Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আয়না

তাহমিনা কোরাইশী | প্রকাশের সময় : ২৩ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

মায়ের চেচামেচিতেও সম্বিৎ ফেরে না সুন্দরীর। প্রতিদিন আয়নার সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করে। সুন্দরীকে সবাই আয়না বানু বলে ডাকতেই পছন্দ করে বেশী। সুন্দরী যখন জন্মেছিল তখন চাঁদের আলো মাখামাখিতে পূর্ণ ছিল ঘরটি। মা-বাবা আত্মীয় স্বজনদের আনন্দের সীমা ছিল না। সবাই বলেছে মেয়ে হয়েছে তাতে কি রূপ দেখ রূপ একেবারে সাক্ষাৎ দেবী দূর্গা প্রতিমা। বিয়ে থা দিতে বেগ পেতে হবে না। কাড়িকাড়ি টাকাও ঢালতে হবে না।
সেই সুন্দরী আহ্লাদে আটখানা হয়েই থাকলো। দিন দিন যত বড় হচ্ছে ততই আয়না প্রীতি বাড়ছে। জোকের মত আয়নার সাথে লেগেই আছে। আর লেখা পড়া শিকায় তুলে রাখতেই পছন্দ। তবুও বাবা মায়ের ইচ্ছেতে স্কুলে যাওয়া আসা। বিনা বেতনে লেখাপড়া তার ওপর উপড়ি পাওয়া সরকারী টাকা। এ কি হাতছাড়া করা যায়? গাইটের টাকা খরচ করে এই বোঝা টানতো কেন? লেখাপড়া করে মেয়ে মানুষ কি জজ-ব্যরিষ্টার হবে? একটা চাকরীও পাবে না। গরীবের ঘরে মেয়ে এটুকু বিদ্যা দিয়ে ভাঙ্গা কপাল জোড়া লাগে না। গরীবের ঘোড়া রোগে সমস্যা।
তবুও সুন্দরী যায় নিত্যই স্কুলে। রূপের আলো ছড়াতে ছড়াতে। সে বোঝে তার রূপে মুগ্ধ হয়ে পাড়ার ছাওয়াল পাওয়ালরা পাগলের মত লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সে কাউকেই পাত্তা দেয় না। মতি, মনা, আব্বাস, করিম, আলিম কেউ ওর পিছু ছাড়ে না। সুন্দরী ভাবে আমি কি যা তা একেবারে আগুনের হাতা। ওর মনের মাঝে সুপ্ত বাসনায় আসছে রাজপুত্র ঘোড়ায় পিঠে সওয়ার হয়ে। কিন্তু বাস্তবে আসে কই! বিয়ের প্রস্তাব আসে। চাষ আবাদ করে খায়। আছে ধানি জমি। সুন্দরীর বাবা-মা ওতেই খুশি। দু’বেলা পেঠ ভরে খেতে পারবে তো তার মেয়ে। সুন্দরী কিছুতেই রাজি হয় না। লেখাপড়া করবে সে। লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। মানে টাইমপাস করা এরই মধ্যে যদি এসে হাজির হয় তার স্বপ্নের রাজপুত্র। দেখতে দেখতে এইট পাশ দিয়ে ফেলে সুন্দরী।
স্কুল থেকে ফেরার পথে হঠাৎ করেই ওর নজর কাড়ে ঐ ছেলেটা অবশ্য ঘোড়ার পিঠে সাওয়ার হয়ে নয়। হোন্ডার পিঠে বসেই তার সামনে এসে হোন্ডার ব্রেক চাপে। রমিজের দৃষ্টিতে সুন্দরী মোমের মত গলে যায়। রমিজের দৃষ্টি একেবারে অন্ধ হবার উপক্রম। ধুতরার নেশা জাগে রমিজের। বশিকরণ যখন দু’জন দু’জনকে করে ফেলেছে তবে আর দেরি কই হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়াতে। সুন্দরীকে নিয়ে পঙ্খিরাজ হোন্ডার পিছনে বসিয়ে নিত্য চলে কাশবন বিহার, নদীপাড়, ঝোপঝাড়। মাকড়শা তার জালে যেমন শিকার ধরার ফাঁদ পাতে ধীরে ধীরে আটকে ফেলে নিরীহ পোকাটি বোঝার আগে। তেমনি ভাবে সুন্দরীও আটকে যায় রমিজের পাতা ফাঁদে। রমিজ গ্রাম মাতব্বরের ছেলে যদিও শহরে থকে। লম্পট তার চারিত্রিক গুণ। একদিন সুন্দরীকে নিয়ে যায় পোড়ো জরার্জিণী বাড়িতে। সুন্দরী ভালোবাসা শব্দটির মানে বোঝার আগেই শিকরী নেকড়ের থাবায় পড়ে যায়। সুন্দরীর স্বপ্ন চুরচুর হয়ে যায় ওর আর্তনাদে ভাঙ্গা বাড়ির পলেস্তারা ঝুরঝুর করে পড়ে যায়। রমিজের বিভৎস এক অট্টহাসিতে পোড়ো বাড়ির নিরীহ প্রাণীরাও ভয়ে ছুটোছুটি করে। সুন্দরী ঠায় বসে থাকে লজ্জা ঘৃণায় আজ সে বোবা পাথুরে মূর্তি। স্বপ্নের ঘোর যায় কেটে। গ্রহণলাগা এই মুহুর্তে সুন্দরীর মুখ অবয়ব বিষন্নতায় ছেয়ে যায়। ধর্ষিতা সুন্দরী আজ বাড়ি যাবার রাস্তা ভুলে যায়।
গুড বাই বলে চির বিদায় নেয় রমিজ। ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকে সুন্দরী। ওঠে আস্তে আস্তে, হাঁটতে হাঁটতে জলের কাছে যায় সুন্দরী। জল আয়নায় আর ওর নিজের চেহারা দেখা যায় না। কেবল দেখা যায় একটি বিশাল আজদাহা। অবশেষে একদিন আয়না সুন্দরীর দেহটি ভেসে ওঠে ঐ নদীর জলে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আয়না

২৩ আগস্ট, ২০১৯
২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

আরও
আরও পড়ুন