Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কিংবদন্তির বেদনাদায়ক বিদায়!

| প্রকাশের সময় : ১৪ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

স্পোর্টস ডেস্ক : একটি সার্থক গল্প বা উপন্যাসের শেষটা আনন্দদায়ক বা সুখকর নাও হতে পারে। বাস্তব জীবনে তো সেটা আরো বেশি সম্ভব। বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে উসাইন বোল্টকে দেখুন, উত্তর পেয়ে যাবেন।
ট্রাক এন্ড ফিল্ডে কি করেননি বোল্ট। সর্বকালের সব রেকর্ড ভেঙে হয়েছেন ইতিহাসের সেরা দৌড়বীদ। যে কারণে সময়-ই তাকে ভুষিত করেছে কখনো ‘বজ্রবিদ্যুৎ’ কখনো বা ‘গতি দানব’ নামে। অনেক সময় এমনও শোনা গেছে যে, কোন বিশেষনই জ্যামাইকান গতীতারকার নামের পাশে মানানসই নয়! এমনটা হবে নাই বা কেন, ট্রাক অ্যান্ড ফিল্ডে প্রতিপক্ষকে নিয়ে যে শ্রেফ ছেলেখেলায় মেতে উঠতেন এই ৩০ বছর বয়সী।
কিন্তু নিয়তির কি নির্মম পরিহাস! ক্যারিয়ারের শেষটা রুপকথাময় হলো না। ইংল্যান্ডে চলমান বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়ন্সশিপে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ক্যারিয়ারের ইতি টেনেছেন বোল্ট। দুটি ইভেন্টে অংশ নিয়ে একটিতেও জয়ী হতে পারেননি। ১০০ মিটারে আমেরিকার জাস্টিন গ্যাটলিন ও ক্রিশ্চিয়ান কোলেম্যানের কাছে হেরে তৃতীয় হওয়ার পর পরশু রাতে ক্যারিয়ারের শেষ প্রতিযোগীতা তো শেষই করতে পারলেন না! চোটের কারণে ৪ গুনন ১০০ মিটার রিলে দৌড় শেষ করার আগেই ট্রাকে লুনোপুটি খান মাংশপেশীতে টান পড়ায়। ৫০ মিটার দৌড় শেষ করার পরই বাম থাইয়ের পেশীতে টান পান তিনি। এরপর ট্র্যাকেই লুটিয়ে পড়েন। জ্যামাইকার স্বর্ণ জয়ের স্বপ্নও সেখানে লুটোপুটি খায়! সেই সুযোগে ৩৭.৪৭ সেকেন্ড সময় নিয়ে স্বর্ণ জয় করে বৃটেন।
বৃটেনকে চ্যাম্পিয়ন করতে সবকিছু পরিকল্পিত বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বোল্টের হাতে ব্যাটন তুলে দেওয়া উয়োহান বেøক। আসর পরিচালনাকীদের একহাত দিয়ে তিনি বলেন, “তারা (আয়োজকরা) আমাদের কল রুমে দীর্ঘ সময় আটকে রেখেছিল।’ তিনি বলেন, ‘বোল্ট ঠান্ডায় জমে গিয়েছিল। এমনকি বোল্ট আমাকে বলেও ফেলে: ‘ইয়োহান, আমার মনে হয় এটা পাগলামো।” বেøক বলেন, ‘এসময় আমরা ওয়ার্ম আপ চালিয়ে যায় এবং অপেক্ষার পর অপেক্ষা করতে থাকি। এরপর দেখলাম এজন লিজেন্ড ও সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন বের হলেন এবং এভাবে (ইনজুরির শঙ্কা নিয়ে) লড়াই করলেন।’ এসময় ঠান্ডা রুমে তাদের ৪০ মিনিটের বেশি আটকে রাখা হয়েছিল বলে জানান তিনি।
ইনজুরি আক্রান্ত বোল্টকে ট্র্যাক থেকে হুইল চেয়ারে করে বাইরে নিয়ে আসা হয়। দলের হয়ে শেষ খেলোয়াড় হিসেবে বোল্ট যখন দৌড় শুরু করেছিলেন তখন জ্যামাইকা তৃতীয় স্থানে ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লন্ডন স্টেডিয়ামে ৬০ হাজার সমর্থককে খুশী করতে পারেননি সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই অ্যাথলেট। কে জানত, ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান ডন ব্রাডম্যানের মত তার ক্যারিয়ারের শেষটাও হতে যাচ্ছে অন্ধোকারময়। জ্যামাইকান দলের চিকিৎসক ড: কেভিন জোনস জানিয়েছেন বাম পায়ের হ্যামস্ট্রিংয়ে টান পড়েছে বোল্টের। প্রচন্ড ব্যাথার কারনে তিনি শেষ পর্যন্ত আর দৌড়াতে পারেননি। গত তিন সপ্তাহ তার উপর দিয়ে দারুন চাপ গেছে। এখন তার সুস্থতার জন্য সকলে আশাবাদী।
চিজিনডু উজা, অ্যাডাম জেমিলি, ড্যানিয়েল টালবোট ও নেদাননিল মিচেল-বেøককে নিয়ে গঠিত স্বাগতিক বৃটেন স্বর্ণ জয় করায় কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে বোল্ট সমর্থকরা। বৃটেন থেকে ০.০৫ সেকেন্ড কম সময় নিয়ে রৌপ্য জিতেছে জাস্টিন গ্যাটলিনের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র। ৩৮.০৪ সেকেন্ড সময় নিয়ে ব্রোঞ্জ জয় করে অবাক করেছে জাপান।
এদিকে জ্যামাইকান দলের হয়ে দ্বিতীয় লেগে দৌড়ানো জাস্টিন ফর্টে বলেন, ‘আসলেই কি ঘটেছিল সে সম্পর্কে বোল্ট আমাদের কিছুই বলেনি। কিন্তু আমি যতটুকু দেখেছি তার পেশীতে টান পড়েছিল। সে এজন্য আমাদের সকলের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। কিন্তু আমরা তাকে জানিয়েছি এখানে ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই। ইনজুরি খেলারই একটি অংশ।’ সদ্য ১১০ মিটার হার্ডলসে চ্যাম্পিয়ন জ্যামাইকার নেতৃত্বে থাকা ওমর ম্যাকলিওড বলেন, ‘এমনটা দেখতে পাওয়া বেদনাদায়ক আমি পুরোটাই দিয়েছিলাম এবং চেয়েছিলাম স্বর্ণজয়ের মধ্য দিয়েই বোল্টের বিদায় হোক। এমনকি একটা মেডেল হলেও হত। এটা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি ব্যাথিত এবং ঘোরের মধ্যে আছি।’ তিনি যোগ করেন, ‘ সে যাই হোক উসাইন বোল্টের নাম সবসময়ই সকলের মধ্যে জীবিত থাকবে।’
ম্যাকলিওড, ফোর্টে, বোল্ট ও ২০১১ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইয়োহান বেøককে নিয়ে শক্তিশালী দল গঠন করেছিল জ্যামাইকা। লন্ডন স্টেডিয়ামে আগত সমর্থকরা নিজ নিজ দেশকে বাদ দিয়ে যেন বোল্টকে দেখতে ও তাকে শেষবারের মত সমর্থন দিতেই উন্মুখ ছিল। স্টেডিয়ামে জায়ান্ট স্ক্রিনও আটকে ছিল বোল্টের দিকেই। প্রথম তিন লেগে বৃটেন, যুক্তরাষ্ট্র ও জ্যামাইকা সমান তালে লড়াই চালিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বোল্ট পড়ে গেলে তৃতীয় স্থানে উঠে আসে জাপান।
এর মাধ্যমে ১০০ ও ২০০ মিটারে বিশ্বরেকর্ড ধারী বোল্ট ১১টি বিশ্ব আসরের পদক নিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এলিসন ফেলিক্সের থেকে যা মাত্র একটি কম। এছাড়া তার ঝুলিতে রয়েছে আটটি অলিম্পিক স্বর্ণপদক। অলিম্পিকের তিন আসরে ১০০মি ও ২০০ মিটারে স্বর্ণজয়ী একমাত্র ক্রিড়াবীদ তিনি। অলিম্পিকে স্বপ্নের ‘ট্রিপলের ট্রিপল’ও জিতেছিলেন, কিন্তু স্বতীর্থের ড্রাগ কেলেঙ্কারিতে একটি পদক হাতছাড়া হয়ে যায়।

বোল্টনামা
ট্রাক অ্যান্ড ফিল্ডের মহানায়ককে বিদায় জানাতে প্রস্তুত ছিল গোটা বিশ্ব। কিন্তু উসাইন বোল্টের বিদায়টা রূপকথাময় হলো না। লন্ডনে বিশ্ব অ্যাথলেটিক্সে প্রথমে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে সোনা জিততে ব্যর্থ হওয়ার পর নিজের শেষ ইভেন্ট ৪ গুনন ১০০ মিটার রিলেতেও দৌড়ই শেষ করতে পারলেন না। হ্যামস্ট্রিং চোটে ট্র্যাকেই লুটিয়ে পড়লেন। এমনই বেদনাময় পরিসমাপ্তি ঘটল সর্বকালের সেরা অ্যাথলেটের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের। প্রিয় পাঠক, বিদায়লগ্নে চলুন জেনে নেওয়া যাক বোল্টকে নিয়ে আরো কিছু তথ্য...

১ পুরো ক্যারিয়ারে একবারই ব্রোঞ্জপদক জিতেছেন উসাইন বোল্ট। সেটিও ক্যারিয়ারের একেবারে গোধূলিবেলায়। চলমান লন্ডনে বিশ্ব অ্যাথলেটিক্সে ১০০ মিটার দৌড়ে ব্রোঞ্জ জোটে বোল্টের ভাগ্যে। এই ইভেন্টে সোনা জেতেন যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিন গ্যাটলিন।

৩ পরপর তিনটি অলিম্পিকে ১০০ মিটার দৌড়ে সোনাজয়ী ইতিহাসের একমাত্র অ্যাথলেট উসাইন বোল্ট। ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিক দিয়ে শুরু। এরপর ২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিকের পর ২০১৬ সালে রিওতেও জয় করেন সোনা। অলিম্পিকে ‘ট্রেবল’ ‘ট্রেবল’টাও তাঁরই হতো; যদি না বেইজিং অলিম্পিক রিলের সতীর্থ নেস্তা কার্টার ডোপপাপী প্রমাণিত হতেন। ১০০ মিটার স্প্রিন্টের মতোই বেইজিং, লন্ডন আর রিওতে জ্যামাইকাতে রিলে দৌড়ে সোনা জিততে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। বেইজিংয়েরটা বাতিল হয়ে গেলেও লন্ডন আর রিওর রিলে-সাফল্যের কৃতিত্বটা তো তাঁর থাকছেই।

৪ চারবার ‘ওয়ার্ল্ড স্পোর্টসম্যান অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হয়েছেন নিজের ক্যারিয়ারে। ২০০৯ আর ২০১০ সালে পরপর দুবার জেতেন এই পুরস্কার। ২০১৩ সালে জেতেন তৃতীয়বারের মতো। শেষটি জিতেছেন এ বছর ২০১৭-তে।

৫ জীবনে পাঁচজন স্প্রিন্টারের কাছেই হেরেছেন বোল্ট। এঁরা হলেনÑ ক্রিশ্চিয়ান কোলম্যান, আসাফা পাওয়েল, টাইসন গে আর জাস্টিন গ্যাটলিন। এই পাঁচ অ্যাথলেট নিশ্চিতভাবেই অমর হয়ে থাকবেন অ্যাথলেটিকসের ইতিহাসে।

৬ আইএএফের সেরা পুরুষ অ্যাথলেটের শিরোপা ছয়বার নিজের করে নিয়েছেন বোল্টÑ ২০০৮, ২০০৯, ২০১১, ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৬ সালে।

৮ বোল্টের ক্যারিয়ারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক সংখ্যা। অলিম্পিকে আটটি সোনার পদক জিতেছেন তিনি। ২০০৮ সালে বেইজিং, ২০১২ সালে লন্ডন আর ২০১৬ সালে রিও অলিম্পিকে ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্টের ছয়টি সোনা। পাশাপাশি লন্ডন ও রিওর রিলের দুটি সোনা।

৯.৫৮ সংখ্যাটা হয়তো অনেকেরই মুখস্ত। ২০০৯ সালে বার্লিনে বিশ্ব অ্যাথলেটিকসে ৯.৫৮ টাইমিংয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়ে ১০০ মিটার স্প্রিন্ট জিতেছিলেন বোল্ট।

৯.৬৩ ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকে এই টাইমিং দিয়েই ১০০ মিটার স্প্রিন্ট জিতেছিলেন বোল্ট। পরের বছরই বার্লিনে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে এই টাইমিং ছাড়িয়ে যান। এটি তাঁর ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেরা টাইমিং।

৯ ক্যারিয়ারে মোট নয়বার বোল্ট ৯.৭৭ থেকে কম অথবা এর বেশি টাইমিংয়ে ১০০ মিটার দৌড় শেষ করেছেন।

১১ বিশ্ব অ্যাথলেটিকসে তাঁর মোট সোনার সংখ্যা। ১০০ মিটার (২০০৯, ২০১৩ ও ২০১৫), ২০০ মিটার (২০০৯, ২০১১, ২০১৩, ২০১৫) রিলে (২০০৯, ২০১১, ২০১৩, ২০১৫)।

৮.৭০ এটাও বোল্টের টাইমিং। তবে একটি দৌড়ের শেষ ১০০ মিটারের হিসাব। ২০০৯ সালে ম্যানচেস্টারের বুপা গ্রেট সিটি গেমসে ১৫০ মিটার দৌড়ের শেষ ১০০ মিটারে এমন অবিশ্বাস্য গতিতে দৌড়েছিলেন সর্বকালের সেরা এই অ্যাথলেট।

১৯.১৯ জাদুকরী এই খংখ্যাটাও অনেকের মনে লেগে আছে। ২০০৯ সালে বার্লিনে বিশ্ব অ্যাথলেটিকসের ২০০ মিটার স্প্রিন্টে বোল্টের বিশ্ব রেকর্ড গড়া টাইমিং এটি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বোল্ট

৮ নভেম্বর, ২০১৮

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ