পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত দশকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে হানা দিয়েছিল প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণীঝড় সিডর ও আইলা। প্রায় একযুগ পার হওয়ার পরও সে আঘাতের ক্ষতচিহ্ন শুকায়নি। উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ও বন্যা প্রতিরোধী বাঁধ ভেঙ্গে ঢুকে যাওয়া নোনা পানিতে হাজার হাজার একর ফসলি জমি এখনো তলিয়ে আছে। সিডরের আঘাতে বরগুনা, শরণখোলা, পাথরঘাটা, তালতলি, কলাপাড়া গলাচিপা উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত দুই হাজার কিলোমিটারের বেশি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বেশিরভাগ এখনো মেরামত বা পুনঃনির্মাণ সম্ভব হয়নি। সিডর আইলার মত প্রলয়ঙ্করী না হলেও প্রায় প্রতিবছরই নতুন নতুন নামের ঘূর্ণীঝড় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হেনে চলেছে। সামদ্রিক ঘূর্ণীঝড়ের শত শত বছরের ধারাবাহিক ইতিহাস থাকলেও সাম্প্রতিক দশকগুলোতে এর মাত্রা ও তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে মানুষের জীবনযাত্রা ও কর্মতৎপরতার বড় ধরনের দায় রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে শুরু করে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরের উপকূলে আঘাত হানা এসব ঘূর্ণীঝড়ের তান্ডবকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হিসেবেই দেখা হয়। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে শত শত মানুষের প্রাণহানি, লাখ লাখ হেক্টর ফসলি জমি এবং হাজার হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার ক্ষয়ক্ষতি শুধুমাত্র টাকার অঙ্কে নিরূপণ করা সম্ভব নয়। এটা নিশ্চিত যে, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, নদী ভাঙ্গন এবং ক্ষরা-বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বড় অংশই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশ গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের মূল অংশ হলেও হিমালয় থেকে প্রবাহিত নদনদীর শাখা-প্রশাখা চীন, ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশ হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। এ কারণে কয়েকটি আভ্যন্তরীণ নদী ছাড়া আমাদের বড় নদীগুলোর প্রায় সবই আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে স্বীকৃত। গঙ্গার পানিচুক্তির আগে আন্তর্জাতিক নদী আইনে যৌথ নদীর উপর বাংলাদেশের অধিকারের প্রশ্নটি ভারত বরাবরই অগ্রাহ্য করছিল। ফারাক্কা বাঁধ চালুর দুই দশক পরে নব্বইয়ের দশকে দ্বিপাক্ষিক সর্ম্পক ও আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতায় বাংলাদেশের সাথে গঙ্গার পানিচুক্তি সম্পাদিত হলেও বাংলাদেশ কখনো চুক্তি অনুসারে শুকনো মওসুমে পানির ন্যায্য হিস্যা পায়নি। সে সময় পদ্মা-মেঘনা ও শাখা নদীগুলো শুকিয়ে মরুময় হয়ে উঠে। পানির অভাবে দেশের বড় বড় সেচ প্রকল্পগুলোর বেশিরভাগ অংশ অকার্যকর হয়ে পড়ায় ব্যাপকভাবে ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে দেশের কৃষি ও সেচ ব্যবস্থা। ভূ-গর্ভস্থ পানির অতি ব্যবহারের ফলে পানির স্তর দ্রুত অনেক নিচে নেমে যাওয়ার পাশাপাশি আর্সেনিক দূষণসহ নানা ধরনের ভূ-প্রাকৃতিক সমস্যা ও ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছি আমরা। যৌথ নদীর উপর উজানে ভারতের বাঁধ নির্মাণ, পানি প্রত্যাহারের কারণে একদিকে নদী শুকিয়ে যাওয়া নদী অববাহিকায় মরুময়তা দেখা দিচ্ছে, আবার বর্ষায় পাহাড়ি ঢলের তোড় সামলাতে ফারাক্কা-তিস্তা বাঁধের সুইস গেটগুলো খুলে দেয়ার কারণে পলি জমে ভরাট হওয়া নদীতে আকস্মিক বন্যার শিকার হচ্ছে। মরা নদীতে বান ডেকে অস্বাভাবিক ভাঙ্গনের সম্মুখীন হচ্ছে দেশের বিপুল জনপদ। দেশের মানুষ এসব দুর্যোগ-দুর্বিপাককে এখন আর শ্রেফ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে মানতে নারাজ। বাংলাদেশে নদনদীর পানি, নদী ভাঙ্গন ও ক্ষরা-বন্যার শিকার হওয়ার ক্রমবর্ধমান তীব্রতার বাস্তবতাকে প্রতিবেশী দেশের ভূ-রাজনৈতিক এজেন্ডার অংশ বলেই বিবেচিত হচ্ছে।
গত এক দশক ধরে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। ঐতিহাসিকভাবেই আওয়ামী লীগ হচ্ছে ভারতের প্রতিষ্ঠাকালীন রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আস্থাপূর্ণ রাজনৈতিক দল। গত একযুগে ভারতের ক্ষমতায় পালাবদল ঘটলেও বিজেপি শাসনামলেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের সাথে ভারতের সম্পর্ক কংগ্রেস সরকারের ধারাবাহিকতায় অটুট রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী মন্ত্রী ও আমলারা বাংলাদেশের সাথে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ‘অনন্য উচ্চতায়’ পৌঁছার কথা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও একই কথার পুনরাবৃত্তি হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। বন্ধুত্বের এই অনন্য উচ্চতার সময়েও যৌথ নদী থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা পায়নি বাংলাদেশ। ভারত ভাগ হওয়ার পর থেকে গত ৭০ বছর ধরে বাংলাদেশের কাছে প্রত্যাশিত প্রায় সব কিছুই গত এক দশকে ভারতকে দিয়ে দেয়ার পরও তিস্তা নদীর পানিচুক্তির মতো ন্যায্য অধিকারের প্রশ্নে ভারতকে রাজি করাতে পারেনি বাংলাদেশ। এ সময়ে আন্তর্জাতিক মহলের আহ্বান ও সদিচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে বাংলাদেশে একপাক্ষিক নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার বাস্তবতায় মুখ্য নেপথ্য ভূমিকায় দেখা যায় ভারতকে। উপরন্তু এ সময়ে সৃষ্ট রোহিঙ্গা সংকট, এনআরসি, সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টে ভারতের রাজনৈতিক মহল থেকে বৈরিতার সম্মুখীন হয়েছে বাংলাদেশ। এতকিছুর পরও তথাকথিত বন্ধুত্বের গায়ে এতটুকু আঁচড় লাগেনি! পার্লামেন্ট সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট প্রস্তাব পেশ করতে গিয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে মিথ্যা বক্তব্য দিচ্ছেন ভারতীয় নেতারা। অবৈধ বলে কথিত ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ পুশ-ইন করছে, তখনো বাংলাদেশের নেতারা বলছেন ওসব ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয়। এনআরসি ও সিএএ ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয় হলেও এসব বিষয়ের সাথে যখন বাংলাদেশকে জড়িত করা হয়, বিতর্কিত আইন পাস হওয়ার পর বাংলাদেশ সীমান্তে অবৈধ ভারতীয়দের পুশ-ইন করার তৎপরতা দেখা যায়, তখন আর তা ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয় থাকে না। ভারতের সীমান্তরক্ষি বাহিনীর প্রধান এনআরসি কে তার দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় বলে দাবি করছেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন একই সুরে কথা বলেন, তখন দেশের নাগরিক সমাজের বিস্ময়, হতাশার সীমা থাকে না। একইভাবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যখন কাশ্মীরিদের উপর ভারতীয় বাহিনীর নির্যাতন, অবরোধ ও মানবাধিকার হরণের বিরুদ্ধে কাশ্মীরী মুসলমানদের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরছেন, তখন আমাদের সরকার ভারত সরকারের পক্ষেই নিজেদের সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। উপমহাদেশের চলমান আঞ্চলিক, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় আমাদের সরকারের নীতিগত অবস্থান ও কূটনৈতিক ব্যবস্থা দেশের পক্ষে অবস্থান সংহত করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হচ্ছে। রোহিঙ্গা সমস্যা যেমন মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ সমস্যা, একইভাবে এনআরসি ও সিটিজেনশিপ অ্যাক্টও ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয়। তবে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে এসব বিষয়ে যখন বাংলাদেশ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, তখন এসব সমস্যাকে মিয়ানমার বা ভারতের অভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ রাখতে এবং তার শান্তিপূর্ণ সমাধানে মিয়ানমার ও ভারতকে বাধ্য করতে দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা ও রাজনৈতিক মবিলাইজেশনের পদক্ষেপ গ্রহণ বাংলাদেশের জন্য অত্যাবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়ায়।
অর্থনৈতিক গেøাবালাইজেশন ও ক্লাইমেটে চেঞ্জের যুগে বাণিজ্য ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো বিষয়গুলো এখন আর কোনো দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। যে সব আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পদক্ষেপ অন্যদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজ্যব্যবস্থাকে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে আক্রান্ত করে, সে সব পদক্ষেপকে আভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে ছাড় দিয়ে চুপ থাকার সুযোগ নেই। আক্রান্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত দেশটি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বা সামরিকভাবে যত ক্ষুদ্রই হোক, আন্তর্জাতিক আইন ও সম্প্রদায়ের মতামতকে প্রভাবিত করার সামর্থ্য থাকলে প্রতিটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদাই সমান। আন্তর্জাতিক শালিসি আদালতে মামলা দায়েরের মধ্য দিয়ে মিয়ানমার ও ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিস্পত্তির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীনরাও তার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছে। তবে জটিল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতার কারণে রোহিঙ্গা সংকটের শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় বাংলাদেশ সরকারের কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে না চাওয়ার ফলাফল নিয়ে এখনো দেশের মানুষ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সন্দিহান। তবে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে গাম্বিয়ার মামলায় বাংলাদেশকে অবশ্যই যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। সম্পর্ক বা বন্ধুত্ব কখনো একপাক্ষিক হয় না। শক্তি ও মর্যাদায় সমান হলে এবং সম্পর্ক ও বৈরিতায় পরস্পরের লাভ- ক্ষতির হিসেবের মধ্য দিয়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্থির হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য না থাকলে একপক্ষ নিজের স্বার্থে আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে, অন্যপক্ষ দুর্বলতার কারণে ক্ষতি মেনে নিয়ে চুপ থাকলেও কখনো স্থিতিশীল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে পৌঁছাতে পারবে না। ভারতের সেভেন সিস্টার্সে আভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতাবাদ দমন, প্রায় বিনা শুল্কে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট, ভারতীয়দের কর্মসংস্থানের সুযোগ দিয়ে বাংলাদেশ থেকে বছরে শত শত কোটি ডলারের রেমিটেন্স আয়ের সুযোগ এবং বাংলাদেশের সমুদ্র ও নৌ-বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেয়ার পরও বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে তিস্তার পানি বণ্টন, বাণিজ্য বৈষম্য নিরসন, সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিবর্ষণ বা মাদক পাচারের মত সমস্যা সমাধানে কোনো ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছে না বাংলাদেশ। এমনকি যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক বা সার্কের প্রটোকল রক্ষা হচ্ছে না ভারতের আধিপত্যবাদী মনোভাব ও একক অনিচ্ছার কারণে। এহেন বাস্তবতায় সংস্কৃতি ও ভূরাজনৈতিক কারণে ভারতের সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রতিবেশী নেপাল, শ্রীলঙ্কা, এমনকি ভূটানের মতো অতি ক্ষুদ্র প্রতিবেশীও ভারতের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে চীনা প্রভাব বলয়ে শামিল হতে শুরু করেছে। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে ভারত আফগানিস্তানে বিনিয়োগ ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক খাতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে প্রভাবশালী অবস্থান নিশ্চিত করতে কাজ করলেও সাম্প্রতিক সময়ে দ্রæত পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় আফগানিস্তানে নিজের অবস্থান হারিয়েছে ভারত। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার কিংবা তালেবানদের সাথে সন্ধিচুক্তির আলোচনায় প্রভাবশালী পক্ষ হিসেবে পাকিস্তানকে সক্রিয় দেখা গেলেও ভারতের কোনো ভূমিকাই দেখা যায় না। একইভাবে রোহিঙ্গা সংকটে জাতিসংঘ, ওআইসি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টসহ তুরস্ক, মালয়েশিয়া বা গাম্বিয়ার ভূমিকার বিপরীতে চীনকে ডি-ফ্যাক্টো ভূমিকায় দেখা গেলেও অন্যতম আঞ্চলিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে রোহিঙ্গা গণহত্যা ও আঞ্চলিক সংকটে ভারতের ভূমিকা খুবই ক্ষীণ ও দুর্বল। এভাবে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ ভূমিকা নিয়ে কোনো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে পারে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক থাকার পরও আঞ্চলিক ক্ষেত্রে চীনের কাছে ভারতের ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ সম্ভবত এটাই।
আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পাশাপাশি ভারতের অর্থনীতি এখন গত কয়েক দশকের মধ্যে নাজুক অবস্থায় উপনীত হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মন্দাভাব অতটা প্রকট হয়ে না উঠলেও বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও গার্মেন্ট রফতানির মতো মূল অর্থনৈতিক খাতগুলো থমকে দাঁড়াতে শুরু করেছে। দেশে নতুন কর্মসংস্থানের হার শ্লথ হয়ে পড়ায় শিক্ষিত বেকারের হার বেড়ে চলেছে। তবে দেশের শিক্ষিত বেকারদের উপযুক্ত কর্মসংস্থান না হলেও ভারতের অর্থনৈতিক মন্দায় বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে লাখ লাখ ভারতীয়র কর্মসংস্থানের অন্যতম ক্ষেত্র। দেশের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরীসহ নানা খাতে ভারতীয় কর্মীর প্রকৃত সংখ্যা কোনো কর্তৃপক্ষের কাছেই নেই। কিছুদিন আগে সুপ্রিমকোর্টে এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বেপজা, এনজিও ব্যারোসহ সংশ্লিষ্ট অধিদফতরের কাছে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। বাংলাদেশে ভারতীয় কর্মীর সংখ্যা ৫ লাখ থেকে ২০ লাখ বলে নানা মাধ্যমে তথ্য পাওয়া গেলেও সঠিক পরিসংখ্যান না থাকায় তারা বাংলাদেশ থেকে কি পরিমাণ রেমিটেন্স নিয়ে যাচ্ছে তারও সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে না। ২০১৫ সালে প্রকাশিত সিপিডির এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ৫ লাখ ভারতীয় কাজ করছে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। গত ৫ বছরে তা অন্তত দ্বিগুণ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে গত রবিবার প্রকাশিত এক গবেষণা রিপোর্টে বাংলাদেশে কাজ করে ২-৩ লাখ ভারতীয় বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছে বলে দাবি করা হয়। সিপিডিসহ অন্যান্য উৎসের তথ্য সঠিক হলে এ সংখ্যাটি দ্বিগুণ হতে পারে। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি প্রবাসী যে রেমিটেন্স আয় করে তার অর্ধেকের বেশি ভারতীয়রা নিয়ে যায়। গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আইনজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশ থেকে বছরে ভারতীয়দের ৫ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স নিয়ে যাওয়ার বাস্তবতাকে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার চরম ব্যর্থতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। দেশে লাখ লাখ উচ্চশিক্ষিত বেকার কর্মসংস্থানের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরলেও অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত ভারতীয়রা বাংলাদেশে এসে বেশি বেতনের চাকরি নিয়ে আয়ের টাকা পুরোটাই দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এসব ভারতীয়দের বেশিরভাগই ভ্রমণ ভিসায় এসে ওয়ার্ক পারমিট ছাড়াই কাজ করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বিদেশে টাকা পাচার করছে। বছরে হাজার কোটি ডলারের রেমিটেন্স পাওয়ার উৎস বাংলাদেশকে ভারতের বিজেপি সরকার নানাভাবে শুধু অগ্রাহ্যই করছে না, তারা অহরহ উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে এ দেশের মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলছে। একবিংশ শতকের বিশ্ববাস্তবতায় একদিকে নদনদীর পানি, সমুদ্রসম্পদের অংশীদারিত্ব এবং আঞ্চলিক- আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি, বিনিয়োগ, বাণিজ্য, কর্মসংস্থান এবং পারস্পরিক কৌশলগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবিচ্ছেদ্য নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের প্রায় পুরোটাই ভারতের অনুকূলে। যৌথ নদীর পানি বণ্টন, সীমান্ত বাণিজ্য ও মাদক পাচারের মতো বিষয়গুলোর সাথে বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি, কৃষি ব্যবস্থা, খাদ্য নিরাপত্তাসহ সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতিকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের অনীহা অনিচ্ছার উপর সবকিছু নির্ভরশীল হতে পারে না। ভারত-বাংলাদেশের প্রধান নদী গঙ্গা-যমুনার মূল উৎস হিমালয়ের তিব্বত অংশে যার নিয়ন্ত্রণ চীনের হাতে। ব্রহ্মপুত্রের উৎসমুখে চীন বিশালাকার ড্যাম নির্মাণ করে জলবিদ্যুত ও পানি প্রত্যাহারের (ইয়ারলং সাংবো) প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে বলে কয়েক বছর আগে রিপোর্ট বেরিয়েছিল। গঙ্গা-তিস্তার উপর ভারতের বাঁধ নির্মাণের ফলে বাংলাদেশে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। উজানে চীনের ড্যাম নির্মাণের ফলে ভারতেও অনুরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। রাজনৈতিক কারণে দেশভাগ ও মানচিত্র বদল হলেও নদী, পাহাড় ও উপত্যকারও একটি নিজস্ব ভূ-প্রাকৃতিক মানচিত্র আছে। রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সার্বভৌম শক্তি যৌথ নদীকে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে তার প্রতিক্রিয়া পুরো অঞ্চলকেই গ্রাস করে। উজানে পানি প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে ভারত বা চীন নদীর হাজার বছরের গতি প্রবাহকে নিজেদের ইচ্ছামত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে মানব সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয় পুরো অঞ্চলের জন্যই বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। একদেশদর্শি চিন্তা ও রাজনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্রিক স্বার্থপরতার দিন শেষ। জলবায়ুর পরিবর্তন ও বিশ্বরাজনৈতিক পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল ও সম্ভাবনা জেগে উঠেছে। উপমহাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক বাস্তবতায় চীন-ভারতসহ দেশগুলোর মধ্যে বৈরিতা বা আধিপত্যের সুযোগ নেই। আগামী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ দেশ গড়তে আমাদেরকে এখন ক্লাইমেট চেঞ্জ, নদনদীর পানি, উপকূলীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় যুগোপযোগী অর্থনৈতিক ডিপ্লোম্যাটিক চ্যানেল গড়ে তুলতে হবে। অববাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে দেশগুলোকে সমন্বিত যুগোপযোগীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।