পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মোহাম্মদ অংকন:
শব্দ দূষণ এখন ‘শব্দসন্ত্রাস’ নামে পরিচিত। এই শব্দসন্ত্রাস দূর্বিষহ করে তুলেছে জন-জীবন। শব্দ দূষণের উৎসগুলো আপনার আমার সকলের নাগালের মধ্যে। যেমন, বিয়ে বা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানসহ নানা সামাজিক-রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে উচ্চ শব্দে মাইকে গান বাজানো যেন একটা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নেতার জন্মদিন, মৃত্যুবার্ষিকী বা বিশেষ দিবসগুলোতে সারাদিন-রাত ধরে উচ্চ শব্দে মাইক বাজিয়ে শব্দ দূষণের মাত্রাকে বাড়িয়ে চলেছে। এসব বন্ধের প্রতিবাদ করতে কারও কি সাহস আছে? জানি, একজনকেও পাওয়া যাবে না।
শব্দ দূষণরোধে আমি আপনিই বা কেন প্রতিবাদ করব? দেশে তো আইন রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে অন্য কথা। দেশে শব্দ দূষণ প্রতিরোধে আইন থাকলেও তার তেমন কোনো প্রয়োগ নেই। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কারও সাহসও নেই বলে দেশের মানুষজন আজ শব্দকে কানের আহার ভেবে গ্রহণ করছেন। কিন্তু এর পরিণতি যে ভয়াবহ তা আমরা একবারও কানে তুলছি না। এক গবেষণায় জানা গেছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকার মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ কানে কম শুনবে। পরিসংখ্যানটি ঢাকাকেন্দ্রিক হলেও দেশের সকলের জন্যই তা অমঙ্গলজনক এক বার্তা বহন করছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ক্ষমতাবলে শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদন্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদন্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই আইনের তেমন কোনো প্রয়োগ দেখা যায় না। ফলে শব্দ দূষণকারীরা যেমন আইনের তোয়াক্কা করছেন না, তেমনি অসচেতনরা প্রতিনিয়ত শব্দ দূষণ করে জনজীবনকে বিষিয়ে তুলছে। ভুক্তভুগি মানুষগুলো এর ফল সঙ্গে সঙ্গে না পেলেও এর পরিণাম যে সুদূরপ্রসারী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমাদের দেশে শব্দ দূষণ, পানি দূষণ, মাটি দূষণ অর্থাৎ পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে পরিবেশবাদীদের প্রায়ই আন্দোলন, মিটিং-মিছিল করতে দেখা যায়। লেখকদের এ নিয়ে পাতা পাতা লেখাও চোখে পড়ে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় না। তাহলে উদ্যোগগুলো কীভাবে কাজে আসতে পারে? আসল কথা হল, সরকারের যদি একান্ত সদিচ্ছা না থাকে, তাহলে আমার আপনার ও পরিবেশবাদীদের শত চেষ্টা এবং প্রচারণা কোনো কাজে আসবে না। দেশে সবকিছু নিয়েই কম-বেশি আইন আছে। তবে এগুলোর ব্যবহার কি আমরা দেখতে পাচ্ছি? কেউই আইনের সুফল ভোগ করছে না। যদি তাই হয়, তাহলে আইন তৈরি করা হয় কিসের জন্য? এ আইনের সুফল শুধু জনগণের ওপর বর্তায় না। দেশের সরকার যদি চায় অবশ্যই জনগণকে উৎসাহিত করতে পারে। আমরা আন্দোলন করি, শুধু সরকারের কানে পৌঁছানোর জন্য। কিন্তু তা শব্দ দূষণের ভিড়ে গিয়ে সরকারের কানে পৌঁছায় কি? যদি পৌঁছে থাকে, তাহলে আমি ক্ষুদ্র কণ্ঠ দিয়ে বলতে চাই, বিশ্বের অন্যান্য দেশে শব্দ দুষণ রোধ করা সম্ভব হলে আমাদের দেশে কেন রোধ করা যাবে না? আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, প্রয়োজন শুধুমাত্র কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা। আর এটা দেশের সরকার ছাড়া কোনো ব্যক্তি কিংবা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের একার পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়।
শব্দ দূষণের বিদ্যমান পরিস্থিতি তুলে ধরতে আমরা সরকারি কোনো সংস্থার কার্যক্রম লক্ষ করি না। তাদের আশায় বসেও থাকতে পারে না সচেতন মহল। বেসরকারি সংস্থা ‘ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট’ স¤প্রতি ঢাকা শহরের ১০টি স্থানের শব্দ পরিমাপ করে দেখেছে। ঢাকায় নির্ধারিত মানদন্ডের চেয়ে গড়ে প্রায় দেড় গুণ বেশি শব্দ সৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকা শহরের বেশিরভাগ এলাকায় এখন শব্দের সার্বক্ষণিক গড় মাত্রা ১০০ ডেসিবেল। ঢাকায় সাধারণভাবে যানবাহন ও হর্ণের শব্দই শব্দ দূষণের মূল কারণ। তবে এর বাইরে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উচ্চ শব্দে মাইক বা সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করা আরও কয়েকটি বড় কারণ। আজকাল প্রতিটি দিন শহরের কোথাও না কোথাও উচ্চ শব্দ সৃষ্টি করে মাইক কিংবা সাউন্ড বক্সে গান বাজাতে শোনা যায়। কোন অনুষ্ঠান বা উপলক্ষ লাগে না, স্থানীয় লোকজন দোকানপাট কিংবা বাসার ছাদে তীব্র শব্দে গান বাজনা ছেড়ে দেয়। এছাড়া শহরে প্রয়োজনীয় কাজে যারা মাইক ব্যবহার করে, তারা কেউই সাধারণ মানুষের কথা না ভেবে শব্দের মানমাত্রার চেয়ে বেশি শব্দ সৃষ্টি করে শব্দ দূষণ করে। এতে যেমন সকলের সমস্যা হয়, তেমনি সচেতনরা বিরক্ত বোধ করে। মোটের ওপর অধিকাংশ লোকজন শব্দ দূষণের কারণে অতিষ্ট সবসময়। এছাড়া যদি আমরা ঘরোয়া শব্দ দূষণের দিকটি বিবেচনায় নেই তা হলে টাইলস লাগানো, ড্রিলিং এগুলোর শব্দ তো আছেই।
সত্য যে, আজকাল সর্বত্র শব্দ দূষণের ক্ষতিকর দিকগুলো আমাদের তাড়া করে ফিরছে। আমাদের অর্থনীতির একটা বড় অংশ আজ সেখানে নষ্ট হচ্ছে। কেননা, উচ্চমাত্রার শব্দের কারণে মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস, বধিরতা, হৃদরোগ, আলসার হওয়ার কারণে এসব থেকে মুক্তি পেতে ডাক্তারের কাছে ঢালতে হচ্ছে অপরিমেয় টাকা। চিকিৎসার জন্য যেতে হচ্ছে বিদেশে। শব্দ দূষণের কারণে মেজাজ খিটমিটে ও বিরক্ত হওয়া স্বাবাবিক ঘটনা। শব্দ দূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু এবং বয়স্করা। আমি একজন তরুণ হয়েও শব্দ দূষণজনিত পীড়ায় ভুগছি। মন দিতে পারছি না পাঠে। যদিও শব্দ দূষণ শিক্ষার্থীদের মনোযোগকে নষ্ট করছে, তবুও হাট-বাজার ও মিল-কারখানা সংলগ্ন এলাকায় স্কুল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। এর বিপরীতটাও বলা যেতে পারে। কিন্তু প্রতিরোধে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ দেখছি না।
আমি বিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে মনে করি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে শব্দ দূষণের প্রভাব বেশ স্পর্শকাতর। যেমন, মায়ের গর্ভে থাকা সন্তানও শব্দ দূষণের কবলে পড়ে ক্ষতির শিকার হতে পারে। অর্থাৎ তাদের শ্রবণশক্তি খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এছাড়া শিশুদের বেড়ে ওঠা বাধাগ্রস্থ হয় এবং গর্ভবতী নারীদের মৃত সন্তান জন্ম দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর আমাদের নিজেদের কথা কি বলব, ক্রমাগত শব্দ দূষণের ফলে আমাদের শ্রবণশক্তি হ্রাস পাচ্ছে, হৃদযন্ত্রের কম্পন ও রক্তচাপ বেড়ে যাচ্ছে, হজমক্রিয়া ব্যহত হচ্ছে ও মাংসপেশীতে খিঁচুনি হচ্ছে।
শব্দ এক প্রকার শক্তি। এই শক্তি আমরা দৈন্দদিন কাজে ব্যবহার করি। কিন্তু এই শক্তি ব্যবহার করতে গিয়ে আমরা অপব্যবহার করে বসি। অযথা শব্দের মাত্রা বাড়িয়ে শব্দ দূষণ করি। শব্দ ব্যবহারে শব্দের মানমাত্রার পরিমাণ আমাদের জানা দরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, আবাসিক এলাকায় শব্দের মাত্রা দিনের বেলা ৫৫ ডেসিবেল, রাতের বেলা ৪৫ ডেসিবেল হওয়া উচিত। বাণিজ্যিক এলাকায় দিনের বেলা ৬৫ ডেসিবেল, রাতের বেলা ৫৫ ডেসিবেল, শিল্পাঞ্চলে দিনের বেলা ৭৫ ডেসিবেল, রাতের বেলা ৬৫ ডেসিবেলের মধ্যে শব্দ মাত্রা থাকা উচিত। আর হাসপাতালে সাইলেন্স জোন বা নীরব এলাকায় দিনের বেলা ৫০, রাতের বেলা ৪০ ডেসিবেল শব্দ মাত্রা থাকা উচিত। তাই আমরা প্রতিদিন এসব স্থানে কত মাত্রার শব্দ তৈরি করছি, তা অবগত থাকা দরকার। এর জন্য সকলের শব্দের তীব্রতা মাপার জন্য ‘অডিওমিটার’ যন্ত্রের সফল প্রয়োগ ঘটাতে হবে। জনগণকে আগ্রহী করে তুলতে হবে যাতে তারা অতিরিক্ত শব্দ সৃষ্টি না করে। যদি শব্দের মানমাত্রা অতিক্রম হয়, তাহলে শব্দ দূষণ রোধকরণে তাগিদ দিতে হবে। প্রচার মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে সচেতন করতে হবে। আর এ জন্য সরকারের আন্তরিকতা খুবই দরকার। সরকারের গৃহিত পদক্ষেপের অংশ হিসাবে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে শব্দ দূষণের মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, গল্পকার
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।