Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কোটা সংস্কার করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১০ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ঢাকায় শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের গত রোববারের দিনভর শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী রাতে সহিংস রূপ লাভ করে। শাহবাগ মোড়ে অবস্থানরত আন্দোলনকারীদের রাত ৮টার দিকে পুলিশ সরিয়ে দিতে চাইলে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ, রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে চাইলে তারাও ইটপাটকেল নিক্ষেপের মাধ্যমে জবাব দিতে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে গোটা এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আন্দোলনকারীরা শাহবাগ মোড়ের অবস্থান ছেড়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। সংঘাত-সংঘর্ষ রাত দেড়টা-দুইটা অবধি অব্যাহত থাকে। এতে অন্তত ৭৫ জন আন্দোলনকারী আহত হয়েছে। ১১জন পুলিশ সদস্যও আহত হয়েছে। কমপক্ষে ২৬ জনকে আটক করেছে পুলিশ। এই লাগাতার সংঘাত-সংঘর্ষের সময় রাত পৌনে দুইটার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবন হামলায় শিকার হয়। বাসভবনে ব্যাপক ভাংচুর করা হয়। ওদিকে রাত দেড়টার দিকে ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক শাহবাগ মোড়ে এসে সাংবাদিকদের জানান, এই আন্দোলনের কথা প্রধানমন্ত্রী জানেন। তিনি বিষয়টি সমাধানের জন্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসে যেটা ভালো হয় সেটা করবেন। পর্যবেক্ষকদের মতে, শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের পূর্ব ঘোষিত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচীতে পুলিশ ওইভাবে চড়াও না হলে সংঘাত-সংঘর্ষের অপ্রীতিকর ঘটনা হয়তো ঘটতো না। পুলিশের সংযম হারিয়ে মারমুখী হওয়া ঠিক হয়নি। ওইদিন শুধু ঢাকাতেই নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা ও অবস্থান কর্মসূচী পালিত হয়েছে। অন্য কোথাও এ ধরনের ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। ঢাকার ঘটনা গোটা দেশে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে দিয়েছে। গতকাল দেশের নানা এলাকায় মিছিল, সমাবেশ ও সড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটেছে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে গত ফেব্রæয়ারি থেকে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচীর মাধ্যমে আন্দোলন চালিয়ে আসছে। এর মধ্যেই তারা ঢাকায় মানববন্ধন, প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান, শাহবাগে অবস্থান, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সামনে অবস্থান ও স্বারকলিপি প্রদান কর্মসূচী পালন করেছে। শেষোক্ত কর্মসূচীর দিনে সারা দেশের জিলা প্রশাসকদের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান করার কর্মসূচীও ছিল। কিন্তুু ঢাকার কর্মসূচীতে পুলিশ লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এতে ১৬ জন আহত হয়। ৬৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। মামলা দেয়া হয় ৭-৮শ’ অজ্ঞাতনামার বিরুদ্ধে। গত ২৫ মার্চ এক অভিনব প্রতিবাদ জানায় আন্দোলনকারীরা। গলায় সদনপত্র ঝুলিয়ে ঝাড়– নিয়ে তারা রাস্তা পরিষ্কারে নামে। আন্দোলনের এই ধারাবাহিকতায় ১ থেকে ৭ এপ্রিল ছিল কোটা সংস্কার সচেতনতা সপ্তাহ। সুনির্দিষ্ট ৫ দফা দাবিতে চলছে এই আন্দোলন। দাবিগুলো হলো : কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করে ৫৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে আনা, কোটায় যোগ্যপ্রার্থী না পাওয়া গেলে খালি পদগুলোতে মেধাবীদের নিয়োগ দেয়া, কোনো ধরনের বিশেষ পরীক্ষা না নেয়া, সরকারী চাকরির ক্ষেত্রে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা নির্ধারণ করা এবং নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একবারের বেশি ব্যবহার না করা। বিরাজমান প্রেক্ষাপটে দাবিগুলোর যৌক্তিকতা ও গ্রহণযোগ্যতা মোটেই অস্বীকার করা যায় না। এইসব দাবিতে আরো আগেই শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনে নামা উচিৎ ছিল বলে অনেকে মনে করেন। যে কোনো কারণেই সেটা সম্ভব হয়নি। ঠিক দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মুখে বাধ্য হয়ে তারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নেমেছে। অথচ তাদের দাবির প্রতি ন্যূনতম সহানুভূতি এখনো সরকারের তরফে দেখানো হয়নি। উল্টো আন্দোলন দমনের চেষ্টা হয়েছে। গত ১৪ মার্চ ও ৮ এপ্রিল পুলিশের অ্যাকশন তারই প্রমাণ বহন করে। বাস্তবতা তো এই যে, দেশের হাজার হাজার শিক্ষিত ও মেধাবী তরুণ যাবতীয় যোগ্যতা সত্তে¡ও বেকারত্বের অভিশাপ মাথায় নিয়ে গ্লানিকর জীবনযাপন করছে। সরকারি চাকরির সুযোগ এমনিতেই সীমিত। সেই সীমিত সুযোগেও কোটার কারণে আরও সীমিত। শতকরা ৫৬ ভাগ চাকরি যদি কোটাধারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকে তবে মেধাবীরা যাবে কোথায়?
দেখা যায়, কোটার কারণে কম মেধাবী ও কম যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীদের চাকরি হয়ে যাচ্ছে। অথচ পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো ফললাভকারী ও তুলনামূলকভাবে বেশী মেধাবীরা চাকরি পাচ্ছে না, চাকরি আশায় ঘুরে ঘুরে মরছে। আরও দু:খজনক ঘটনা, যে ৪৪ শতাংশ চাকরির সকলের জন্য উন্মুক্ত তারও একটা বড় অংশ সরকারের অনুগত-অনুসারীরা নিয়ে নিচ্ছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে। অনেকেই মনে করেন, সরকারের বিভিন্ন বিভাগে যোগ্য ও উপযুক্ত কর্মকর্তার নিদারুণ অভাব রয়েছে। এবং সর্বত্র যেরকম অনিয়ম, দুর্নীতি, অযোগ্যতা ও শ্লথতা দৃশ্যমান তার মূলে রয়েছে কোটাপ্রথা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে কম যোগ্য ও মেধাবীদের নিয়োগ দেয়া। যদি সরকারী চাকরির ক্ষেত্রে মেধাবীদের অগ্রাধিকার দেয়া হতো তাহলে এ অবস্থা কখনোই সৃষ্টি হতো না। বরং প্রশাসন ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আরো কার্যকর ও গতিশীল হতো। সরকারী চাকরিতে কোটার কেউ বিরোধী নয়; এমন কি যারা এখন আন্দোলন করছে তারাও নয়। তবে সেই কোটা যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত হতে হবে। এদিকে বেসরকারী খাতে উচ্চ শিক্ষিত ও মেধাবীদের চাকরির সুযোগ খুব বেশী নেই। ব্যাংকিংখাত ধসে পড়েছে। বিনিয়োগ নেই। শিল্প কারখানা যা আছে তার অবস্থাও ভালো নয়। ব্যবসা-বাণিজ্যে চলছে মন্দা। শিক্ষা এখন রাহুগ্রাসে পতিত। সেখানেও মেধাবীরা সুযোগ পাচ্ছে না। এর ওপরে রয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্বিচার দলীয়করণ। সব মিলে অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গীন। এ অবস্থা উত্তরণে যে নীতি-ব্যবস্থা, নৈতিক অবস্থান, সাম্য ও সুশাসন থাকার কথা, তাও নেই। বলা বাহুল্য, যোগ্য ও মেধাবীদের উপেক্ষা করে কোনো দেশ এগিয়ে যেতে পারেনা। আজ সরকারী চাকরিতে কোটা, ভর্তিতে কোটা, যানবাহনে কোটা-সর্বত্র কোটা আর কোটা। কোটার কারণে যার যা প্রাপ্য, তা সে পাচ্ছে না। আজ শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা যে আন্দোলন করছে, পুলিশী ব্যবস্থা নিয়ে তা দমন করা যাবে না। উল্টো তা ব্যাপক আকারে দেশময় ছড়িয়ে পড়বে। এ ব্যাপারে একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান করতে হবে এবং সরকারকেই সেটা করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কোটা সংস্কার


আরও
আরও পড়ুন