পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দেশে আশঙ্কাজনক হারে ধর্ষণ ও গণধর্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কোনোভাবেই এর লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। একশ্রেণীর বিকৃত মানসিকতার মানুষ এতটাই বেপরোয়া যে দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে ধর্ষণ করছে। ঘরেও অনেক নারী নিরাপদ থাকছে না। সিলেটের এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে এবং নোয়াখালির তোলপাড় করা ধর্ষণের ঘটনাসহ দেশজুড়ে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়া নিয়ে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য স্থানে তুমুল বিক্ষোভ-সমাবেশ চলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে সর্বত্র এ ক্ষুদ্ধতা দেখা দিয়েছে। ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলাকালেই সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদÐের বিধান করে আইন সংশোধন করেছে। তবে এ নিয়ে কারো কারো ভিন্নমতও রয়েছে। মৃত্যুদÐ দিয়ে ধর্ষণের মতো বর্বরতা বন্ধের নজির দুনিয়াতে আছে কি-না, এ নিয়ে আলোচনা চলছে। কারো কারো মতে, মানুষের ক্ষোভ নিরসনে সরকার তড়িঘড়ি করে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদÐের বিধান করেছে। কেউ কেউ আবার একে একটি রাজনৈতিক কৌশলও বলছেন। মানুষের দৃষ্টিকে ভিন্ন দিকে নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। অনেকে উদাহরণ টেনে বলেন, আগের সরকারের আমলে অ্যাসিড ছোঁড়ার শাস্তি মৃত্যুদÐ করায় এ অপরাধটি কমে গেছে। একইভাবে মৃত্যুদÐের বিধান করলে ধর্ষণও কমে যাবে। আইন বিশেষজ্ঞসহ চিন্তাশীলরা এমন সরলীকরণে সায় দিচ্ছেন না। কারণ দেখিয়ে তারা বলছেন, ধর্ষণ আর অ্যাসিড নিক্ষেপ এক ধরনের অপরাধ নয়। এক পরিসংখ্যান বলছে দেশে গড়ে ৯৭% ধর্ষণের বিচার হয় না। ধর্ষণের প্রমাণ দাঁড় করানো কঠিন। কারণ, এক্ষেত্রে ধর্ষিতকেই প্রমাণ করতে হয় তিনি ধর্ষিত হয়েছেন। যার ফলে তা প্রমাণ করতে করতে ধর্ষিত নারী পদে পদে অপদস্ত হয়। এক পর্যায়ে নিজেই আর মামলা চালাতে চায় না। অনেক সময় মামলা তুলেও নেন। আবার কখনো কখনো ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগকারী আসামী হয়ে যায়।
ধর্ষণ একটি সহিংসতা, মোটেই যৌনতা নয় । আমরা কখনো কখনো তা গুলিয়ে ফেলি। অনেক সময় গণমাধ্যমেও তালগোল পাকিয়ে ফেলে। মনে রাখতে হবে, যৌন হয়রানির প্রতিবেদন শুধু ভাষাগত নয়, এর প্রেক্ষাপটও খুঁজে পাওয়া। যৌন সহিংসতার উপর রিপোর্ট করতে হলে অবশ্যই নৈতিক সংবেদনশীলতা, সাক্ষাৎকারের দক্ষতা, আইনের ধারা-প্রয়োগ ইত্যাদি স¤পর্কে জ্ঞান থাকতে হয়। কারণ ধর্ষকদের বেশিরভাগই কোন না কোনভাবে ক্ষমতাবান, প্রভাবশালী হয়ে থাকে। আবার তাদের কারো কারো গডফাদারও থাকে। তারা তাদের কুসন্তানদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে নিরাপদ রাখার সব চেষ্টা করে। রাজনৈতিক এসব আশ্রয়-প্রশ্রয় দাতাদের কারণেই ধর্ষকরা অনেক সময় পার পেয়ে যায়। এই অসুস্থ রাজনীতি বন্ধ না হলে ধর্ষণ ও ধর্ষকদের নিবৃত করা যাবে না। দেশের রাজনীতি শুদ্ধ হলে, রাজনীতি রাজনীতির জায়গায় এলে, জবাবদিহিতা থাকলে সকল অপরাধই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এদের লিপ্সা কমতে বাধ্য।
ধর্ষকদের প্রশ্রয় দাতারা প্রভাবশালী ধর্ষণ-গণধর্ষণ বা ধর্ষণের পর মেরে ফেলা অথবা ধর্ষিতকে মিথ্যুক-চরিত্রহীন বানিয়ে ফেলা তাদের কাছে কোনো বিষয়ই না। আবার ধরা পড়লেও তাদের কোন লজ্জাও হয় না। আদালতে বুক ফুলিয়েই যাতায়াত করে। অন্যদিকে মান-সম্মানের কিছুই অবশিষ্ট থাকে না ধর্ষিত নারী ও তার পরিবারের। সোশ্যাল মিডিয়ায় কারণে এখন ধর্ষিতার ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। এতে আইনের বালাই নেই বললেই চলে। যদিও সবই এখন তথ্য অধিকারের আওতাভুক্ত। দেশের সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদ নাগরিকদের যে ন্যূনতম ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার দিয়েছে গণমাধ্যমে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে ধর্ষিতার ছবি প্রকাশ করে বুঝে না-বুঝে সে অধিকারটিও কেড়ে নিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্ষিতার ছবি ও ভিডিওও প্রকাশ করার এক ধরনের প্রতিযোগিতা যেন চলছে।
ধর্ষণবিরোধী আইনের ইতিহাস বেশ পুরনো। অন্তত দেড়শ বছরেরও আগের। শুধু ধর্ষণ নয়, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে অনেক আইনই দেশে বলবৎ। ২০০০ সালে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন হয়েছে। তাতে ধর্ষণসহ নারী নির্যাতন কমেনি। বরং এর সাথে শিশু নির্যাতনও বেড়েছে। যদি আইনটি সবার সবার জন্য সমান এবং এর সঠিক প্রয়োগ হতো তবে চিত্রটি ভিন্ন হতে পারতো। ১৮৬০ সালে ব্রিটিশরা ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন এবং জরিমানার বিধান করেছিল। ২০০০ সালে বাংলাদেশে প্রণীত নারী ও শিশু নির্যাতন বিরোধী আইনেও যাবজ্জীবনের বিধান করা হয়েছে। আর ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু হলে আসামীর মৃত্যুদÐের বিধানও রয়েছে। অপরাধটি জামিন অযোগ্য। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি আসামী জামিন পায়ে যায়।
বিশ্বের তিন চতুর্থাংশ দেশেই মৃত্যুদÐের বিধান নেই। অনেক দেশ মৃত্যুদÐের বিধান রহিত করছে। কেউ কেউ আইন থাকলেও মৃত্যুদÐ দিচ্ছে না। এমনকি প্রতিবেশি ভারতেও মৃত্যুদÐের হার খুবই কম। হিসাব অনুযায়ী, আমাদের দেশে বর্তমানে কনডেম সেলে আঠারশ’র বেশি মৃত্যুদÐে দÐিত রয়েছে; যা মৃত্যুদÐের দÐিতের সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে তৃতীয় বা চতুর্থ স্থানে রয়েছে। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদÐ কার্যকর হওয়া শীর্ষ পাঁচটি দেশ হলো, চীন, সউদী আরব, ইরান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। বলার অপেক্ষা রাখেনা, সুশাসন ও আইনের শাসনের ঘাটতিতে শুধু সরকারই অগণতান্ত্রিক হয় না। ধর্ষক ও অপরাধীরাও দুর্বীনিত হয়ে ওঠে। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা মানিকের কেক কেটে ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদযাপন, সুবর্ণচরের সেই গৃহবধুর ঘটনা বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের বিচারে মজনু নাটকসহ এই রকম অহরহ বহু ঘটনার উদাহরণ রয়েছে এখন দেশে। সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত ধর্ষণের ঘটনা তো রয়েছেই। ধর্ষণের কিছু ঘটনায় জড়িত কিছু ব্যক্তিকে ক্রসফায়ারে দেয়া হয়েছে। তাতে কি ধর্ষণ থেমেছে? এছাড়া অনেক খুনি, দাগী আসামিকেও ক্রসফায়ার করা হয়েছে। তাতে কি খুন বন্ধ হয়েছে? হয়নি।
প্রশ্ন হচ্ছে ধর্ষক, নির্যাতক, খুনি, ব্যাংক-শেয়ারবাজার লুটেরা, জনগণের অর্থ-স¤পদ লুটেরা, জনগণের হক লুটেরারা কেন এত প্রভাবশালী? কোথায় তাদের খুঁটির জোর? সম্প্রতি ধর্ষণকারীর জন্য কোনো রাজনৈতিক দল যেন আশ্রয়ের ঠিকানা না হয়, এমন বক্তব্য দিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ স¤পাদক। দেশের সিংহভাগ মানুষের মনে কথাও এটি। কিন্তু কথা আর কাজ কি এক হচ্ছে? দুঃখজনক হলেও সত্য, ক্ষমতাসীন দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতার এমন বয়ান মানুষকে এখন আর আশাবাদী করে না। বরং চাতুরি এবং ঘটনাকে রাজনৈতিক মিঠা কথায় আড়ালের চেষ্টা মনে করে।
এদিকে, ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে ক্রসফায়ারের দাবি এসেছে। জাতীয় সংসদে কোনো কোনো এমপিও ক্রসফায়ারের দাবি তুলেছিলেন। তারা আইন প্রণেতা, তারা দেশের জন্য, নাগরিকদের জন্য আইন প্রণয়ন করেন। তারা কেন বেআইনী পদক্ষেপ চান? তাও আবার আইন প্রণয়নের জন্য তৈরি সংসদ ভবনে দাড়িয়ে? ক্রসফায়ারকে ছড়িয়ে কেউ কেউ ধর্ষকদের বিশেষ অঙ্গ কেটে ফেলা, প্রকাশ্যে মেরে ফেলার মতো চরম শাস্তিরও দাবি তুলেছেন। এটি তাদের আবেগ, জেদ বা ক্ষোভের তাৎক্ষণিকতা। এই ধরনের দাবি অবশ্য কোনো কোনো কবি, সাহিত্যিক, সংস্কৃতি অঙ্গণের লোকজনও করছেন। তাদের আবেগের প্রতি অসম্মান করা যায় না। আবার পুরোপুরি সমর্থনও করা যায় না। কারণ, ধর্ষণের শাস্তি চাইতে গিয়ে তারা অবচেতনে মধ্যযুগীয় বিচার ব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করে তুলছেন কি-না, তা ভেবে দেখার আবশ্যকতা রয়েছে। তার চেয়ে যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে দ্রæত বিচার আইন ও বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হলে, পাশাপাশি রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় না দিলে ধর্ষণ এবং ধর্ষকদের প্রতিরোধ করা সম্ভব। কারণ তাদের এ কর্মটি মোটেই যৌণতার জের নয়। বরং ক্ষমতার দাপট। তারা মনে করে, ক্ষমতার জোরে অপরাধ করে পার পেয়ে যাবে। অপরাধ করলে শাস্তি হয় এবং হবেই- মানুষের মধ্যে এ সচেতনতা সৃষ্টি করা না গেলে ধর্ষণসহ কোনো অপরাধই বন্ধ হবে না। আইনের শাসন থাকলেই কেবল নাগরিকদের মনে আইন মান্য করার মানসিকতা তৈরি হয়। অপরাধ করা থেকে নিবৃত্ত হয়। এছাড়া যতই মৃত্যুদÐের বিধান রেখে আইন প্রণয়ন করা হোক এবং তার যদি সঠিক প্রয়োগ না থাকে তাতে কোনো লাভ হবে না।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।