Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা

মুহাম্মদ আবদুল হামিদ | প্রকাশের সময় : ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

পরম দয়ালু আল্লাহ তা’লা সৃষ্টি করেছেন মানুষ। মানের ভাব প্রকাশের জন্য মানুষকে দান করেছেন ভাষা। ভাষার মাধ্যমে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। মানবজাতির জন্য মাতৃভাষা খোদা প্রদত্ত সেরা দান, এক মহা নেয়ামত। আল্লাহ তা’লা ইরশাদ করেছেন, ‘পরম করুণাময় আল্লাহ, তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন, সৃষ্টি করেছেন মানুষ, শিক্ষা দিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে।’ (সুরা রাহমান) এই আয়াতে ভাব প্রকাশ বলতে প্রত্যেক ব্যক্তির মাতৃভাষাকে বুঝানো হয়েছে, যা বিশেষ শিক্ষা গ্রহণ ছাড়াই প্রত্যেক ব্যক্তি নিজে নিজেই বলতে পারে এবং নিজের মনের ভাবকে প্রকাশ করতে পারে।
পৃথিবীর সকল প্রাণীরই নিজস্ব ভাষা আছে। সকল প্রাণীই তার মনের ভাব প্রকাশের জন্য ধ্বনি বা আওয়াজ দিয়ে থাকে। অন্যান্য প্রাণীর মুখ-নিঃসৃত শব্দ অর্থাৎ- তাদের মুখের ভাষা আমরা বুঝতে পারি না। তারা নিজেরা পর¯পরের ভাষা বুঝতে পারে। ভাষা মনের ভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যম। একমাত্র মানুষই অর্থবোধক ধ্বনি দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশের জন্য যে ধ্বনি ব্যবহার করে তার নামই ভাষা। পৃথিবীর একেক স্থানের মানুষের মনের ভাব প্রকাশের ভাষা একেক রকম। বাংলা, আরবি, ফার্সি, উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি, তুর্কি ইত্যাদি ভাষায় মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করে। আল্লাহ তা’লা তার কুদরত প্রদর্শনের জন্যই বৈচিত্রময় সুন্দর এই পৃথিবী, বিভিন্ন বর্ণে-গোত্রে বিভক্ত মানুষ ও ভাষার সৃষ্টি করেছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘এবং তাঁর (আল্লাহর কুদরতের) নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশমন্ডলী ও যমীনের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা রুম- ২২) আল্লাহ তা’লা মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের অন্যত্র ইরশাদ করেছেন, ‘আমি কোনো নবীই এমন পাঠাইনি, যে তাঁর (মাতৃ)-ভাষায় (আমার বাণী মানুষের কাছে পৌছায়নি), যাতে করে সে তাদের কাছে (আমার আয়াত) স্পষ্ট করে দিতে পারে।’ (সূরা ইব্রাহীম- ৪)
মাতৃভাষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ এই আয়াত দ্বারা স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয় যে, স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পৃথিবীতে যত নবী প্রেরণ করেছেন সবাইকে স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছেন, যাতে তাঁরা মানুষকে আল্লাহর বিধান সহজভাবে বুঝাতে পারেন এবং মানুষও আল্লাহর বিধানকে সঠিকভাবে সহজে বুঝতে পারে।
রাসুল (সা.)-এর মাতৃভাষা আরবি। এজন্যেই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কুরআনের ভাষা হিসেবে মনোনীত করেছেন আরবিকে। যেন আরব সমাজের প্রতিটি মানুষ কুরআনের বাণী অতি সহজেই অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে নবী! কুরআনকে আমি তোমার নিজের ভাষায় সহজ করে অবতীর্ণ করেছি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে।’ (সূরা আদ-দোখান- ৫৮) মহানবী (সা.) নিজের মাতৃভাষা আরবিকে এত বেশি ভালোবাসতেন যে, তিনি বলেছেন, ‘আমি তিনটি কারণে আরবিকে ভালোবাসি। তন্মধ্যে একটি হল, মাতৃভাষার কারণে।’ মহানবী (সা.) ছিলেন স্বীয় মাতৃভাষায় অতুলনীয়। তিনি মাতৃভাষা শুদ্ধ এবং সু¯পষ্টভাবে উচ্চারণ করতেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাকে দান করা হয়েছে সর্বমর্মী বচন।’ (মুসলিম- ৫২৩)
আমরা বাঙ্গালি। বাংলায় আমাদের মনের ভাব প্রকাশ করি তাই আমাদের ভাষার নাম বাংলা ভাষা। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা আজ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা। পৃথিবীর প্রায় ছয় সহস্রাধিক ভাষার মধ্যে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার স্থান ষষ্ঠ। আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে ভালোবাসি। ভাষার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি, সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ স্বীকার করেছি, যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ও অনন্য ঘটনা।
ফেব্রুয়ারি মাস। এই মাসটি আমাদের কাছে ভাষার মাস হিসেবে পরিচিত। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এক রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা পেয়েছি মাতৃভাষার মর্যাদা। সেই দিনের আন্দোলনে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবীসহ সকল স্তরের অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছেন, জুলুম-অত্যাচার সহ্য করেছেন, কারাবরণ করেছেন অনেকে। সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার-সহ নাম না জানা অনেকে এ মাসেই ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে বাঙ্গালি জাতি ভাষার প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা প্রদর্শনের এমন এক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছিল যেমনটা বিশ্বের আর কোথাও খুজে পাওয়া বিরল। বাঙ্গালি জাতির স্বাধিকার ও সংস্কৃতি রক্ষার ইতিহাসে এ আন্দোলন ‘মহান ভাষা আন্দোলন’ নামে খ্যাত। আমাদের মাতৃভাষা ও ভাষা আন্দোলন নিয়ে কবি সাহিত্যিকরা হৃদয়ের শুভ্রতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বহু কাব্য রচনা করেছেন। তাইতো ফেব্রুয়ারি মাস এলেই বাঙ্গালির মুখে মখে ধ্বনিত হয়, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’
আমাদের গৌরব গাঁথা এই ইতিহাসটিকে শুধু আমরা নই, বিশ্ববাসীও যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করে। ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ ইউনেস্কোর ৩০তম অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ইউনেস্কোর এ অধিবেশনে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে বলা হয়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভাষা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। মাতৃভাষার প্রচলন কেবলমাত্র ভাষাগত বৈচিত্র্য, বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষাকেই উৎসারিত করে না, তা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনুধাবন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রেও অবদান রাখবে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য হলো প্রতিটি মাতৃভাষাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া, বিশেষ করে দুর্বল ও জীর্ণ মাতৃভাষাগুলিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা, দুর্বল বলে কোনো ভাষার ওপর প্রভুত্ব আরোপের অপচেষ্টা না করা। এ দিবসে প্রত্যেক ভাষাভাষী মানুষ নিজের মাতৃভাষাকে যেমন ভালোবাসবে তেমনি অন্য জাতির মাতৃভাষাকেও মর্যাদা দেবে। এভাবে একুশকে ধারণ করে মাতৃভাষাকে ভালোবাসার প্রেরণা পাবে মানুষ।
২১ ফেব্রুয়ারি ২০০০ থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর অনেকেই যথাযথ মর্যাদায় পালন করছে। প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি আমরা হৃদয়ের সমস্ত শুভ্রতা উৎসারিত করে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি আমাদের ভাষা শহীদদের। মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় সেই দিনে বাঙ্গালিদের আত্মত্যাগ যথার্থই অতুলনীয়। আমরা গর্বিত জাতি। আমরা গর্বিত আমাদের মাতৃভাষার জন্য। শহীদরা আমাদের পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বের সম্মানজনক স্থানে। সার্থক হয়েছে তাঁদের রক্তদান। তাই, মহান ভাষা আন্দোলনের সৈনিকদের শ্রদ্ধা জানাই এবং এতে যারা শহিদ হয়েছেন তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শনের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী আয়োজন করা হয় বই মেলা। লেখক-পাঠকদের মহা সম্মেলনে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। বাংলা ভাষায় রচিত কাব্য, নিবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে দেশের বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক, লেখক, গবেষকদের রচিত নতুন নতুন বই মেলায় নিয়ে আসা হয়। এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশ মুসলিম রাষ্ট্র। একুশের বই মেলায় ইসলামী বই অপর্যাপ্ত। এদেশে ইসলামী ভাবধারার অসংখ্য লেখক-পাঠক রয়েছেন, যারা বাংলা সাহিত্যে অনেক বই পুস্তক লেখেন এবং পড়েন। একুশের বই মেলায় ইসলামী ভাবধারার বই বেশি বেশি নিয়ে আসতে হবে। শুধুমাত্র ফেব্রুয়ারিতে নয়, সারা বছর সর্বত্র মাতৃভাষার চর্চা বাড়াতে হবে। মাতৃভাষার শুদ্ধ উচ্চারণ ও শুদ্ধ বানানের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমরা দেখতে পাই, বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও এফএম রেডিওকে অনুসরণ করে অনেকে জগাখিচুড়ির মত ভিন্ন ভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণে কথা বলে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে ইংরেজিকে প্রধান্য দেয়া হচ্ছে। এসব বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে অন্য কোনো ভাষার আকর্ষণে মাতৃভাষার আকর্ষণ কমে না যায়। অন্য ভাষা যতই সহজ হোক না কেন, মাতৃভাষা ছাড়া মনের ভাব উত্তমরূপে আর কোনো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। তাইতো কবি বলেন, ‘নানান দেশের নানান ভাষা/ বিনা স্বদেশী ভাষা, মিটে কি আশা।’
মহান প্রভূর দরবারে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি এই জন্য যে, তিনি তাঁর অপার মহিমায় আমাদেরকে মাতৃভাষা দান করেছেন, যার দ্বারা আমরা পরস্পরের কাছে সহজেই মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি। অমৃত সুধায় ভরা মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা সম্পর্কে কবির ভাষায় বলা যায়, ‘মধুর চেয়েও আছে মধুর, সে যে আমার মাতৃভাষা। মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা।’
মানুষের যতগুলো জন্মগত অধিকার রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভাষা। মায়ের সঙ্গে যেমন সন্তানের সম্পর্ক গভীর, মাতৃভাষার সঙ্গে মানুষের সম্পর্কও তেমনি গভীর। এজন্যেই কোনো বাংলাভাষী মায়ের সন্তান ইংরেজি বা ভিন্ন কোনো ভাষায় কথা বলতে শেখে না। মা যে ভাষায় কথা বলেন, কোলের শিশুও সেই ভাষায়ই কথা বলতে শেখে। মানুষের অস্তিত্বের প্রধান তিনটি অবলম্বন হচ্ছে মা, মাতৃভাষা আর মাতৃভ‚মি। ডক্টর শহীদুল্লাহ বলেছেন, ‘মাতৃভাষা মাতৃস্তন্যের ন্যায়। প্রত্যেক জাতির তিনটি করে মা থাকে। একটি জন্মধাত্রী মা, একটি মাতৃভাষা, আরেকটি হচ্ছে মাতৃভূমি।’ আমরা মাকে ভালোবাসি। ভালোবাসি মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকে। এগুলোর প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন করা প্রতিটি মানুষের জন্য অপরিহার্য।
লেখক: নিবন্ধকার



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মাতৃভাষা

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন