিয়া।  
১২. জার্মান ভাষা - ৭ কোটি ৬৮ লক্ষ, জার্মানি।   
১৩. ফরাসি ভাষা - ৭ কোটি ৬১ লক্ষ, ফ্রান্স।
১৪. তেলুগু ভাষা - ৭ কোটি ৪২ লক্ষ, ভারত।
১৫. মারাঠি ভাষা - ৭ কোটি ১৮ লক্ষ, ভারত।
১৬. তুর্কি ভাষা - ৭ কোটি ১১ লক্ষ, তুরস্ক।
১৭. উর্দু ভাষা - ৬ কোটি ৯১ লক্ষ, পাকিস্তান।
১৮. ভিয়েতনামি ভাষা - ৬ কোটি ৮১ লক্ষ, ভিয়েতনাম।
১৯. তামিল ভাষা - ৬ কোটি ৮০ লক্ষ, ভারত।
২০. ইতালীয় ভাষা - ৬ কোটি ৩৪ লক্ষ, ইতালি। (কেউ কেউ আঞ্চলিক ভাষা ও ইতালীয় ভাষায় সমান পারদর্শী)
২১. ফার্সি ভাষা - ৬ কোটি ১৯ লক্ষ, ইরান।
২২. মালয় ভাষা - ৬ কোটি ৮ লক্ষ, মালয়েশিয়া।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সকল ভাষা শহীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিকে অপসংস্কৃতির হাত থেকে সুরক্ষা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করার খুবই গুরুত্ব রয়েছে বলে অভিজ্ঞ মহলের অভিমত। কারণ এই বাংলা ভাষায় ৯৯% ছেলে মেয়ে মসজিদ মাদ্রাসা স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে। পরিতাপের বিষয়, অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সুকৌশলে এ ১৬ আমাদের কোমলমতি শিশুদের পাঠ্যক্রমে ধর্ম বিদ্বেষী চিন্তা চেতনা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নাস্তিক্যবাদীরা স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করতে চাচ্ছে ধর্ম বিরোধী কেচ্ছা কাহিনী। আমাদের সকলের উচিত এ গভীর ষড়যন্ত্রের নীল নকশার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা। সকল ভাষার প্রতি সন্মান পদর্শন করে পৃথিবীতে হারিয়ে যাওয়া প্রায় ৪২ টি ভাষাকে পুনরায় ফিরে পাওয়ার জন্য জাতিসংঘ তথা বিশ্ববাসীর প্রচেষ্টা চালানো উচিত বলে মনে করি।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন