পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশের প্রশংসা করেছেন। ৭ নভেম্বর গণভবনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে দ্বিতীয় দফা বৈঠকের শুরুতেই তিনি ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশ ভালো হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। খবরটি চাউর হওয়ার পর রাজনৈতিক সচেতন মহলে সৃষ্টি হয়েছে নানা গুঞ্জন। অনেকেই প্রধানমন্ত্রীর এহেন মন্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। কেননা, যেখানে সরকার বিরোধী দলকে সভা-সমাবেশ করতে দিতে চায় না, সেখানে সরকারবিরোধী একটি বিশাল সমাবেশকে প্রধানমন্ত্রী ‘ভালো হয়েছে’ বলে প্রশংসা করবেন তা যেন কারো বিশ্বাস হতে চাচ্ছে না। আর অবিশ্বাসের কারণটিও অজানা নয় কারো। আমাদের দেশে সরকারের ভালো কাজের যেমন বিরোধী দল প্রশংসা বা সমর্থন করে না, তেমনি বিরোধী দলের গঠনমূলক সমালোচনাও সরকার সহ্য করতে পারে না। যদিও এসবই গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিপন্থী, তবে এটাই আমাদের দেশের বাস্তবতা। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে পরস্পর প্রতিদ্ব›দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে সম্প্রীতি-সৌহার্দ্য বিদ্যমান থাকার কথা, আমাদের দেশে তার অনুপস্থিতি অত্যন্ত প্রকট। এখানে এক দল আরেক দলকে প্রতিদ্ব›দ্বী না ভেবে শত্রæ হিসেবে বিবেচনা করে। রাজনীতি দিয়ে পরাজিত না করে পেশিশক্তির দ্বারা নিশ্চিহ্ন করে ফেলার জিঘাংসা পোষণ করে। দলগুলো মুখে ‘জনগণই ক্ষমতার উৎস’ বলে, কিন্তু নির্ভর করতে চায় রংবাজ-মাস্তানের ওপর। ব্যালটের ওপর ভোটারদের সিলের চেয়ে সন্ত্রাসীদের দ্বারা কেন্দ্র দখল করে বাক্স ভরাকে অগ্রাধিকার দিতে চায়। ফলে রাজনীতি এখানে প্রায়শই হয়ে উঠে সংঘাতময়। হানাহানি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা গ্রাস করে রাজনৈতিক অঙ্গনকে। আর সেজন্যই সাধারণ মানুষ রাজনীতির প্রতি আগ্রহ-উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। নির্বাচন এলে ভোট দেয়ার আনন্দের চেয়ে ভোট দিতে পারব কিনা, সন্ত্রাসীদের হাতে জীবন দিতে হয় কিনা-এসব ভেবে তাদের উদ্বিগ্ন হতে দেখা যায়।
গত কয়েক বছর ধরে বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে পারছিল না। অজ্ঞাত কারণে সরকার দলটিকে সেখানে সমাবেশ করতে দেয়নি। গত সেপ্টেম্বর মাসে একটি সমাবেশ করার অনুমতি অবশ্য বিএনপি পেয়েছিল, তবে সেজন্য সরকারের দেওয়া ২২টি শর্ত তাকে মেনে নিতে হয়েছিল। এছাড়া বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় নয়াপল্টনের সামনের রাস্তায়ও অনেকবার সমাবেশের অনুমতি দেয়নি পুলিশ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বড় একটি সমাবেশ করলেই বোধকরি সরকারের গদী উল্টে যাবে। অথচ সভা-সমাবেশ করা রাজনৈতিক দলের সাংবিধানিক অধিকার। এসব নিয়ে আলোচনা সমালোচনা অনেক হয়েছে। কিন্তু সরকারের মনোভাবের কোনো পরিবর্তন হয়নি। গত ১ নভেম্বর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টর সঙ্গে সরকার পক্ষের বৈঠকের পরই সরকারের মনোভাবে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নিশ্চয়তা দেয় যে, এখন থেকে সভা-সমাবেশে কোনো বাধা দেওয়া হবে না। যদিও বিষয়টি দাবির প্রশ্ন ছিল না। এটা চাওয়া-পাওয়ার বিষয়ও নয়। কেননা সংবিধানের ৩৭ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, এটা দেশের যে কোনো নাগরিকের অধিকারের মধ্যে পড়ে। বলা যায়, সরকার এতদিন তা খর্ব করে আসছিল, এখন সে অগণতান্ত্রিক অবস্থান থেকে একটু সরে এসেছে।
লক্ষ্যযোগ্য বিষয় হলো, সমাবেশ হয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে এবং সেখানে উপস্থিত পঁচানব্বই ভাগ লোকই ছিল বিএনপির। ঐক্যফ্রন্টের অপরাপর শরিক দলগুলোর নেতাকর্মী সমর্থকের সংখ্যা ছিল অতি নগন্য। এটা অবশ্য বলার অপেক্ষা রাখে না, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মূলশক্তি বিএনপি। কিন্তু মূল ভ‚মিকায় আগের মতো তাই অনেকেই মনে করছেন যে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হবার পর থেকেই সরকারের মনোভাবে পরিবর্তন এসেছে। কারণ, এ ক্ষেত্রে বিএনপি অনেকটা ব্যাকফুটে চলে গেছে, আর যে কোনো কর্মকাণ্ড এখন বিএনপির পরিবর্তে ঐক্যফ্রন্টের নামে পরিচালিত হচ্ছে। এজন্যই প্রায় দুই-আড়াই বছর ধরে চিৎকার করে গলায় রক্ত উঠালেও বিএনপি একটি সংলাপ বা আলোচনায় সরকাকে রাজী করাতে পারেনি। অথচ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্যাডে ড. কামাল হোসেনের স্বাক্ষরে একটি চিঠিই প্রধানমন্ত্রীকে সংলাপে রাজী করিয়ে ফেললো। শুধু তা-ই নয়, প্রধানমন্ত্রী দুই দফা সংলাপ করলেন। এ যেন জাদুমন্ত্রের খেলা। বিষয়টি আরো বিস্ময়কর হয়ে উঠেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশ ভালো হয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসায়।
এটা ঠিক যে, ক্ষমতাসীন সরকার তথা আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। সরকার বহু চেষ্টা করেও আওয়ামী লীগবিরোধী শিবিরের এক নম্বর অবস্থান থেকে বিএনপিকে সরাতে পারেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনের পর এরশাদের জাতীয় পার্টিকে সামনে এনে বিএনপিকে পেছনে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা ছিল দৃশ্যমান। কিন্তু তা সত্তে¡ও বিএনপির গুরুত্ব কমেনি। এমন কি সরকার বা সংসদে না থাকা সত্তে¡ও বিদেশিদের কাছে বিএনপির আগের গুরুত্ব রয়েই গেছে। এমনও দেখা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি মেহমান সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার সঙ্গে দেখা না করে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গেছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারে থাকা অবস্থায় নানামুখী বাঁধার পরও বিএনপি বহু সভা-সমাবেশ করেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বা সরকারের কোনো মন্ত্রী তার প্রশংসা করেছে এমন নজির নেই। অনেকেই বলছেন যে, ৬ নভেম্বরের সমাবেশ যদি বিএনপির ব্যানারে হতো, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর মুখ দিয়ে এ প্রশংসাসূচক বাক্য বেরুত না।
একটি বিষয় বিএনপি নেতাকর্মীদের ভাবিয়ে তুলেছে। তাহলো দলটির নেতাকর্মীদের অবিরাম গ্রেফতার। ১ নভেম্বরের সংলাপের সময় সরকার আশ্বাস দিয়েছিল, আর কোনো হয়রানিমূলক মামলা বা গ্রেফতার করা হবে না। অথচ প্রধানমন্ত্রী যে সমাবেশের প্রশংসা করেছেন, সে সমাবেশ থেকেই গ্রেফতার করা হয়েছে বেশ কয়েকজন বিএনপি নেতাকর্মীকে। গত ৮ নভেম্বর একটি দৈনিকের খবরে বলা হয়েছে, আগেরদিন চব্বিশ ঘণ্টায় রাজধানীতে বিএনপির চার শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদেরকে বিভিন্ন নাশকতা মামলার আসামি হিসেবে আদালতে পাঠিয়ে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড আবেদন করেছে পুলিশ। অনেকের সন্দেহ, সরকার একদিকে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সমঝোতার নাটক চালিয়ে যাচ্ছে, নমনীয়তা দেখাচ্ছে, অন্যদিকে গ্রেফতার-মামলা পুরোদমে চালিয়ে বিএনপিকে দুর্বল করার চেষ্টাও অব্যাহত রাখছে। বিএনপি নেতারা অবশ্য বলছেন, দাবি না মানলে তারা কঠোর আন্দোলন শুরু করবেন, তবে বাস্তবতা তা বলে না। কারণ, সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করতে যে রকম আন্দোলন দরকার, তেমন আন্দোলন বিএনপি করতে পারবে, এ কথা অনেকেই বিশ্বাস করে না। ফলে চেয়ারপার্সনকে কারাগারে রেখেই দলটিকে নির্বাচনে অংশ নিতে হতে পারে।
অনেকেই এখন অংক কষছেন ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়ে বিএনপির লাভ লোকসানের বিষয়ে। কেউ কেউ বলছেন, এতে বিএনপির তেমন কোনো লাভ হয়নি। শেষ পর্যন্ত যদি চেয়ারপার্সনকে কারাগারে রেখেই দলটিকে নির্বাচনে যেতে হয়, তাহলে নেতাকর্মীদের মনোবল যেমন আশা করা হয়, সেরকম থাকবে না। ৭ নভেম্বরের দ্বিতীয় দফা সংলাপ ফলপ্রসূ হয়নি। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ঐক্যফ্রন্ট উত্থাপিত দাবিসমূহ, যার মধ্যে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিও ছিল, তা নাকচ করে দিয়েছে সরকার। এছাড়া সংসদ ভেঙ্গে দেয়া, সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচন কমিশন সংস্কার, বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন ইত্যাদি দাবিও অগ্রাহ্য হয়েছে। ফলে সংলাপ কার্যত ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়। অবশ্য বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান সংলাপে হয়েছে এমন নজির নেই। সংলাপ যে সফলতার মুখ দেখবে না এমন আশঙ্কা অনেকেই করেছিলেন। তবুও যারা আশাবাদী লোক তারা ভেবেছিলেন, জাতির স্বার্থে হয়তো উভয় পক্ষ শেষ পর্যন্ত একটি ঐকমত্যে পৌঁছুতে সক্ষম হবে। কিন্তু এবারও সংলাপ ব্যর্থ হওয়ার ঐতিহ্য আমাদের অক্ষুণ থাকলো।
প্রশ্ন হলো, এখন কী করবে বিএনপি? নির্বাচন না আন্দোলন? দলটি কি রাজপথে নামবে, নাকি ‘নেত্রীর মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবে’ নির্বাচনে অংশ নেবে? সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, বিএনপির আন্দোলন ও নির্বাচন দুটির প্রস্তুতিই রয়েছে। বরাবরই বিএনপির নেতারা বলে আসছেন, আন্দোলন চলবে এবং সরকারকে এক তরফা নির্বাচন করতে বা ফাঁকা মাঠে গোল দিতে দেয়া হবে না। এখন দেখা যাক, কী হয়।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।