পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল থামছেই না। এটা যেন সারাদেশের যাত্রী সাধারণের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়কে বের হওয়া মানেই যেন মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া। বাসা থেকে বের হয়ে কেউ যে জীবীত অবস্থায় ফিরতে পারবে, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। ‘দুর্ঘটনায় কারো হাত নেই’ বলে একটা কথা আমাদের দেশে প্রচলিত আছে। তবে এ কথাটি বিশ্বের অন্য কোনো দেশের ক্ষেত্রে পুরোপুরি সঠিক নয়। সড়ক অব্যবস্থাপনা, পরিবহন চালকদের অদক্ষতা, বেপরোয়া মনোভাব, ফিটনেসবিহীন যানবাহনকে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য মূলত দায়ী করা হয়। এসব দূর না করে যখন বলা হয়, ‘দুর্ঘটনায় কারো হাত নেই’ তখন তা কোনোভাবেই মানা যায় না। যানবাহন চালায় চালকরা, সেই চালকরা যদি অদক্ষ ও বেপরোয়া হয়, তবে দুর্ঘটনার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার কি কোনো উপায় আছে? দুঃখের বিষয়, অদক্ষ ও বেপরোয়া মনোভাবসম্পন্ন চালকদের বিরুদ্ধে যখন দুর্ঘটনার নামে ‘হত্যাকান্ডর অভিযোগ তুলে মৃত্যুদন্ডের বিধান রেখে আইন প্রণয়ন করার দাবি ওঠে, তখন পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের সাথে জড়িত প্রভাবশালী এক মন্ত্রী তাতে ঘোর আপত্তি জানান। তিনি এর তীব্র বিরোধিতা করে একে ‘হত্যাকান্ড’ বলতে নিষেধ করেছেন। শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, যখন সরকার এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করে তখন এতে হত্যাকানেডর শাস্তি মৃত্যুদন্ড দূরে থাক যাবজ্জীবনও নয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যখন বেপরোয়া, ভুয়া লাইসেন্সধারী ঘাতক চালকদের দুর্ঘটনার পক্ষ নেয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই তারা প্রশ্রয় পেয়ে যায় এবং আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে। এ প্রেক্ষিতে সড়ক-মহাসড়ক ‘মৃত্যুফাঁদ’ হওয়া ছাড়া কি কোনো গতি থাকে? মৃত্যুর মিছিল কি থামানো যাবে?
ঈদ এলেই মানুষের মধ্যে আগেভাগেই আশঙ্কা জন্মায় সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এবং ঘটেও। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গতকালের পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৪ ঘন্টায় সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৭ জনের প্রাণ গেছে, আহত হয়েছে প্রায় ১৫০ জনের মতো। আগের কয়েক দিনের হতাহতের ঘটনা যোগ করলে এ সংখ্যা যাবে তাতে সন্দেহ নেই। এছাড়া এমন ছোট ছোট অনেক দুর্ঘটনা আছে, যেখানে একজন বা দুজনের মৃত্যু হয়েছে সেগুলো সংবাদ মাধ্যমে আসেনি। সংবাদ মাধ্যমে সাধারণত বড় দুর্ঘটনার খবরগুলো আসে। এর বাইরে যথাসম্ভব অন্যান্য ছোট ছোট দুর্ঘটনার খবরও দিয়ে থাকে। গত শুক্রবার দিবাগত রাতে গাইবান্ধার পলাশতলী উপজেলায় যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সাথে ধাক্কা লেগে প্রায় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই ১৮ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় অনেকে। এর কারণ হিসেবে দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাসটির চালক ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এছাড়া ফরিদপুরের ভাঙা থানা, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, গোপালগঞ্জ, সাভার, টাঙ্গাইল, চুয়াডাঙ্গা ও নরসিংদীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ আহত ও নিহত হয়েছে। বলা যায়, সড়ক-মহাসড়কগুলো একেকটি মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। এর কারণ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, আমরা কেবল সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের আহত-নিহতের সংখ্যাটাই জানি। এর মধ্যে যারা নিহত হয়, তাদের পরিবারের অবস্থা কী হয়, তা চিন্তা করি না। সরকারও চিন্তা করে না। সরকার এমন কোনো নজির স্থাপন করে নাই যে, একটি পরিবারের মূল উপার্জনকারি ব্যক্তি নিহত হওয়ার পর তার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে। একমাত্র উপার্জনকারি ব্যক্তির মৃত্যুতে তার পরিবার কত গভীর সংকট ও অস্তিত্বহীনতার মধ্যে পড়ে, তা সরকার ভাবে বলে মনে হয় না। আর যারা আহত হয়ে চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করে, তাদের যে কী অভিশপ্ত জীবনযাপন বয়ে বেড়াতে হয়, তার খোঁজ কখনোই নেয়া হয় না। দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত পরিবারগুলো যে নিঃস্ব হয়ে সমাজের বোঝায় পরিণত হচ্ছে এবং অর্থনীতির ক্ষতি করে চলেছে, এ বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। এক হিসেবে দেখানো হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ ক্ষতি হয়। কারণ, নিহত ও আহতদের সিংহভাগই কর্মজীবী এবং তরুণ শ্রেণীর। এত বড় ক্ষতি জেনেও সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল কেন বিষয়টি সিরিয়াসলি নিচ্ছে না, তা বোধগম্য নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, একজন গাড়িচালক যখন ৪০-৫০ জন বা তার বেশি যাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করে, তখন তার সুস্থ্যতা ও সচেতনতার ওপর যাত্রীদের বাঁচা-মরা নির্ভর করে। আর যেসব চালক নিয়মিত সড়ক-মহাসড়কগুলোতে গাড়ি চালিয়ে যাতায়াত করে, সেই সড়ক-মহাসড়কের পরিস্থিতি কি, তা তাদের অজানা থাকার কথা নয়। কাজেই কীভাবে গাড়িটি চালাতে হবে, তা তাদের নখদর্পণে থাকার কথা। তাহলে কেন দুর্ঘটনা ঘটবে? সড়ক খারাপ হতে পারে, এটা মেনে নিয়েও বলা যায়, তাদের যে শ্রমিক সংগঠন রয়েছে, তার মাধ্যমে কি আন্দোলন করে সড়ক-মহাসড়ক সঠিকভাবে মেরামত করতে সরকারকে বাধ্য করতে পারে না? তারা তো রাস্তা-ঘাটে চাঁদাবাজি বা দুর্ঘটনা ঘটানোর কারণে তাদের কোন চালককে আটক করলে ধর্মঘট করে গাড়ি না চালিয়ে সারাদেশ অচল করে দেয়। সরকার বাধ্য হয় তাদের দাবী মেনে নিতে। সড়ক-মহাসড়কের বেহাল অবস্থা নিয়ে কি তারা এ ধরনের আন্দোলন করতে পারে না? যদি করত, তাহলে কি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মেরামত না করে পারত? সরকার প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা সড়ক-মহাসড়ক সংস্কার ও মেরামতে ব্যয় করছে। অর্থ ব্যয় হচ্ছে, মেরামত আর হচ্ছে না। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বলেছে, সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়। এ থেকেই বোঝা যায়, এ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার বৃহদংশটি কোথায় যায়। নামকাওয়াস্তে কোনো রকমে মেরামত করে বাকী অর্থ ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়া হয়। সমস্যা যে তিমিরে থাকার, সে তিমিরেই থেকে যায়। আর দুর্ঘটনায় ঝরে যায়, শত শত মানুষের প্রাণ। আমরা জানি না, মৃত্যুর এই মিছিলের শেষ কোথায়।
২০১৬ সালে হাইওয়ে পুলিশ মহাসড়কের সবচেয়ে দুর্ঘটনাপ্রবণ ২৯২টি স্পট চিহ্নিত করে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ঝুঁকুপূর্ণ বাঁক, মহাসড়কের সাথে ছোট ছোট সংযোগ সড়ক, বড় বড় গাছ, ট্রাফিক সংকেত ও চিহ্ন না থাকা। এসব ঝুঁকিপূর্ণ স্পট সংস্কারের জন্য ২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবরে রোড ট্রান্সপোর্ট ও হাইওয়ে ডিপার্টমেন্ট মন্ত্রণালয়ে এক হাজার ৩৩ কোটি টাকার বাজেট করে। এ অর্থ সারাদেশের ৬ হাজার কিলোমিটারের মধ্যে যেসব ঝুঁকিপূর্ণ স্পট রয়েছে সেগুলো সংস্কারের জন্য চাওয়া হয়। মন্ত্রণালয় এ অর্থ বরাদ্দ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে সংস্কারের বিষয়টি ঝুলে আছে। এ থেকে বোঝা যায়, মন্ত্রণালয় সড়ক-মহাসড়ক সংস্কারের ক্ষেত্রে চরম শৈথিল্য ও উদাসীনতা দেখাচ্ছে। ফলে দিনের পর দিন দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণ যাচ্ছে, আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করছে। এ অবস্থা আর কতদিন চলবে, তা আমরা জানি না। আমরা শুধু বলতে পারি, সড়ক-মহাসড়ককে যথাযথভাবে সংস্কারের মাধ্যমে যানবাহন চলাচলের জন্য উপযুক্ত করতে ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। বেপরোয়া চালক এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহনের মালিকদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নিয়মিত চালকদের শারিরীক ও মানসিক পরীক্ষা করতে হবে। গাড়ির স্টিয়ারিং ধরার আগে এ পরীক্ষা জরুরী। পরিবহন কোম্পানিগুলোতে নিয়োজিত চালকদের নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে মাসে অন্তত একবার সড়ক-মহাসড়কে নিয়ম-কানুন এবং গ্রুমিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট পরিবহন কোম্পানিকে বাধ্যতামূলকভাবে করতে হবে। আমরা চাই না, সড়ক-মহাসড়ক মৃত্যুর ফাঁদ হয়ে থাকুক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।