Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আত্মঘাতী সাম্রাজ্যবাদ আত্মঘাতী জাতি

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২৪ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

সমুদ্রের তলদেশে ভ‚মিকম্প হলে সমুদ্রপৃষ্ঠে ঝড় ও সুনামী দেখা দেখা দেয়। অর্থাৎ সুনামী ও ঝড়ের পেছনে থাকে ভ‚মিকম্পের প্রভাব। বিশ্বায়নের যুগে বিশ্বরাজনীতির গতি প্রকৃতির কেন্দ্রে রয়েছে এককেন্দ্রীয় পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমানবিক বোমা ব্যবহার করে সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে পশ্চিমা নতুন বিশ্বব্যবস্থার নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গ্রীক-রোমান,মিশরীয়, চৈনিক, উসমানীয়, সুলতানী-মোঘল সভ্যতার প্রাচীনকাল থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত মানব সভ্যতার ইতিহাসে যে সব রাজনৈতিক অর্থনৈতিক শক্তির আর্বিভাব ঘটেছিল তার প্রায় প্রতিটি শত শত বছর স্থায়িত্ব লাভ করেছিল। সেই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ দুই প্রতিদ্বন্দি রাজনৈতিক শক্তি সোভিয়েত রাশিয়া মাত্র ৭০ বছরেই পতিত হয়েছে। এরপর এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আরো সুদৃঢ় ও সংহত হওয়ার কথা থাকলেও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকেই মার্কিন শাসকরা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পতনের আত্মঘাতি তৎপরতা বহুগুনে বাড়িয়ে দেয়। তবে মার্কিন পুঁজিবাদের সূচনাকালেই তার পতনের বীজ বপিত হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ত্রুটিপূর্ণ অর্থব্যবস্থা ও জনগনের নিয়ন্ত্রণহীন কর্পোরেট ব্যাংকিং সিস্টেমের চ’ড়ান্ত ফলাফল সম্পর্কে মার্কিন গণতন্ত্রের ফাউন্ডিং ফাদার আব্রাহাম লিঙ্কন প্রথম হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছিলেন। আমেরিকান গৃহযুদ্ধের পর ১৯৬৪ সালে স্টেট অব দি ইউনিয়ন বক্তৃতায় প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় অর্থব্যবস্থার উপর রাষ্ট্র ও জনগনের নিয়ন্ত্রণ থাকবে এবং কাগুজে মূদ্রার ব্যবহার ও জনগনের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রশ্নে এই ব্যবস্থা সর্বদা কার্যকর ভ‚মিকা পালন করবে।’ তবে রাষ্ট্রের সম্পদের উপর জনগণের নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রশ্নে আব্রাহাম লিঙ্কনের সুদৃঢ় ভ‚মিকার কারণেই প্রাইভেট ব্যাংকার ও কর্পোরেট পুঁজিবাদের নিয়ন্ত্রকরা লিঙ্কনকে বাঁচতে দেয়নি। তার স্বাক্ষরিত কারেন্সি অ্যাক্ট বাস্তবায়নের আগেই তাঁকে আততায়ীর গুলিতে মরতে হয়েছে। এরপর আর কখনোই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থব্যবস্থা ও ব্যাংকিং সিস্টেমের উপর রাষ্ট্র ও জনগনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষকে বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকারে পরিনত করে সেখানে সুবিধাভোগী ও পুঁজিপতি একভাগ মানুষের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শত বছরে এসব কর্পোপেরট পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠান এখন রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানবে পরিনত হয়ে মার্কিন গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দেউলিয়াত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছে। জনগনের ট্যাক্সের টাকায় হাজার হাজার কোটি ডলারের বেইল-আউট প্রোগ্রাম গ্রহণ করেও এই আত্মঘাতি ব্যবস্থার ধন ঠেকানো যাচ্ছেনা। মার্কিন ও পশ্চিমা অর্থব্যবস্থার ভ‚মিকম্প বিশ্বের অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর সুনামী হয়ে দেখা দিয়েছে। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ শ্লোগান সামনে রেখে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি এখন চীন-রাশিয়াসহ বিশ্বঅর্থনীতির জন্য বড় ধরনের ঝড় সৃষ্টি করতে চলেছে। মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেয়া বাণিজ্যযুদ্ধ পুরো বিশ্বব্যবস্থাকেই এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে দাড় করিয়ে দিয়েছে। আমদানী-রফতানীর ভারসাম্যহীনতা এবং রাষ্ট্রের ব্যয় নির্বাহ করতে সমরাস্ত্র বিক্রির উপর নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ার কারণে সারাবিশ্বেই এখন যুদ্ধের ঝুঁকি বেড়ে গেছে। তৃতীয় বিশ্বের দুর্বল শাসকরা জনগনের সম্পদের উপর জনগনের স্বার্থ রক্ষার বদলে পশ্চিমাদের সাথে আপস করে একদিকে পশ্চিমা স্বার্থে কাজ করছে, অন্যদিকে কল্পিত ও মেকি শত্রæর জুজু দেখিয়ে শত শত কোটি ডলারের সমরাস্ত্র কিনতে বাধ্য হচ্ছে। একটা তরতাজা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসহীন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সউদি সাংবাদিক তুরস্কের সউদি কনসুলেটে নিহত হওয়ার ঘটনায় প্রথমে ডোনাল্ড ট্রাম্প সউদি আরবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বললেও সউদি আরবের তৈলাস্ত্র ব্যবহার এবং কথিত শত মিলিয়ন ডলার বিনিময়ের পর ট্রাম্পের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে।

এক সময়ের স্নায়ুযুদ্ধের মূল প্রতিদ্বন্দি রাশিয়াকে ছাড়িয়ে চীন এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেট পুঁজিবাদের মূল প্রতিদ্বন্দী হয়ে দাঁড়িয়েছে । গতানুগতিক প্রোপাগান্ডায় বিশ্ব অর্থনীতির উপর চীনা আধিপত্য খর্ব করা যাচ্ছেনা। আবার চীনের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের সামরিক-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ গ্রহণের সামর্থ্যও এখন তাদের নেই। এ ক্ষেত্রে চীনা পন্যের উপর হাজার হাজার কোটি ডলারের নতুন ট্যারিফ আরোপ করাকেই মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এটি নি:সন্দেহে একটি বাণিজ্যযুদ্ধ এবং মার্কিনীদের এই ট্যারিফ যুদ্ধে চীনা ম্যানুফেকচারিং খাত বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়েছে। বাড়তি ট্যারিফ এড়াতে মার্কিন ক্রেতারা তৈরী পোশাক কিনতে এখন বাংলাদেশসহ বিকল্প বাজারগুলোর দিকে পা বাড়িয়েছে। এর মধ্য দিয়ে এসব দেশের রফতানী খাত চাঙ্গা হবে। তবে অর্থনৈতিক ধস ঠেকাতে মানবাধিকার ও অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে মার্কিন শাসকদের আপস এবং অস্ত্র বিক্রির অজুহাত তৈরী করতে প্রক্সি ওয়ারের ইন্ধন বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলকে অস্থিতিশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। ব্যাপক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা থাকার পরও এসব দেশে কাঙ্খিত বিনিয়োগ ও সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দেখা যাচ্ছেনা। চীনাপণ্যে মার্কিনীদের ট্যারিফ আরোপের জবাবে চীনও মার্কিন পণ্যের উপর শত শত কোটি ডলারের ট্যারিফ আরোপ করতে শুরু করেছে। সেই সাথে মার্কিন সভরেন্ট বন্ডের সবচেয়ে বড় ক্রেতা চীন মার্কিন সভরেন্ট বন্ড বিক্রি করে দিতে শুরু করেছে। ট্রিলিয়ন ডলারের চীন ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা এ সময়ে মার্কিন অর্থনীতির নেই। এ কারণেই ট্যারিফ যুদ্ধে দুই প্রতিপক্ষের কারোই বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার পতনের প্রথম ধাপের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেছে। এই যুদ্ধের প্রধান প্রতিপক্ষ চীন হলেও রাশিয়াকেও তারা ভুলে যায়নি। সিরিয়ায় রিজিম চেঞ্জ করে ইরাণসহ মধ্যপ্রাচ্যে এবং বিশ্বব্যবস্থার উপর মার্কিন নিয়ন্ত্রণ নিষ্কণ্টক রাখতে মার্কিনীরা যে পরিকল্পনা করেছিল রাশিয়ার হস্তক্ষেপে তা কার্যত ভন্ডুল হয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিবদমান দেশগুলো এখন রাশিয়ার মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম কিনতে লাইন ধরতে দেখা যাচ্ছে। অতএব মার্কিন মিলিটারী ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সও এখন রাশিয়া ও চীনের সাথে প্রবল প্রতিদ্বন্দীতার সম্মুখীন। ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যের অপ্রতিদ্বন্দী সামরিক পরাশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা হলেও মিলিশিয়া বাহিনী হেজবুল্লাহ ও হামাসের কাছে গত এক দশকে অন্তত: দুইবার পরাজয়ের মুখোমুখি হয় ইসরাইলী বাহিনী। অর্থাৎ অর্থনৈতিক আধিপত্য হারানোর সাথে সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের কৌশলগত অঞ্চলের উপর সামরিক আধিপত্যও হারিয়েছে। এমনকি জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্ব থেকেও নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বহু বছরে অর্জিত টিপিপি চুক্তি, ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংকটে টু-স্টেট সমাধানের প্রতিশ্রæতি, বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি এবং ইরানের সাথে ৬ জাতির পরমানু চুক্তির মত অতিব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এসব চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি থেকে সরে যাওয়ার ঘোষনাকে কেউ সমর্থন করেনি এবং মার্কিনীদের পশ্চাদপসারণের পর এসব উদ্যোগের কোনটিই থেকে যায়নি। এভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের কাছে তার গুরুত্ব, গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বস্ততা হারাতে বসেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ত্রুটিপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, কর্পোরেট ব্যাংকিং সিস্টেম ও ভোগবাদি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালুর মধ্য দিয়েই এর পতন শুরু হয়েছিল। হেজিমনিক সিস্টেম দিয়ে বৈষম্য ও দু:শাসন বাড়িয়ে কোন রকমে টিকে থাকার চেষ্টায় চলে গেছে আরো বেশ কিছু দশক। ভিয়েতনাম যুদ্ধ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ পশ্চিমাদের আধিপত্যের লড়াই, নিরবতা ও প্রশ্রয়ে সংঘটিত গণহত্যার দৃশ্যাবলী দেখে সত্তরের দশকে মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ তার একটি কাব্যগ্রন্থের নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য ফল অব আমেরিকা’। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের স্মৃতিবহ কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অ্যাট জেশোর রোড’ এই কাব্যগন্থে স্থান পেয়েছে। নাইন-ইলেভেন নামে পরিচিত ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্ক ও পেন্টাগনে সন্ত্রাসী বিমান হামলার পর প্রেসিডেন্ট বুশের ‘ওয়ার অন টেররিজম’ ঘোষনার পর নিউজার্সির পোয়েট লরিয়েট আমিরি বারাকা ‘সামবডি বে্উ আপ আমেরিকা, শিরোনামে একটি দীর্ঘ কবিতা লিখে প্রকাশ করেছিলেন। এই কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে বারাকা নতুন করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদি চেহারার মুখোশ উন্মোচন করে দেন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদি শোষন ও অপকর্মের নেপথ্যে ইহুদি জায়নবাদিদের ভ‚মিকার কথা এই কবিতায় দ্ব্যর্থহীনভাবে উঠে আসে। প্রতিবাদে এন্টি ডিফেমিস্ট লীগসহ জায়নিস্ট গ্রুপগুলো আমিরি বারাকার বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রোপাগান্ডা চালিয়েছিল। কিন্তু বারাকাকে তার বক্তব্য থেকে এক চুলও টলানো যায়নি। নাইন-ইলেভেন সম্পর্কিত তদন্ত কমিশন রিপোর্টসহ পরিবর্তি ঘটনাবলীতে আমিরি বারাকার কবিতায় বর্ণিত প্রশ্নগুলোই বার বার উঠে এসেছে।

পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী মার্কিন সাংবাদিত ক্রিস হেজের লেখা ‘আমেরিকা: দ্য ফেয়ারওয়েল ট্যুর’ গ্রন্থটি গত আগস্টে প্রকাশিত হয়েছে। এই বই প্রকাশিত হওয়ার পর মার্কিন টিভি টকশোতে ক্রিস হেজের একাধিক সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়েছে। ‘ দ্য কলাপ্স অব আমেরিকান অ্যাম্পায়ার? ’ শিরোনামের এক টকশোতে প্রসঙ্গক্রমে গত ৫ দশকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পতনের ধারাবাহিক ঘটনাক্রম উপস্থাপন করেছেন। ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির ক্রমাবনতিশীল বাস্তবতা, সামাজিক অবক্ষয়-অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা, মাদকাসক্তি, স্কুল হত্যাকান্ড, আত্মহত্যা ইত্যাদি সামাজিক-অর্থনৈতিক অনুসঙ্গগুলোর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রব্যবস্থা কোন প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিতে পারছেনা। সামাজিক-অর্থনৈতিক বিষয়গুলো রাজনীতিতে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করছে এবং নির্বাচন ব্যবস্থায় ম্যানিপুলেশনের মধ্য দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত লোক প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের পতনকেই ত্বরান্বিত করেছে। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ক্রিস হেজের বই থেকে একটি উদ্ধুতি তুলে ধরেছেন, যেখানে বলা হয়েছে, ‘রাজনীতি হচ্ছে ভয় ধরানোর খেলা। শাসকশ্রেনীকে ভয় পাইয়ে দেয়ার মত ক্ষমতা যদি তোমার না থাকে, তবে তুমি রাজনীতিতে সফল হতে পারবেনা। আর তা যদি সম্ভব না হয় তবে জাস্টিস, ইকুয়্যালিটি, ডেমোক্রেসী ইত্যাদি শব্দগুলো শুধু কথার কথা মাত্র। ক্ষমতাসীনরা যখন ক্ষমতা হারানোর ভয় পায় কেবলমাত্র তখনি তারা কাজ করতে বাধ্য হয়। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের প্রতি অনুনয়-বিনয় তেমন কোন কাজে আসেনা’। সাংবাদিক হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ঘটনাগুলো নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ক্রিস হেজ বুঝেছেন, যে কোন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তনের জন্য জনগনের ঐক্যবদ্ধ শক্তিই যথেষ্ট। এ প্রসঙ্গে পূর্ব জার্মানী, চেকো ভ্লাভাকিয়া, রোমানিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা বলেন ক্রিস হেজ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে, দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তি (রিপাবলিকান এবং ডেমোক্রেট) কর্পোরেট শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এটাকে তিনি কর্পোরেট ক্যুদেতা বলে আখ্যায়িত করেছেন। মার্কিন রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটা ধীরে ধীরে সংঘটিত হচ্ছে। জনগনের বিরুদ্ধে এই কর্পোরেট আগ্রাসন মোকাবেলায় জনগনকেই ঐক্যবদ্ধভাবে ভ‚মিকা নিতে হবে।

জনগনের ঐক্যবদ্ধ ভ‚মিকা গ্রহণের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে গণতন্ত্র, রাষ্ট্রব্যবস্থা, সামাজিক-রাজনৈতিক ন্যায্যতার দাবীসমুহ শুধুমাত্র কথার কথা হিসেবে টিকে থাকে। এভাবেই একটি সমাজ ও রাষ্ট্র আত্মঘাতি ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনতে (টু মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন) যে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন ক্রিস হেজ সহ মার্কিন লেখক-গবেষক, মানবাধিকারকর্মীদের অনেকে এসব পদক্ষেপকে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের পতনের জন্য দায়ী করছেন। মানবাধিকার এটর্নি ও লেখক জন হোয়াইটহেডের একটি সম্প্রতি একটি অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত হয়। ‘ইউ ওয়ান্ট টু মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন? স্টার্ট বাই মেকিং আমেরিকা ফ্রি এগেইন’ শিরোনামের নিবন্ধের শুরুতে তিনি মার্কিন ফাউন্ডিং ফাদার জর্জ ওয়াশিংটনের সেই বিখ্যাত উক্তিটির উদ্ধৃতি দিয়েছেন, “ইফ দ্য ফ্রিডম অব স্পিচ বি টেকেন আওয়ে, দেন ডাম্ব এন্ড সাইলেন্ট উই মে বি লেড, লাইক শিপ টু দি স্টার - জর্জ ওয়াশিংটন”, মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হলে, তা সমাজকে নিরব ও বধির করে দেয়, যা অনেকটা ভেড়ার পালকে কসাইখানায় নিয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। জন হোয়াইটহেড আমেরিকার প্রেক্ষাপটে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সামাজিক-রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্নে রাজনৈতিক দল ও জনগনের অবাধ বিচরণের ক্ষেত্রকে নিরাপদ রাখার বিষয়ের উপর জোর দিয়েছেন। ট্রাম্পের আগে থেকেই হোমল্যান্ড সিকিউরিটির নামে মার্কিন জনগনের উপর রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তারক্ষি ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরদারি ও খবরদারির পাশাপাশি অধিকার খর্ব করার প্রক্রিয়া রাষ্ট্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, মার্কিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও চিরায়ত মূল্যবোধের উপর কালিমা লেপনের মধ্য দিয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার গৌরব হারিয়েছে। তবে পশ্চিমা বিশ্বের কোন কোন দেশে এখনো গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধের বিষয়গুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব সহ নিরাপত্তা দেয়া হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার অনুগত ও বশংবদ শাসকরা শান্তির লক্ষ্যে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতিশ্রুতিকে ক্রমাগত অগ্রাহ্য করে বিশ্বকে অশান্ত ও অনিরাপদ করে তোলা হচ্ছে। পরিবর্তনের জন্য জন হোয়াইটহেড জনসমাজের সাহসী ভ‚মিকার প্রসঙ্গ তুলেছেন, তিনি বলেন, ‘যদি মার্টিন লুথার কিং তার সময়ের আইন মানতেন, তবে সিভিল রাইট মুভমেন্টই হতো না। এবং মার্কিন ফাউন্ডিং ফাদাররা যদি বৃটিশ রাজকীয় ডিক্রি মেনে তাদের পথচলা বন্ধ করতেন, তবে আমেরিকান রেভ্যুলেশন হতো না’। গত বুধবারের নিবন্ধে কানাডার বর্ষিয়ান সমাজতাত্তি¡ক হার্ভে লোথিয়ানের উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম, যেখানে তিনি চলমান সামাজিক- রাজনৈতিক বাস্তবতায় ইসলামের প্রফেট মোহাম্মদ(স.)এর একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। হার্ভে লোথিয়ানের আরেকটি নিবন্ধের শিরোনাম ‘হাউ অ্যা নেশন সেল্ফ ডেস্ট্রাক্টস’ একটি জাতি কিভাবে আত্মবিধ্বংসী হয়। তিনি লিখেছেন, জাতি গঠনের মূল উপাদান মানুষ, মানুষে মানুষে পারস্পরিক আস্থা ও সম্পর্ক যত মজবুত হবে জাতি তত শক্তিশালী হবে। বিভেদ অনৈক্য পরিহার করে মানুষের মধ্যে সামাজিক-রাজনৈতিক বন্ধন সুদৃঢ় হলে জাতি যে কোন কঠিন সংকট মোকাবেলা করতে সক্ষম হতে পারে। তিনি আরো লিখেছেন, যদি রাষ্ট্রের শাসকরা জাতির ঘাড়ে বিশাল বৈদেশিক ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেয় এবং উচ্চ বেতনের চাকুরীর সুযোগ ও অর্থ বিদেশে চলে যায়, সে ক্ষেত্রে সামাজিক-রাজনৈতিক বিভেদে জর্জরিত জাতির সামনে অর্থনৈতিক সংকট ও দেউলিয়াত্ব দেখা দিলে রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা থাকে। সে সময় নিরাপত্তাহীনতা চেপে বসে এবং সকলেই সশস্ত্র অবস্থা গ্রহন করতে বাধ্য হয়। এভাবে হানাহানি ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে জাতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা ধ্বংসের প্রান্তে চলে যায়। চলমান সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় আমরা কি এখন এমন একটি আশঙ্কার মধ্যে বসবাস করছি না?
[email protected]

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাতি

১৩ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন