Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের অপরাধে হুলিয়া মাথায় নিয়ে কয়েক মাস কাটালেও পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

ছাত্র থাকা অবস্থাতেই আমি পাকিস্তান আন্দোলন ও ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্পদিনের মধ্যেই নতুন এ স্বাধীন রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক ভিত্তি জোরদার করার লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের তরুণ শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেমের উদ্যোগে ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামের একটি সাংষ্কৃতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এ পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় নতুন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা।
রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তি মাত্রই জানেন যে, ১৯০ বছরের সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের পরাধীনতা থেকে উপমহাদেশ মুক্তি পায় অবিভক্ত হিসাবে নয়, ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি স্বতন্ত্র, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে। এর মধ্যে স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষা যে হিন্দী হবে সে সম্পর্কে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতারা পূর্বাহ্নেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে সে সম্পর্কে কোন আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পূর্বেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়ে যাওয়ায় এ সমস্যা অমীমাংসিতই থেকে যায়।
১৯৪৭ সালে স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের প্রাক্কালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করার সুপারিশ করেন। এর বিরুদ্ধে বহু তথ্য ও তত্ত¡ সহকারে জোরালো প্রতিবাদ জানান বহু ভাষাবিদ পন্ডিত ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। আরও অনেক কবি-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী এ বিষয়ে লেখালেখি করেন। তবে এ প্রশ্নে আনুষ্ঠানিক আন্দোলন শুরু করেন উপরে উল্লেখিত সাংস্কৃতিক সংস্থা তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাসেম।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে কোন আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে অবাঙ্গালী উচ্চপদস্থ উর্দুভাষীদের বিপুল সংখ্যাধিক্যের সুযোগে তারা উর্দুকে এক মাত্র রাষ্ট্রভাষা ধরে নিয়ে পোস্টকার্ড, পোস্টাল এনভেলাপ, মানি অর্ডার ফর্ম ইত্যাদিতে ইংরেজ আমলের ধারাবাহিকতায় ইংরেজীর পাশাপাশি শুধু উর্দু ভাষার ব্যবহার শুরু করে দেন। এই পূর্ব প্রেক্ষপটেই পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজের মধ্যেও উর্দুভাষী অফিসারদের বাংলা বিরোধী মনোভাব ধরা পড়ে যায়। এর প্রতিবাদেই তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা, না উর্দু” শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশের মাধ্যমে শুরু হয়ে যায় ঐহিহাসিক ভাষা আন্দোলন।
অধ্যাপক আবুল কাসেম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার স্বপক্ষে শুধু পুস্তিকা প্রকাশ করেই বসে থাকেননি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে ছাত্র ও শিক্ষকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলোচনা ছাড়াও বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে সভা শুরু করে দেন। এই সব সভায় কোন কোনটিতে তিনি নিজে সভাপতিত্ব করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের পাশাপাশি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ফজলুল হক মুসলিম হল মিলনায়তনেও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে সভা শুরু হয়।
১৯৪৭ সালের মধ্যেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে আন্দোলন পরিচালনার উদ্দেশ্যে বিশ^বিদ্যালয়ের রসায়ণ বিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক নুরুল হক ভুঁইয়াকে কনভেনর করে তমদ্দুন মজলিস একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। ইতোমধ্যে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারী পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক ছাত্রদের উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ নামে একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের সূচিত ভাষা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দান করে যেতে থাকে। ছাত্র লীগের প্রতিষ্ঠার পর তমদ্দুন মজলিস ও ছাত্র লীগের যুগপৎ সদস্য শামসুল আলমকে কনভেনর করে সংগ্রাম পরিষদ পুর্নগঠিত করা হয়।
এ সময়ে করাচীতে অনুষ্ঠানরত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে কংগ্রেস দলীয় সদস্য বাবু ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত ইংরেজী ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও বক্তৃতা দানের অনুমতি দাবী করলে তা প্রত্যাখ্যাত হয়। এই প্রত্যাখানের বিরুদ্ধে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ হরতাল পালিত হয়। এটাই ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম হরতাল। রেলওয়ে কর্মচারী লীগের নেতাদের সাথে তমদ্দুন মজলিসের সুসম্পর্ক থাকায় ঐদিন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে কোন ট্রেন রওনা হতেই পারেনি।
ঢাকার পরিস্থিতি ছিল আরও ভয়াবহ। সকাল থেকেই ঢাকা সেক্রেটারিয়েটের চার দিকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে পিকেটারদের অবস্থান গ্রহণের কারণে অনেক সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী সেদিন অফিস করতে সেক্রেটারিয়েটে প্রবেশ করতেই সক্ষম হননি। সে সময় বর্তমানের মত সেক্রেটারিয়েটের চারদিকে পাকা দেয়াল ছিল না। ছিল কাঁটা তারের বেড়া। কাঁটা তারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে অনেক পিকেটার ভেতরে প্রবেশ করে সচিব ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করলে সরকারী পদে ইস্তফা দানের ওয়াদা নিয়ে আসেন।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে পিকেটিংরত ভাষা সৈনিকদের সেক্রেটারিয়েটের নিকট থেকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ একাধিকবার লাঠিচার্জ করে। অনেক পিকেটারকে গ্রেপ্তারও করা হয়। এ সব খবর শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। কিছুক্ষণের মধ্যে শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা বিক্ষোভ প্রদর্শনরত মানুষের ভীড়ে সমগ্র সেক্রেটারিয়েট এলাকা বিক্ষুদ্ধ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। এর প্রভাবে সমগ্র রাজধানী নগরীতেই অরাজক অবস্থা সৃষ্টি হয়। এই অবস্থা চলতে থাকে ১১ মার্চ থেকে শুরু করে ১২, ১৩, ১৪, ১৫ মার্চ পর্যন্ত।
এতে ভয় পেয়ে যান পূর্ববঙ্গের তদানীন্তন চীফ মিনিস্টার খাজা নাজিমুদ্দিন। কারণ কয়েকদিনের মধ্যে কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা সফরে আসার কথা। তিনি যদি ঢাকা এসে ঢাকার এই অরাজক পরিস্থিতি দেখেন খাজা নাজিমুদ্দিনের প্রতি তাঁর খুশী থাকার কথা নয়। এ কারণে খাজা নাজিমুদ্দিন নিজে উদ্যোগ নিয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের সকল দাবী দাওয়া মেনে নিয়ে তাদের সাথে চুক্তিস্বাক্ষর করেন।
চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হয়ে আসে। এরপর ১৯ মার্চ কায়েদে আজম ঢাকা আসেন। তিনি ঢাকায় এসে রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় এবং কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন উৎসবে বক্তৃতা করেন। উভয় স্থানে তিনি উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার স্বপক্ষে বক্তব্য দান করেন। উভয় স্থানেই তাঁর এ বক্তব্যের প্রতিবাদ হয়।
রেস কোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় কে বা কারা কোন্ দিক থেকে তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ করে তা তিনি খেয়াল না করতে পারলেও কার্জন হলের সীমিত উপস্থিতিতে তাঁর বক্তব্যের বিরুদ্ধে ছাত্রদের প্রতিবাদে তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। ভাবেন যে তরুণ ছাত্ররা এই সেদিন তাঁর আহ্বানে পাকিস্তান আন্দোলনে যে কোন ঝুঁকি নিয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা এমনভাবে বদলে গেলো কি করে? তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বক্তৃতা সংক্ষেপ করে সভাস্থল ত্যাগ করেন। এর পর তিনি ছাত্র নেতাদের সাথে ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হন। কিন্তু উভয় পক্ষ যার যার বক্তব্যে অটল থাকায় বৈঠক ব্যর্থ হয়। তবে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়। ঐ বছরে (১৯৪৮ সালে) ১১ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে তিনি প্রকাশ্যে আর কোন বক্তব্য দান করেননি। শুধু তাই নয়। মৃত্যু শয্যায় তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক কর্ণেল এলাহি বখশের সঙ্গে আলাপচারিতা কালে তিনি একাধিকবার বলেন, আমি জীবনে অন্যের কথায় বিশ্বাস করে বেশ কয়েকটা ভুল করেছি। এর একটা ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে। বিষয়টি গণপরিষদের উপর আমার ছেড়ে দেয়া উচিৎ ছিল।
বিশ্বস্থ সূত্রে জানা যায় ‘অন্যের কথায় বিশ্বাস করা’ বলতে তিনি খাজা নাজিমুদ্দিনের কথা বুঝিয়েছিলেন। নাজিমুদ্দিন নিজে পারিবারিকভাবে উর্দুভাষী ছিলেন এবং মনে করতেন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উর্দু বোঝে। এই ধারণার বশবর্তী হয়েই তিনি ১৯৫২ সালের জানুয়ারী মাসে পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী হিসাবে ঢাকায় এসে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্রভাষা ইস্যুকে নতুন করে পুনর্জীবিত করেন।
এই ঘটনা থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় ১৯৪৮ সালে তিনি যে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের দাবী দাওয়া মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন, এ ব্যাপারে তিনি আন্তরিক ছিলেন না। তিনি শুধু কায়েদে আজমের ঢাকা সফর মাথায় রেখে পরিস্থিতি শান্ত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের দাবী দাওয়া মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে খাজা নাজিমুদ্দিনের আন্তরিকতার অভাবের কারণেই ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা ইস্যুতে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা শহীদদের বুকের তাজা রক্ত ঢালতে হয় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে।
আজকের এ লেখা শেষ করার আগে বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনকালের কিছু বিচিত্র অভিজ্ঞতা সংক্ষেপে তুলে ধরতে চাই। ১৯৫২ সালের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে আমি ও অধ্যাপক আবুল কাসেম ছিলাম তমদ্দুন মজলিসের প্রতিনিধি। তমদ্দুন মজলিসের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক ছিল ভাষা আন্দোলনের অঘোষিত মুখপত্র। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে একুশে ফেব্রুয়ারীর রক্তাক্ত ঘটনাবলীকে নিয়ে পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারী সাপ্তাহিক সৈনিক লাল রঙ্গের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সাপ্তাহিক সৈনিক-এর সকল কপি ফুরিয়ে যায়। সমগ্র ঢাকা শহরের মানুষ যেন ভেঙ্গে পড়েছিল ১৯ নম্বর আজিমপুর রোডস্থ সাপ্তাহিক সৈনিক অফিসে। ফলে ভাষা আন্দোলনের সর্বশেষ খবর নিয়ে সাপ্তাহিক সৈনিক এর নতুন সংস্করণ ছাপতে হল। এ অবস্থা চলতে থাকে ২২ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত। সৈনিক পত্রিকার নিত্য নতুন সংস্করণ প্রকাশ ও পুন:প্রকাশ যতই এগিয়ে যেতে থাকে, ততই অন্যান্য ভাষা সৈনিকদের মত আমার ও অধ্যাপক আবুল কাসেমের গ্রেপ্তারের আশংকা দেখা দেয়। আমরা এই প্রেক্ষাপটে সিদ্ধান্ত নেই, পরিস্থিতি যে পর্যায়েই যাক, আমরা ধরা দেব না।
অবশেষে এলো সেই চরম মুহূর্ত। ২৩ ফেব্রুয়ারী দিবাগত রাত তিনটার দিকে পুলিশ এসে হানা দিলো তমদ্দুন মজলিসের ১৯ নং আজিমপুর রোডস্থ অফিসের গেটে। আমাদের সিদ্ধান্ত আগেই ঠিক করা ছিল। তার প্রেক্ষাপটে অধ্যাপক আবুল কাসেমের স্ত্রী বেগম রাহেলা কাসেম ছুটে গেলেন গেটের দিকে। গেটের ভেতর থেকে দাঁড়িয়ে পুলিশের উপস্থিতির প্রতিবাদ করে তিনি বলেন, এত রাতে একটা ফ্যামিলি কোয়ার্টারে আসা আপনাদের ঠিক হয়নি। আপনারা ভোরে এসে যা বলার বলবেন। এভাবে পুলিশের সাথে বেগম রাহেলা কাসেমের তর্কাতর্কির সুযোগে আমরা ঐ বাড়ীর পেছন দিয়ে সরে পড়তে সক্ষম হই। সরে পড়ে আমি আমার পুরাতন জায়গীর বাড়ী যেয়ে আত্মগোপন করি। আবুল কাসেম সাহেবও আমার জায়গীর বাড়ীর অদূরে অরেকটা পরিচিত বাড়ীতে আত্মগোপন করেন। এরপর দিন আমরা পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক তেজগাঁও এক পরিচিত বাড়ীতে এক রাত কাটিয়ে তেজগাঁ স্টেশন গিয়ে ট্রেনে উঠি। পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক ঐ ট্রেনে ওঠেন অধ্যাপক কাসেমের স্ত্রী ও তার দুই ছেলে। জামালপুরের দাগী স্টেশনে নেমে সেখান থেকে সাইকেল যোগে আমরা চলে যাই কাসেম সাহেবের শ্বশুর বাড়ী।
সেখানে দুই সপ্তাহ আত্মগোপন করে থাকার পর গোপন সূত্রে জানতে পারি যে কাসেম সাহেবের শ্বশুরবাড়ীতে আমাদের অবস্থান করার নিকটস্থ খবর থানায় পৌছে গেছে। সুতরাং আবার আবাসস্থল পরিবর্তন। তবে এবার আর দুজনে এক সাথে নয়। কাসেম সাহেব জামালপুর থেকে চট্টগ্রামের দিকে। আর আমি চলে গেলাম জগন্নাথগঞ্জ ঘাট সিরাজগঞ্জ ঈশ্বরদী হয়ে কুষ্টিয়ায়। কুষ্টিয়ায় গিয়ে হাইরোডের পাশে অবস্থিত সাবেক মন্ত্রী শামসুদ্দিন আহমদের ভাই ডাক্তার সদরুদ্দিন আহমদের বাসায় উঠলাম। সেখানে তাঁর ডিসপেনসারীর এক রুমে কঠিন টিবি রোগী ঘোষণা করে আমাকে আটকে রাখা হল। কিন্তু সেটাও পুলিশের কাছে জানাজানি হয়ে যাওয়ায় আমাকে সেখান নিয়ে যাওয়া হল ব্যারিস্টার (পরে মন্ত্রী) আবদুল হকের গ্রামের বাড়ীতে। ভেড়ামারা রেলস্টেশন থেকে অনেক দূরে অবস্থিত এই বাড়ীতে প্রায় এক মাস অবস্থানের পর জানা গেল, ভাষা আন্দোলনের বন্দীদের ছেড়ে দেওয়া শুরু হয়েছে এবং এই আন্দোলনে অংশগ্রহণের অপরাধে আর কাউকে নতুন করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। আরও পরে জানা গেল ভাষা আন্দোলনে বন্দীদেরকে ছেড়ে দেয়া শুরু হয়েছে। এটা জানার পর ঢাকায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম।
ঢাকায় ফিরে এসে দেখলাম ঢাকার পরিস্থিতি প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। সংগ্রাম পরিষদ নতুন করে পুনগঠিত হয়েছে এডভোকেট আতাউর রহমান খানকে কনভেনর করে। সর্বশেষ পরিস্থিতি জানার উদ্দেশ্যে চকবাজার সোয়ারীঘাট লেনে গিয়ে দেখা করলাম আতাউর রহমান খানের সঙ্গে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মাতৃভাষা

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন