বাংলাদেশের জন্মকথা
মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এই
বুড়িগঙ্গা তীরের এক রহস্যনগরী। এই নগরীতে একসময় এক টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। আরেক সময় এক টাকা খরচ করে পাওয়া যেত ২৫৬টি কমলালেবু কিংবা ২০টি মোরগ। এই নগরীর এক শাসনকর্তা বুলবুলি, কুকুর ও বিড়ালের বিয়ে দিতে এবং ইউরোপীয় নারীদের ঢঙে পোশাক পরতে পছন্দ করতেন। আরেক শাসনকর্তা হাতির পিঠে চড়ে শিকারে যেতেন। এই নগরীতে ঘন জঙ্গল ছিল এবং সেখানে চিতাবাঘ থাকত। নগরীর তাঁতিরা ‘মসলিন’ নামে যে মিহি কাপড় তৈরি করত, দিল্লির মুগল সম্রাজ্ঞী নূরজাহান শখ করে তা ব্যবহার করতেন।
এই রহস্যনগরীর নাম ঢাকা। ১৬১০ সালে সুবেহ বাংলার রাজধানী হিসেবে মুগল সুবাহদার ইসলাম খাঁ প্রতিষ্ঠা করেন এই নগরী। ঢাকা এখন আমাদের প্রিয় শহর, স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী। বয়স চারশ বছর ছাড়িয়ে গেছে। সভ্যতার, রাষ্ট্রের আর রাষ্ট্রনায়কদের বিচিত্র উত্থান-পতনকে প্রত্যক্ষ করেছে এই নগরী। রহস্যের যেন শেষ নেই এই নগরীতে। না, শুধু রহস্যইবা বলি কেন-এই নগরীর আছে গৌরবগাথা, আছে নানা ঘটনা আর গল্প। অলিগলি, মহল্লা, এমনকি প্রতিটি ইট-পাথরের মধ্যেও লুকিয়ে আছে ইতিহাসের অনেক উপাদান।
ঢাকা নগরীর অতীত অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিশ্বের সেরা শহরগুলোর মধ্যে একটি ছিল ঢাকা। আর সেরা শহরের ক্রমানুসারে ঢাকার স্থান ছিল দ্বাদশতম। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ঢাকার বর্ণনা করতে গিয়ে জেমস টেলর লিখেছেন, ‘বর্ষাকালে বড় বড় মিনার ও অট্টালিকা শোভিত ঢাকা নগরীকে মনে হয় ভেনিস নগরীর মতো।’ ১৮৪০ সালে কর্নেল ডেভিসন ঢাকায় পা রেখে দেখলেন, ‘এক টাকা খরচ করলে পাওয়া যায় ২৫৬টি কমলা আর দুই টাকা খরচ করলে একটি বেহালা। দিনরাত ঢাকায় শোনা যায় বেহালার সুর।’ টাকায় ৮ মণ চাল পাওয়া যেত শায়েস্তা খাঁর আমলে। তাই তিনি ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার সময় নগরীতে প্রবেশের পশ্চিম দরজা বন্ধ করে দিয়ে লিপি উৎকীর্ণ করে লিখে যান যে, ঢাকায় কোনো শাসক চালের দাম তাঁর আমলের সমান নামিয়ে আনতে না পারলে যেন ওই দরজা না খোলেন। সরফরাজ খাঁর আমলে ঢাকায় চালের দাম সস্তা হয়ে টাকায় ৮ মণ চাল হলে ওই দরজা খোলা হয়। ১৬৬৬ সালে পর্যটক ট্যাভারনিয়া যখন ঢাকা পরিদর্শন করেন তখন মসলিন, সিল্ক, সুতিবস্ত্র ও ফুল-ফলের কাজ করা বস্ত্র ইতালিসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশে যেত। ভুটান, আসাম, শ্যামদেশে রফতানি হতো প্রবাল, স্ফটিক ও শঙ্খ। নেপালে যেত নানা বস্ত্র এবং ভোঁদর চর্ম ও শাঁখের চুড়ি। করমন্ডল উপকূলে রফতানি হতো চাল। এছাড়া মসলা, হাতির দাঁত, চিনি, রন্ধনদ্রব্য, নানারকম সুগন্ধি ও সাবান বিদেশে রফতানি হতো। এক টাকায় তখন কুড়িটিরও বেশি মোরগ কিংবা হাঁস পাওয়া যেত।
যার লোভে সাত সাগর তেরো নদী পেরিয়ে বিদেশি বণিকরা ঢাকায় আসত, সে হলো মসলিন। ১০ গজ দৈর্ঘ্য ও এক গজ প্রস্থের এক টুকরা মসলিন অনায়াসে একটি আংটির ভেতর দিয়ে বের করা যেত। আগেই বলেছি মুগল সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের খুব পছন্দের বস্ত্র ছিল মসলিন। সুবাহদার ইসলাম খাঁ মুগল বাদশাহ জাহাঙ্গীরের জন্য ঢাকার সোনারগাঁয়ের তৈরি মসলিন পাঠিয়েছিলেন।
কিংবদন্তি আর মজার কাহিনিতে ভরপুর এই ঢাকা নগরী। নৌ, পদাতিক বাহিনী, অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে সুবাদার ইসলাম খাঁর সৈন্যসংখ্যা ছিল ৫০ হাজার। ১৬১০ সালে তিনি এক লাখ লোক নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন। ইসলাম খাঁর বজরার নাম ছিল ‘চাঁদনী’। বুড়িগঙ্গায় নোঙ্গর করা এই চাঁদনীতেই থাকতেন তিনি। সেজন্য ‘চাঁদনীঘাট’ নাম হয়। নবাব শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৪ সালে ঢাকায় আসেন। পরের বছর ১৬৬৫ সালে বাদশাহ আওরঙ্গজেবকে তিনি বাংলার রাজস্ব থেকে ৫৫ লাখ টাকা পাঠিয়েছিলেন ১১০টি বলদের গাড়িতে করে। বাদশাহ আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র শাহজাদা মোহাম্মদ আজম বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হয়ে ঢাকায় আসেন ১৬৭৮ সালে। তিনি শিকার করতে ভালোবাসতেন। চকবাজার থেকে ইসলামপুর পর্যন্ত ঢাকায় ইটের পাকা রাস্তা তাঁর নির্দেশেই প্রথম বানানো হয়। ঘোড়ায় চড়ে পতাকাবাহী সৈন্যদল নিয়ে তিনি ঢাকায় বেড়াতেন। কর্নেল ডেভিসন লিখেছেন, ‘ঢাকার দুই মাইল দূরে একটি গ্রাম। নাম তেজগাঁ। ঢাকা থেকে তেজগাঁ যেতে হলে ঘন এক জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যেতে হয়। এ জঙ্গল দেখতে সুন্দর, কিন্তু বিপদও আছে। এতে ওত পেতে থাকে বাঘ।’
নওয়াব সৈয়দ গাজীউদ্দিন খান বাহাদুর ফিরোজ জঙ্গ একসময় ছিলেন ঢাকার নায়েব নাজিম পরিবারের কর্তা। এমন কোনো নেশা নেই যাতে তাঁর আসক্তি ছিল না। রমণীদের প্রতি তার ছিল বিশেষ মোহ। এছাড়া ভালোবাসতেন ঘুড়ি ওড়াতে, মোষ এবং মোরগের লড়াই দেখতে, বুলবুলি, কুকুর ও বিড়ালের বিয়ে দিতে এবং ইউরোপীয় মহিলাদের ঢঙে পোশাক পরতে। ১৮৪০ সালে ঢাকায় চাকার প্রচলন হয়নি। তবে বিশপ হেবার লেখেন, ১৮২৩ সালে ঢাকায় একটি ঘোড়ার গাড়ি ছিল, যা ব্যবহার করতেন নায়েব নাজিম শামসউদ্দৌলা। কর্নেল ডেভিসন লেখেন, ‘রাতে ঢাকার রাস্তায় হাঁটার সময় যদি উঁকি দেন, দেখবেন একজন অক্লান্ত কারিগর বেহালা তৈরি করছেন, আরেকজন বেহালা বা সারেংগী বাজাচ্ছেন।’ ঢাকায় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সঙ্গীতজ্ঞ ও বাঈজীরা আসতেন। ১৮৫৭ সালের পর এ ধারা প্রবল হয়েছিল। আর্থার লয়েড ক্লে ১৮৬৬ সালে ঢাকায় আসেন জয়েন্ট কালেক্টর হয়ে। তার ছিল শিকারের শখ। শিকার করতে তিনি গিয়েছিলেন টঙ্গীতে হাতির পিঠে চড়ে। টঙ্গীর জঙ্গলে তখন থাকত চিতাবাঘ।
ঢাকার ইতিহাসের দিকে তাকালেও অনেক কাহিনি। কলকাতার অনেক আগে ঢাকার জন্ম। উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক হাসান দানীর মতে, ‘ঢাকা হাজার দেড়েক বছরের প্রাচীন তো হবেই।’ তবে নগরীর পত্তন ঘটে কখন, তার সঠিক দিন-তারিখ নেই। গুপ্ত, পাল, বর্মণ, সেনযুগীয় শাসন আমলে ঢাকার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল সাভার, বিক্রমপুর, সুবর্ণগ্রাম প্রভৃতি বিভিন্ন সময়ে উল্লেখযোগ্য প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল। সুলতানি শাসনামলেও (১৩৩৮-১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ) রাজধানী সোনারগাঁয়ের নিকটবর্তী স্থান হিসেবে ঢাকার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
ঢাকার আদি বাসিন্দা হিসেবে তাঁতি ও শাঁখারিদের উল্লেখ আছে। তৎকালীন ঢাকা শহরের পরিধি সঠিকভাবে নিরূপণ করা কঠিন। তবে তাঁত ও শাঁখা শিল্পকে কেন্দ্র করে ঢাকা একটি গঞ্জ বা বন্দর শহর ছিল। মুসলমানদের আগমনের ফলে সুলতানি আমলে শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। শহর ঢাকা বুড়িগঙ্গার উত্তরপাড়ে সদরঘাট থেকে দু’দিকে সমদূরত্বে চার মাইল বিস্তৃত ছিল। যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ছিল নদীপথ। সুলতানি আমলে ঢাকায় মুসলিম সংস্কৃতির আগমন ঘটেছিল সত্য; কিন্তু ইসলাম খাঁ কর্তৃক ঢাকাকে রাজধানী নগরী হিসেবে গ্রহণ করায় রাজকীয় দরবারি কৃষ্টি ঢাকার জনজীবনে প্রভাব বিস্তার করে। নগরায়ন, আবাসন, উদ্যান, স্থাপত্য, ব্যবসাবাণিজ্য, শিল্প ও চারুকলা, সঙ্গীত, পোশাক-পরিচ্ছদ, আদব-কায়দা, খাওয়া-দাওয়া, চাল-চলন প্রভৃতি ক্ষেত্রে মুগল প্রভাবের প্রতিফলন ঘটে। ঢাকার প্রাচীনতম ধর্মীয় ইমারত বিনত বিবির মসজিদ (১৪৫৭ সালে স্থাপিত) নারিন্দায় অবস্থিত। সুবাদার ইসলাম খাঁর ঢাকায় আগমনের ফলে সৈন্যবাহিনীসহ বহিরাগত লক্ষাধিক লোকের ঢাকায় অবস্থানে তখন কোনো অসুবিধা হয়নি। সুলতানি বাংলার পরিধি ওই সময় বেড়ে দ্বিগুণ হয়। ঢাকা শহর বুড়িগঙ্গার তীর ধরে পশ্চিম দিকে বিস্তৃতি লাভ করে। এই বিস্তৃতি শাহবাগ এবং আম্বরশাহের সেতু পর্যন্ত প্রসারিত হয়। লালবাগের কেল্লা, পরী বিবির মাজার, কেল্লামধ্যস্থ মসজিদ, খান মোহাম্মদ মৃধার মসজিদ, চকবাজার মসজিদ, কারতলব খান মসজিদ, হোসেনী দালান, বড় কাটরা, ছোট কাটরা, বিবি চম্পার মাজার, শায়েস্তা খাঁর মসজিদ, ইসলাম খাঁর মসজিদ, নারিন্দা ব্রিজ, পাগলার পুল, হাজী খাজা শাহবাজের মসজিদ ও মাজার, মুসা খানের মসজিদ, ধানমন্ডির ঈদগাহ, দারা বেগমের সমাধি, আল্লাহ্ ফুরী মসজিদ, বাগে শাহী প্রভৃতি মুগল যুগের স্মৃতি বহন করছে।
১৭১৭ সালে রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর হওয়ার ফলে ঢাকার মর্যাদার অবনতি ঘটে। ব্যবসাবাণিজ্য ও লোকসংখ্যা হ্রাস পায়। টেলরের বিবরণ থেকে জানা যায়, ১৮শ’ সালেও ঢাকার লোকসংখ্যা ছিল ২ লাখ। হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক ছিল চমৎকার। নৌকাই ছিল প্রধান যানবাহন। শহরের মুসলিম মহিলারা পর্দাপ্রথা মেনে চলত এবং বাইরে চলার জন্য ডুলি বা পালকি ব্যবহার করত। ঢাকায় ঈদ, মহররম, জন্মাষ্টমী ও অন্যান্য অনুষ্ঠান সাড়ম্বরে পালিত হতো। ব্রিটিশ শাসনামলে ঢাকার বিরাট পরিবর্তন হয়। ঢাকা পৌরসভা, ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড, সরকারি স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা আবদুল গণি, খাজা আহসানউল্লাহর দানে ঢাকায় পানি এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা হয়। তেমনি ১৮৪১ সালে ঢাকা কলেজ, ১৮৫৮ সালে মিটফোর্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা এবং ১৮৮৫ সালে জগন্নাথ কলেজ ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের মধ্যে রেল সংযোগ হয় ১৮৮৬ সালে, ময়মনসিংহ ঘাট পর্যন্ত যার বিস্তৃতি ঘটে। ১৮৬২ সাল থেকে গোয়ালন্দ এবং নারায়ণগঞ্জের মধ্যে স্টিমার সার্ভিস চালু হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকা পূর্ববঙ্গ ও আসামের রাজধানী হয়। নতুন নতুন ইমারত নির্মিত হয়। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে এর বিকাশ ব্যহত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ঢাকায় বিমানবন্দর এবং সামরিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়, এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানী হয়। আজিমপুর, ধানমন্ডি, তেজগাঁ, রমনা, শান্তিনগর, ইস্কাটনের দিকে শহর সম্প্রসারিত হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে ঢাকা সর্বপ্রথম স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজধানীতে পরিণত হয়। ঢাকার আয়তন এখন ৫৯০ বর্গমাইল বা ১৫২৮ বর্গকিলোমিটার। ঢাকায় গড়ে উঠেছে সারি সারি আকাশছোঁয়া অট্টালিকা। নগর ভবন, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর ভবন, নতুন বিমানবন্দর এবং আরও কত কি! শহর শুধু উত্তর দিকেই দ্রুত ছুটছে না, পূর্ব-পশ্চিমেও বিস্তৃতি ঘটছে। এই নগরী এখন ধারণ করছে প্রায় দেড় কোটি মানুষ।
ঢাকা রাজধানী হওয়ার গল্প
ঢাকার পুরনো ইতিহাস গৌরবময়। নতুন ইতিহাসও কম আকর্ষণীয় নয়। চারশ বছরের এই নগরী একেক সময় একেক রূপধারণ করে, চরিত্রও বদলায়। একক কোনো উপমায় এই নগরীকে বোঝানো সম্ভব নয়। ঢাকা প্রকৃতই রহস্যেভরা এক রহস্যনগরী। অন্য অর্থে আনপ্রেডিক্ট্যাবল বা অপ্রত্যাশিত চরিত্রের এক নগরী।
ঢাকা কয়েকবার রাজধানী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। অন্তত চারবার রাজধানী হয়েছে প্রকৃত অর্থেই। মুগল আমলে ১৬১০ সালের ১৬ জুলাই সম্রাট জাহাঙ্গীরের ফরমান অনুযায়ী সুবাহ বাংলার (সারা বাংলা) রাজধানী হয় ঢাকা। এরপর ১৯০৫ সালে ইংরেজরা যখন বাংলাকে দু’ভাগ করে তখন পূর্ববঙ্গ ও আসামের রাজধানী হয় ঢাকা। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী হয় ঢাকা। আর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হয় ঢাকা। বাংলাদেশের সংবিধানের ৫ (ক) অনুচ্ছেদ(১৬) অনুযায়ী বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। এছাড়াও মুগল ও বৃটিশ আমলে রাজধানী কয়েকবার স্থানান্তর হয়। সম্রাট আকবরের আমলে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার প্রাদেশিক রাজধানী ছিল বিহারের রাজমহল। সুবাহ বাংলায় তখন চলছিল মুগল বিরোধী বারো ভূঁইয়াদের রাজত্ব। মুগলরা বারো ভূঁইয়াদের নিয়ন্ত্রণ থেকে বাংলাকে উদ্ধার করতে চেষ্টা চালায়। এ লক্ষে সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে ১৬০৮ সালে ইসলাম খান চিশতিকে রাজমহলের সুবেহদার নিযুক্ত করা হয়। তিনি ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার ভৌগলিক অবস্থান বিবেচনা করে রাজধানী রাজমহল থেকে সরিয়ে ঢাকায় স্থানান্তর করেন। সুবেদর ইসলাম খাঁ এ সময় তার নিয়ন্ত্রনে এক শক্তিশালী নৌ বাহিনী গড়ে তুলেন। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে বারো ভূঁইয়াদের পতন ঘটে। বর্তমান চট্টগ্রামের কিছু অংশ বাদে পুরো সুবেহ বাংলা মুগল সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। টানা প্রায় ৪০ বছর ঢাকা সুবেহ বাংলার রাজধানী থাকার পর ১৬৫০ সালে সুবেদার শাহ সুজা রাজধানী আবার রাজমহলে স্থানান্তর করেন। তবে তার পতনের পর ১৬৬০ সালে সুবেদার মীর জুমলা পুনরায় রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করেন। এরপর বেশ কিছুকাল ঢাকা নির্বিঘ্নে রাজধানীর মর্যাদায় থাকে। ১৭১৭ সালে সুবেদার মুর্শিদ কুলি খাঁ রাজধানী ঢাকার পরিবর্তে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন। তখন ঢাকায় চলে নায়েব নাজিমদের শাসন যা ১৭৯৩ সালে বৃটিশ শাসন শুরুর আগ পর্যন্ত ছিল। বৃটিশরা রাজধানী হিসেবে কলকাতাকে পছন্দ করলে ঢাকা গুরুত্ব হারায়। ১৯০৫ সালে বঙ্গবঙ্গের পর ঢাকা আসাম ও বাংলার রাজধানী হয়। যদিও ভারতীয় কংগ্রেসের বাধার মুখে ‘ব্রিটিশ রাজ ১৯১১ সালে রাজধানী পুনরায় কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়েছিল।’
ঢাকা প্রথমে সমতট, পরে বঙ্গ ও গৌড় প্রভৃতি রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল। খৃস্টীয় ১৩শ শতাব্দীর শেষের দিকে মুসলমানদের দখলে আসে ঢাকা। আট ও নয়ের শতকে ঢাকা ছিল কামরূপের রাজাদের অধীনে। তারপর সেন ও পাল রাজাদের অধীনে। শেরশাহ যখন দিল্লীর সিংহাসন আরোহন করেন, তখন ঢাকায় নির্মাণ করেছিলেন একটি দুর্গ যা পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর। এর অবশ্য এখন চিহ্ন নেই। শেরশাহের পতন হলে ঢাকার ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন সোনারগাঁয়ের সুলতানরা। মুগল সুবাহদার ইসলাম খাঁ ঢাকায় আসার সময় ঈশাখাঁর পুত্র মূসাখানের সঙ্গে তার প্রবল যুদ্ধ হয়। মূসা খাঁ পরাজিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদুল্লাহ হলের কাছে মূসা খাঁর অনাড়ম্বর কবর রয়েছে।
খ্রিস্টীয় ৭ম শতক থেকে ঢাকায় লোক বসবাস শুরু করে। ঢাকার সন্নিকটে বিক্রমপুরে সেনদের রাজধানী ছিল। সেন পরবর্তী যুগে ঢাকা তুর্কি ও আফগান শাসনাধীন হয়। এ সময় ঢাকা দিল্লী সালতানাত নির্ধারিত শাসকদের দ্বারা শাসিত হয়। সুলতানি আমলে ঢাকা ছিল একটি নগর কেন্দ্র। তবে ১৬০৮ সালে ঢাকায় প্রথম মুগলদের পা পড়ে। মুগল আমলে প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা পাওয়ার পর এর প্রসিদ্ধি লাভ করে। প্রাদেশিক রাজধানী হওয়ার পর প্রায় ১০০ বছর ঢাকার এ মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকে। ১৬১০ সালে সুবাহদার ইসলাম খাঁন ঢাকা এসে মুগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামে ঢাকাকে জাহাঙ্গীরনগর নামে নামকরণ করেন। দিল্লির সম্রাটের প্রতিনিধি হিসেবে ১৭জন গভর্নর বা সুবাহদার বাংলা শাসন করেন। সুবাহদাররা আবার নবাব হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। আলোচিত কয়েকজন সুবাহদার হলেন ইসলাম খান চিশতি (১৬১০Ñ১৬১৩), শাহ সুজা (১৬৩৯-১৬৬০), মীর জুমলা (১৬৬০-১৬৬৩), শায়েস্তা খাঁ (১৬৬৩-৬৮), আজিম উশশান (১৬৯৮-১৭১২। ইসলাম খাঁর পর উল্লেখযোগ্য সুবেহদার ছিলেন ইব্রাহিম খাঁ ফতে জং। তিনি ছিলেন সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের ভাই। শান্তিপ্রিয় নবাব হিসেবে তিনি পরিচিত। শাসনকাজের চেয়েও পড়াশোনা করতে বেশি ভালোবাসতেন। মুগল শাসনামলে ১৬২৬ সালে ঢাকা একবার মগ দস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। ৭০টি জাহাজে করে এসে তারা এ আক্রমণ করে। বিশ্বব্যাপী মসলিন বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল এটি। ঢাকাতে সেরা মসলিন কাপড় তৈরি হতো। এ শহরে ছিল প্রশাসনিক সদর দফতর, সুবেদার ও অন্যান্য রাজ কর্মচারীদের বাসস্থান। জাহাঙ্গীরনগর নাম হলেও পর্যটক, ক‚টনীতিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের চিঠিপত্রে একে ঢাকা বলেই উল্লেখ করা হয়।
মুগল পরবর্তী যুগে ঢাকা প্রায় ১৯০ বছর ব্রিটিশ শাসনাধীন থাকে। এ সময়েই আধুনিক ঢাকা শহরের বিকাশ ঘটে। এই সময় ব্রিটিশ অনুগত নবাবগন ঢাকা শাসন করতেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ইংরেজরা চলে গেলে ঢাকা পূর্ব বঙ্গের রাজধানী হিসেবে পাকিস্তানের অন্তর্গত হয়। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ ঢাকাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়। ঢাকা পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনিক রাজধানী হয়। ১৯৫০-৬০ সালের মধ্যে এই শহর বিভিন্ন সামাজিক, জাতীয়তাবাদী ও গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় এবং ঢাকা হয় এর রাজধানী।
লেখক: সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেসক্লাব
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।