Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আয়বৈষম্য নিরসনই বড় চ্যালেঞ্জ

ড. মইনুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০২১, ১২:১৩ এএম

১৯৭২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা (১৯৭৩ সালে সেক্রেটারি অব স্টেট) ড. হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি ‘তলাবিহীন আন্তর্জাতিক ভিক্ষার ঝুলি’ হতে যাচ্ছে। অথচ, ১৯৭৫ সাল থেকে স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটেগরিতে থাকা বাংলাদেশকে ১৬ মার্চ ২০১৮ তারিখে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল জানিয়ে দিয়েছে যে, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটেগরি থেকে উন্নয়নশীল দেশের ক্যাটেগরিতে উত্তরণের শর্তগুলো পূরণ করেছে এবং ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশ ঘোষণা করবে। (অবশ্য করোনা ভাইরাস মহামারির বিপর্যয়ের ফলে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের প্রাপ্য সুবিধাগুলো ২০২৬ সাল পর্যন্ত চালু রাখার আহবান জানিয়েছে)। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল গুতেরেজ ঘোষণা করেছেন, বাংলাদেশ এখন বিশে^ উন্নয়নের ‘রোল মডেল’।

জাতিসংঘ স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশের ক্যাটেগরির প্রচলন করেছিল ১৯৭১ সালে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার বহু সাধ্য-সাধনা করে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটেগরিতে অন্তর্ভুক্ত করাতে সক্ষম হয়েছিল স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্যে প্রযোজ্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা লাভের প্রত্যাশায়। যদিও সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার কোনো দেশকে সাধারণত এই ক্যাটেগরিতে অন্তর্ভুক্ত করার নিয়ম ছিল না। (অবশ্য, বিশ্বের ‘মিসকিনদের ক্লাব’ হিসেবে পরিচিত এই ক্যাটেগরিতে অন্তর্ভুক্ত হতে অনেক দেশ রাজি হয়নি। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় থাকা সত্তে¡ও- ঘানা, ভিয়েতনাম এবং জিম্বাবুয়ের নাম এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য)।

এই ক্যাটেগরিতে অন্তর্ভুক্তির পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত আশা ছিল, এক দশকের মধ্যেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের পরিচয় ঝেড়ে ফেলে উন্নয়নশীল দেশের ক্যাটেগরিতে উত্তরণে সক্ষম হবে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবার নিহত হওয়ার পর রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখলকারী সরকারগুলো স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে নানান ধরনের খয়রাতি সাহায্য, বৈদেশিক অনুদান এবং স্বল্প-সুদের ঋণ (তথাকথিত সফ্ট লোন) পাওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য দেশের বাজারে বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা পাওয়াতে দেশের এই অবমাননাকর পরিচয়টিকে অগ্রহণযোগ্য বিবেচনা করেনি। একই কারণে ১৯৯১ সালের পরও ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারগুলোর কাছে স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটেগরি থেকে উত্তরণকে হয়তো আর তেমন আকর্ষণীয় বিষয় মনে হয়নি!

অবশ্য, ড. কিসিঞ্জারকে তাঁর ঐ হতাশাজনক ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য দোষ দেওয়া যাবে না। কারণ, স্বাধীন দেশ হিসেবে যাত্রা শুরুর পর্যায়ে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য বছরে যে দেড় কোটি টন খাদ্যশস্যের প্রয়োজন হতো, তার মাত্র এক কোটি দশ লাখ টন উৎপাদন করার সামর্থ্য ছিল আমাদের। বাকি ৪০ লাখ টন খাদ্যশস্য বিশ্বের কাছে ভিক্ষা চাইতে হতো। কারণ, ঐ ঘাটতি খাদ্যশস্য আমদানির সামর্থ্য ছিল না আমাদের। ১৯৭২ সালে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল প্রায় শূন্যের কোটায়। আমাদের প্রধান রফতানি পণ্য পাট ও পাটজাত দ্রব্যের আন্তর্জাতিক বাজার সংকুচিত হয়ে যাচ্ছিল। ফলে, দেশের যৎসামান্য রফতানি আয় দিয়ে ঐ সময় আমদানি ব্যয়ের ৩০ শতাংশও মেটানো যেতো না। এরপর মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যখন ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক তেল সংকট শুরু হলো, তখন দেশের অর্থনীতি বেসামাল হয়ে গেলো।

বঙ্গবন্ধুর সরকার যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ এবং দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর পছন্দসই সরকার ছিল না, তাই ঐ মহাসংকটের সময় বাংলাদেশ যথেষ্ট পরিমাণ সাহায্য-সহায়তা পায়নি। আরো দুর্ভাগ্যজনক হলো, ১৯৭৩ সাল থেকে দেশে ক্রমবর্ধমানহারে দুর্নীতি ও পুঁজিলুণ্ঠন শুরু হয়ে গেলেও বঙ্গবন্ধু তাঁর দলের দুর্নীতিবাজ নেতা-কর্মী, শ্রমিক নেতা, রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের প্রতিষ্ঠান ও কল-কারখানাগুলোর প্রশাসক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুই আফসোস করেছিলেন, ‘আমি সারা দুনিয়া থেকে বাংলার দুঃখী মানুষের জন্য ভিক্ষা করে আনি, আর তা সাবাড় করে দেয় চাটার দল’। ১৯৭৪ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, যাতে প্রায় এক লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন বলে ধারণা করা হয়। (কিউবায় বাংলাদেশের চটের বস্তা রফতানির অজুহাতে ১৯৭৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য খাদ্যশস্যবাহী পাঁচটি জাহাজকে আটকে দিয়ে দুর্ভিক্ষকে ত্বরান্বিত করেছিল)।

জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বাংলাদেশে বৈদেশিক অনুদান এবং সফ্ট লোনের বান ডেকেছিল। প্রফেসর রেহমান সোবহানের বিশ্বখ্যাত বই The Crisis of External Dependence এর নবম পৃষ্ঠার সারণীতে দাবি করা হয়েছে যে, জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বৈদেশিক অনুদান ও ঋণপ্রবাহ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে পেতে ১৯৮১-৮২ অর্থ-বছরে জিডিপি’র অনুপাত হিসেবে ১৩.৭ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল, যেটা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বৈদেশিক সহায়তা-নির্ভরতার নজির হয়ে গেছে। জিয়াউর রহমান গর্বভরে বলতেন, ‘Money is no problem’। বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানও বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান সংগ্রহে তাঁর সাফল্যকে খুবই গর্বভরে উল্লেখ করতেন।

জিয়াউর রহমানের কেনাবেচার রাজনীতির স্বার্থেই বৈদেশিক সাহায্য লুণ্ঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয়েছিল তাঁকে। (যদিও তিনি নিজে দুর্নীতি করতেন না বলে ধারণা রয়েছে!) মার্কাস ফ্রান্ডা তাঁর বইয়ে প্রমাণ দিয়েছেন যে জিয়া একাধিকবার বলেছেন, ‘এদেশে রাজনীতিবিদ এবং আমলাদের দুর্নীতিকে তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের বাস্তবতার মতো স্বাভাবিক বলেই মেনে নিতে হবে’। অতএব, জিয়াউর রহমানের আশ্কারার ফলে তাঁর আমলে বৈদেশিক সাহায্য লুটপাট ব্যাপক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছিল। স্বৈরাচারী এরশাদের শাসনামল থেকে বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থাকে ‘চৌর্যতন্ত্র’ (kleptocracy) আখ্যায়িত করা হচ্ছিল, যা শক্তিশালী হতে হতে ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত পাঁচবার বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে শ্ব্বেচ্যাম্পিয়নশিপ’ অর্জন করেছিল। গত দেড় দশকে অবস্থার কিঞ্চিত উন্নতি হলেও বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে এখনো সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচার।

সত্তর ও আশির দশকের ঐ বিশ্ব-ভিক্ষুকের দীনহীন অবস্থা থেকে গত তিন দশকে বাংলাদেশের যে চমকপ্রদ অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা তাতে প্রধান ভূমিকা পালন করে চলেছে কৃষিখাত, রফতানি খাত, প্রবাসীদের রেমিট্যান্স, ক্ষুদ্রঋণ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাত। বাংলাদেশের অর্থনীতির এই অগ্রযাত্রা বিশে^র সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তালিকাটি দেখুন:

১। ২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করে ধান-উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হয়েছে। (অবশ্য ২০১৭ সালের অকাল বন্যার ফলে দেশে খাদ্য ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছিল)। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ধান উৎপাদন ছিল মাত্র এক কোটি দশ লাখ টন (তখন দেশে গম এবং ভুট্টা উৎপাদন ছিল নগণ্য)। ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে বাংলাদেশের খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছিল চার কোটি তের লাখ টনে, যার মধ্যে তিন কোটি বাষট্টি লাখ টন ধান, আটত্রিশ লাখ টন ভুট্টা এবং তের লাখ টন গম। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয় স্থান দখল করেছে। শাক-সবজি, মুরগী এবং ডিম উৎপাদনেও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। সার্বিকভাবে দেশে একটি কৃষি বিপ্লব চলমান রয়েছে।

২। বাংলাদেশের রফতানি আয় ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে ৪০০৩ কোটি ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল, অথচ ১৯৮১-৮২ সালে তা ছিল মাত্র ৭৫.২ কোটি ডলার। (করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে রফতানি আয় ৩৪৫০ কোটি ডলারে নেমে গেছে)। রফতানি আয়ের প্রায় ৮৩ শতাংশই আসছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে আবারো সঞ্জীবিত হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। চামড়াজাত পণ্য, ঔষধ, সিরামিক পণ্য, জাহাজ নির্মাণ ও কৃষি-ভিত্তিক খাদ্যপণ্য রফতানি বাজারে ভালই সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।

৩। বাংলাদেশের এক কোটি ত্রিশ লাখেরও বেশি মানুষ বিদেশে কাজ করছেন। তাঁরা প্রতি বছর ফর্মাল চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে ২০২০ সালে ২২০০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। করোনা ভাইরাস মহামারির পূর্বে হুন্ডি পদ্ধতি ও অন্যান্য ইনফর্মাল চ্যানেলে ৮ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিতে প্রবেশ করতো বলে ধারণা করা হয়। মহামারির কারণে এসব ইনফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণ অনেক হ্রাস পাওয়ায় ফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো সাম্প্রতিক সময়ে দ্রুত বেড়ে চলেছে। ফলে, এই বর্ধিত রেমিট্যান্স প্রবাহ অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করে চলেছে।

৪। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘খানা আয়-ব্যয় জরিপ’ মোতাবেক ২০১৬ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার অনুপাত ২৪.৩ শতাংশে নেমে এসেছিল। ২০১০ সালে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার অনুপাত ছিল ৩১.৫ শতাংশ, ২০০৫ সালে ছিল ৪০ শতাংশ, আর ২০০০ সালের জরিপে ঐ অনুপাত ছিল ৪৪ শতাংশ। ২০২০ সালের মার্চে এই অনুপাত ২০.৫ শতাংশে নেমে গিয়েছিল। (কিন্তু, করোনা ভাইরাস মহামারির আঘাতে গত পনেরো মাসে দারিদ্র্য আবার বাড়ছে বলে অনুমান করা হচ্ছে)।

৫। ১৯৮১-৮২ অর্থ-বছরে বাংলাদেশের জিডিপি’র অনুপাত হিসেবে বৈদেশিক সাহায্য ১৩.৭ শতাংশ পৌঁছে গিয়েছিল। গত ৩৯ বছরে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর এদেশের অর্থনীতির নির্ভরতা কমতে কমতে এখন জিডিপি’র দুই শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, এখনকার বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের মাত্র ১ শতাংশ খাদ্য সাহায্য, আর বাকি ৯৯ শতাংশই প্রকল্প ঋণ। বিংশ শতাব্দীর সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশের বৈদেশিক সাহায্যের ২৯.৪ শতাংশ ছিল খাদ্য সাহায্য, ৪০.৮ শতাংশ ছিল পণ্য সাহায্য, আর ২৯.৮ শতাংশ থাকত প্রকল্প সাহায্য (রেহমান সোবহান, প্রাগুক্ত, ১৯৮২, পৃ: ৬২ দ্রষ্টব্য)। ঐ সত্তর ও আশির দশকগুলোতে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটগুলোর প্রায় শতভাগ বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের ওপর নিভরশীল ছিল, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উন্নয়ন বাজেটের বৈদেশিক ঋণ/অনুদান-নির্ভরতা এক-চতুর্থাংশেরও নিচে নেমে গেছে।

৬। গত পনেরো অর্থ-বছরের দুই বছর বাদে প্রতি বছর বাংলাদেশ তার লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত অর্জন করে চলেছে। বাণিজ্য ভারসাম্যে ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও প্রবাসী বাংলাদেশিদের বৈধ পথে প্রেরিত রেমিট্যান্সের চমকপ্রদ প্রবৃদ্ধির হার এবং বাংলাদেশের রফতানি আয়ের চমকপ্রদ প্রবৃদ্ধি দেশের লেনদেন ভারসাম্যের এই স্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি করেছে। গত দু’দশক ধরে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে, এবং ২০২১ সালের মে মাসে রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে, যা ভারতের পর দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

৭। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে ৮.২ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে ২০১৯-২০ অর্থ-বছরে প্রবৃদ্ধির হার ৫.২৪ শতাংশে নেমে গেলেও তা বিশে^ প্রশংসনীয় বিবেচিত হয়েছে। কারণ মহামারির কারণে বিশে^র প্রায় সব দেশে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়ে গেছে।

৮। ক্ষুদ্র ঋণ আন্দোলনের সাফল্য গ্রামের ভূমিহীন নারীদের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে দেওয়ার একটা অত্যন্ত কার্যকর হাতিয়ার বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর এক চতুর্থাংশের বেশি ঋণগ্রহীতা তাঁদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সাফল্য অর্জন করেছেন। অবশ্য, ক্ষুদ্রতর সংখ্যক ঋণগ্রহীতা সাফল্যের সাথে দারিদ্র্য থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে পেরেছেন। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠিগুলোর কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে দেওয়ার এই সফল উদ্ভাবনটিকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক দিক উন্মোচনের কৃতিত্ব দিতেই হবে।

৯। দেশের দ্রুত বিকাশমান পোশাক শিল্পে ৩৫ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, আর এই শ্রমিকদের ৬০ শতাংশেরও বেশি নারী। সমাজের দরিদ্র ও প্রান্তিক অবস্থানের এসব নারীর প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পখাতে কাজের ব্যবস্থা করাটা তাঁদের বঞ্চনা ও চরম দারিদ্রের বিরুদ্ধে একটি তাৎপর্যপূর্ণ নিরোধক হিসেবে ভূমিকা রাখছে। একথা বলতেই হবে, তৈরি পোশাক শিল্পখাত বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের একটি অত্যন্ত ইতিবাচক প্রতিষ্ঠান হিসেবে উদ্ভূত হয়েছে।

১০। বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষ এখন মোবাইল টেলিফোনের আওতায় এসে গেছে এবং সাত কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে।

অবশ্য, আমি প্রধান প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোতেও আলোকপাত করতে চাই: ১) রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি এখনো দেশের এক নম্বর সমস্যা রয়ে গেছে। সর্বশক্তি দিয়ে শক্তহাতে দুর্নীতিকে মোকাবেলা করতেই হবে; ২) প্রাথমিক জ্বালানি ও ভৌত অবকাঠামোগত সমস্যাগুলো এখনো অনেক ক্ষেত্রে জটিল রয়ে গেছে; ৩) ২০১৮ সালের নির্বাচনে জালিয়াতি গণতন্ত্রকে লাইনচ্যুত করেছে; ৪) শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে বৈষম্যকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মোকাবেলা করতে হবে; ৫) খেলাপিঋণ সমস্যা, পুঁজি পাচার এবং আর্থিক কেলেংকারিগুলোকে শক্ত হাতে দমন করতে হবে; এবং ৬) ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য নিরসন করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রকে অবশ্যই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে আয় পুনর্বণ্টন ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে।

আমার মতে, উল্লিখিত চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য নিরসন বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারের প্রধান অগ্রাধিকারের দাবিদার। সর্বশেষ প্রাক্কলন মোতাবেক ২০২১ সালের জুনে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি ২২২৭ ডলারে পৌঁছে যাবে। কিন্তু, মাথাপিছু জিডিপি যেহেতু একটি গড় সূচক, তাই মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে যদি দেশে আয়বৈষম্যও বাড়তে থাকে তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠির কাছে পুঞ্জীভূত হওয়ার প্রবণতা ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকে। এর ফলে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। আয়বৈষম্য পরিমাপক জিনি সহগ বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে ছিল ০.৩৬, যেখান থেকে মারাত্মকভাবে বেড়ে ২০১৬ সালে তা ০.৪৮৩ এ পৌঁছে গেছে। যে সব দেশে জিনি সহগ ০.৫ এর বেশি ওগুলোকে উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ অভিহিত করা হয়। এর মানে, বাংলাদেশ এখন ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের’ দেশে পরিণত হওয়ার কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে।

এই আয়বৈষম্য-বৃদ্ধিকারী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফল নাটকীয়ভাবে ধরা পড়েছে বিশ্বে ধনকুবেরের সংখ্যার প্রবৃদ্ধির হারে বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জনের খবরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’-এর প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড আল্ট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৮ মোতাবেক ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ এই পাঁচ বছরে ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির দিক দিয়ে বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলে সারা বিশ্বে এক নম্বর স্থানটি দখল করেছে বাংলাদেশ। ঐ পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছে বার্ষিক ১৭.৩ শতাংশ হারে।

সাধারণ জনগণের কাছে বোধগম্য যেসব বিষয় আয়বৈষম্য বৃদ্ধির বিপদটার জানান দিচ্ছে সেগুলো হলো: ১) দেশে প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে ১১ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেখানে মাতাপিতার বিত্তের নিক্তিতে সন্তানের স্কুলের এবং শিক্ষার মানে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে; ২) দেশে চার ধরনের মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে; ৩) ব্যাংকের ঋণ সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশের কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে এবং ঋণখেলাপি বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে; ৪) দেশের জায়গা-জমি, অ্যাপার্টমেন্ট, প্লট, ফ্ল্যাট, মানে রিয়াল অ্যাস্টেটের দাম প্রচন্ডভাবে বেড়েছে; ৫) বিদেশে পুঁজি পাচার মারাত্মকভাবে বাড়ছে; ৬) ঢাকা নগরীতে জনসংখ্যা দুই কোটিতে পৌঁছে গেছে, যেখানে আবার ৪০ শতাংশ বা ৮০ লাখ মানুষ বস্তিবাসী; ৭) দেশে গাড়ি, বিশেষত বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে; ৯) বিদেশে বাড়িঘর, ব্যবসাপাতি কেনার হিড়িক পড়েছে; ১০) ধনাঢ্য পরিবারগুলোর বিদেশ ভ্রমণ বাড়ছে; ১১) উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রবাহ বাড়ছে; ১২) উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য ঘনঘন বিদেশে যাওয়ার খাসলত বাড়ছে; ১৩) প্রাইভেট হাসপাতাল ও বিলাসবহুল ক্লিনিক দ্রুত বাড়ছে; ১৪) প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার হিড়িক পড়েছে; ১৫) দেশে ইংলিশ মিডিয়াম কিন্ডারগার্টেন, ক্যাডেট স্কুল, পাবলিক স্কুল এবং ও লেভেল/এ লেভেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার মোচ্ছব চলছে; ১৬) প্রধানত প্রাইভেট কারের কারণে সৃষ্ট ঢাকা ও চট্টগ্রামের ট্রাফিক জ্যাম নাগরিক জীবনকে বিপর্যস্ত করছে; ১৭) দেশে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি বেড়ে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে পদে পদে, দুর্নীতিলব্ধ অর্থের সিংহভাগ আবার বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে; এবং ১৮) চলমান করোনা মহামারি মোকাবেলায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চরম অপর্যাপ্ততা প্রমাণিত হয়ে গেছে। উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার সহকারে প্রতিরোধে সর্বশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে আয়বৈষম্য নিরসনে ব্রতী হতেই হবে।
লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি, বিশিষ্ট কলামিস্ট ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আয়বৈষম্য
আরও পড়ুন