Inqilab Logo

বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দরকার আইনের সঙ্গে যথাযথ বিধিমালাও

ইলিয়াস কাঞ্চন | প্রকাশের সময় : ২২ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০০ এএম

বিশ্বব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনা এবং হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশও সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, দেশে বছরে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। দেশের সাম্প্রতিক অর্থনীতিতে সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে জিডিপির প্রায় ২.৫ শতাংশ, যা টাকায় প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার সমান। অন্যদিকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অব রোড সেফটি ২০১৮-এর তথ্য অনুসারে, প্রতি বছর বিশ্বে ১০ লাখ ৩৫ হাজার মানুষ সড়কে মারা যায়। সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্বে ৮ম বৃহত্তম মৃত্যুর কারণ। বিশেষ করে, ৫-২৯ বছর বয়সী শিশু ও অল্প বয়স্কদের মৃত্যুর এটি প্রধান কারণ। এসব দুর্ঘটনায় ৯০ শতাংশ মৃত্যু ঘটছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে। এমন পরিস্থিতিতে সড়ক নিরাপত্তায় জাতিসংঘ দশকব্যাপী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সংস্থাটি বলেছে, যেমন চলছে তেমন আর চলতে দেওয়া যাবে না। এজন্য জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-এর ২০২০-২০৩০ সালের পরিকল্পনায় বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা ৫০ শতাংশ নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ৫টি রিস্ক ফ্যাক্টর- সিট বেল্ট, অতিরিক্ত গতি, স্ট্যান্ডার্ড হেলমেট, ড্রিংক ড্রাইভিং, শিশু আসন চিহ্নিত করা হয়েছে। এই অতি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো অর্জনের মাধ্যমে সবার জন্য নিরাপদ, সুরক্ষিত, সহজলভ্য ও টেকসই জীবন নিশ্চিত করার ঘোষণা দিয়েছে জাতিসংঘ। এছাড়া জাতিসংঘ সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম পাঁচটি পিলারও চিহ্নিত করেছে। সেগুলো হলো: সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ যানবাহন, নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী এবং সড়ক দুর্ঘটনা পরবর্তী করণীয়। বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তায় এই বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করতে হলে আইনের যথাযথ প্রয়োগ অপরিহার্য। বাস্তবতা হচ্ছে, এগুলো বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

এ কথা সত্য, এই লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণে উদ্যোগী হয়েছে। শক্তিশালী করা হচ্ছে আইনগত কাঠামো। প্রণয়ন করা হয়েছে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮। তবে আইনটি যুগোপযোগী হওয়া সত্ত্বেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যে কারণে আইনটি এ বছর আবারও সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, সড়ককে নিরাপদ করার জন্য জাতিসংঘ ঘোষিত রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো আমাদের দেশে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হচ্ছে না। এর বড় কারণ হচ্ছে, সড়ক পরিবহন আইনটির যথাযথ প্রয়োগ শুরু না হওয়া। আইনটি ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও এর প্রয়োগ এখনও শুরু হয়নি। আজ পর্যন্ত এই আইনের বিধিমালাই প্রণয়ণ করা হয়নি। আইনকে যদি প্রয়োগ করতে হয়, তাহলে যথাযথ বিধিমালা জরুরি। এই বিধিমালার অভাবেই আইনটির যথাযথ প্রয়োগ সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে মূলত আইনটি অকার্যকর হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ফলে সড়কে শৃঙ্খলা আনতে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ কেউই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। তাই এই ৫টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় বাস্তবায়ন করতে হলে বিধিমালা খুব জরুরি। এরপর কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এই ৫টি বিষয় কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, এর ব্যবস্থাপনা কেমন হবে তার বিশদ দিকনির্দেশনা থাকতে হবে। কীভাবে জনমত ও সচেতনতা বাড়াতে হবে, প্রশিক্ষণ কেমন হবে, আইন প্রয়োগ কীভাবে হবে ইত্যাদি। যেমন দুর্ঘটনার বড় একটি কারণ হলো গতি। অতিরিক্ত গতি কে কমাবে? ড্রাইভার? তাহলে ড্রাইভারকে সচেতন করতে হবে, যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এজন্য এর একটি রূপরেখা দরকার। আবার চালক অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালায় কেন? ট্রিপের ফাঁদ। এছাড়া আরও অন্যান্য কারণ আছে, সেগুলোও খুঁজে বের করতে হবে। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর একটি কারণ হলো, মাদকাসক্তি। চালকদের কীভাবে এখান থেকে বের করে আনা যায়, সেই পথ বের করতে হবে। তাদের সমস্যা ও চাহিদাগুলোতে নজর দিতে হবে। এরপরও কোনো চালক গতিসীমা না মানলে আইন প্রয়োগ করতে হবে। তাহলে দেখা যাবে, গতিজনিত দুর্ঘটনা কমে আসবে। ম্যানেজমেন্টটা হতে হবে এ রকম। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কর্মপরিকল্পনাগুলো ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করতে হবে। এভাবে প্রত্যেকটি রিস্ক ফ্যাক্টরকে ধরে ধরে সমাধান করতে হবে। সড়ক পরিবহন আইনের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে। আমরা আশা করছি, সড়ক পরিবহন আইনের সংশোধনীতে এই পাঁচটি রিস্ক ফ্যাক্টর অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা থাকবে। আইনের বিধিমালাটি অতি দ্রুত চূড়ান্ত করে তা কার্যকর করতে হবে।

সড়ক নিরাপত্তায় জাতিসংঘ ঘোষিত পাঁচটি অতি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় আইনের মাধ্যমে নিশ্চিত করার বিষয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)।

গতি: সড়ক দুর্ঘটনার যত কারণ আছে তার মধ্যে অন্যতম বড় কারণ হলো গতি। দেখা যায়, যতগুলো সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয় তার প্রায় সবগুলোর সাথে অনিয়ন্ত্রিত বা অতিরিক্ত গতিতে মোটরযান চালানোর বিষয়টি স¤পর্কিত। বিশ্বের ৮০টির বেশি বড় বড় শহরে পরিচালিত সমীক্ষার উপর ভিত্তি করে জাতিসংঘ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, সর্বোচ্চ গতিসীমা ৩০ কিলোমিটার করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। যে কারণে জাতিসংঘসহ উন্নত দেশগুলো গতি নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে। এজন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যাতে গতিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন আইনের দুর্বলতা হলো- আইনে গতিসীমা লঙ্ঘনের বিধান বর্ণিত থাকলেও গতিসীমা নির্ধারণ কিংবা পর্যবেক্ষণের নির্দেশনা ও পরিকল্পনা উল্লেখ করা হয়নি। মোটরযান আইনে যানবাহনের গতিসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও চালকেরা তা মেনে চলেন না।

জাতিসংঘ শহর অঞ্চলের মধ্যে গতিকে ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে রাখতে চাইছে। কারণ গতি যদি কম থাকে তাহলে গাড়িকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যেমন, কেউ হঠাৎ করেই রাস্তা পার হচ্ছে তখনই একটি গাড়ি চলে এলো। চালক দেখলো কেউ একজন রাস্তা পার হচ্ছে, স্বভাবতই ব্রেক কষবে। যদি গাড়ির গতি কম থাকে তাহলে ব্রেক করলে গাড়ি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকে, দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা কম থাকে। কোনো কারণে দুঘটনা ঘটলেও ক্ষতি কম হয়। সে কারণে জাতিসংঘের পরামর্শ মতে, উন্নত বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই শহরে যানবাহনের গতি সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে এবং যথাযথভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে লন্ডন ও নিউইয়র্ক সিটির কথা বলা যায়। সেখানকার মেয়র শহরে ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে গতি নির্ধারণ করে কঠোরভাবে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছে, যার সুফলও মিলেছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গবেষণায় দেখা গেছে, ৫ শতাংশ গতি কমানো গেলে অন্তত ২০ শতাংশ ক্ষতি কমানো যাবে। সড়ক বিশেষজ্ঞদের মূল স্লোগান ‘কিল স্পিড, নট লাইভস’। অর্থাৎ গতিকে মারো, জীবনকে নয়। বিষয়টি আমাদের মাথায় রাখা উচিত। গাড়ির গতি যত কম হবে, ক্ষতি তত কম হবে। দুর্ঘটনাও কম হবে। উন্নত বিশ্বে এসব কারণ বের করে সমাধানের জন্য সরকারের আলাদা বিভাগ রয়েছে। বাংলাদেশে পুলিশের সেই ধরনের দক্ষতা নেই। ফলে অনেক কারণ ও সমাধান অজানা থেকে যায়। হাইওয়ে পুলিশের গতি মাপার কিছু যন্ত্র আছে। তবে তা ব্যবহার করে যানবাহন চালককে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার নজির কম। এটা নিশ্চিত করতে হলে হাইওয়ে পুলিশের তৎপরতা বৃদ্ধি ও চালকের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।

বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা তথ্য বলছে, সব ধরনের সড়ক দুর্ঘটনার ৮৪ শতাংশ ঘটে অতিরিক্ত গতির কারণে। ওই গবেষণায় দেখা যায়, ৩০ কিলোমিটার গতির একটি যান যদি কোনো মানুষকে ধাক্কা দেয় তাহলে তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকে ৯৫ শতাংশ। এই গতি ৪০ হলে বাঁচার সম্ভাবনা থাকে ৪৫ শতাংশ। আর যানের গতি ৫০ কিলোমিটার হলে ধাক্কা লাগা ব্যক্তির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকে মাত্র ৫ শতাংশ। অর্থাৎ গাড়ির গতি সামান্য বাড়লে মানুষের বাঁচার সুযোগ তত কমে যায়। কিন্তু মহাসড়কগুলোতে ৮০-৯০ কিলোমিটার গতির নিচে কোনো যান চলাচল করে না। জাতিসংঘের তথ্য বলছে, গড়ে ৫ শতাংশ গতি কমলে ৩০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি কমবে। গবেষণায় আরও উঠে এসেছে গতিই হলো সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ।

সুপারিশ: সড়কে গতিসীমা নির্ধারণ ও পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালানো বন্ধ করতে হবে। সকল চালকের বেতন মাসিক ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হবে। চালকদের পেশাদারি মনোভাব গড়তে যথাযথ প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। অতিরিক্ত গতির ক্ষতি স¤পর্কে ধারণা প্রদান কার্যক্রম বাড়াতে সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে। বিজ্ঞানভিত্তিক সিস্টেমে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গণপরিবহন ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে হবে। নিয়ম অমান্যকারী চালকের যেমন শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি আইন অমান্যকারীকে ছাড় দিলে,দুর্নীতি করলে সেই ট্রাফিক পুলিশকেও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। যাতে আইন অমান্যকারীর এই ধারণা তৈরি না হয় যে, সড়কে আইন না মানলেও টাকা দিয়ে ছাড় পাওয়া যায়।
ড্রিংক ড্রাইভিং: গ্লোবাল রোড সেইফটি পার্টনারশিপ এর তথ্যমতে, মদপ্য অবস্থায় বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে মোটরযান পরিচালনা সরাসরি দুর্ঘটনার ঝুঁকির পাশাপাশি আঘাতের তীব্রতা এবং সেই দুর্ঘটনার ফলে মৃত্যুর আশঙ্কাকে প্রভাবিত করে। যদি মদ্যপ অবস্থায় মোটরযান চালানো নিষেধ বিধানটি শতভাগ প্রয়োগ করা যায় তাহলে দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ২০ শতাংশ কমানো যাবে। বিশেষজ্ঞ বলছেন, ড্রিংক ড্রাইভিং বা মাদকাসক্ত অবস্থায় গাড়ি চালালে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। মাদক গ্রহণের ফলে শরীরে এক ধরনের সাময়িক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এজন্য একজন মাদকাসক্তের পক্ষে কখনও স্বাভাবিকভাবে গাড়ি চালানো সম্ভব নয়। মোটরযান আইনে মাদকাসক্ত অবস্থায় গাড়ি চালালে শাস্তির বিধান আছে। এটি দেখভালের দায়িত্ব বিআরটিএ’র। কিন্তু প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতায় তা হয়ে উঠছে না। এ বিষয়ে চালকদের দায়িত্বহীনতা, উদাসীনতা রয়েছে। তবে যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের আওতায় আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। আইনের মাধ্যমে মাদকাসক্ত অবস্থায় গাড়ি চালনা নিবৃত্ত করতে কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। এজন্য ডোপ টেষ্ট জরুরি। চিকিৎসকদের দ্বারা নির্ধারিত মাদকদ্রব্য বা অন্যান্য ড্রাগ দ্বারা প্রভাবিত গাড়ির ড্রাইভিং নিশ্চিত করতে হবে।


সুপারিশ: নির্ধারিত কর্মঘণ্টার অতিরিক্ত সময় কোনো চালক গাড়ি চালাতে পারবেন না। চালকের অর্থনৈতিক ও মানসিক ও স্বাস্থগত অবস্থার উন্নতি করতে হবে।

সিটবেল্ট: সিটবেল্ট ড্রাইভার বা যাত্রীর জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। সিটবেল্ট ব্যবহার সরাসরি দুর্ঘটনার ঝুঁকির উৎস নয় তবে দুর্ঘনায় হতাহতের সংখ্যা কমাতে ভূমিকা পালন করে। সিটবেল্ট পরা চালক এবং সামনের আসনের যাত্রীর মধ্যে মৃত্যুর ঝুঁকি ৪৫-৫০ শতাংশ। পেছনের আসনের যাত্রীদের মধ্যে মৃত্যু এবং গুরুতর আঘাতের ঝুঁকি ২৫ শতাংশ হ্রাস করে (সূত্র: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)। গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়লে সিট বেল্ট ড্রাইভার ও যাত্রী সাধারণকে ধরে রাখে বা নিয়ন্ত্রণ রাখে। গাড়ি দুর্ঘটনার সময় গাড়ির যাত্রী ও চালক ব্যথা পান গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল, ড্যাশ বোর্ড বা সামনের উইন্ডস্ক্রিনে ধাক্কা খেয়ে। আবার গাড়ি উল্টে গেলে একজন যাত্রী আরেকজনের উপর গিয়ে পড়েন অথবা গাড়ির ফ্লোরেই পড়ে হাত পা ভাঙ্গেন। সিটবেল্ট গাড়ি চালাবার সময় মোড় ঘুরাতে কিংবা ওভারটেকের সময় গাড়ির গতি বেশি হলে যাত্রী এবং চালক উভয়ের ভারসাম্য রক্ষা করে। গাড়ি দ্রুতগতিতে চালাবার সময় হার্ড ব্রেক করলে সিটবেল্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবে আটকে গিয়ে যাত্রী ও চালকে সামনে গিয়ে ধাক্কা খাওয়া থেকে রক্ষা করে। এছাড়া গাড়ির চালককে অনেক সময় গাড়ি চালনায় মনযোগী করে রাখতে সহায়তা করে থাকে সিটবেল্ট। সুতরাং, গাড়িতে চড়ার সময় যাত্রী বা চালক সবাইকে সিটবেল্ট বেঁধে নিলে এই ধরনের আঘাত খুব সহজেই কমিয়ে আনা যায়।

সুপারিশ: সিটবেল্ট ছাড়া গাড়ির ফিটনেস দেওয়া বন্ধ করতে হবে। চালককে সচেতন করতে হবে। সিটবেল্ট থাকার পরও না পরলে চালককে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। যাত্রীর সিটবেল্ট ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা সড়ক পরিবহন আইনে সংযোজন করতে হবে। বিধিমালায় বিষয়টি আনতে হবে। গাড়ির চেসিসের ত্রুটিপূর্ণ মোটিফিকেশন কোনো অবস্থায় করা যাবে।
শিশু আসন: সড়ক শিশুদের জন্য উচ্চ পর্যায়ের ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা হয়ে উঠেছে। শিশুদের জন্য নিরাপদ বা সুরক্ষিত আসন সড়ক দুর্ঘটনায় বেশি ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ এবং বড় শিশুদের ক্ষেত্রে ৫৪-৮০ শতাংশ মারাত্মক আঘাত পাওয়া এবং মৃত্যুহার কমাতে অত্যন্ত কার্যকর। (সূত্র: গ্লোবাল রোড সেইফটি পার্টনারশিপ)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে; ৮৪টি দেশ মোটরযানে শিশুদের জন্য নিরাপদ বা সুরক্ষিত আসন সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করেছে। এর মধ্যে ৩৩টি দেশে আইনে সর্বোত্তম অনুশীলন হিসেবে স্বীকৃত। একটি শিশু আসন সন্তানের বয়স এবং ওজনের সাথে সর্বোত্তমভাবে মিলে যাওয়া উচিত।

সুপারিশ: সড়ক পরিবহন আইনে শিশু আসন ব্যবহারের বিষয়টি সংযোজন করতে হবে।

মানসম্মত হেলমেট: গণপরিবহনের বিকল্প হিসেবে মোটরসাইকেলের যথেচ্ছ ব্যবহার আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। দেশে প্রতিনিয়ত মোটরসাইকেলের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, দুর্ঘটনাও বাড়ছে। অচিরেই এর লাগাম টেনে না ধরলে রাস্তায় আরও বিপদ বাড়াবে এই মোটরসাইকেল। প্রাপ্ত তথ্য মতে, গত ঈদে রাজধানী থেকে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ মোটরসাইকেলে বিভিন্ন জেলায় গেছে। এই সময়ে ১২৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। ঈদযাত্রায় সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় ছিল মোটরসাইকেলের ব্যাপক ব্যবহার, যা আগে কখনও দেখা যায়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে বিষয়টি উদ্বেগজনক। ঈদকে ঘিরে ১৪ দিনে সড়ক দুর্ঘটনার চিত্রে দেখা গেছে, ২৫ এপ্রিল থেকে ৮ মে ১৪ পর্যন্ত দেশে ২৮৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৭৬ জনের প্রাণ গেছে, আহত হয়েছেন কমপক্ষে দেড় হাজার। এর মধ্যে ১২৮টি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই হিসেবে মোট দুর্ঘটনার ৪৫ দশমিক ২২ শতাংশ মোটরসাইকেলের। আর মোট মৃত্যুর ৪১ দশমিক ৪৮ শতাংশ ঘটেছে এই দুই চাকার বাহনের দুর্ঘটনায়।

মানসম্মত হেলমেট ব্যবহারের বিষয়টি আইনে উল্লেখ না থাকা সড়ক পরিবহন আইনের সীমাবদ্ধতাগুলোর একটি। আইনটিতে মোটরসাইকেলে হেলমেট পরিধান বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হলেও মানসম্মত হেলমেট ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা কিংবা এর মানদন্ড নির্ণয় করে দেওয়া হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক ও গ্রামীণ সড়কে মোটরসাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে চালকেরা নিয়ম মানছেন না। চালক ও আরোহীরা হেলমেট পরেন না। এক মোটরসাইকেলে দুজনের বেশি না ওঠার নিয়মটিও মানা হয় না।

সুপারিশ: গণপরিবহনের বিকল্প হিসেবে মোটরসাইকেল ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে হবে। মোটরসাইকেলের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে হবে। মোটরসাইকেল চালক-আরোহীর মানসম্মত হেলমট ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশকে কঠোর হতে হবে। এভাবে এই পাঁচটি রিস্ক ফ্যাক্টরকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কর্মপরিকল্পনার মধ্যে নিয়ে জাতিসংঘ ঘোষিত টার্গেট সড়ক দুর্ঘটনারোধকল্পে জনগণের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং সুশৃঙ্খল সড়ক ব্যবস্থাপনা দ্বারা নিরাপদ ও টেকশই বাসযোগ্য বসবাস নিশ্চিতের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে।

নিসচার কার্যক্রম: জাতিসংঘের নতুন ডিকেড অব অ্যাকশন ফর রোড সেফটি ঘোষণার ধারাবাহিকতায় সারাদেশের নিসচা কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নবম মহাসমাবেশে কর্মউদ্দীপনা ও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই মহাসমাবেশে জাতিসংঘের রোড সেফটি নিয়ে নানা দিক ও পাঁচটি রিস্ক ফ্যাক্টর নিয়ে করণীয় বিষয়ে দিকনির্দেশনা তুলে ধরা হয়। যার প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, সড়ক নিরাপত্তায় জাতিসংঘ ঘোষিত পাঁচটি অতি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় আইনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা। নিসচার মূল কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে নতুন শিক্ষিত ড্রাইভার তৈরি করা, বিদ্যমান ড্রাইভারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, সচেতনতা বাড়াতে কর্মশালা, সমাবেশ, প্রচার, প্রশিক্ষণ, নাটক এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রযোজনা, লিফলেট, পোস্টার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ডস, স্ট্রিট ড্রামা পরিচালনা এবং বিল বোর্ড প্রচলন করা, কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুসারে ফুটওভার ব্রিজ/আন্ডারপাস, জেব্রা ক্রসিং এবং অন্যান্য নিয়ম মানতে পথচারীদের সচেতন করা। নিসচা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে যেন সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসে। তার জন্য একটি আইনের দরকার ছিল। সেজন্য পুরনো আইনকে যুগপোযোগী করে একটি নতুন আইন চেয়েছিলাম আমরা। সে আইনটি ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদে পাস হবার পর আজও তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।

সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণগুলি চিহ্নিত এবং বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের স¤পৃক্ততার পদ্ধতির মাধ্যমে সমস্যা মোকাবেলা করা। এছাড়া নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অ্যাডভোকেসি, স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে নিয়ে জনসচেতনতায় কার্য ক্রম, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান, তদন্ত, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, পেশাদারদের অর্জিত জ্ঞান প্রয়োগ, ট্রাফিক পুলিশদের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সড়ক নিরাপত্তায় কৌশলগত পরিকল্পনা, গণমাধ্যমের সঙ্গে অ্যাডভোকেসি, মিডিয়া ক্যা¤েপইন এবং সড়ক পরিবহন আইনের দুর্বলতা খুঁজে বের করে তা সংশোধনের জন্য সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে অ্যাডভোকেসি করার মাধ্যমে আরও কার্যকর ভূমিকা তৈরি করা।

এভাবে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর গ্যাপগুলো বের করে তা সংশোধনের জন্য সরকার ও নীতি-নির্ধারকদের সাথে অ্যাডভোকেসি করার মাধ্যমে একটি কঠোর আইন প্রণয়ন করা যা সড়ক ব্যবহারকারীর আচরণগত ঝুঁকির কারণগুলি পরিবর্তনে দৃঢ়ভাবে সহায়ক হবে। সড়ক পরিবহন আইন পুরোপুরি প্রয়োগে আমরা মনে করি বিআরটিএ’র কারিগরি সক্ষমতা বাড়াতে হবে, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ করে ট্রাফিক বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্টদের উপযুক্ত ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা, চালক, মালিক, পথচারী ও যাত্রীদের আইন স¤পর্কে জানাতে প্রচার মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার ও সড়ক ব্যবহারকারী সকলকেই নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য স¤পর্কে সচেতন করে গড়ে তুলতে বিশেষ কর্মশালার গুরুত্ব রয়েছে। সড়ক পরিবহন আইনে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে বিধিমালা প্রণয়ন ও অনুমোদন করলে এবং সে অনুযায়ী প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সকল মহল কাজ করলে সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে, যার ফলে লক্ষ্যমাত্রাগুলোও অর্জন করা সম্ভব হবে। এজন্য যথাযথ আইনের প্রয়োগ ছাড়াও রাজনৈতিক অঙ্গীকারও অত্যন্ত জরুরি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দরকার আইনের সঙ্গে যথাযথ বিধিমালাও
আরও পড়ুন