বাংলাদেশের জন্মকথা
মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এই
দৈনিক ইনকিলাব জাতীয় পত্রিকাসমূহের মধ্যে অনন্য একটি নাম, যা শুধু দেশ ও জনগণের কথা বলে। এদেশের ৯০ ভাগ মুসলমানের হৃদয়ের স্পন্দন দৈনিক ইনকিলাব। ইনকিলাব ইসলামি ও মুসলিম সভ্যতার কথা তুলে ধরে এবং বিজাতীয় আগ্রাসী সংস্কৃতির ছোবল থেকে মুক্ত থেকে জাতিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার পথ দেখায়। ইনকিলাবের কথা বললেই এর প্রতিষ্ঠাতা আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান আলেমেদ্বীন মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর কথা মনে পড়ে। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) ছিলেন এদেশের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, স্কুল, কলেজ, মাদরাসা শিক্ষক সমাজের ঐক্যের প্রতীক। শুধু ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতাই নন, তিনি ছিলেন মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের পেশাজীবী সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি। তাঁরই সুযোগ্য নেতৃত্বে বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন স্কেলসহ বেশ কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ দাবি আদায় হয়। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) শিক্ষক-কর্মচারী, আলেম-ওলামাদের ভাগ্য পরিবর্তনের সাথে সাথে ইসলামি তাহজিব তামাদ্দুন তথা ইসলামি সংস্কৃতি প্রসারের ও প্রচারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের মালিকানায় এই ধরনের একটি জাতীয় পত্রিকা প্রকাশ করা হবে। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের জাতীয় নির্বাহী কমিটির কয়েকটি সভায় এনিয়ে বিশদ আলোচনাও হয়। একটি জাতীয় পত্রিকা প্রকাশ ও এর ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য বিষয়াবলী বিশ্লেষণ করে সকলেই ঐক্যমত পোষণ করেন যে, জমিয়াতের মাধ্যমে এই ধরনের জাতীয় পত্রিকা প্রকাশ মোটেই সম্ভব হবে না। তবে এমন একটি পত্রিকা প্রকাশের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সকলেই। তাই মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) সাহেবকে সম্মিলিতভাবে অনুরোধ জানানো হয়, তাঁর দায়িত্বে ও মালিকানায় পত্রিকাটি প্রকাশের জন্য। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) ছিলেন একজন বিচক্ষণ ও দূরদর্শী ব্যক্তি, তিনি ছিলেন রাসূল (সা.) প্রেমিক ও আউলিয়া কিরামের উত্তরসূরী। সেই সুবাধেই তিনি জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ যারা দেশ বিখ্যাত আলেমেদ্বীন, তাঁদের নিয়ে পবিত্র হজ্বের সফরে পবিত্র মক্কা মোয়াজ্জামায় ও পবিত্র মসজিদে নববীতে বসে এই পত্রিকা প্রকাশের বিষয়ে সকলকে নিয়ে আলোচনা করেন এবং এ বিষয়ে আল্লাহপাকের সাহায্য কামনা করেন। হুজুরে পাক (সা.) এর দরবারে সুনজর প্রার্থনা করেন। বাগদাদের বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) এর দরবারে এ নিয়ে আলেম-ওলামা ও দরবারের দায়িত্বশীলগণের নিকট দোয়া কামনা করে আলেম-ওলামা ও দেশের প্রখ্যাত পীর-মাশায়েখের অনুমতি ও দোয়া নিয়ে তিনি পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সকলের সাথে আলোচনা করে পত্রিকাটির নাম ঠিক করা হয় ‘দৈনিক ইনকিলাব’। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) প্রাণের চেয়ে ভালবাসতেন জমিয়াতুল মোদার্রেছীনকে। তাঁর চিন্তার ফসল মসজিদের গাউছুল আজম কমপ্লেক্স ও বহু সাধনার ফসল দৈনিক ইনকিলাব। দেশে তখন হাতেগোনা কয়েকটি পত্রিকা ছিল। সে সকল পত্রিকায় আলেম-ওলামা ও পীর-মাশায়েখের সংবাদ ও ইসলামি সংস্কৃতির সংবাদ পাওয়া যেত না বললেই চলে। তাই দেশের পীর-মাশায়েখ, আলেম-ওলামা, তথা ইসলামপ্রিয় বিপুল জনগোষ্ঠির প্রতীক্ষার প্রহরের সমাপ্তি রেখা টেনে সকলের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে ১৯৮৬ সালের ৪ জুন বনানীর একটি ভাড়া করা বাড়ি থেকে দৈনিক ইনকিলাব প্রকাশনার সূচনা করেন। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) তাঁরই সুযোগ্য জ্যেষ্ঠপুত্র এ এম এম বাহাউদ্দীনকে এ পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত করেন। অল্প বয়সেই এ দায়িত্ব নিয়ে সল্প সময়েই তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক ও সম্পাদকের আসনে আসিন হয়ে সকলের অন্তরে স্থান করে নেন। যেহেতু দৈনিক ইনকিলাব শুধু দেশ ও জনগণের কথা বলে, আমি মনে করি, সেই কারণেই ইনকিলাবের উপর ঈর্ষান্বিত হয়ে অনেকেই এর বিরোধিতা শুরু করে। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় হঠাৎ ইনকিলাব পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হলে দেখেছি, এর প্রতিবাদে দেশের ইসলামপ্রিয় জনগণ, পীর-মাশায়েখ, আলেম-ওলামার আন্তরিকতা। ছারছীনা দরবারের মরহুম পীর আবু জাফর মো. ছালেহ (রহ.), ফুলতলীর পীর আল্লামা আব্দুল লতিফ (রহ.) সহ অসংখ্য দরবারের পীর সাহেব তাঁদের অনুসারীদের নিয়ে রাজপথে মিছিল করেছেন। হাজার হাজার আলেম-ওলামা আল্লাহর দরবারে প্রর্থনা করেছেন। বিভিন্ন মাদরাসায় দোয়া অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) ইনকিলাবকে একটি আন্তর্জাতিক মানের পত্রিকা হিসেবে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ২/১ আর. কে. মিশন রোড, যেখানে ইনকিলাবের অফিস রয়েছে সে জায়গাটি খরিদ করে দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা ইনকিলাব ভবন তৈরি করে ভাড়া বাড়ি থেকে নিজস্ব ভবনে উন্নত মানের ছাপাখানার মাধ্যমে দেশে-বিদেশে ইসলাম ও ইসলামি সংস্কৃতির কথা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তখন ইন্টারনেট ব্যবস্থা না থাকায় বহু দেশে, বিশেষ করে ইসলামি দুনিয়ায় ইনকিলাবের প্রচুর চাহিদা ছিল। এখনো সকল ধারার ও মতের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ যত্নকরে লালন করেন প্রিয় পত্রিকা ইনকিলাবকে।
১৯৩৭ সালে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের প্রতিষ্ঠা হলেও মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর দুরদর্শী নেতৃত্বে জমিয়াতুল মোদার্রেছীন পুনরুজ্জীবন লাভ করে। তাই বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের প্রত্যেক সদস্য মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)কে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর হাতে গড়া সংগঠনের কর্মীগণ মনে করেন, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন, দৈনিক ইনকিলাব ও মসজিদে গাউছুল আজম কমপ্লেক্স মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর বহু কষ্টের ফসল, সাধনার ধন। এখন এসবের নেতৃত্বে রয়েছেন তাঁরই সুযোগ্য সন্তান আলহাজ্ব এ এম এম বাহাউদ্দীন। আজ মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) আমাদের মাঝে নেই। রয়ে গেছ তাঁর স্বপ্নের দৈনিক ইনকিলাব, প্রাণপ্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন। তাই আজকে, ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে বলতে চাই, আমরা বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন ও দৈনিক ইনকিলাব একই পরিবারের সদস্য হিসেবে অতীতের ন্যায় ভবিষ্যতেও যদি এগিয়ে চলি তাহলে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ইনকিলাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই মঞ্জিলে অচিরেই পৌঁছতে সক্ষম হবো। আমাদের সঙ্গে রয়েছে দেশের পীর-মাশায়েখ, আলেম-ওলামা ও ইসলামপ্রিয় নিবেদিত প্রাণ জনতা। যার নেতৃত্বে রয়েছেন সকলের আস্থাভাজন দৈনিক ইনকিলাবের সনামধন্য ও সফল সম্পাদক আলহাজ্ব এ এম এম বাহাউদ্দীন। আল্লাহ আমাদের এই মহৎ বাসনাকে কবুল করুন। আমিন।
লেখক: মহাসচিব, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।