Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হুমকির মুখে সমুদ্র ও সমুদ্রসম্পদ

| প্রকাশের সময় : ১১ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

সমুদ্রে এবার মাছ আহরণের পরিমাণ কম। আগে যেখানে ৫ থেকে ৭ দিনের ট্রিপে জেলেরা ৫ থেকে ৭ টন মাছ শিকার করতে পারতো এবার সেখানে পারে ২ থেকে ৩ টিন। মৎস্যক্ষেত্রগুলোতে মাছ আর আগের মতো নেই। কী কারণে মাছের অবস্থিতি ও বিচরণ কমে গেছে সেটা যৌক্তিক প্রশ্ন। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশী ট্রলারের অবৈধ অনুপ্রবেশ ও নির্বিচারে মাছ শিকার, বোমা ও রাসায়নিক ব্যবহার করে মৎস্যক্ষেত্রের ক্ষতিসাধন, প্রজনন মওসুমে মাছ শিকার, তেলসহ বিভিন্ন প্রকার ক্ষতিকর বর্জ্যরে প্রতিক্রিয়া এবং আবহাওয়ার পরিবর্তনজনিত প্রভাবই মাছ কমে যাওয়ার বা আহরণ কম হওয়ার কারণ। বঙ্গোপসাগর মাছের ‘খনি’ হিসাবে খ্যাত। সেই খনিতে মাছ কমে যাওয়ায় সামুদ্রিক মৎস্য-অর্থনীতিতে ব্যাপক বিরূপতা সৃষ্টি হতে পারে। সমুদ্রে দস্যু-তস্করের হানা, মাছ ধরার পাশাপাশি মৎস্যক্ষেত্র ধ্বংস, অতিরিক্ত মাছ শিকার, তেলসহ বিভন্ন বর্জ্যদূষণ, আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাব ইত্যাদি মোটেই নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরেই ওই উৎপাৎ-উপদ্রব ও নাশক কার্যপ্রক্রিয়া চলছে। অথচ এসবের নিরোধ বা প্রতিকারে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি সরকারের। এ প্রেক্ষিতে মাছ কমে যাওয়া, মাছের অবস্থান ও বিচরণ এলাকার পরিবর্তন অস্বাভাবিক ও অসম্ভব বলে মনে হয় না। ইতোমধ্যে আর একটি ভয়ংকর খবর পাওয়া গেছে। জানা গেছে, সমুদ্রে বাংলাদেশ সীমানার কাছাকাছি অক্সিজেনশূণ্য এলাকার সৃষ্টি হয়েছে। এতে আগামীতে সমুদ্র সম্পূর্ণ মৎস্যশূণ্য হয়ে পড়তে পারে। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান-গবেষণা চলছে। উচ্চতর গবেষণার জন্য আগামী আগস্ট মাসের মধ্যেই জাতিসংঘের সহায়তায় নরওয়ের জরিপ ও গবেষণা জাহাজ আরভি ড.ফ্রিটজফ নেনসেন-৩ আনা হচ্ছে।
পানির নীচে অক্সিজেন ছাড়া মাছ বা জলজ প্রাণীর টিকে থাকা সম্ভব নয়। হয় তারা মারা পড়বে, না হয় স্থান ছাড়তে বাধ্য হবে। বঙ্গোপসাগরে কম অক্সিজেন বা শূণ্য-অক্সিজেন এলাকার বিষয়টি ধরা পড়ে ২০১৬ সালে। এলাকাটি বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার ৬শ থেকে ৭শ মাইল দূরে। এলাকা চিহ্নিত করা হলেও আসলে এর প্রকৃত অবস্থান কোথায়, পরিধিই বা কতটা তা এখনো নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। এব্যাপারে যথাযথ অনুসন্ধান ও গবেষণার বিকল্প নেই। সব সাগর-মহাসাগরেই এ ধরনের অক্সিজেন-শূণ্য এলাকা সৃষ্টি হতে পারে এবং হয়তো বা সব সাগর-মহাসাগরেই অক্সিজেনশূণ্য এলাকা বিদ্যমান রয়েছে। বঙ্গোপসাগরে অক্সিজেনশূণ্য এলাকা শনাক্ত হওয়ার পর বিজ্ঞানীদের ধারণা, অনেক আগেই এই প্রক্রিয়ার সূচনা এবং এর অনির্বায প্রতিক্রিয়াও প্রবাহমান অবস্থায় রয়েছে। মাছ ও প্রাণীকূলের মরে যাওয়া ও পালিয়ে যাওয়াই যেহেতু এর অনিবার্য পরিণতি সুতরাং এ আন্দাজ অমূলক মনে হবে না যে, সমুদ্রে মাছ কমে যাওয়া বা আগের মত না পাওয়ার অন্যতম কারণ হতে পারে এই অক্সিজেনশূণ্য এলাকা সৃষ্টি। বিজ্ঞানীদের মতানুসারে, জ্বালানিতেল, পোড়াতেল, জ্বালানিবর্জ্য পরমাণুবর্জ্য এবং জমিতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে রাসায়নিক সারসহ কীটনাশকের ব্যবহারে সৃষ্ট নাইট্রাস অক্সসাইড সাগরতলকে অক্সিজেনশূণ্য করে তুলছে। নাইট্রাস অক্সসাইড থেকে তৈরি হচ্ছে নাইট্রাইড যা সমুদ্রপরিবেশে এককোষি শৈবাল সৃষ্টি ও বৃদ্ধি করছে এবং ওই শৈবাল ডি কম্পোড হওয়ার পর সৃষ্ট ব্যাকটেরিয়া অক্সিজেন খেয়ে শেষ করে ফেলছে। বলা বাহুল্য, অক্সিজেনশূণ্য হওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করা না গেলে সমুদ্রের পরিবেশ, মৎস্য, প্রাণী ও উদ্ভিদসম্পদ রক্ষা করা সম্ভব হবে না। যেহেতু সমস্যাটি কোনো একটি মাত্র মহাসাগর, সাগর বা উপসাগরের নয়। কাজেই এটি গুরুতর একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। বিশ্বে বøু ইকোনমির যে বিপুল সম্ভাবনার কথা এখন উচ্চারিত হচ্ছে তার জন্য এটা মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। অক্সিজেনশূণ্য এলাকা সৃষ্টির কারণগুলো যেহেতু জানা হয়ে গেছে, সুতরাং কারণগুলো নিরসনে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ও পদক্ষেপ জরুরি।
বঙ্গোপসাগরে মাছ ছাড়াও বিভিন্ন রকমের মূল্যবান সম্পদ রয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য সসমুদ্র দেশের মতো আমাদের দৃষ্টিও তাই বঙ্গোপসাগরের দিকে হওয়ার কথা। সমুদ্রসীমানা নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে যে বিরোধ ছিল তার অবসান হয়েছে। এখন আমাদের সমুদ্র এলাকার মধ্যে অবস্থিত সম্পদ রক্ষা ও আহরণের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দু:খজনক হলেও বলতে হচ্ছে, ‘সমুদ্রজয়ের’ ডংকানিনাদে সরকার যতটা উৎসাহী, সমুদ্রসম্পদ রক্ষা, উন্নয়ন, আহরণ ইত্যাদিতে ততটা উৎসাহী নয়। ভারত ও মিয়ানমার তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে অনেক দূর এগিয়ে গেলেও আমাদের কোনো ‘খবর নেই’ অবস্থা থেকেই সরকারের উদ্যম-আগ্রহের ঘাটতিটি উপলব্ধি করা যায়। এখন পর্যন্ত সমুদ্রসম্পদের মধ্যে মাছই আমাদের আহরণযোগ্য সম্পদ। জাতীয় মৎস্য চাহিদার একটি অংশ পূরণ ছাড়াও সামদ্রিকমৎস্য রফতানি করে আমরা কিছু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করি। সেই মাছও এখন আক্রা হয়ে যাচ্ছে। এর চেয়ে দু:সংবাদ আর কি হতে পারে! ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, বিশ্বের মহাসাগর, সাগর ও উপসাগরগুলো নানা প্রকার দূষণের প্রতিক্রিয়ার শিকার। ডলফিনসহ জীববৈচিত্র ধ্বংস, মৎস্য ও মৎস্যক্ষেত্র বিনাশ, অক্সিজেনশূণ্য এলাকা সৃষ্টি এমনকি সাগর শুকিয়ে যাওয়ার মতো বেনজীর প্রতিক্রিয়াও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমাদের নদীগুলো শেষ হয়ে গেছে ভারতের পানি আগ্রাসনে। নদীতে আর এখন আগের মতো মাছ পাওয়া যায়না। এমন নদীও কম নেই, দখল-দূষণে যাদের পানিতে মাছের অস্তিত্ব নির্মূল হয়ে গেছে। এখন সমুদ্রও হুমকির মুখে। আগামীর মৎস্যচাহিদা পূরণে সমুদ্রের বৃহত্তর ভূমিকা রাখার সুযোগ সংকুচিত হয়ে পড়ার আশংকা স্পষ্ট। এ প্রেক্ষাপটে, সমুদ্রে পর্যবেক্ষন, জরিপ ও গবেষণা জোরদার করতে হবে। সুরক্ষা বাড়াতে হবে। আমাদের কাছে সমুদ্র গল্পের সেই সোনার ডিম দেয়া হাঁসের মতো। তাকে কোনোভাবেই মারা যাবে না বা মরতে দেয়া যাবে না। জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থেই সমুদ্রকে বাঁচাতে হবে।



 

Show all comments
  • মাহমুদুর রহমান ১১ জুন, ২০১৮, ১:২৭ এএম says : 0
    বিষয়টি খুবই উদ্বেগের
    Total Reply(0) Reply
  • পারভেজ ১১ জুন, ২০১৮, ১:২৮ এএম says : 0
    আরও নিবিড় গবেষণা প্রয়োজন। এ বিষয়ে অবহেলা করা যাবে না।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হুমকির মুখে


আরও
আরও পড়ুন