শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিল আড়িয়াল। ঢাকা শহরের অদূরে এ বিলে সম্প্রতি শতাধিক কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, থিয়েটার কর্মীর অংশ গ্রহণে বিলের অপূর্ব দৃশ্য মূর্ত হয়ে উঠে। আয়োজনে ছিল মুন্সিগঞ্জের কালের ছবি সংগঠন।
একজন শিক্ষক যদুনাথ রায়ের বাড়িটির নাম দিয়েছিলেন ‘বিলের ধারে প্যারিস শহর’। এখনে আমি স্যারের কথাটা একটু ঘুরিয়ে আমার নিজের ভালো লাগার উচ্ছ্বাস প্রকাশের জায়গা থেকে এককথায় বলে ফেললাম ‘প্যারিস শহরের ধারে বিল’।
আড়িয়াল বিলটি কেবলমাত্র ছোট পরিসরে যদুনাথ রায়ের বাড়িটিকে নয় এ যেন সমগ্র মুন্সিগঞ্জকেই প্যারিস শহরে পরিণত করেছে। আড়িয়াল বিলের প্রাকৃতিক দৃশ্য ও ঐশ্বর্যের প্রাচুর্যই মুন্সিগঞ্জ তথা বিক্রমপুরকেই দিয়েছে দৃষ্টিনন্দন প্যারিস নগরীর আবহ।
কাল গিয়েছিলাম সেই রূপে-প্রাচুর্যে ভরপুর আড়িয়াল বিল দেখতে।যাওয়ার আগে ভয় ছিল আবহাওয়া নিয়ে। কিন্তু কালকে পুরো প্রকৃতিই আমাদের সঙ্গী হয়েছিল না রোদ, না বৃষ্টি হয়ে। তাও শেষেরদিকের বৃষ্টি মনে হয় প্রকৃতির অন্য এক রূপ দেখাবে বলেই দেখা দিয়েছিলো।
থৈ থৈ জল আর সাদা,বেগুনি,লাল রঙের আধফোটা শাপলা এবং ট্রলারে বিলের পানির ছল্লাৎ শব্দ ছাপিয়ে ছোট ভাইদের গলা ছেড়ে গান দিয়েছিলো অন্যরকম এক অনুভূতি।তখন বড় আফসোস হচ্ছিলো খুব ভোরে হয়তো এই ফুটন্ত শাপলায় ভরা বিলটি না দেখতে পারার।
হঠাৎ চোখে পড়লো জেলেদের মাছ ধরার ছোট নৌকা তৎক্ষণাৎ মাথায় আসলো, মাঝিদের কাছ থেকে জেনে নেওয়ার আমরা ঠিক এখন কোথায় কোন জায়গাটায় আছি।জেনে নিলাম- বাড়ৈখালীগ্রাম পার হয়ে আমরা এখন আছি আলমপুর সাত দিঘির মাথার উপরে। আর সাথেই সাথেই ভাবলাম ২৬ মাইল দৈর্ঘ্য এবং ১০ মাইল প্রস্থের যে জলাভূমির আয়তন তাহলে তো সেই জলাভূমির বলতে গেলে এক ইঞ্চি দেখেছি মাত্র। এইসব কথা চিন্তা শেষ হতে না হতেই মাঝির নৌকার পাতাতনের নিচে চোখ পড়লো।বুঝা যাচ্ছে মাছ ধরা শেষে বাড়ি ফিরছে মাঝি ভাই।মৎস্যসম্পদের অভয়ারণ্যের বুকে মাঝির চোখে-মুখে এক চিলতে সুখ দেখতে পেলাম।
আমি গল্পের ছলে আড়িয়াল বিল সম্পর্কে আমার না জানা অনেক কিছুই জেনে নিতে লাগলাম যারা আগেও বিভিন্ন মৌসুমে গিয়েছিলো এই বিলে।
বর্ষাকালে পুরো বিল এখন পানিতে টই টই করছে। কিন্তু ঠিক এই জায়গাগুলোই নাকি শীতকালে অন্যরকম এক পরিবেশ সৃষ্টি করে। শীতকালে বিলের ভিতরে ঢুকতে হয় নৌকা নিয়ে। অনেক সময় পানি প্রায় তলানিতে গিয়ে ঠেকে। তাই সেইসময়টাতে কৃষকদের চাষ করা বড় বড় কুমড়া নৌকায় রেখে গুন টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। এখন শুধু এই আড়িয়াল বিল ছাড়া আমাদের দেশের কোথাও গুনটানা নৌকা দেখা যায় না। আর আরেকটা কথা শুনে খুবই অবাক হলাম আড়িয়াল বিলের কোনো কোনো মিষ্টি কুমড়া নাকি দুই মণেরও বেশি ওজনের হয়ে থাকে। আর এও শুনে অবাক হলাম এক হাজার টাকায় একটা কৈ মাছও বিক্রি হয় এখান থেকে। প্রকৃতিকে প্রকৃতির মতো থকতে দিলে এই প্রকৃতিই যে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে এরচেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে?
মামুন ভাই, অপু ভাইদের মুখে শুনতে পেলাম এখানে প্রায় পাঁচশর বেশি ছোট বড় দিঘি আছে।দিঘির ফাঁকে ফাঁকে বড় বড় টিলার আকৃতি কিছু জায়গা আছে। ঐ রকমই একটা গাছ আবৃত স্থানে চললো আমাদের মধ্যাহ্নভোজ। এই রকম ছোট বড় অনেক টিলা আকৃতির অনেকগুলো জায়গা দেখতে পেলাম আর সেখানে মেহেগনী,হিজল,মানুষের চাষ করা পেঁপেঁ বাগান এমন কি নাম না জানা অনেক গাছও ছিলো। গাছ আবৃত সে উঁচু জায়গাগুলো দূর থেকে জলের মাঝে গাছে ঘেরা ছোট ছোট দ্বীপের মতো মনে হচ্ছিলো। আর অর্ধেক ডুবে থাকা হিজল গাছের মাথা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যখন আমাদের ট্রলার এগিয়ে যাচ্ছিলো তখনকার পরিবেশটা মনে করিয়ে দিয়েছিলো সিলেটের রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টের কথা।
তবে ইদানিং ভ্রমণপিপাসুদের জায়গার বেশি স্থান পেয়েছে প্রকৃতি নষ্টপিপাসু মানুষের। ঘুরতে গিয়ে যে যার ইচ্ছে মতো প্লাস্টিকের বোতল, গ্লাস, প্লেট এখানে সেখানে ফেলে রেখে আসছে।আসার পথে ট্রলার থেকে সেই ফেলে আসা ময়লা আবর্জনার স্তূপও দেখে নিলাম। আর আমি যখন শাপলা ফুল তোলার আনন্দে আত্মহারা ঠিক তখনই একটা কথা মনে পড়লো। আমার বাড়ির টবে লাগানো ফুলগাছ থেকে যদি এইসব গ্রামের মানুষজন গিয়ে ফুল ছিঁড়ে আবার সেই টবের সামনেই ফেলে রেখে আসে তাহলে আমার কেমন কষ্ট লাগতে পারে।ঠিক তেমনি এই আড়িয়াল বিল যাদের তারা তাদের বিল নামক টবের ফুল ছিঁড়ে ফেলা দেখে কতটা কষ্ট পেতে পারে!সেই কথা চিন্তা করে এরপর আর একটা ফুলও ছিঁড়তে সাহস হয় নি।
মুন্সিগঞ্জের প্রতিটি এলাকায় বর্ষার যে রূপ দেখা যেতো তা এখন আর তেমনটা চোখে পড়ে না।আমার নিজের বাড়িই রামপাল দিঘির পাশে।আগে প্রতিটি বর্ষা আমি আমার মতো করে উপভোগ করতে পারতাম।কিন্তু আধুনিকায়নের ছোঁয়ায় বর্ষার সেই অপরূপ দৃশ্য এখন আর চোখে দেখি না।তাই আমি আমার বাড়ি থেকে কয়েক মাইল দূরে গিয়েও মনে হয়েছিলো আমি আমার বাড়ির সামনে ঘাটে বসে পানিতে খেলা করা মাছের আনাগোনা দেখতে পারছি।
প্রাকৃতিক জীবভাণ্ডার আড়িয়াল বিল দেখে আর এর সম্পর্কে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের গল্প শুনে যা বুঝলাম, আড়িয়াল বিলের এই মাছ আহরণকারী, মাছচাষী, ফসলীকৃষক, কৃষিশ্রমিক যাদের সম্পর্কে আমি এখন এককথায় বলে দিতে পারি তাদেরকে কৃষক বা মৎস্যজীবী কোন অণুসংঙ্গাতেই সীমাবদ্ধ রাখা যায় না। এ মানুষগুলোকে বলা যায় আড়িয়াল বিলের আর্শিবাদপুষ্ট মানুষ। দেশের বহু মানুষের নানা রকম সংকট ও না পাওয়ার গল্পের বাইরে এ মানুষগুলো যুগ যুগ ধরে প্রকৃতির অসীম অনুগ্রহ আর দান উপভোগ করে আসছে।সাপ,পোকা,ফড়িং আর ছোট বড় নানান পাখির এ রাজ্য টিকে আছে প্রকৃতির সব ধরনের আবর্তন।আর সেকারনেই এখানে এখনো পাওয়া যায় জলাশয় ভরা মাছ আর ক্ষেত ভরা ফসল।আড়িয়াল বিল এভাবেই সুরক্ষিত থাক যুগের পর যুগ। প্রকৃতির বুকে মাথা রেখেই ঘুমাক প্রকৃতি। তাহলেই পৃথিবী থাকবে আমাদের বাসযোগ্য।
এক কথায় পুরো ভ্রমণের টুকরো টুকরো আনন্দ লিখে ভাগ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।তাও কিছুটা হয়তো চেষ্টা করেছি আমার থেকে গল্প শুনতে চাওয়া স্যার,বন্ধু-বড়-ছোট ভাই বোনদের জন্যে।
এই ভ্রমণের সঙ্গি হিসেবে আমি এমন ক›জন দেশবরেণ্য, মুন্সিগঞ্জ-বিক্রমপুরের জ্ঞানী-গুণী মানুষদের সান্নিধ্য পেয়েছি যা কখনোই ভোলার মতো না। আড়িয়াল বিলের আনন্দ ভ্রমণের সারথি ছিলেন উত্তরাধুনিক কবি ফাহিম ফিরোজ, প্রাবন্ধিক কাজী আশরাফ, কবি জাকির সাঈদ,আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান সম্পন্ন পটচিত্রশিল্পী আবুল খায়ের, চিত্রশিল্পী সজল সূত্রধর, সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন স্বজল, মশহ শিহাব, মোহাম্মদ উজ্জল হোসেন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সাব্বির হোসেন জাক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।