Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দেশ-পরিচয়ের গর্বিত পতাকা

চট্টগ্রাম মহাবন্দর

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ৫ জুন, ২০২১, ১২:০৩ এএম

দুই হাজার বছরের প্রাচীন চট্টগ্রাম মহাবন্দর ‘সম্পদ’ হিসাবে গণ্য। নিরাপদ পোতাশ্রয়। একে ঘিরেই শিপিং সেক্টর গতিশীল। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে লুসাই পাহাড়। গিরিকন্যা খরস্রোতা কর্ণফুলী নদী। এর মোহনায় বন্দর চট্টগ্রাম। উদার প্রকৃতির অপার দান। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে ভূ-প্রাকৃতিক কৌশলগত সুবিধাজনক অবস্থান এর। সাগরপ্রান্তে নেই বলেই বন্দর সুবিধাবিহীন দেশগুলো ভাগ্যবঞ্চিত। প্রতিবেশী নেপাল, ভুটানসহ পৃথিবীর ভূমি বেষ্টিত (Land Locked) দেশগুলোর দিকে তাকালে তাদের বঞ্চনা দেখা যায়। চট্টগ্রাম বন্দরের থিম স্লোগান- ‘সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার- চট্টগ্রাম বন্দর’। ÔCountry Moves With Us’।
দেশের সমগ্র আমদানি-রফতানির ৯২ শতাংশই সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। কন্টেইনার শিপিং বাণিজ্যের ৯৮ ভাগ। বন্দরভিত্তিক দেশের একক বৃহৎ রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস তথা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) খাত এবং অন্যান্য খাত-উপখাতে রাষ্ট্রের তহবিলে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ বার্ষিক অন্তত এক লাখ কোটি টাকা কর ও রাজস্ব জোগান আসছে প্রধান এই বন্দরের সুবাদে। আমদানি-রফতানি, দেশীয় ও বৈদেশিক ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পায়ন, শিল্প প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা পরিচালনা, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানের চাবিকাঠি এ বন্দর। বাংলাদেশের ‘গেইটওয়ে’, অর্থনীতির ‘লাইফ লাইন’ অথবা ‘হৃৎপিন্ড’ এই বন্দরের সার্থক উপমা-অভিধা। চট্টগ্রাম বন্দরের হালচাল বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছে। গতিময়তার অন্যতম প্রধান সূচক এই বন্দর।
সুখকর দিক হলো, লন্ডনভিত্তিক পোর্ট-শিপিং বিষয়ক প্রাচীন জার্নাল ‘দ্য লয়েড’স লিস্ট’ বিগত ৩০ আগস্ট-২০২০ সর্বশেষ যে মূল্যায়ন-জরিপ প্রকাশ করেছে, তাতে পৃথিবীর একশ’টি সর্বাপেক্ষা কর্মব্যস্ত কন্টেইনার পোর্টের কার্যক্রম বিবেচনায় চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ৫৮। এক দশকে ৩০ ধাপ (২০১০ সালে ছিল ৮৮তম) এবং এর মধ্যে এক বছরে ছয়টি ধাপ অতিক্রম করেছে বৈশ্বিক সূচকে। তাছাড়া নৌ-দস্যুতার হুমকিমুক্ত, শ্রম অসন্তোষ মুক্ত এবং দক্ষতা, গতি, সক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনায় উন্নতির সূচকে চট্টগ্রাম বন্দর দেশের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করছে। গেল ২০২০ সালে চট্টগ্রাম পোর্ট লিমিট কুতুবদিয়া অবধি বিস্তার লাভ করেছে। প্রায় ৭০ কিলোমিটার নৌসীমা-উপকূল-সমুদ্রজুড়ে বন্দর কার্যক্রমের বিশাল ব্যাপ্তি।
দিন-রাত তিন শিফটে সার্বক্ষণিক (২৪/৭) বন্দর কর্মচঞ্চল। করোনা মহামারীকালেও বাতিঘরের মতো জেগে আছে তার দ্যুতি ছড়িয়ে। বন্দর-শিপিং কর্মপ্রবাহের সাথে যুক্ত অর্থাৎ বন্দর ব্যবহারকারী স্টেকহোল্ডার সরকারি-বেসরকারি বিভাগ, সংস্থা, সমিতি, প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দুই ডজনেরও বেশি। নিরবচ্ছিন্ন মুনাফা অর্জনকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এটি। চট্টগ্রাম বন্দরের অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তায় তৃতীয় বন্দর পায়রা গড়ে উঠেছে। তাছাড়া মাতারবাড়ীতে নির্মাণাধীন বহুমুখী সুবিধাসম্পন্ন গভীর সমুদ্রবন্দর মেগাপ্রকল্প তদারক ও অর্থায়নে গৌরবময় অংশীদার।
আছে সমস্যা-সঙ্কট
অস্বীকার করা যায় না, বিভিন্ন ধরনের সমস্যা-সঙ্কট, সীমাবদ্ধতা, বাধা-প্রতিবন্ধকতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা চট্টগ্রাম বন্দরের গতিশীলতা, দক্ষতা-সক্ষমতা, স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতাকে কমবেশি ব্যাহত করছে। ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত¡াবধায়ক সরকারের আমলে চট্টগ্রাম বন্দর-শিপিং-কাস্টমসে শুদ্ধি অভিযানের পাশাপাশি যুগান্তকারী সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়, যা গত এক যুগের বেশি সময়েও বাস্তবায়িত হয়নি। এর অন্যতম উপেক্ষিত দিক হচ্ছে বন্দর-কাস্টমসের সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন। ডিজিটালাইজড বা অটোমেটেড প্রধান সমুদ্রবন্দরের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে।
তাছাড়া ক্রমবর্ধমান চাপ ও চাহিদা সামাল দিতে নতুন নতুন জেটি-বার্থ, ইয়ার্ড-শেড, টার্মিনালসহ অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ অপ্রতুল। ভারী সরঞ্জামের বিশেষত কন্টেইনার হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্টসের ঘাটতি রয়েছে। বন্দর ব্যবহারকারীদের সঙ্গে সমন্বয় দুর্বল। নাব্য রক্ষায় নিয়মিত ও মানসম্মত ড্রেজিং হচ্ছে না। একদা বন্দরে পৃথক ড্রেজিং শাখা থাকলেও সেটি আগেই বিলোপ করা হয়েছে। বিশ্বায়নের উপযোগী ও প্রতিযোগী করতে চট্টগ্রাম বন্দরের সমন্বিত উন্নয়ন-আধুনিকায়নে জার্মানির হামবুর্গ পোর্ট কনসালটিং (এইচপিসি) ২০১৩ সালে একটি প্রেক্ষিত মহাপরিকল্পনা তৈরি করে। ত্রিশ বছর মেয়াদি ধাপে ধাপে বাস্তবায়নযোগ্য এই মহাপরিকল্পনায় প্রথম ধাপে ১৫ বছরে ৮৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির দিক গুরুত্ব পায়। ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে নিয়ে যেতে প্রধান বন্দরের উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে এমনটি আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। অথচ, এর বাস্তবায়ন অনিশ্চিত। তাছাড়া বন্দরের লাগোয়া হালিশহর-আনন্দবাজারে বহুল আলোচিত ‘বে-টার্মিনাল’ নির্মাণকাজ শুরু হতেই থমকে আছে।
বিতর্কিত ট্রানজিট-করিডোর
একদিকে বার্ষিক ২৮ থেকে ৩১ লাখ টিইইউএস কন্টেইনার এবং সাড়ে ১০ কোটি মেট্রিক টন পণ্যসামগ্রী, সাড়ে ৩ হাজার জাহাজ হ্যান্ডলিং করতে গিয়ে হিমশিম অবস্থা। অন্যদিকে ভারতের ইচ্ছা-অভিলাষ পূরণে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে কানেকটিভিটি কিংবা ট্রান্সশিপমেন্টের নামে ট্রানজিট এবং করিডোর সুবিধা দেয়া হয়েছে, যা বন্দর-জটসহ নানাবিধ ক্ষেত্রে সমস্যা-সঙ্কট তৈরি করবে এই শঙ্কা পোর্ট-শিপিং সার্কেলের এবং দেশের অর্থনীতিবিদদের। ইতোমধ্যে ট্রানজিটের ট্রায়াল রান সম্পন্ন হয়েছে প্রথম দফায়। বিগত ২১ জুলাই-২০২০ ‘এমভি সেঁজুতি’ জাহাজ কলকাতা বন্দর থেকে চার কন্টেইনার ভর্তি ট্রানজিট পণ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। এসব পণ্য সড়কপথে পরিবাহিত হয় ত্রিপুরা ও আসাম তথা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যকার চুক্তির বাস্তবায়নে পরীক্ষামূলক ট্রানজিট চালু হলেও বাংলাদেশের ন্যূনতম প্রাপ্য রাজস্ব, বন্দর-চার্জ, মাসুল, লেভি, ট্যাক্স ইত্যাদি ‘লাভে’র খাতায় মস্তবড় ফাঁক! এই অভিনব ট্রানজিটের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশের উপর দিয়ে ভারতে পরিবহন’। চুক্তিটিই বলছে ‘মুভমেন্ট অব গুডস টু অ্যান্ড ফ্রম ইন্ডিয়া’। তাছাড়া ট্রানজিট-করিডোরের সাথে নিরাপত্তার প্রশ্নও জড়িত। প্রতিবেশী ভূমিবেষ্টিত দেশ নেপাল ও ভুটান কেনইবা বঞ্চিত হবে?
বন্দর-শিপিং সার্কেল, ভূ-কৌশলগত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদদের অভিমত, সমুদ্রবন্দরে ভারতকে ট্রানজিট-করিডোর সুবিধা দিতে গিয়ে সরকার যা করেছে পৃথিবীতে আর কেউ তা করেনি। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুযোগ ভারত সেই ১৯৭২ সাল থেকেই দাবি করে আসছিল। শেষ পর্যন্ত ভারতের ইচ্ছেপূরণ হয়েছে। এরজন্য চট্টগ্রাম বন্দরের অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা কতটুকু রয়েছে সেই তর্কে না গিয়েও বাংলাদেশের নিজস্ব নিরাপত্তা সম্পর্কিত ঝুঁঁকি নিয়ে প্রশ্ন অসঙ্গত নয়। তাছাড়া বাংলাদেশের রেলওয়ে, সড়ক, সেতুর মতো গুটিকয়েক অবকাঠামোর উন্নয়নের জন্য ভারত যে ঋণ দিচ্ছে সেটাও কৈ-এর তেলে কৈ ভাঁজার শামিল।
বাংলাদেশকে ভারতীয় ঋণ সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হবে। তাছাড়া এই ঋণ ব্যবহার করেও যে ‘উন্নয়ন’ হবে সে অবকাঠামো ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে এ ফোঁড় ও ফোঁড় করবে করিডোর সুবিধার বিনিময়ে, এমনটা শঙ্কা অমূলক কী? ট্রানজিট-করিডোর একটি স্পর্শকাতর জাতীয় বিষয়। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত স্পর্শকাতর, অথচ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের দিকটি গভীর বিবেচনার দাবি রাখে। ট্রানজিটের বিষয়টি নিছক অর্থনৈতিক মানদন্ডে বিচার করা সম্ভব নয়। ভূ-কৌশলগত নিরাপত্তার দিকগুলো কোনো অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে বিবেচিত হয় না।
ট্রানজিট-করিডোর প্রসঙ্গে প্রবীণ অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মু. সিকান্দার খান ইনকিলাবকে বলেন, ভারতসহ সকল প্রতিবেশীর সাথে আমাদের সম্পর্ক হওয়া উচিত সমমর্যাদার ভিত্তিতে। শুধুই ‘নেব আর নেব’ এই মানসিকতা নিয়ে প্রতিবেশীর সাথে টেকসই সম্পর্ক হয় না। সম্পর্ক হতে হবে সুষম। ‘নেবো আর দেবো’- Ôgive and take’. ভারত আমাদের ন্যায্য পাওনা কিছুই দিচ্ছে না। অথচ, আমরা নিজে না খেয়ে বন্ধুকে খেতে দিচ্ছি। আমরা যেন বাধ্য হয়েই সন্তুষ্ট। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ চবি অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর ড. আবুল কালাম আযাদ বলেন, ট্রানজিট পণ্যের চাপ সামলাতে দিতে গিয়ে বন্দর সক্ষমতা হারাবে। ভারতের সাথে দরকার ট্রেড পলিসির পরিবর্তন। তাহলে বাংলাদেশের অনেক পণ্য উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যে প্রবেশ নিশ্চিত হবে।
ইতিহাসের সঙ্গী
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, প্রাচীন গ্রিস, মেসোপটেমিয়া (ইরাক-সিরিয়া-তুরস্ক), পারস্য (ইরান) সমুদ্র বন্দরসমূহে মার্চেন্ট জাহাজবহর গমনাগমনকালে বন্দরের জেটি-ঘাটে হাতে লিখিত আমদানি মালামালের তালিকা টানানো হতো। দুই হাজার বছর আগেকার কথা। তালিকায় থাকতো জাহাজে ভর্তি মালামালের বিবরণ, যেমন- কোন কোন জাহাজে কী কী পণ্য কোন দেশ থেকে কী পরিমাণে এসেছে ও খালাস হচ্ছে, সম্ভাব্য মূল্য ইত্যাদি লেখা হতো। আবার কোন মালামাল রফতানি চালানে কোন জাহাজযোগে কোন দেশে যাবে তার বর্ণনাও থাকতো।
এ ধরনের তালিকার অনেকগুলো হাতে লেখা কপি বন্দর-ঘাট-জেটি ছাড়াও জনবহুল স্থানে টানানো হতো। ক্রেতা-বিক্রেতা তথা বন্দর ব্যবহারকারী (স্টেকহোল্ডার) কাছেও এসব তালিকা বিক্রি করা হতো। কাটতিও বেড়ে যেতো। এর মধ্যদিয়ে প্রাচীনকালে ‘সংবাদপত্রে’র কনসেপ্ট তৈরি হয়। চমকপ্রদ বিষয় হলো, এই ডিজিটাল যুগে এসেও প্রধান বন্দরের ধারক-বাহক বন্দরনগরী চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সংবাদপত্রে বিশেষ পাতায় ছাপা হয় ‘জাহাজের খবর’ (বার্থিং সিডিউল)। এতে জাহাজের নাম, গমনাগমন সিডিউল, নোঙরের স্থান, কোন কোন দেশের পতাকাবাহী এবং জাহাজভর্তি পণ্যের বিবরণ, পরিমাণ ইত্যাদি তথ্য-উপাত্ত দেয়া হয়, যা সেই হাজার বছর পূর্বেকার গ্রিস, মেসোপটেমিয়া, পারস্যের সমুদ্র বন্দরসমূহে বাণিজ্যতরী বোঝাই মালামালের ফর্দ বা তালিকার হাত ধরে সংবাদপত্রের জন্মস্মৃতি বহন করে।
এবার আসি চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথায়। পৃথিবীর তিন ভাগের দুই ভাগই পানি। মাত্র এক ভাগ স্থল। স্থলভাগের অনেককিছুই মানুষের আয়ত্তে এসে গেছে। কিন্তু বিস্তীর্ণ পানির মহারাজ্য অনেকটাই অজেয়। আজও বিজ্ঞানীদের কাছে অপার বিস্ময় ও রহস্য। সাগর-উপসাগর, মহাসাগর, নদ-নদী, হ্রদকে জীবনধারণ, জীবনমান উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক বিকাশের স্বার্থে মানুষ কাজে লাগানোর নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে আসছে সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই। নিত্য ও ভোগ্যপণ্য, খাদ্যশস্য বিনিময়, সংস্কৃতি-সভ্যতা ও শিক্ষার আদান-প্রদান, জনবসতি, পরিভ্রমণ ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজনের তাগিদে মানবজাতি এক দেশ থেকে ভিন্ দেশে পাড়ি জমিয়েছে ‘কিস্তি’, নৌযান, জাহাজযোগে।
আজকের বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চলে, দেশে দেশে মানবসভ্যতা-সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের পেছনে সুপ্রাচীনকাল থেকেই প্রধান নিয়ামক শক্তি বা ফ্যাক্টর হিসেবে অবদান রেখে আসছে সাগর-মহাসাগর তথা সমুদ্রভিত্তিক কর্মকান্ড, যা পৃথিবীর ৯২ শতাংশ মানুষের অর্থনীতি, জীবন-জীবিকার চাবিকাঠি। পালতোলা জাহাজে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের গমনাগমন আর মেলবন্ধন তৈরি হয় এক বন্দর থেকে আরেক বন্দরে। আধুনিক ডিজিটাল যুগে এসে এর অর্থনৈতিক দিক প্রাধান্য পাচ্ছে। তাই একে বলা হচ্ছে Blue Economy- নীল অর্থনীতি, যার প্রধান দিগন্ত হচ্ছে বন্দর-শিপিং।
আগেই বলেছি দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ (Connectivity) সন্ধিস্থলে সুবিধাজনক ভূ-কৌশলগত অবস্থানে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর। এই অবস্থানগত কারণে দুই হাজার বছর পূর্বেই এটি বিভিন্ন দেশ-জাতির আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। অনেক শাসক-যোদ্ধার লোভাতুর চোখও পড়ে। তবে সত্যিকার অর্থে এই অঞ্চলে সভ্যতা-সংস্কৃতির শাহী দরজা চট্টগ্রাম ও তার বন্দর। খ্রিস্টীয় ৭ম থেকে ১১তম শতক অবধি এই উপমহাদেশে আরব-ইয়েমেন থেকে আগত সুফি-আউলিয়া-দরবেশগণ ইসলাম প্রচার-প্রসার করেন। তাই চট্টগ্রামকে বলা হয় ইসলামের প্রবেশদ্বার- ‘বা’বুল ইসলাম’। পালতোলা সামুদ্রিক জাহাজবহরে সুফিদের সঙ্গে আসেন আরব, তুর্কি পরিব্রাজক ও বণিকগণ। তারা চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পদ্মা-গঙ্গা, মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র, সুরমা-কুশিয়ারা তথা বরাক অববাহিকায় ছড়িয়ে পড়েন। তাদের পথরেখার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এ অঞ্চলের সভ্যতা, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক বিকাশ, অর্থনৈতিক অগ্রগতির ইতিহাস।
বঙ্গোপসাগর-বিধৌত চট্টগ্রাম অঞ্চলটি বন্দরকে ঘিরে নোয়াখালী, বাকেরগঞ্জ, খুলনাব্যাপী প্রাগৈতিহাসিক যুগেও ছিল সমৃদ্ধ। খ্রিস্টীয় সালের গোড়ার দিকে লিখিত ‘পেপিরাস অব দ্য ইরিথ্রিয়ান সী’ গ্রন্থে আছে চট্টগ্রাম বন্দরের নাম। এর বর্ণনায় আছে: এটি নিরাপদ, সুবিন্যস্ত, ভৌগোলিক অপূর্ব সুবিধাজনক প্রাকৃতিক পোতাশ্রয়। বন্দর চট্টগ্রামের গোড়াপত্তন হয় দুই হাজার বছর পূর্বে। আজকের সন্দ্বীপ-হাতিয়া পর্যন্ত তা বিস্তৃত ছিল।
প্রাচীন ব্যাবিলনীয় শাসনামলে এবং ইয়েমেন ও আরব্য বণিকগণ ছাড়াও গ্রিস, মেসিডোনিয়াসহ পূর্বের জাভা, সুমাত্রা, মালয়, চীন থেকে এসে বণিকেরা পালতোলা বাণিজ্যতরী ভিড়িয়েছেন যুগে যুগে। তারা সুরাট, কোচিন, তাম্রলিপ্ত ও চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে জমজমাট ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন স্বাচ্ছন্দ্যে। বিখ্যাত মিশরীয় ইতিহাসবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী টলেমী চট্টগ্রামকে নিকট প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সর্বাপেক্ষা সুন্দর শহর হিসেবে বর্ণনা করেন। মালয়ী ইতিহাস বলছে, খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দী থেকে দারুচিনি, লবঙ্গের দেশ মালয়ের সাথে চট্টগ্রামের ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের সেতুবন্ধন। বিশ্বখ্যাত পরিব্রাজক ঐতিহাসিক ফা-হিয়েন, হিউয়েন সাঙ, ইব্নে বতুতার বর্ণনা মতে, চট্টগ্রাম বন্দর পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতা ও সওদাগরী বাণিজ্যের জন্য আকৃষ্ট করে। চীন, তুর্কিস্থান, আরব এবং পর্তুুগিজ ও ইউরোপীয় বণিকগণ প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরকেই বেছে নিতেন। এই বন্দরের খ্যাতি ও দ্যুতি ছড়ায় দুনিয়াব্যাপী। চট্টগ্রাম নামটির আরবি শব্দ ‘সেৎগান’। যার মানে- গঙ্গা অববাহিকা থেকে যে অঞ্চলটি উৎপন্ন হয়েছে। আরব্য বণিকগণ চট্টগ্রামকে ‘মহাবন্দর’ হিসেবে দেখেন। অষ্টম শতাব্দীতে আরব বণিকগণ চট্টগ্রাম বন্দরে পালতোলা জাহাজ নিয়মিত ভিড়ান। নবম শতাব্দীতে বন্দরের নাম দেন ‘সামুন্দা’।
চীনা পর্যটক মা-হুয়ানের নেতৃত্বে একটি দল ১৪০৫ সালে চট্টগ্রামে আসেন। তিনি চট্টগ্রামকে ‘চিট-লে-গান’ নামে উল্লেখ করে একটি পরিপাঠি বন্দর হিসেবে আখ্যা দেন। তখন চীনা মার্চেন্ট জাহাজ প্রায়ই চট্টগ্রামে ভিড়তো। ইউরোপীয়দের মধ্যে পর্তুগিজরা সর্বপ্রথম চট্টগ্রামে আসে। ১৫১৭ সালে পর্তুগিজ ক্যাপ্টেন হোয়াও দ্য সিলভেইরা ‘লোপো সোয়ানা’ জাহাজ নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে এসে বিমুগ্ধ হন। পরে আলফন্সো দ্য মিলোর নেতৃত্বে ১৫২৭ সালে চট্টগ্রাম দখলের ব্যর্থ হয়।
শেষ পর্যন্ত পর্তুগিজরা সম্রাট শেরশাহ শূরীর বিরুদ্ধে বাংলার সুলতান মাহমুদ শাহকে সাহায্য করার বিনিময়ে তার কাছ থেকে চট্টগ্রাম ও সাতগাঁওয়ের কর্তৃত্ব অধিকার লাভ করে। পর্তুগিজদের অধীনে চট্টগ্রাম ও বন্দর হয় সমৃদ্ধ। পর্তুগিজ পোর্ট-শিপিং ইতিহাসের পাতায় চট্টগ্রামকে বাংলার সবচেয়ে খ্যাতিমান ও সম্পদশালী শহর হিসেবে তুলে ধরা হয়।
১৫২৮ সালে পর্তুগিজ নাবিকেরা চট্টগ্রামকে ÔPorte Grande "রূপে পরিচিত করান। যার অর্থ ‘মহাবন্দর’। ১৬৬৫-৬৬ সালে বাংলার মুঘল সুবেদার নবাব শায়েস্তা খাঁন চট্টগ্রামে অতর্কিত অভিযানে বন্দরটি দখল করেন। বন্দরের গুরুত্ব ও খ্যাতি প্রসার লাভ করে ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে আফগানিস্তান, মধ্য-এশিয়া অবধি। চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করেই কর্ণফুলীর তীরে আড়াইশ’ বছর পূর্বে গড়ে উঠে দেশের সর্ববৃহৎ সওদাগরী বাণিজ্যপাড়া চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ। তুর্কি ‘চাগতাই’ নামক ব্যবসায়ী গোষ্ঠির নামে হয় চাক্তাই। বনেদী সওদাগর খাতুনবিবির নামে নামকরণ করা হয় খাতুনগঞ্জ।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে উপমহাদেশে ব্রিটিশ শক্তির উত্থানের শুরুতেই চট্টগ্রাম বন্দর ভৌগোলিকভাবে এ অঞ্চলে সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব লাভ করে। যদিও প্রথম দিকে কলকাতা বন্দর বেশি গুরুত্ব পাচ্ছিল। আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের সদর দফতর চট্টগ্রামে স্থাপিত হয়। দক্ষিণ-পূর্ব ব্রিটিশ ভারতের সিংহভাগ আমদানি-রফতানি চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ব্রিটিশরা চট্টগ্রাম বন্দর দখলে মরিয়া হয়ে উঠে। উদ্দেশ্যটা হলো, চট্টগ্রাম দখল করতে পারলে উপসাগরে তাদের সবধরনের সুবিধা আয়ত্তে এসে যাবে। জানুয়ারি, ১৬৮৯ সালে চট্টগ্রাম দখলের জন্য ক্যাপ্টেন হিথের নেতৃত্বে একটি নৌবহর প্রেরিত হয়। তবে তাদের এই দ্বিতীয় চেষ্টাও বিফল হয়। হিথ চট্টগ্রাম দখলের ক্ষেত্রে বাধা-বিপত্তিগুলো উপলব্ধি করেন। মাসখানেক পর নোঙর তুলে ফিরে যান। দখল পরিকল্পনাটি পরিত্যক্ত হয়। চট্টগ্রাম আরও একশ’ বছর বাংলার মুঘল শাসকদের অধীনে থাকে। দুই শতাব্দীতে বেশিরভাগ সময়েই মুঘল, পর্তুগিজ ও ব্রিটিশরা ভারত মহাসাগরের নৌবাণিজ্যের প্রধান বন্দর চট্টগ্রামকে আয়ত্তে নিতে লোভাতুর ছিল। ব্রিটিশরা চট্টগ্রাম দখলে নিতে ব্যর্থ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত কলকাতায় ঘাঁটি স্থাপন করে।
ব্রিটিশ শাসনামলের গোড়ার দিকে ইংরেজ ও দেশীয় ব্যবসায়ীরা বার্ষিক এক টাকা সেলামির বিনিময়ে নিজ ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীতে কাঠের জেটি নির্মাণ করেন। পরে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম দু’টি অস্থায়ী জেটি নির্মিত হয়। ১৮৭৯ সালে সদরঘাটে একমাত্র লোহার জেটি নির্মিত হয়। এর আগে-পরে যাত্রী, মালামাল বিশেষত লবণ জাহাজীকরণের জন্য চারটি কাঠের জেটি নির্মিত হয়।
অন্যদিকে যুগের চাহিদা পূরণে চট্টগ্রাম বন্দরের ভৌত ও কারিগরি অবকাঠামো সুবিধা বৃদ্ধির প্রয়োজনে ১৮৮৮ সালের ২৫ এপ্রিল চিটাগাং পোর্ট ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন পরিপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যদিয়ে বন্দরের নতুন অভিযাত্রা। এটি ১৩৪ বছর অতিক্রম করলো। প্রতিবছর চট্টগ্রাম বন্দরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হিসেবে দিবসটি উদযাপন করা হয়। ১৯০৩ সালে বন্দরের জেটি-ঘাটসমূহের নিয়ন্ত্রণ আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৯৬০ সালে অধ্যাদেশ দ্বারা সংশোধিত ১৯১৪ সালের পোর্ট অ্যাক্টের বিধান অনুযায়ী একটি আধা-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে পোর্ট ট্রাস্ট পুনর্গঠিত হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর বন্দরের ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে। বন্দরের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ দ্রুতায়িত করার লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ অধ্যাদেশ জারি করা হয়। বিধি-বিধানসমূহ বিভিন্ন সময়ে যুগোপযোগী সংশোধনীর মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) বন্দর পরিচালনা করছে।
লেখক: উপ-সম্পাদক ও ব্যুরো প্রধান দৈনিক ইনকিলাব, চট্টগ্রাম
ইনসেট
দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ সন্ধিস্থলে সুবিধাজনক ভূ-কৌশলগত অবস্থানে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর। এই অবস্থানগত কারণে দুই হাজার বছর পূর্বেই এটি বিভিন্ন দেশ-জাতির আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। অনেক শাসক-যোদ্ধার লোভাতুর চোখও পড়ে। তবে সত্যিকার অর্থে এই অঞ্চলে সভ্যতা-সংস্কৃতির শাহী দরজা চট্টগ্রাম ও তার বন্দর।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম মহাবন্দর
আরও পড়ুন