Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পাকিস্তান সুপার লিগ যেভাবে বিশ্বের শীর্ষ এক টুর্নামেন্ট হয়ে উঠলো

অনলাইন ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৭ জানুয়ারি, ২০২২, ১০:৩৮ এএম | আপডেট : ১০:৩৯ এএম, ২৭ জানুয়ারি, ২০২২

পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান রমিজ রাজা দরজা খুলে ঢুকছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দফতরে, প্রধানমন্ত্রীর কক্ষে এসে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড প্রেসিডেন্ট বলছেন, ‘পিএম, সময় হয়েছে’। এরপর ইমরান খান ঘোষণা করলেন, আসছে পাকিস্তান সুপার লিগের সপ্তম আসর - এমন একটা ভিডিও টুইটারে এখন বেশ আলোচনায়।

২০১৬ সালে যখন পাকিস্তান সুপার লিগ আনুষ্ঠানিকভাবে মাঠে গড়ায় অনেকে ভাবেননি এটা পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড চালিয়ে নিতে পারবে, কিংবা নিয়মিত আয়োজিত হবে এই আসর। এখন ক্রিকেটার, ধারাভাষ্যকারদের কাছে এটি বিশ্বের অন্যতম সেরা টি-টোয়েন্টি আসর।

আফগানিস্তানের রশিদ খান লাগেজ গুছিয়ে ছবি পোস্ট করেছেন, যাচ্ছেন পাকিস্তান, ডেভিড উইলি আরো চার দিন আগেই রওনা হয়েছেন ইংল্যান্ড থেকে।

ইংল্যান্ডের হয়ে ক্রিকেট খেলা অ্যালেক্স হেইলস বলেছেন, পিএসএল একটি উঁচু মানের লিগ। এখানে স্থানীয় যেসব ক্রিকেটার আছেন, বিশেষত বোলাররা খেলাটাকে অন্যরকম প্রতিযোগিতামূলক করে তোলেন। শেষ ম্যাচ পর্যন্ত বলা যায় না কারা টিকে থাকবেন কারা বাদ পড়বেন।

এখন শুধু পাকিস্তানী ক্রিকেট সমর্থকরাই নয়, বিশ্বের ক্রিকেট অনুসারীদের অনেকেই অপেক্ষায় আছেন কাল বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হতে যাওয়া এই টুর্নামেন্টের।

দর্শকদের জন্য এই ধরনের টুর্নামেন্টগুলো শুধু ক্রিকেটেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তারা এতে বিনোদনও খোঁজেন, পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড কোনো ফাঁক রাখতে চায় না সেখানে।

পাকিস্তান সুপার লিগের উত্থান
পাকিস্তানের জনপ্রিয় গায়ক আতিফ আসলাম ও অ্যায়মা বাইগের গান থেকে শুরু করে সম্প্রচারের দায়িত্বেও আছে বিশ্বের সুপরিচিত ক্রিকেট সম্প্রচারক ফক্স স্পোর্টস।

এবারই প্রথমবারের মতো পাকিস্তান সুপার লিগের প্রচারস্বত্ব নিয়েছে ফক্স স্পোর্টস, অস্ট্রেলিয়া দর্শকরা ফক্স স্পোর্টসে দেখতে পারবেন পিএসএল, নিউজিল্যান্ডের দর্শকরা দেখতে পাবেন স্কাই স্পোর্টসে, যুক্তরাজ্যে স্কাই স্পোর্টসে দেখা যাবে পিএসএল, সাব সাহারা আফ্রিকান অঞ্চলে পিএসএল দেখাবে সুপারস্পোর্ট। এছাড়া উপমহাদেশের দর্শকরা টেন স্পোর্টস ও পিটিভি স্পোর্টসেও দেখা যাবে খেলা।

২০১৮ সালে পাকিস্তান সুপার লিগের জন্য পিসিবিকে সম্প্রচারক খুঁজতে মাঠে নামতে হয়েছিল, তিন বছর পর ২০২০ সালে এই সুপার লিগ বিশ্বব্যাপী ১৮টি দেশে ৪০টি চ্যানেলে সম্প্রচারিত হচ্ছে।

এই প্রক্রিয়ায় পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড একটা শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামোও তৈরি করেছে, ক্রিকেটারদের টাকা দিয়ে পাকিস্তানে আনছে, তারা ক্রিকেট খেলছে, ক্রিকেট বিপণনটাও হচ্ছে, এতে ফিরতি অর্থ ফেরত পাচ্ছে পাকিস্তান ক্রিকেট।

কাতার অয়েল, হেয়ার গ্রুপের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান পাকিস্তান সুপার লিগে ফ্র্যাঞ্চাইজের মালিক।

সম্প্রচারস্বত্ব থেকে পাওয়া অর্থের ৮০ ভাগ ফ্র্যাঞ্চাইজের মধ্যে ভাগ হয়ে যায় এবং বাকি ২০ ভাগ নেয় পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড।

পাকিস্তান সুপার লিগের ডিরেক্টর সালমান নাসের বলেছেন, ‘পিএসএল এখন বৈশ্বিক একটা ব্র্যান্ড। চলতি বছর স্পন্সরশিপ ও প্রচারস্বত্ব আগের চেয়ে ২০০ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হয়েছে।’

আরো চমক নিয়ে এসেছে পাকিস্তান সুপার লিগের ধারাভাষ্যকারদের প্যানেল, যেন একটা ক্রিকেট একাদশ বানানো যাবে।

ইংল্যান্ডের নিক নাইট, ডেভিড গাওয়া, অস্ট্রেলিয়ার মাইক হেইজম্যান, জিম্বাবুয়ের পমি এমবাঙ্গোয়ারা তো আছেনই।

আছেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের অন্যতম বিনোদনদাতা ধারাভাষ্যকার নিউজিল্যান্ডের ড্যানি মরিসন, পাকিস্তানের সাবেক তারকা ক্রিকেটার ওয়াকার ইউনুস, পাকিস্তান নারী ক্রিকেট দলের সানা মীর।

আর উপস্থাপনায় আছেন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ- আইপিএলে ও বিখ্যাত ক্রিকেট ওয়েবসাইট সেভেন ক্রিকেটের হোস্ট অ্যারিন হোল্যান্ড ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের ২০১৯ বিশ্বকাপের উপস্থাপক জেয়নাব আব্বাস।

খেলোয়াড়দের তালিকাটাও দেখার মতো, ইংল্যান্ডের নামিদামি টি-টোয়েন্টি তারকারা আছেন, আর টুর্নামেন্ট যেহেতু পাকিস্তানের তাই পাকিস্তানের তরুণ ক্রিকেটারদের নিয়ে পৃথক পৃথক বিজ্ঞাপন দিয়ে পাকিস্তান সুপার লিগের সোস্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলগুলো সয়লাব।

পিএসএল এখন শুধু একটা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট টুর্নামেন্টের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই পাকিস্তানের জন্য এটা একটা বিজ্ঞাপন।

আর এবারের আসরটি আরো গুরুত্বপূর্ণ কারণ পাকিস্তানের সরকার ও ক্রিকেট প্রশাসনের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ পাকিস্তানকে বিদেশী ক্রিকেটারদের জন্য নিরাপদ দেশ প্রমাণ করা।

করোনাভাইরাস মহামারীর আবির্ভাবের পর খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা এখন আর বাহ্যিক সামরিক নিরাপত্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, এখন কোভিড থেকেও আগলে রাখতে হয় অ্যাথলিটদের।

তিনটি আলাদা ‘বাবলে’ ক্রিকেটার ও পিএসএলের সাথে সংশ্লিষ্ট স্টাফরা থাকবেন, বাবলে ঢোকার আগে দুটি কোভিড নেগেটিভ সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক, প্রত্যেক ব্যক্তি হোক সে ক্রিকেটার অথবা স্টাফ প্রতি দুই দিনে একবার কোভিড টেস্ট করা হবে।

যেকোনো দলীয় ক্রীড়া ইভেন্টের বড় আকর্ষণ থাকে মাঠের দর্শকরা, মাঠে দর্শক না থাকলে টেলিভিশনেও খেলা দেখতে প্রাণহীন লাগে, তাই কোভিড সংক্রমণের শংকার মধ্যেই ফুলহাউজ স্টেডিয়ামে করার কথা ছিল পিএসএল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান জাতীয় কমান্ড অ্যান্ড অপারেশন সেন্টারের নির্দেশে করাচীতে ধারণক্ষমতার ২৫ শতাংশ দর্শক বসতে দেয়া হবে। লাহোরে এখনো অন্য শহরের তুলনায় কোভিড সংক্রমণ কম, তাই এই শহরে এখনো পর্যন্ত পুরো গ্যালারিজুড়ে দর্শক বসতে দেয়ার সিদ্ধান্ত দেয়া আছে।

কারা আসছেন এবার পাকিস্তানে
তবে দিনশেষে পিএসএল তো ক্রিকেট আসর, তাই সবার চোখ থাকবে ক্রিকেটারদের দিকেই।

বিভিন্ন ক্রিকেট বোর্ড নানা সময়ে তাদের ক্রিকেটারদের দলগতভাবে পাকিস্তান পাঠাতে না পারলেও, পিএসএল খেলতে অনেক ক্রিকেটারই পাকিস্তান এসেছেন এর আগে।

ইসলামাবাদ ইউনাইটেডে আছেন ইংল্যান্ডের অ্যালেক্স হেইলস নিউজিল্যান্ডের কলিন মানরো।

করাচী কিংসের হয়ে খেলবেন ইংল্যান্ডের ক্রিস জর্ডান, পাকিস্তানি তারকা মোহাম্মদ আমির আছেন এই দলে। বিশ্বের সেরা সীমিত ওভারের ব্যাটসম্যান বাববর আজম করাচী কিংসের অধিনায়ক।

আইসিসির বর্ষসেরা ক্রিকেটার শাহীন শাহ আফ্রিদি আছেন লাহোর কালান্দারসে। সাথে আছেন হ্যারিস রওফ ও পাকিস্তানের তারকা ক্রিকেটার মোহাম্মদ হাফিজ, ফখর জামান। এই দলে টি-টোয়েন্টি ইতিহাসের অন্যতম সেরা বোলার আফগানিস্তানের রশিদ খান আছেন।

মুলতান সুলতানসে আছেন দক্ষিণ আফ্রিকার তারকা ফ্র্যাঞ্চাইজ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটার রাইলি রুশো ও ইমরান তাহির, ইংল্যান্ডের ডেভিড উইলি। আইসিসির বর্ষসেরা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটার মোহাম্মদ রিজওয়ানও আছেন এই দলে।

পেশওয়ার জালমিতে আছেন আফগানিস্তানের হজরতউল্লাহ জাজাই, লিয়াম লিভিংস্টোন, ওয়াহাব রিয়াজ, শোয়েব মালিক, কামরান আকমল।

কোয়েটা গ্ল্যাডিয়েটরসে আছেন ইংল্যান্ডের তারকা জেসন রয়, জেমস ভিন্স। শহীদ আফ্রিদির মতো সাবেক তারকা ক্রিকেটার খেলবেন কোয়েটার হয়ে। এছাড়া ইংল্যান্ডের বেন ডাকেট ও ২০১৫ বিশ্বকাপ ফাইনালের নায়ক অস্ট্রেলিয়ান অলরাউন্ডার জেমস ফকনার খেলবেন গ্ল্যাডিয়েটরসের হয়ে।

পিএসএল যেভাবে পাকিস্তানের বিজ্ঞাপন হয়ে উঠছে
২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট দলের ওপর সন্ত্রাসী হামলার পরে পাকিস্তানের মাটিতে ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের নিয়ে এক মাসের আসর বসানো পাকিস্তানের ক্রিকেট কর্তৃপক্ষের জন্য বড় একটা ব্যাপার।

পাকিস্তান সুপার লিগ এখন পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের জন্য আর্থিকভাবে জ্যাকপটের সামিল। একইসাথে লোকাল ক্রিকেটারদের জন্য অনেক বড় সম্ভাবনার জায়গা, যারা পাকিস্তানে নিরাপত্তা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বঞ্চিত।

পাকিস্তানে মাঝেমধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, বাংলাদেশ, জিম্বাবুয়ে, শ্রীলঙ্কা সিরিজ খেলতে গেলেও অন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দলের সাথে তুলনা করলে পাকিস্তানের দর্শকরা গত ১২ বছরে ঘরের মাটিতে ক্রিকেট দেখতেই পারেনি।

২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে পাকিস্তানে আসার কথা ছিল নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের। প্রথমে নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা বলে নিউজিল্যান্ড এবং এরপর ক্রিকেটারদের মানসিক বিশ্রামের কথা বিবেচনা করে ইংল্যান্ড পাকিস্তান সফর বাতিল করে।

সেসময় রাগ দমিয়ে রাখেননি পিসিবি প্রধান রমিজ রাজা। খোলামেলাই বলেছেন, ‘পশ্চিমা ক্রিকেট দেশগুলো এক হয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে একটা এজেন্ডা দাঁড় করাচ্ছে।’

মাঠে ক্রিকেটারদের জবাব দিতেও বলেছেন রমিজ রাজা। এবারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের পুরষ্কার পাওয়া ক্রিকেটারদের দিকে তাকালে মনে হবে রমিজ রাজার কথা রেখেছেন পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা। বর্ষসেরা ক্রিকেটার হয়েছেন শাহীন শাহ আফ্রিদি, বর্ষসেরা ওয়ানডে ক্রিকেটারের পুরস্কার পেয়েছেন বাবর আজম, বর্ষসেরা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটারের পুরস্কার পেয়েছেন মোহম্মদ রিজওয়ান এবং বর্ষসেরা উদীয়মান নারী ক্রিকেটারের পুরস্কার পেয়েছেন ফাতিমা সানা।

তবে পাকিস্তান সুপার লিগের চিন্তা ছিল পাকিস্তানের সাবেক বোর্ড প্রেসিডেন্ট নাজাম সেঠির। তিনিই একটি চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন।

বিবিসি উর্দুর সাথে এক সাক্ষাৎকারে নাজাম শেঠি বলেছেন, ‘আমি যখন পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডে আসি তখন পাকিস্তান সুপার লিগ ছিল একটা বন্ধ খাতা। আমার আগে যারা ছিলেন তারা ভাবতেন যেখানে ক্রিকেটাররা খেলতে আসতে চায় না সেখানে একটা লিগ কী করে সম্ভব।’

তখন নাজাম শেঠি পরিকল্পনা করেন প্রথমে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাকিস্তান সুপার লিগ শুরু করে পরে পাকিস্তানে নিয়ে আসবেন।

টুর্নামেন্টের দৈর্ঘ্য একটা বড় ব্যাপার। ছয় দলের পাকিস্তান সুপার লিগ এক মাসেই শেষ হয়ে যায়, তাই যেসব অনুসারীরা নিয়মিত ফলো করেন তারা পুরোটা সময় ধরেই মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন। অনেক দর্শকের জন্যই ৪৫ দিন যাবৎ চলা আইপিএলে কিছু ম্যাড়ম্যাড়ে মুহূর্ত আসে।

পাকিস্তানের স্থানীয় ক্রিকেটারদের অনেকেই দক্ষতা থাকলে পিএসএল খেলতে পারেন। প্রত্যেক ফ্র্যাঞ্চাইজই দেশজুড়ে উন্মুক্ত প্রতিভা অন্বেষণ করে থাকে। মোহাম্মদ ইরফান, ইয়াসির জান, এবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের স্কোয়াডে থাকা শাহনেওয়ার ধানির মতো ক্রিকেটাররা পিএসএল থেকেই উঠে এসেছেন।

সূত্র : বিবিসি



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ক্রিকেট


আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ