পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
তিতুমীর কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেলে গুরুতর আহত হয়ে দু’চোখ হারাতে বসেছে। ময়মনসিংহের তারাকান্দার ঢাকেরকান্দা গ্রামের এক অতিদরিদ্র পরিবারের সন্তান সিদ্দিকুরের স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শেষ করে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সরকারি চাকরি করবে। বড় ভাই ও মায়ের দুঃখ-দারিদ্র্য দূর করবে। মাকে সে দু’বছর ধৈর্য ধরতে বলেছিল। সিদ্দিকুরের সেই স্বপ্ন এখন ধূলিস্যাৎ হয়ে যাওয়ার পথে। তার চোখের আলো নির্বাপিত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত শনিবার জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসকরা তার দু’চোখের অস্ত্রোপচার করেছেন। চিকিৎসকদের মতে, তার চোখের আলো ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। একজন মেধাবী, উদ্যমী ও উজ্জ্বল ভবিষৎ গড়ার স্বপ্নে বিভোর তরুণের এহেন পরিণতি দুর্ভাগ্যজনক এবং এর দায় গত বৃহস্পতিবার শাহবাগের ছাত্র সমাবেশে যারা কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করেছিল, পুলিশের সেই সদস্যরা কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ঢাকার ৭টি কলেজের প্রায় দু’লাখ শিক্ষার্থী গত কিছুদিন ধরে না ঘরকা না ঘাটকা অবস্থায় রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজটের দোহাই দিয়ে ওই ৭টি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হলেও যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়নি। শিক্ষার্থীরা রুটিনসহ পরীক্ষার তারিখ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে। এই দাবি বা আন্দোলনের অংশ হিসেবেই সেদিন শাহবাগে কিছু শিক্ষার্থী অবস্থান গ্রহণ করে। শিক্ষার্থীদের ওই অবস্থান কর্মসূচিতে শামিল ছিল সিদ্দিকুর। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল। হঠাৎই পুলিশ মারমুখী হয়ে ওঠে। ছুটে এসে তাদের ব্যানার কেড়ে নেয়, লাঠিপেটা শুরু করে এবং কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, পুলিশের একজন সদস্য দৌঁড়ে এসে খুব কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাস ছুড়ছে। এর পরপর সিদ্দিকুর মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। রাস্তার ওই স্থানটি রক্তে লাল হয়ে যায়। এ ব্যাপারে পুলিশের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ তো দূরের কথা উল্টো অজ্ঞাত ১২০০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, মিছিলকারীদের ছোড়া ফুলের টবের আঘাতে সিদ্দিকুর আহত হয়েছে। কথায় বলে, পুলিশ কী না করতে পারে! এটা সেই ‘কী না’ করতে পারার এক বড় নজির।
আমরা জানি না, এরপর কি হবে। আমরা জানি না, অজ্ঞাতনামা আসামিদের গ্রেফতার করার জন্য অভিযান চালানো হবে কি না। আমরা এ-ও জানি না, সিদ্দিকুরের ব্যাপারটির কি হবে। এটাই কি সাব্যস্ত করা হবে যে, পুলিশের টিয়ার শেলের আঘাতে নয়, মিছিলকারীদের ছোড়া ফুলের টবের আঘাতেই সিদ্দিকুরের চোখ দুটো ওভাবে আহত হয়েছে। ভিডিও ফুটেজের সাক্ষ্যের তাহলে কি হবে? বলা বাহুল্য, সাময়িকভাবে ‘জজমিয়া’ তৈরি করে সফল হওয়া গেলেও আখেরে সব জারিজুরিই ফাঁস হয়ে যায়। আশা করা যায়, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে না। শিক্ষার্থীরা তাদের আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। তারা ৭ দফা দাবি দিয়েছে। তার মধ্যে সিদ্দিকুরের চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়া, শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার এবং রুটিনসহ পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সিদ্দিকুরের চোখ বাঁচানো এ মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বেøম গেইম বাদ দিয়ে কিভাবে তার দৃষ্টি রক্ষা করা যায় সেদিকে নজর দেয়া দরকার। দেশে যদি চিকিৎসা সম্ভব না হয় তাহলে তাকে বিদেশে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। অবিলম্বে পুলিশের দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। এই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মূল দাবি রুটিনসহ পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করতে হবে। বড়ই বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, যেখানে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে আন্দোলন করে সেখানে যথাসময়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠানের জন্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নামতে হয়েছে। এ জন্য তাদের ধন্যবাদ জানানো উচিত। অথচ উল্টো তাদের পুলিশের লাঠিপেটাসহ চÐ আচরণের শিকার হতে হয়েছে, মামলার আসামি হতে হয়েছে এবং সিদ্দিকুরের মতো শিক্ষার্থীর চোখ হারানোর ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয়েছে। এর চেয়ে বেদনাদায়ক, দুঃখজনক ও নিন্দনীয় আর কি হতে পারে!
পুলিশের অমানবিক আচরণ, নিষ্ঠুরতা, অতি উৎসাহে বাহাদুরি প্রদর্শনের প্রবণতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ-দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অপরাধের এত ঘটনা ও নজির রয়েছে, যা উল্লেখ করে শেষ করা যাবে না। অনেকে অভিযোগ করেন, দেশটা আসলে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। পুলিশই এখন দেশের রাজা। সরকার পুলিশে ব্যাপক দলীয়করণ করেছে এবং কার্যত পুলিশকে দলীয় বাহিনীতে পরিণত করেছে। সরকার বিরোধী দল দমন-পীড়নে পুলিশকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করছে। পুলিশের একশ্রেণীর কর্মকর্তা ও সদস্য রীতিমতো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা গণপীড়নেও দ্বিধা করছে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, পুলিশের দায়িত্ব শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং নাগরিকদের সবরকম নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে পুলিশের অপারগতা ও ব্যর্থতা স্পষ্ট। এ অবস্থা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশের ভাব-মর্যাদার জন্য হানিকর। বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিতে হবে। সরকার যাবে, সরকার আসবে; কিন্তু পুলিশ থাকবে। রাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশকে তাই দায়িত্বশীল আচরণ ও ভূমিকা প্রদর্শন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশের মানুষ গণপীড়ক নয়, গণবান্ধব পুলিশই দেখতে চায়। তাদের প্রত্যাশা খুবই স্বাভাবিক। এ কারণেই পুলিশের যে কোনো অসদাচরণ, নির্মমতা, দুর্নীতি ও অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হতে হবে। পুলিশের দায়মুক্তির যে কালচার গড়ে উঠেছে, তার অবসান ঘটাতে হবে। সঙ্গতভাবেই আমরা আশা করতে চাই, সেদিন শাহবাগে পুলিশ যে অযাচিত ও নিষ্ঠুর আচরণ করেছে তার উপযুক্ত তদন্ত করা হবে এবং দোষীদের যথাবিধি শাস্তি দেয়া হবে। সবশেষে আমরা প্রার্থনা করি: সিদ্দিকুর যেন তার চোখের আলো না হারায়, তার স্বপ্নের যেন মৃত্যু না হয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।