পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ভারত ও চীন উভয় দেশের সাথেই রাশিয়ার সম্পর্ক ভালো। ভারত বিভক্ত হওয়ার পর পন্ডিত নেহরু যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন তখন পাকিস্তান মার্কিন তথা পশ্চিমা শিবিরে ঢুকে পড়ে। পন্ডিত নেহরু ছিলেন চতুর পলিটিশিয়ান। মিশরের প্রেসিডেন্ট কর্নেল নাসের এবং যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোকে সাথে নিয়ে তিনি জোট নিরপেক্ষ শিবির গঠন করেন। এই শিবিরটি নামেই ছিল জোট নিরপেক্ষ। কিন্তু কাজে এটি ছিল সোভিয়েট ক্যাম্পে। সেই সোভিয়েট ইউনিয়নের উত্তরসূরী হলো বর্তমান রাশিয়ান ফেডারেশন বা সংক্ষেপে রাশিয়া। সেই তখন থেকেই রুশ-ভারত সখ্য। ভূস্ট্র্যাটেজিক নয়া বাস্তবতায় আমেরিকা ও ইসরাইলের সাথে দহরম-মহরম করলেও রাশিয়ার সাথে তার রয়েছে নাড়ীর টান। আমেরিকা পাকিস্তানকে শুধুমাত্র লিপ সার্ভিস দিয়েছে। দিয়েছে সেকেলে পুরাতন অস্ত্র। সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নের উদ্দেশ্যে আধুনিক অস্ত্র ক্রয়ের জন্য ইমরান খানের সরকার রাশিয়ার সাথে নেগোশিয়েট করছিল। রাশিয়া কিছু আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র পাকিস্তানের কাছে বিক্রি করতে রাজিও হয়েছিল। এই সময় মস্কোতে যান ভারতে বিজেপির সাবেক সভাপতি এবং বর্তমানে ভারতের দেশরক্ষা (প্রতিরক্ষা) মন্ত্রী রাজনাথ সিং। পাকিস্তানের কাছে কোনো সমরাস্ত্র বিক্রি না করতে তিনি রুশ সরকারকে অনুরোধ করেন। সেই অনুরোধে সাড়া দিয়ে রাশিয়া পাকিস্তানর কাছে অস্ত্র বিক্রি করবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বলছিলাম, ভারত যেমন রাশিয়ার বন্ধু, তেমনি চীনও রাশিয়ার বন্ধু। দুটিই কমিউনিস্ট রাষ্ট্র। এখন অবশ্য তারা কট্টর কমিউনিস্ট নয়। কঠিন বাস্তব তারা লেনিন ও মাও সে তুংয়ের পথ থেকে বেশ কিছুটা সরে এসেছে। চীন-ভারত বিরোধে রাশিয়া বিব্রত হয়। শ্যাম রাখি, না কুল রাখি। এই বিরোধে রাশিয়া চেষ্টা করে একটি ব্যালান্সিং ফ্যাক্টর হতে। এবারও রাশিয়া সেই চেষ্টাই করেছিল। চেষ্টা করেছিল, চীন-ভারতের মধ্যে একটি আপোসরফা করতে। কিন্তু দিন শেষে দেখা গেল, চীন-ভারতের মধ্যে জমাট হয়ে থাকা বরফ গলেনি। পূর্ব লাদাখ নিয়ে এখনও চীন-ভারতের মধ্যে টান টান উত্তেজনা রয়েই গেছে। এর মধ্যে মস্কোতে শুরু হয় সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক। ভারত থেকে মস্কোতে যান দেশরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্কর। চীন থেকে আসেন দেশরক্ষা মন্ত্রী উই ফেংহি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াংই।
এই সুযোগটিই নিয়েছিল রাশিয়া এসসিও মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের ফাঁকে বা অবসরে (সাইডলাইন) রাশিয়া চীন ও ভারতের মধ্যে দূতীয়ালি করে। রাশিয়া দেশ দুটির মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের ব্যবস্থা করে। প্রথমে বৈঠক বসে চীন ও ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের মধ্যে। এই বৈঠকের প্রথম দিকে উপস্থিত ছিলেন রুশ মন্ত্রী। কিছুক্ষণ পর দুই দেশের মন্ত্রীদেরকে একান্তে কথা বলার সুযোগ দিয়ে রুশ মন্ত্রী বেরিয়ে আসেন। কিন্তু দুই দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
পরদিন বৈঠকে বসেন দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। এই বৈঠককে ঘিরে ভারতে বিপুল আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিল। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে মস্কোতে যখন দিন, দিল্লিতে তখন রাত। দিল্লির পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়কে বলা হয়, সাউথ ব্লক। যেমন, মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতরকে বলা হয়, পেন্টাগন। একটি সুখবরের আশায় সাউথ ব্লকের সিনিয়র অফিসারগণ সারারাত জেগে ছিলেন। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সভা শেষ হলো। কথার ফুলঝুরি রচনা করা হলো। কূটনৈতিক পরিভাষার মারপ্যাঁচে বৈঠকের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা হলো অনেক। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। ১৫ ও ১৬ জুন চীনা বাহিনী গালওয়ান উপত্যকা এবং প্যাং গংস হ্রদ তীরবর্তী যেসব এলাকা দখল করেছে, ভারতের দাবি ছিল, চীন ১৫ ও ১৬ জুনের পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে যাক। চীন অনেক ভালো কথা বলেছে। সেও সীমান্তে উত্তেজনা চায় না। সেও চায় শান্তির সীমানা। কিন্তু আগের দিন চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলেছিলেন, এক ইঞ্চি জায়গাও তারা ছাড় দেবেন না। সেই কথাতেই অটল রইল চীন। ব্যর্থ হলো দুটি বৈঠকই। প্রশ্ন: বৈঠক দুটি কেন ব্যর্থ হলো? চীন-ভারত সম্পর্ক কি আর আগের অবস্থায় ফিরে যাবে?
দুই
ফিরে যাবে না। কেন যাবে না, সেটা বুঝতে হলে চীনের কৌশলটি বুঝতে হবে। চীন এখন সমগ্র গালওয়ান উপত্যকায় তার সার্বভৌমত্ব চায়। এই গালওয়ানে রয়েছে ১৪ নং ফিঙ্গার পয়েন্ট। ফিঙ্গার পয়েন্ট হলো উঁচু পাহাড়েরর ওপর সামরিক ঘাঁটি। গালওয়ানে এই ধরনের ১৪টি ফিঙ্গার পয়েন্ট রয়েছে। ভারতের প্রাক্তন নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং অভিজ্ঞ নিরাপত্তা বিশ্লেষক এম. কে নারায়ন মনে করেন যে, যদি ১৪ নং ফিঙ্গার পয়েন্ট দখলে থাকে তাহলে ডারবুক-শায়ক-দৌলতবেগ ওন্ডি রাস্তার ওপর চীনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। সদ্য নির্মিত এই রাস্তাটি কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই রাস্তাটি কারাকোরাম গিরিপথে মিলে গেছে। ভারতের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, গালওয়ান উপত্যকা যদি চীনের দখলে চলে যায়, তাহলে সমগ্র স্থিতাবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে। তা ছাড়া, আরো গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়, সেটি হলো সমগ্র গালওয়ান উপত্যকা যদি চীনের দখলে চলে যায় তাহলে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পূর্বে যেসব ইস্যুর নিষ্পত্তি হয়েছে বলে ধরা হয় সেসব ইস্যু আবার পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে।
লাদাখে চীন-ভারত বিরোধের কেন্দ্রস্থল রয়েছে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার ব্যাখ্যা। চীনের সর্বশেষ ব্যাখ্যা বা দাবি হলো ১৯৫৯ সালে নভেম্বরের নিয়ন্ত্রণ রেখা। পক্ষান্তরে ভারতের ব্যাখ্যা ও দাবি হলো ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরের নিয়ন্ত্রণ রেখা।
সাদা চোখে মনে হচ্ছে যে, চীন-ভারত বিরোধের কেন্দ্রবিন্দু শুধুমাত্র লাদাখ। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, লাদাখ বিরোধের নিষ্পত্তি হয়ে গেল, তাহলেই কি চীন-ভারতের সব সমস্যার অবসান হবে? হবে না। কারণ, লাদাখ ছাড়াও ভারতের সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চল জুড়ে চীনের সীমান্ত। তিব্বত এবং জিনজিয়াং উইঘুর চীনের অংশ হওয়ার পর ভারতের ৪টি রাজ্য বা প্রদেশের সাথে রয়েছে চীনের সীমান্ত। এসব রাজ্য হলো উত্তরাখন্ড, হিমাচল, অরুণাচল ও সিকিম। লক্ষ্য করার বিষয় হলো এই যে, ১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীন প্যাং গংস লেকের বড় অংশ, গালওয়ান নদী উপত্যকার সিংহভাগ, দেপসাং সমভূমির আশে পাশের এলাকা, হটস্প্রিং, ডেমাচক, দৌলতবেগ ওন্ডিসহ বেশ কিছু এলাকাকে নিজের বলে দাবি করে। পরবর্তী ৫৮ বছর সে নীরব ছিল। কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, চীন নাকি এখন দাবি করছে যে, সমগ্র লাদাখ তাদের অংশ। কারণ লাদাখ পূর্ব তিব্বত এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে জিনজিয়াং উইঘুরের অংশ। সমগ্র লাদাখ দখল করার জন্য চীন উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় বসে ছিল। এবার চীন লাদাখের একটি অংশ দাবি করেছে। উপযুক্ত সময়ে তারা সমগ্র লাদাখই দাবি করবে।
তিন
লাদাখের পাশাপাশি লিপুলেখ সংলগ্ন টাইজংশন নিয়ে নেপালের সাথে ভারতের বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। বিতর্কের কেন্দ্র একটি নয়। আরো আছে। ভুটান-তিব্বত-অরুণাচল নিয়ে বিতর্ক জোরদার হয়েছে। উত্তরাখন্ড-তিব্বত সীমান্তের বারোহাতি, উত্তর সিকিমের ফিঙ্গার এরিয়া এবং সমগ্র অরুণাচল প্রদেশ রয়েছে চীনের দাবির তালিকায়। চীন কখনও ম্যাকমোহন লাইনের অস্তিত্ব স্বীকার করেনি। চীনকে ক‚টনৈতিক পর্যায়ে কোণঠাসা করার জন্য ভারত আমেরিকার দিকে মাত্রাতিরিক্তভাবে হেলে পড়েছে। আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও বৈঠক পর্যায়ে এক নং শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করেছেন চীনকে। করোনা প্যানডেমিকের পূর্ব পর্যন্ত চীন ও আমেরিকার মধ্যে চলছিল বাণিজ্য যুদ্ধ। কিন্তু বিগত ৬ মাসে সেটি স্নায়ু যুদ্ধের চেয়েও বড় কিছুতে রূপান্তরের চেষ্টা করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। দক্ষিণ চীন সাগর মার্কিন মুল্লুক থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে। অথচ, সেখানে দুটি বিমানবাহী জাহাজ পাঠিয়েছেন ট্রাম্প। চীনকে মোকাবেলা করার জন্য ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানকে নিয়ে এক ধরনের সামরিক গাঁটছড়া বাঁধার চেষ্টা করছেন তিনি।
চীনের প্রতি আমেরিকার এই ধরনের মারমুখো নীতি অব্যাহত থাকবে কিনা সেটি এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। কারণ, আগামী ৪ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আর মাত্র ১ মাস ১৮ দিন রয়েছে। ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি কী হবে সেটি পরিষ্কার নয়। তার পররাষ্ট্রনীতির রূপরেখা বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় বিস্তারিতভাবে এসেছে বলে মনে হয় না। যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়লাভ করেন তাহলে এককথা। কিন্তু যদি ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন বিজয়ী হন তাহলে পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন হবে। ডেমোক্র্যাটের ভারতপ্রীতি হয়তো অব্যাহত থাকবে। কিন্তু বিনা কারণে অপ্রাসঙ্গিকভাবে চীন বিরোধিতা থাকবে বলে মনে হয় না। যদি নিরপেক্ষভাবে সাম্প্রতিক অতীত পর্যালোচনা করা হয় তাহলে দেখা যায় যে, চীন কিন্তু মার্কিন বিরোধিতা শুরু করেনি। চীন বিশ্বব্যাপী তার রপ্তানি বৃদ্ধি করছিল। চীনের রপ্তানি বিশ্ববাজার দখল করে এবং এক পর্যায়ে মার্কিন বাজারও দখল করে। অর্থনীতিতে মার খেয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাণিজ্যযুদ্ধকে রাজনৈতিক যুদ্ধে রূপান্তর করেন। ভারতসহ অন্যদের নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দল পাকানো শুরু করেন।
ভারত যেভাবে আমেরিকা এবং ইসরাইলসহ পশ্চিমাদের সাথে মিলে চীনের বিরুদ্ধে জোট পাকাচ্ছে তার ফলে ভারতের বিরুদ্ধে চীনের মনোভাব আরও কঠোর হচ্ছে। এই কঠোরতা আগামী দিনগুলোতে বাড়বে বৈ কমবে না। চীনের কঠোরতা শুধুমাত্র লাদাখেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, উত্তরাখন্ড, হিমাচল, অরুণাচল এবং সিকিম সীমান্তেও তার প্রকাশ ঘটবে বলে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।