পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
করোনা মহামারী সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। এর কুপ্রভাবে অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি এলোমেলো হয়ে পড়েছে। মানুষের মানুষ হয়ে উঠার সূতিকাঘার যে পরিবার সেই পরিবারও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হচ্ছে। মানুষের নীতি-নৈতিকতা, মানবিকতা, মূল্যবোধে চরম আঘাত করেছে। করোনার বিপজ্জনক এই সময়েও অপরাধ, অপকর্ম, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি থেমে নেই। বরং নৃশংসতা অনেক গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। খুনীরা খুন করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, লাশ ঘুম করতে কুপিয়ে খন্ড-বিখন্ড করে ফেলছে। কখনো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে লাশ বিকৃত করে দিচ্ছে। মেয়ে বাবা-মা, বোন ও স্বামীকে খুন করে নিজেই আত্মসমর্পন করছে। প্রতিহিংসা এতটাই নির্মম যে, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। কে কখন কিভাবে নির্মমতার শিকার হবে, তা কেউ বলতে পারে না। এমনকি আপনজনদের হাতেও কেউ নিরাপদ নন। সমাজে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ থাকবে, এটা পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়। তবে অপরাধ যাতে সহনীয় ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে, এজন্য পারিবারিক ও সামাজিক নীতি-নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের চর্চা ও বিকাশ অব্যাহত রাখা জরুরী। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এর ধারাবাহিকতা থাকতে হয়। দেখা যাচ্ছে, মূল্যবোধের এ জায়গাটি নাজুক হয়ে পড়েছে। নীতি-নৈতিকতা কি জিনিস মানুষ তা ভুলতে বসেছে। যে যেভাবে পারছে নিজের আধিপত্য বিস্তারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে সমাজে একের পর এক অস্বাভাবিক ঘটনার উদ্ভব হচ্ছে। একটি নৃশংস ঘটনার পর আরেকটি ঘটছে। কোনোভাবেই এর প্রতিকার করা যাচ্ছে না। একটি সমাজে বহু ধরনের মানুষ নিয়ে গড়ে উঠে। প্রান্তিক থেকে শুরু করে নি¤œ, মধ্য ও উচ্চ শ্রেণী থাকে। এদের মধ্যে যেমন চোর, গুন্ডা, সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ থাকে, তেমনি সভ্য ও সুশীল মানুষও থাকে। সভ্য ও সুশীল শ্রেণীর নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সরব উপস্থিতি ও শক্তির কাছে অসভ্যতা এবং কুশীলতা বরাবরই পরাস্ত হয়। যখনই নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ নীরব হয়ে পড়ে বা ক্ষয়ে যায়, তখনই অস্বাভাবিক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। আমরা সারাজীবন দেখে ও শুনে আসছি, সন্ত্রাস ও গুন্ডামির সাথে তরুণ ও যুবকশ্রেণীই বেশি জড়িত থাকে। এখন দেখছি, ছোট ছোট কিশোর শ্রেণী যাদের কিশোর গ্যাং হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, তারা সমাজে দাবড়ে বেড়াচ্ছে। তারা এমন কোনো অপরাধ নেই যা করছে না। খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, মাদকসেবন, মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে সব ধরনের অপরাধে তারা যুক্ত হয়ে পড়ছে। বলা হয়, সমাজের যে নিম্ন শ্রেণী রয়েছে, বেশির ভাগ কিশোরই সেই শ্রেণী থেকে উঠে আসছে। আবার মধ্যবিত্ত ও ধনী ঘরের সন্তানও রয়েছে। তার অর্থ হচ্ছে, এই কিশোরদের প্রতিরোধে তাদের পরিবার যেমন ব্যর্থ হচ্ছে, তেমনি সমাজের অভিভাবক শ্রেণীও উদাসীন হয়ে রয়েছে। সাধারণত সন্তানদের শাসন-বারণে পরিবারের শৈথিল্য থাকলে সমাজের অভিভাবক শ্রেণীর শাসন-বারণের মুখে পড়ে। এখন পারিবারিক ও সামাজিক শাসন-বারণ না থাকায় কিশোররা যেমন গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ছে, তেমনি একের পর এক অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটছে।
দুই.
দেড় বছরের বেশি সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। খুলব-খুলছি বলেও খোলা হচ্ছে না। করোনার সংক্রমণ এই বাড়ে তো এই কমে। এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কবে খুলবে তা কেউ বলতে পারছে না। দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের আচার-আচরণ ও মনোজগতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের মন-মেজাজ খিটখিটে হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে রাজধানীসহ শহরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অন্য কোথাও বের হতে না পারায় বাসায় বন্ধীজীবন পার করছে। যে সময়টা তাদের বোধ-বুদ্ধি পাকাপোক্ত হওয়ার কথা, সে সময়টাই তাদের বন্ধী থাকতে হচ্ছে। সহপাঠী থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লার প্রতিবেশীদের সাথে মিশতে না পারা এবং খেলাধুলা করতে না পারায় তাদের মনোজগতে এক ধরনের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের জগত ক্ষুদ্র হয়ে পড়েছে। বাবা-মায়েরাও সন্তানদের আচার-আচরণ সামাল দিতে পারছে না। এক অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছে। সন্তানকে শান্ত রাখার জন্য বাধ্য হয়ে তাদের হাতে মোবাইল, ট্যাব ও কম্পিউটার তুলে দিচ্ছে। এসব দিয়ে তাদের ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছে। তবে সন্তানরা এসব প্রযুক্তিগত গ্যাজেটের মাধ্যমে কি করছে, এ ব্যাপারে অনেকটাই উদাসীন থাকছে। উঠতি বয়সী সন্তানরা বিভিন্ন অনাকাক্সিক্ষত সাইটে গিয়ে কিংবা সংঘাতপূর্ণ বিভিন্ন ধরনের গেইমে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এর মধ্য দিয়ে তাদের মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব যেমন পড়ছে, তেমনি অপরাধ প্রবণও হয়ে পড়ছে। কিশোর গ্যাংয়ের আজকের যে উত্থান তা এই সোস্যাল মিডিয়ার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ারই ফসল। অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমে কিশোর শ্রেণী গ্যাং গ্রুপ তৈরি করে পাড়া-মহল্লায় ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করছে। অদ্ভুত সব নাম দিয়ে এই গ্রুপ গঠন করা হচ্ছে। এসব নামের অর্থ থেকে বোঝা যায় তারা নেতিবাচক কর্মকান্ডে জড়িত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রুপের লিডারের নামে গ্রুপ খোলা হয়ে থাকে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারাদেশে শতাধিক কিশোর গ্যাং রয়েছে, যারা খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, জুনিয়র-সিনিয় দ্বন্দ্ব আধিপত্য বিস্তারে মারপিটসহ মাদক ব্যবসায় জড়িত। এর মধ্যে রাজধানীতেই ৭৮টি গ্রæপ সক্রিয়। এদের সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হিমশিম খাচ্ছে। বয়স ও আইনগত জটিলতার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পাশাপাশি কিশোর গ্যাংয়ের পেছনে নেপথ্যে ক্ষমতাসীন দলসহ প্রভাবশালী মহলও জড়িয়ে আছে। ফলে কিশোর গ্যাং সদস্যদের গ্রেফতার করা হলেও সহজেই তারা জামিনে বের হয়ে যাচ্ছে। সংশোধনাগারে পাঠিয়েও তেমন কোনো লাভ হচ্ছে না। এ এক জটিল সমস্যা। এ সমস্যা থেকে উত্তরণে মূল ভূমিকা পালন করতে পারে কিশোরদের পরিবার। গ্যাংয়ের সাথে জড়িতদের পিতা-মাতার সচেতনতার উপরই এর প্রতিকার বহুলাংশে নির্ভর করছে। তারা যদি সন্তান কখন, কোথায় যাচ্ছে, কি করছে, কখন বাসায় ফিরছে, ফিরে কি করছে- এসব বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খোঁজ-খবর রাখে, তাহলে শাসন-বারণের মাধ্যমে সন্তানকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। পারিবারিক এই শাসন-বারণের অভাবেই কিশোররা নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। আমাদের চিরায়ত পারিবারিক মূল্যবোধই হচ্ছে, সন্তানকে রক্ষণশীল আবহে বড় করে তোলা। আদব-কায়দা, পারিবারিক রীতি-নীতি ও সমাজিক সিস্টেম যাতে ব্যাহত না হয়, সেদিকে তীক্ষè নজর রাখা। সন্তানকে যেকোনো অপকর্ম থেকে দূরে রেখে শাসন-বারণের মধ্য দিয়ে গড়ে তোলা। পারিবারিক এ রীতি-নীতি এখন অনেকটাই শিথিল হয়ে পড়েছে। যার ফলে কিশোর গ্যাংয়ের মতো সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় চলতি জেনারেশনের মধ্যে শিক্ষা ও মননশীলতার চরম ঘাটতি এবং মেধাশূন্যতা দেখা দিয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব দেশ ও রাষ্ট্রের মধ্যে যে পড়বে তাতে সন্দেহ নেই। এ নিয়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কোনো চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। একটি প্রজন্ম যে বিকল হয়ে বেড়ে উঠছে এবং সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য হুমকি হয়ে উঠছে, তা নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যাথা নেই।
তিন.
আমাদের পরিবার ও সমাজের যে গঠন তা পশ্চিমা দেশগুলো থেকে একেবারে আলাদা। এখানে পরিবারের অভিভাবক ছাড়াও সমাজের অভিভাবক শ্রেণী সন্তানদের সঠিক পথে চলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কারো ছেলে-মেয়ের চলাফেরা ও আচার-আচরণে অস্বাভাবিক কিছু দেখলে সমাজের অভিভাবকরা তাদের সতর্ক করে, এমনকি সন্তানের বাবা-মায়ের কাছে নালিশ করে। এতে বাবা-মা সতর্ক হয়ে সন্তানদের শাসন-বারণের মধ্যে নিয়ে আসে। কি করতে হবে, কি করা যাবে না-এমন বিধিনিষেধ আরোপ করে। ফলে সন্তানকে এ ধারা অনুযায়ী চলতে হয়। এখন পাড়া-মহল্লায় এ ধরনের বিধি-নিষেধ অনেকটা নীরব হয়ে গেছে। আগে দেখা যেত, কোনো কিশোর কিংবা তরুণ অসামাজিক আচরণ করলে অভিভাবক শ্রেণীর কাছে জবাবদিহির মুখে পড়তে হতো। তারা ডাক দিয়ে সতর্ক করে দিত। এখন এই সতর্কীকরণ দেখা যায় না। সমাজের অভিভাক শ্রেণীর মধ্যে অনেকটাই আত্মকেন্দ্রিক প্রবণতা বিরাজমান। একেক জন যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপবাসী হয়ে বসবাস করছে। অন্যের সন্তান গোল্লায় যাচ্ছে, তাতে আমার কি-এমন মনোভাব তাদের মধ্যে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিংবা দেখেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে যাচ্ছে। গোল্লায় যাওয়া তরুণটিও যে তার সন্তানের ওপরও প্রভাব ফেলছে বা তার সাথে সম্পর্ক রয়েছে হয়তো তা তারা খেয়াল করছে না। ঝড় উঠলে যে তা থেকে কেউই রেহাই পায় না, এ কথাটি তারা বেমালুম হয়ে রয়েছে। সমাজিক মূল্যবোধের এই ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার জন্য দায়ী কে? এ প্রশ্নের উত্তরটি বৃহৎ পরিসরের। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র এই তিনটি ধারার মধ্যে এর উত্তর রয়েছে। একটি দেশের জনগোষ্ঠীর সামাজিক মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার ওপর রাষ্ট্র তথা রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করে তাদের রাষ্ট্রনীতি ও নৈতিকতার প্রভাব ফেলে। রাষ্ট্রের সরকার যদি মনে করে, আমাদের পারিবারিক ও সমাজিক যে বৈশিষ্ট্য তা ধরে রেখে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে, তবে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। আমরা যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখব, সউদী আরব, ইরান, ভুটানসহ অন্যান্য রাষ্ট্র যেভাবে পরিচালনা করে সেভাবেই তাদের পরিবার ও সমাজ পরিচালিত হয়। সউদী আরব, ইরান ইসলামি শাসন ব্যবস্থায় দেশ পরিচালনা করছে। ফলে এ নীতির মাধ্যমেই সেখানের পারিবারিক ও সামাজিক রীতি-নীতি পরিচালিত হচ্ছে। সেখানে অপরাধ সংঘটিত হলেও তা নিয়ন্ত্রণ ও সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান মানুষের সুখী হওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেসের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করছে। দেশটির পরিবার ও সামাজও সেভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বের পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থাও তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি অনুযায়ী পরিচালিত হয়। আমাদের দেশ যে কোন নীতিতে পরিচালিত হচ্ছে, তা বোঝা মুশকিল হয়ে পড়েছে। আমাদের চিরায়ত সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নীতি-নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের মাধ্যমে পরিচালিত হলেও এখন কতটা অবশিষ্ট আছে, তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। না আমরা আমাদের চিরায়ত পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের মধ্য দিয়ে চলতে পারছি, না নতুন কোনো ধারায় চলতে পারছি। এখন অনেকে আমাদের প্রথাগত ধারা থেকে বের হয়ে যুগের সাথে তাল মেলানোর কথা বলে ভিনদেশী ধারার দিকে ছুটে চলেছে। আমাদের সরকারের মধ্যেও এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই। যেভাবে চলছে, চলুক-এমন একটা মনোভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, যেকোনো দেশ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা নির্ভর করে, সে দেশে আইনের শাসন এবং সুশাসন কতটা কার্যকর ও বলবৎ রয়েছে, তার ওপর। আমাদের দেশে এ দুটিরই চরম ঘাটতি রয়েছে। দেশের বিশিষ্টজনরা বরাবরই বলে আসছেন, দেশে বহুদিন ধরেই আইনের শাসন অনুপস্থিত। বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি প্রভাব বিস্তার করছে। তাদের যুক্তি, আইনের শাসন বজায় থাকলে সমাজে অস্বাভাবিক অপরাধ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে থাকত। আমাদের দেশে আইন আছে ঠিকই, তবে তার যথাযথ প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। উল্টো আইনের অপপ্রয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকে বলেন, আইন সবার জন্য সমান নয়। ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীদের জন্য একরকম, দুর্বল ও সাধারণ মানুষের জন্য আরেক রকম। আইন অন্ধ নয়, তার চোখ খুলে দিয়ে বেছে বেছে প্রয়োগ করা হয়। যদি আইনকে আইনের ধারায় চলতে দেয়া হতো এবং যে অপরাধী সে যত বড় হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনা যায়, তাহলে সমাজে একের পর এক অস্বাভাবিক ঘটনা রোধ করা সম্ভব হতো। নৃশংস, নিষ্ঠুর, মর্মবিদারী ঘটনা ঘটত না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, যে দেশে দিনে দুপুরে মানুষকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, ফাঁসির আসামী খালাস পাওয়া স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়, দুর্নীতিবাজরা বহাল তবিয়তে থাকে সে দেশে আইনের শাসন কখনোই সুদৃঢ় হতে পারে না। এর কুপ্রভাব সমাজের সর্বত্রই পড়ে। অর্থাৎ বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি যেখানে গেঁড়ে বসে, সেখানে খুন-খারাবি মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
চার.
আমাদের পরিবার ও সমাজ এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। করোনা এ সময়কে কঠিন করে দিয়েছে। মানুষের আয় কমে যাওয়া, চাকরিচ্যুত হওয়া, দরিদ্র হয়ে যাওয়া সাধারণ মানুষকে এক অসহনীয় পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের প্রায় ষাট ভাগ মানুষ দরিদ্র অবস্থায় রয়েছে। বিপুল সংখ্যক এ জনগোষ্ঠী স্বাভাবিকভাবেই হতাশায় ভুগছে। একজন মানুষ যখন কোনো রকমে খেয়েপরে জীবনযাপন করে, সে যদি হঠাৎ গরীব হয়ে যায়, তাখন তার পক্ষে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। দিশাহারা হয়ে পড়ে। কথায় বলে, অভাব যখন দরজায় এসে দাঁড়ায় ভালবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়। এ কথার অর্থ হচ্ছে, দারিদ্র্য এবং অভাব এমন এক জিনিস তার কবলে পড়লে মানুষের মনমানসিকতা সুষ্ঠু অবস্থায় থাকে না। সে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত, হতাশ ও মানসিক স্থিরতা হারিয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। অনেক সময় হতাশা হিংস্রতায় পরিণত হয়। হতাশা সহ্য করতে না পেরে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। মানুষের জীবনে দুঃখ-কষ্ট, জরা-ব্যাধি, হতাশা থাকবেই। এ অবস্থায় আমাদের ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে। পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারায় মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ, তোমরা ধৈর্য্য ও প্রার্থণার মাধ্যমে আমার সাহায্য কামনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথে রয়েছেন (২:১৫৩)।’ মানুষের উচিৎ আল্লাহর এ আহবান আঁকড়ে ধরে ধৈর্য্য ধারণ করা। পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা ধারণ করে এগিয়ে চলা। দুঃসময়ে নিজের সন্তানদের আগলে রেখে খারাপ দিকে ধাবিত হওয়া থেকে বিরত রাখা। সরকারের উচিৎ আমাদের চিরায়ত সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধকে ধারণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয় এবং অপরাধী যেই হোক, তার যথাযথ বিচার করা। তাহলে সমাজে একের পর এক যে বিভৎস, নৃশংস ও নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটছে তা নিয়ন্ত্রণে করা সম্ভব হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।