পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সড়ক মৃত্যুর খোলা ময়দান। এমন কোনো দিন নেই, যেদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা না যাচ্ছে। গতকালের পত্রিকায় প্রকাশ, ২৪ ঘণ্টায় প্রাণ গেছে ১৬ জনের। এর মধ্যে গাজীপুরের শ্রীপুরে ট্রেনের সঙ্গে শ্রমিকবাহী বাসের সংঘর্ষে মারা গেছে ৫ জন। কুমিল্লার দেবীদ্বারে মারা গেছে স্বামী-স্ত্রীসহ ৩ জন। ঈশ্বরগঞ্জে মারা গেছে ২ জন, কালিহাতিতে ২ জন, গাজীপুরে ২ জন এবং কুড়িগ্রামে ১ জন ও বিরামপুরে ১ জন। এভাবেই প্রতিদিন সড়কে প্রাণ ঝরছে। ১৬ জুলাই সর্বোচ্চ ৩১ জন প্রাণ হারায়। ঈদের আগে-পরের ১৫ দিনে ১১৯টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ৩৯৮ জন। বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঈদের পরে ঘটেছে। সড়ক-মহাসড়কে ন্যূনতম নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণ থাকলে প্রতিদিন এত মানুষের মৃত্যু হওয়ার কথা নয়। ঈদের সময় আমাদের দেশে বিপুল সংখ্যক মানুষের স্থানান্তর ঘটে। সঙ্গত কারণে যান চলাচলও বেড়ে যায়। এ জন্য অন্যান্য সময়ের চেয়ে সড়ক দুর্ঘটনার আশংকাও বেশি থাকে। সব ক্ষেত্রে সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন করলে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব। সেটা এবার ঈদের দিন পর্যন্ত ও লক্ষ করা গেছে। ঈদযাত্রার দিনগুলোতে দুর্ঘটনা কম ঘটেছে। কিন্তু ফিরতি যাত্রার সময় দুর্ঘটনা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। সড়ক ও যানবাহন ব্যবস্থাপনায় ঢিলেঢালা ভাব এর জন্য প্রধানত দায়ী। ঈদের সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে মুসলিম দেশে জনস্থানান্তর স্বাভাবিক। সেটা অনেকটাই ঈদের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। আত্মীয়-স্বজন ও প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করার জন্য মুসলমানদের অনেকেই কর্মস্থল ছেড়ে বাড়িতে যায়। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশে এটা বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো ওইসব দেশে এত সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যু দেখা যায় না।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যু বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। প্রথম নেপাল। নেপালের ভূপ্রকৃতি, রাস্তাঘাটের অবস্থা ও ধরন সড়ক দুর্ঘটনা বেশি ঘটার কারণ। বাংলাদেশ মূলত সমতল ভূমির দেশ। রাস্তাঘাটও তেমন ঝুঁকিপূর্ণ নয়। অথচ এখানে প্রতিদিন গড়ে ২০ জনের (বেসরকারি হিসাবে ৫৫ জন) সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়। আবার মৃত্যুর চেয়েও অধিক সংখ্যক মানুষ আহত হয়। এদের অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যায়। বেশিরভাগ নিরাশ্রয় ও বিরালম্ব হয়ে পড়ে। কদিন আগে এক গর্ভবতী মহিলা স্বামী ও সন্তানসহ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়। আল্লাহর মহিমায় তার গর্ভস্থ সন্তানটি বেঁচে যায়। ওই মহিলার আরো দুটি সন্তান আছে। পিতামাতাহীন ওই তিনটি শিশু কীভাবে বেঁচে থাকবে, কীভাবে বড় হবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। এভাবে প্রতিদিন কত পরিবার যে শেষ হয়ে যাচ্ছে, অসহায় হয়ে পড়ছে, তার ইয়ত্তা নেই। দুর্ঘটনায় হতাহতের ক্ষতিপূরণ প্রদানের বাধ্যবাধকতা আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তির পরিবার-পরিজন বলতে গেলে কিছুই পায় না। সরকার তাদের খোঁজ-খবর নেয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। বেসরকারিভাবেও এমন কোনো সংস্থা গড়ে ওঠেনি, যারা এই অসহায়দের সহায়তা দিতে পারে, পাশে দাঁড়াতে পারে। একেকটি দুর্ঘটনা কীভাবে একেকটি পরিবারকে অনিশ্চয়তার অন্ধকারে নিক্ষেপ করছে, এই বাস্তবতা থেকে সহজেই সেটা হৃদয়ঙ্গম করা যায়। সড়ক দুর্ঘটনায় অপূরণীয় মানবিক বিপর্যয় ও ক্ষতির পাশাপাশি আর্থিক বা সম্পদক্ষতিও কম হচ্ছে না। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর সম্পদক্ষতি হয় হাজার কোটি টাকার ওপর, যা জিডিপির প্রায় ২ শতাংশের সমান। এটা অতীব পরিতাপের বিষয়, সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে, প্রাণহানি এবং সম্পদক্ষতিও বাড়ছে। অথচ, তার রাস টানা সম্ভব হচ্ছে না। কেন এ ব্যর্থতা, তাও চিহ্নিত হচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর জন্য আন্দোলন হচ্ছে, সভা-সেমিনার হচ্ছে, বিশেষজ্ঞরা তাদের মূল্যবান পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনা এমন কোনো সমস্যা নয়, যা সমাধান অযোগ্য। বিশ্বে বহু দেশ সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস করেছে। এমন দেশও আছে, যেখানে সড়ক দুর্ঘটনা প্রায় শূন্যের কোটায়। তাদের পক্ষে যদি দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব হয়, আমাদের দেশে হবে না কেন?
সড়ক দুর্ঘটনার কারণ মোটামুটি সবারই জানা। অজ্ঞ-অদক্ষ চালক, বেপরোয়া গাড়িচালনা, ট্রাফিক আইন অমান্য করা, রাস্তাঘাটের নির্মাণ ত্রুটি, আনফিট গাড়ি, রাস্তাঘাট দখল, দ্রুতগতির গাড়ির পাশাপাশি ধীরগতির গাড়ি চলাচল ইত্যাদি দুর্ঘটনার জন্য প্রধানত দায়ী। সবচেয়ে বেশি দায়ী চালক। এরপর ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি। দেশে যত চালক আছে, তার মধ্যে একটা বড় অংশ ভুয়া ও অদক্ষ। তাদের বৈধ লাইসেন্স নেই। দুই নম্বরি লাইসেন্সই তাদের সম্বল। অভিযোগ আছে, বিআরটিএ’র এক শ্রেণীর কর্মকর্তা ভুয়া লাইসেন্স সরবরাহ করে থাকে। ফিটনেসবিহীন গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট প্রদানের চলও আছে। টাকা দিলে সবই সম্ভব। অদক্ষ-অপ্রশিক্ষিত চালকের হাতে যদি ফিটনেসবিহীন গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল থাকে। তবে দুর্ঘটনা কে রুখবে? গোড়ায় গলদ আগে সারতে না পারলে দুর্ঘটনা কমবে না। যেসব প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা সড়ক, যানবাহন এবং এদের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত, তারা সৎ, স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল না হলে সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর সহজ রাস্তা নেই। দুর্ঘটনা ও দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর দায়ে কঠোর সাজা এক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল দিতে পারে বৈকি। কিন্তু সেই সাজার ব্যবস্থা কই? অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের পর ২০১৯ সালে সড়ক আইন হয়েছে। যানবাহন মালিক-শ্রমিকদের বিরোধিতার কারণে তার সংশোধনীও হয়েছে। তবুও আইন কার্যকর হচ্ছে না। যে আইন কার্যকর হয় না, তা যতই ভালো হোক, লাভ নেই। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, চালক ও যাত্রীদের মোটিভেশন, চালকের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, ফিটনেসওয়ালা গাড়ির চলাচল, ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা হলে দুর্ঘটনা ও দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু দ্রুতই কমে আসতে পারে। সরকার এদিকে অবিলম্বে দৃষ্টি দেবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে, আমরা এটাই প্রত্যাশা করি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।