Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ক্রিকেটের আবেগ ও বাস্তবতা

ম। ন্ত। ব্য প্র। তি। বে। দ। ন

রেজাউর রহমান সোহাগ | প্রকাশের সময় : ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

নিঃসন্দেহে ক্রিকেট এখন বাংলাদেশের সবচাইতে বড় আন্তর্জাতিক পরিচিতি এবং স্থানীয়ভাবেও দেশের একমাত্র জাতীয় ঐক্যমতের প্রতীক। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে যারা যুগ যুগ ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে এই সাফল্য পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন তারা সকলেই দেশবাসীর কাছে বিশেষভাবে ধন্যবাদ প্রাপ্য। জাতি তদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ।

ক্রিকেটে এই উপমহাদেশের এক গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য রয়েছে। এক সময় ক্রিকেটদুনিয়ায় অসাধারণ দাপট দেখিয়েছে এই উপমহাদেশেরই দুই ক্রিকেট পরাশক্তি পাকিস্তান ও ভারত। এই দুই দলের ক্রিকেট ম্যাচ ছিল এই উপমহাদেশের তথা ক্রিকেট বিশ্বের কাছে বহুল আকাক্সিক্ষত ও আকর্ষণীয় বিষয়। কিন্তু কালের আবর্তে সেই অবস্থায় বাঁধ পড়েছে। নানা সমস্যায় জর্জরিত পাকিস্তান ক্রিকেটের সেই দাপট এখন আর নেই। যে কারণে পাকিস্তান-ভারত ক্রিকেট ম্যাচ নিয়েও ক্রীড়ামোদীদের এখন আর আগের মতো সেই আগ্রহ নেই। নেই সেই টান-টান উত্তেজনার বিষয়টিও।

প্রচুর স্পন্সরশিপের কারণে আর্থিক শক্তির পাশাপাশি ক্রিকেটের সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক সংস্থা আইসিসির ধারাবাহিক আনুকূল্যের কারণে ভারত এখনও ক্রিকেট বিশ্বে অন্যতম শীর্ষ ও প্রভাবশালী দল হিসেবে পরিগণিত। কিন্তু ক্রিকেটের নতুন ও শক্তিশালী দল হিসেবে বাংলাদেশের উত্থান এখন সেই শক্তিশালী ভারতের জন্য সবচাইতে বড় কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের সাথে বেশ কয়েকটি ম্যাচে পরাজিত হওয়ার পরে ভারতের কাছে এখন সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জের এবং মর্যাদার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচ-সেটি যে কোনো ফরম্যাটেই হোক না কেন। যে কারণে ভারত এখন বাংলাদেশের বিপক্ষে যে কোনো ক্রিকেট ম্যাচেই প্রভাব বিস্তারের জন্য নিয়মের সাথে অনিয়মকেও প্রকাশ্যেই সম্পৃক্ত করে ফেলছে এবং এটা করতে গিয়ে তারা সারা পৃথিবীর কাছে সমালোচনার ঝড়ের মুখে পড়লেও সেটাকে কোনো আর তোয়াক্কা করছে না! এই ভাবে ভারতের কাছে যমদূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারাটা সার্বিকভাবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের এক বিরাট অর্জন।

বিগত বেশ কয়েক বছর যাবতই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সাফল্য দেখিয়ে আসছে। যে কারণে বাংলাদেশের সর্ব শ্রেণীর মানুষও ক্রিকেটের সাথে নিজেদেরকে একাকার করে ফেলেছেন। একসময় ক্রিকেট যে শুধু ধনি এবং অভিজাত শ্রেণীর খেলা ছিল সেই বৃত্ত থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে এসেছে অনেক আগেই। সর্বশেষ গত ৯ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালে প্রতিদ্ব›দ্বী ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। শুধু ক্রিকেট নয় বাংলাদেশের সার্বিক ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে এটাই দেশের সবচাইতে বড় আন্তর্জাতিক সাফল্য। আন্তরিক অভিনন্দন বাংলাদেশ যুবদলের সকল সদস্যকে।

যথারীতি অতীতের ন্যায় এই ম্যাচেও ভারতের খেলোয়াড়রা বিভিন্নভাবে তাদের অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে আম্পায়ারদেরকে প্রভাবিত করে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের ওপর অযাচিত মানসিক চাপ ও উত্তেজনা সৃষ্টির অপকৌশল নিয়েছিল। কিন্তু ঐ ম্যাচের আম্পায়াররা ভারতের সেই অপকৌশলে সাড়া না দেয়ায় তাদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি এবং ম্যাচ শেষে ভারত আবারও প্রমাণ পেতে বাধ্য হয় ক্রিকেটে যে কেবল বাংলাদেশই এখন তাদের প্রধান ও প্রবল প্রতিপক্ষ।

বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় দেশের সর্বশ্রেণীর মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত এবং এই খুশিতে আনন্দে ভাসছে সারা দেশ। বাংলাদেশের বিপক্ষে সবসময় অযাচিত প্রভাব বিস্তারের কারণে ভারতীয় দলের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ক্ষোভ দীর্ঘদিন থেকেই। আর তাইতো বাংলাদেশের মানুষের কাছে এই স্মরণীয় সাফল্যের আনন্দ আর উল্লাস অতিমাত্রায় বেড়ে গিয়েছে ফাইনালে শুধুমাত্র ভারতকে হারানোর কারণেই, যা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।

বিশ্বকাপজয়ী বাংলাদেশ দল আজ দেশে ফিরছে। তাদেরকে বিমানবন্দরে সংক্ষিপ্তভাবে সংবর্ধনা প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিসিবি। এই সংবর্ধনা ও সম্মান বিশ্বজয়ী ক্রিকেটারদের যথার্থ প্রাপ্য। তবে এই ক্ষেত্রে একটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে আবেগের ঊর্দ্ধে উঠে বাস্তবতার নিরিখে সকলকে ভেবে দেখতে হবে এবং সেটি ক্রিকেটের বৃহত্তর স্বার্থেই। এই ধরণের একটি আন্তর্জাতিক সাফল্যের জন্য অবশ্যই খেলোয়াড়রা যথার্থ সম্মান এবং যোগ্যতা অনুযায়ী অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্য এবং সেটা অবশ্যই তাদেরকে দেয়া উচিত। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই মুহূর্তে কোনোভাবেই যাতে সেটা সামঞ্জস্যের বাইরে মাত্রাতিরিক্ত না হয় এবং খেলোয়াড়দেরকে সেটা দিতে হবে ধাপে ধাপে তাদের বয়স, যোগ্যতা, পারফরমান্স ও জাতীয় স্বার্থের প্রতি কমিটমেন্টের সাথে সামঞ্জস্য অনুযায়ী।

আমাদের মনে রাখতে হবে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের খেলোয়াড়রা সকলেই বয়সে এখনও অপরিণত এবং তাদেরকে ভবিষ্যতে আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। এই মুহ‚র্তে তাদের মনে এমন কোনো ধারণা সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ যেন দেয়া না হয়, যাতে তারা ধরে নেয় এটাই তাদের শেষ এবং শ্রেষ্ঠ সাফল্য এবং তাদের আর করণীয় নেই। দলের অধিনায়ক আকবর আলী ও তার সতীর্থ খেলোয়াড়রা যদি নিজেদেরকে সঠিকভাবে লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থ এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে পারে তাহলে তারাই যে হবে বাংলাদেশের আগামী দিনের সাকিব, মাশরাফি, তামিম ও মুশফিক এই ব্যাপারে কারোরই কোনো দ্বিমত নেই। ইতোমধ্যেই সেই সম্ভাবনার স্বাক্ষর তারা রেখেছে।

এই সাফল্যের পর আমরা মিডিয়ার সদস্যরাও কিছুটা আবেগতাড়িত হয়েই দলের অধিনায়ক আকবর আলীকে ‘আকবর দ্য গ্রেট’ হিসেবে অভিহিত করেছি। আশা করব আকবর ও তার সতীর্থ খেলোয়াড়রা এখনই নিজেদেরকে ‘দ্য গ্রেট’ না ভেবে সামনের অনেক কঠিন পথচলায় গ্যারি সোবার্স, ক্লাইভ লয়েড, ভিভ রিচার্ড, ইমরান খান, জাভেদ মিয়াঁদাদ, ওয়াসিম আকরাম, সুনিল গাভাস্কার, শচীন টেন্ডুলকার, কপিল দেব, স্টিভ ওয়াহ, ব্রায়ান লারা, অজুর্না রানাতুঙ্গা, ইয়ান বোথাম, ডেনিস লিলিদের মতো গ্রেটদেরকেই যেন গ্রেট হিসেবে দেখে তাদেরকেই অনুকরণ করে। তাহলেই ভবিষ্যতে প্রকৃত গ্রেট হতে পারবে আকবর আলী ও তার সতীর্থরা। আর ক্রিকেটাররা যখন প্রকৃত গ্রেট হিসেবে নিজেদেরকে প্রমান করতে পারবে, তখন সম্মান, জনপ্রিয়তা, অর্থ-বিত্ত, গাড়ি-বাড়ি সবকিছুই যথাসময়ে যথাযথভাবেই তাদের হাতে চলে আসবে।

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে অত্যন্ত কঠোরভাবে এই সম্ভাবনাময় দলটির ব্যাপারে নজর এবং নিয়ন্ত্রিত ভ‚মিকা রাখতে হবে যাতে তাদের নিয়ন্ত্রণ, অনুমতি ও নিয়মের বাইরে গিয়ে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই সুযোগে ক্রিকেটের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে শুধুমাত্র নিজেদের প্রচার আর স্বার্থ উদ্ধারের জন্য অতিমাত্রায় সংবর্ধনা, প্রচার-প্রচারণা, অর্থ ও গাড়ি-বাড়ি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আমাদের এই অতিসাধারণ ও কোমলমতি ক্রিকেটারদের ক্যারিয়ারকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে না পারে। সামঞ্জস্যের বাইরে অতিমাত্রায় সুযোগ-সুবিধা, প্রচার আর অর্থ-বৈভবের কারণে সৃষ্ট অহমিকায় একজন প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ার যে কতবড় হোঁচট খায় এবং সঙ্কটের মধ্যে পড়ে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ তো বাংলাদেশেরই দুই ক্রিকেটোর মুস্তাফিজুর রহমান আর মেহেদী হাসান মিরাজ। যাদের অসাধারণ প্রতিভা থাকা সত্তে¡ও তা আজ পুরোপুরি বিকাশের পরিবর্তে অনিশ্চয়তার পথে।

বিসিবি সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বচ্যাম্পিয়ন এই অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দলের পেছনে ট্রেনিং ও অন্যান্য ক্ষেত্রে গত দুই বছরে বিসিবি খরচ করেছে ১৭ কোটি টাকা। প্রয়োজনীয় সব ধরণের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা দিয়েই বিসিবি এই দলটিকে ভবিষ্যতের জন্য গড়ে তুলছে। এটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের অনেক বড় সাংগঠনিক সাফল্য। দলের খোলোয়াড়দেরকে এই বিষয়টি অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেই সামনে এগিয়ে যেতে হবে। ক্রিকেটের বৃহত্তর স্বার্থেই সংশ্লিষ্ট সকলকেই আবেগ পরিহার করে বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। আবেগ মোটেই দোষনীয় নয়, তবে অবশ্যই অনেকক্ষেত্রে অতিমাত্রায় আবেগের প্রয়োগ হীতে বিপরীত হয়ে দেখা দেয় যা কারোরই কাম্য নয়।

ক্রীড়াঙ্গণে অপরিনত বয়সে অতিমাত্রায় প্রচার-প্রচারণা, কর্পোরেট সম্পৃক্ততা আর অর্থ-বিত্ত কখনোই খেলোয়াড়দের ভবিষ্যত ক্যারিয়ারকে নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারেনি। এরকম উদাহরণ বিশ্বে ভুরিভুরি। আশা করছি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এখন থেকেই এই ব্যাপারে খুবই সতর্ক এবং কঠোর অবস্থানে থাকবে। বিশেষকরে বিসিবির প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপনের ভূমিকা এই ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।



 

Show all comments
  • মাসুদ ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:৪০ এএম says : 0
    অত্যান্ত সুন্দর ও গঠনমুলক লেখা। লেখককে অনেক অনেক ধন্যবাদ জ্ঞাপণ করছি
    Total Reply(0) Reply
  • কামরুজ্জামান ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:৪২ এএম says : 0
    আশা করি ক্রিকেট সংশ্লিষ্টারা বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাববেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
    Total Reply(0) Reply
  • খাইরুল ইসলাম ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:৪৩ এএম says : 0
    এদের ভালো খেলার প্রশংসা করুন, কিন্তু অতিরিক্ত কিছু করা যাবে না। কারণ তারা বয়সে তরুণ।
    Total Reply(0) Reply
  • Jahangir Ahmad ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:৪৫ এএম says : 0
    Akbar is the great Emperor of BANGLADESH. We Salute the Emperor.
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammed Azim ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:৪৫ এএম says : 0
    Absolutely he will be best ever captain for future Bangladesh Insha'Allah
    Total Reply(0) Reply
  • Md Firoz Kabir Dipu ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:৪৬ এএম says : 0
    Congratulations Bangladesh young team 09 02 2020
    Total Reply(0) Reply
  • তানিয়া ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:৪৭ এএম says : 0
    শুধু আকবর নয়, পুরো টিমই ভালো খেলেছে, সকলের জন্য রইলো প্রাণঢালা শুভেচ্ছা
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ক্রিকেট


আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ