Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ৩০ মে ২০২৪, ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

অতিমানব মেয়ার্সে বাংলাদেশের লজ্জা

স্পোর্টস রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০০ এএম

অবিশ্বাস্য? তা বলাই যায়। রোমাঞ্চকর? সে তো বটেই! কিন্তু এ দুটি শব্দের কোনোকিছুই এখন শিহরিত করবে না বাংলাদেশ দলকে। বরং বলা ভালো, জয়ের সুবাস নিয়ে দিন শুরু করে শেষটা হলো হতাশায়, লজ্জায়। হাতের মুঠোয় থাকা টেস্টাটা অবিশ্বাস্যভাবে ৩ উইকেটে হেরে বসল বাংলাদেশ। যেন টেস্ট ক্রিকেটের সৌন্দর্যের আরেকটি নিদারুণ গল্প!

দলে নেই সেরা তারকাদের কেউই, এই সফরেই অভিষেক হয়েছে ৯ জনের। সেই আনকোড়া দলের একজনের কাছেই যেন ম্যাচটা হেরে বসলো মুমিনুল, তামিম, মুশফিকদের মতো অভিজ্ঞ তারকায় মোড়ানো বাংলাদেশ। তিনি কাইল মেয়ার্স।

জয়ের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বাংলাদেশের মাটিতে চতুর্থ ইনিংসে সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড গড়তে হতো ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। শুধু কী তাই, টেস্ট ইতিহাসেও চতুর্থ ইনিংসে পঞ্চম সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের নজির গড়তে হতো ক্রেগ ব্রাফেটের দলকে।
ক্রিকেট তার যাবতীয় অনিশ্চয়তা, রোমাঞ্চ আর রঙ মেলে ধরল চট্টগ্রাম টেস্টের শেষ দিনে। প্রথম চার দিন ম্যাচ নিয়ন্ত্রণে রেখেও শেষ দিনে পাত্তা পেল না বাংলাদেশ। ৩ উইকেটের জয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এগিয়ে গেল সিরিজে। ২১০ রানের অপরাজিত ইনিংসে ক্যারিবিয়ানদের এই রূপকথাময় জয়ের নায়ক মেয়ার্স। কদিন আগেও যাকে খুব একটা চিনত না ক্রিকেট বিশ্ব। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ২৯ গড়ের ব্যাটসম্যান টেস্ট অভিষেকে রেকর্ডের মালা গেঁথে উপহার দিলেন অসাধারণ এক ডাবল সেঞ্চুরি। নিশ্চিত করে দিলেন, তাকে আর ভুলতে পারবে না কেউ!

প্রথম ইনিংসে মিরাজের সেঞ্চুরির সঙ্গে বল হাতে চার উইকেট, দ্বিতীয়টিতে মুমিনুলের মাইলফলকছোঁয়া শতককে অর্থবহ করতে এবারও ঘূর্ণির জাদুকরী ছাপ রাখলেন মিরাজ, ধরলেন আরো চারটি শিকার। তবে কিছুতেই কিছু হলো না। বাংলাদেশ যে জয়ের জন্য ৩৯৫ রানের পাহাড়সমান লক্ষ্য ছুঁড়ে দিয়েছিল; শেষ পর্যন্ত এ দুটি মাইলফলক গড়েই ম্যাচটা জিতেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। মেয়ার্সের অতিমানবীয় ব্যাটিংয়ের সামনে এ লক্ষ্যটাই কি-না শেষ দিকে ভীষণ অল্প মনে হচ্ছিল! এতটাই অল্প যে, মাঠের বাইরে হারের যন্ত্রণায় কপাল কুঁচকে থাকা সাকিব আল হাসানের মুখটা ভীষণ অসহায় লাগছিল। সাকিব মাঠে থাকলে ফল তো অন্যরকমও হতে পারত!

কিন্তু যিনি চোটের কারণে থাকতে পারেননি, তাঁকে নিয়ে এখন কথা বলে আর লাভ নেই। বরং চট্টগ্রাম টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে বাংলাদেশের ৩ উইকেটের হারের কাঁটাছেড়ায় উঠে আসতে পারে দুটি বিষয়- প্রথম দুই সেশনে কোনো উইকেট নিতে পারেনি বাংলাদেশ এবং সাকিববিহীন বাংলাদেশের আদতে তিন স্পিনার নিয়ে শেষ দিনে প্রায় নখদন্তহীন লড়াই। মুমিনুল হকের দলের শরীরী ভাষাতেই ফুটে উঠছিল, হারের মুখে বাংলাদেশ।

আর এই শরীরী ভাষা ফুটেছে প্রথম সেশনে উইকেটশূন্য থাকার পর, পরের সেশনে তো বোঝাই যাচ্ছিল হারের শঙ্কা মাথায় নিয়ে চা-বিরতিতে মাঠ ছাড়ছিলেন তারা। শেষ সেশনে মাঠে নামার আগে সাকিবের পরামর্শে উজ্জীবিত হয়ে দ্রুত ২ উইকেট তুলে নেন তাইজুল ইসলাম ও নাঈম হাসান। কিন্তু এরপর মেয়ার্সের সঙ্গে জশুয়া দা সিলভার ১৩০ বলে ১০০ রানের জুটিতে দুই টেস্টের সিরিজে ১-০ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ল বাংলাদেশ। জশুয়া (৫৯ বলে ২০) জয় এনে দেওয়া পর্যন্ত উইকেটে থাকতে পারেননি। তাঁকে বোল্ড আউট করেন তাইজুল। তখন জয় থেকে ৩ রান দূরে ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এরপর কেমার রোচ (০) এসেও দাঁড়াতে পারেননি। কিন্তু তখন উইকেট তুলে নেওয়ার আনন্দ দেখা যায়নি বাংলাদেশ দলে।

৩ উইকেটে ১১০ রান তুলে চতুর্থ দিনের খেলা শেষ করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তখন ম্যাচের পাল্লা ঝুঁকেছিল বাংলাদেশের দিকে। কে জানত, আগের দিন অপরাজিত দুই অভিষিক্ত এদিন বরফের মতো জমে যাবেন উইকেটে! চতুর্থ উইকেটে ৪৪২ বলে ২১৬ রানের অবিশ্বাস্য জুটি গড়ে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেন দুই অভিষিক্ত মেয়ার্স ও এনক্রুমা বোনার। প্রথম দুই সেশনে তারা কোনো উইকেট না দেওয়ায় ম্যাচে মানসিকভাবে এগিয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

২৪৫ বলে ৮৬ রান করা বোনারকে চা-বিরতির পর এলবিডব্লুর ফাঁদে ফেলেন তাইজুল। কিন্তু মেয়ার্সকে থামানো যায়নি। পঞ্চম দিনের প্রথম সেশনেই অবশ্য মেয়ার্সকে ফেরাতে পারত মুমিনুল হকের দল। তাইজুল ইসলামের বল তার প্যাডে লাগলে এলবিডব্লুয়ের আবেদন উঠেছিল। আম্পায়ার তাতে সাড়া না দেওয়ায় রিভিউও নেয়নি বাংলাদেশ। পরে টিভি রিপ্লেতে দেখা যায়, বল লাগত স্টাম্পে। তখন তিনি ব্যাট করছিলেন ৪৭ রানে।

ব্যক্তিগত ৪৯ রানেও জীবন পান মেয়ার্স। মেহেদী হাসান মিরাজের বলে সিøপে ক্যাচ লুফে নিতে ব্যর্থ হন নাজমুল হোসেন শান্ত। এরপর আর তাকে আটকানো যায়নি। ৮৯ বলে ছোঁয়া ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট ফিফটিকে তিনি সেঞ্চুরিতে রূপ দেন চা-বিরতির আগে। মুস্তাফিজুর রহমানকে চার মেরে পৌঁছে যান তিন অঙ্কে।

চা বিরতি পর্যন্ত মেয়ার্সের রান ছিল ১১৭। উইন্ডিজের স্কোর ছিল ৩ উইকেটে ২৬৬। অর্থাৎ শেষ সেশনে ৩৩ ওভারে জয়ের জন্য তাদের প্রয়োজন দাঁড়ায় ১২৯ রান। মেয়ার্সের বীরোচিত পারফরম্যান্সে এই সমীকরণ মিলিয়ে উল্লাসে মাতে ক্যারিবিয়ানরা। এসময়ে তিনি একাই তোলেন ৯৩ রান!

ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট ইতিহাসে তার এই অতিমানবীয় ইনিংস সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। টেস্ট ক্রিকেটের ১৪৪ বছরের ইতিহাসে অভিষেকে চতুর্থ ইনিংসে দ্বি-শতক তুলে নেওয়া প্রথম ব্যাটসম্যান–ই শুধু নন, দলের জয়েও ‘নিউক্লিয়াস’ মেয়ার্সের ৩১০ বলে ২১০ রানের অপরাজিত এই ইনিংস। ৭ ছক্কা ও ২০ চারে ইনিংসটি সাজান এ বাঁহাতি।

স্পিনবান্ধব উইকেটে অন্য ব্যাটসম্যানরা যেখানে অতিরিক্ত সাবধানতা থেকে বাজে বলও সমীহ করে খেলেছেন, মেয়ার্সের সেখানে হাত খুলতে খেলতে বাধেনি। জয়সূচক রানও এসেছে তার ব্যাট থেকে। মুস্তাফিজুর রহমানকে তার প্রথম ওভারে ছক্কা মেরেছেন, মিরাজ-তাইজুলের খাটো লেংথের বল লেগ ও অফ সাইড দিয়ে করেছেন সীমানাছাড়া। ড্রাইভগুলোও দেখার মতো। আবার ভালো বলে ঠিকই জমাট তার রক্ষণ। এ কৌশলে ব্যাট করেই অভিষেক টেস্টে মনে রাখার মতো ইনিংস খেলেন মেয়ার্স। বিশেষ করে বাংলাদেশ দলের জন্য এই ইনিংস বহুদিন ‘ঘা’ হয়ে থাকবে।

বাংলাদেশের হয়ে ৩৫ ওভারে ১১৩ রানে ৪ উইকেট নেন মেহেদী হাসান মিরাজ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুই ইনিংস মিলিয়ে ৮ উইকেট নেন বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসে এ সেঞ্চুরিয়ান। সর্বোচ্চ ৪৫ ওভার বল করেছেন তাইজুল। ৯১ রানে ২ উইকেট নেন তিনি। ৩৪ ওভারে ১০৪ রানে ১ উইকেট নাঈমের। ১৩ ওভারে ৭১ রানে উইকেটশূন্য ছিলেন পেসার মুস্তাফিজ। বৃহষ্পতিবার সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্ট ঢাকায়। তার আগে বোলিং বিভাগে যে বড়সড় মেরামত জরুরী সেটিও দেখিয়ে দিল আনকোরা এই উইন্ডিজ।


সংক্ষিপ্ত স্কোর
বাংলাদেশ : ৪৩০ ও দ্বিতীয় ইনিংস : ২২৩/৮ ডিক্লে.। উইন্ডিজ : ২৫৯ ও দ্বিতীয় ইনিংস : (লক্ষ্য ৩৯৫) ১২৭.৩ ওভারে ৩৯৫/৭ (আগের দিন ১১০/৩) (বোনার ৮৬, মেয়ার্স ২১০*, ব্ল্যাকউড ৯, জশুয়া ২০; মুস্তাফিজ ০/৭১, তাইজুল ২/৯১, মিরাজ ৩/১১৩, নাঈম ১/১০৫)।
ফল : ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩ উইকেটে জয়ী।
ম্যান অব দ্য ম্যাচ : কাইল মেয়ার্স।
সিরিজ : ২ ম্যাচে ১-০তে এগিয়ে উইন্ডিজ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ক্রিকেট


আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ