Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বিস্মরণের কাল এবং সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক সঙ্কট

| প্রকাশের সময় : ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী: এক সমুদ্র রক্তের বিনিময়ে আমরা একটি জাতিরাষ্ট্র গঠন করেছি। প্রথমে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রায় ২০০ বছর, অত:পর উপনিবেশোত্তর ২৩ বছরের রক্তাক্ত সংগ্রামের পথপরিক্রমাশেষে এই জাতিরাষ্ট্রের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা শুরু হয়। বৃটিশ ভারতের দ্বিজাতিত্বাত্ত্কি বিভক্তিতে হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় বিভাজন মূল ভ’মিকা রাখলেও শুধুমাত্র ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য দিয়ে যে একটি রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারেনা পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যুদয় তার অন্যতম উদাহরণ। আধুনিক বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র ধর্ম, ভাষা, বর্ণ ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে ধারণ করেই শান্তিপূর্ণ ও সহাবস্থানমূলক সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশে টিকে থাকলেও পাকিস্তান কেন টিকতে পারলনা তা নিয়ে নিবিড় গবেষণা হতে পারে। তবে সাম্প্রতিক বিশ্বইতিহাসে ভাষাকেন্দ্রীক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ একটি বিশিষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। প্রথমত ১৯৫২ সালে এ দেশের তরুণরা রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। দ্বিতীয়ত ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্র করে একটি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে লাখো প্রাণের আত্মাহুতির এমন ইতিহাস বিশ্বের নজিরবিহিন। লাখো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ আজ নানামাত্রিক সংকটে নিপতিত। আমাদের শাসকরা অর্থনৈতিক উন্নতি-অগ্রগতির নানা পরিসংখ্যান তুলে ধরছেন বটে। তবে তাদের এই পরিসংখ্যানের সাথে বাস্তবের কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। আমাদের রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্বৃত্তায়ণ, অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক লুন্ঠণ, বৈষম্য, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয়, দখলবাজি, অবিচার, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, শিক্ষাব্যবস্থায় চরম বিশৃঙ্খলা-মানহীনতা, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অপাঙ্গতেয় অবস্থা প্রত্যক্ষ করে নতুন প্রজন্ম এক ধরনের আত্মগ্লানিতে ভুগতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণ ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে দেশের লাখ লাখ তরুণ যে মূল্যে দেশত্যাগে মরিয়া হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক নেতা, ক্ষমতার সুবিধাভোগি বুদ্ধিজীবীরা যখন দেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার পরিসংখ্যান নিয়ে মঞ্চ গরম করছেন, তখন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ব্যর্থতা, মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ও জননিরাপত্তাহীনতা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে একের পর এক রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে। নিজেদের নাগরিকদের জন্য ভ্রমণ সতর্কতা জারির পাশপাশি বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশে তাদের দূতাবাসের লোকবল এবং বাণিজ্যিক তৎপরতা সীমিত করার ঘোষনা দিয়েছে। নিরাপত্তাহীনতার কথা বলে কয়েকটি পশ্চিমা রাষ্ট্র বাংলাদেশে তাদের কার্গো নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত রেখেছে। আমাদের সরকার বিভিন্ন সময়ে বিদেশিদের আশ্বস্ত করা সত্তে¡ও বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে তারা আস্থা রাখতে পারছেনা বলেই ধরে নেয়া যায়। সা¤্রাজ্যবাদি সামরিক আগ্রাসন, প্রক্সি-ওয়ার, গৃহযুদ্ধ ও সন্ত্রাসী বাহিনীর হামলায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে যখন লাখ লাখ গৃহহীন, নিরাপত্তাহীন মানুষ দেশত্যাগ করে বিপদসঙ্কুল সমুদ্রপথে ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছে। মাঝে মাঝেই এসব অভিবাসিবাহী নৌযান ডুবে সমুদ্রে বিয়োগান্তক সলিল সমাধি ঘটছে, অথবা কোন রাষ্ট্রীয় কোষ্টগার্ড বাহিনীর উদ্ধার অভিযানে অবৈধ অভিবাসিদের জাহাজ আটক হচ্ছে। দু:খের বিষয় ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়-সোমালিয়ার নাগরিকদের পাশাপাশি বাংলাদেশের নাগরিকদের ছবিও বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলাদেশে কোন সামরিক আগ্রাসন নেই, গৃহযুদ্ধ নেই, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা থাকলেও রক্তাক্ত আন্দোলনের অস্থিতিশীলতা নেই। তথাপি লাখ লাখ তরুণ দেশ ছাড়তে চাইছে কেন? দেশের ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করে দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর বদলে দেশ থেকে পুঁজি পাচার করে দিচ্ছেন কেন? দেশের চরম ক্রান্তিকালেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ দেশের যুব সমাজ রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়ছে কেন? শাসকশ্রেনী ও নাগরিক সমাজ এসব প্রশ্নের নির্মোহ বিশ্লেষণ ও জবাব খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হলে দেশের সব সম্ভাবনা পঙ্কিল অন্ধকারে হারিয়ে যেতে পারে।
এই ফেব্রুয়ারীতে মহান ভাষাশহীদদের আত্মদানের ৬৬তম বার্ষিকী পালন করেছি আমরা। একুশে ফেব্রæয়ারীর ভাষাশহীদ দিবস এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবেও পালিত হয়। ভাষার জন্য রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে আত্মোৎসর্গের ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনা বিজড়িত দিবসটির এই স্বীকৃতি আমাদের জন্য অনেক গর্বের বিষয়। কিন্তু যে ভাষা ও সংস্কৃতিকে ঘিরে আমরা একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলাম সেই ভাষা, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রের হালহকিকত নিয়ে দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ এখন দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ভাষা একটি জাতীয় সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান হলেও ভাষার পাশাপাশি মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও উত্তরাধিকারের প্রশ্ন একটি বড় ফ্যাক্টর। একটি সফল ভাষা আন্দোলনের ৬৬ বছর এবং একটি রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভের ৪৬ বছর পর আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্র কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে তার মূল্যায়ণ, বিচার-বিশ্লেষণ এবং উত্তরণের পন্থা নির্ধারণ জাতীয় দিবসগুলোর মূল প্রতিপাদ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু আমরা দেখছি, আমাদের জাতীয় দিবসগুলোও দুর্বৃত্তায়িত দলীয় রাজনীতির নিগড়ে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘যে দেশে গুনীর কদর নেই সেখানে গুণী জন্মাতে পারেনা’। গুনীর গুন এখন ক্ষীন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা যাচাই বাছাই করে তবেই তা কদর বা পুরস্কারের জন্য নির্ধারিত হয়। প্রতিবছর একুশে পদক, বাংলাএকাডেমী পুরস্কার বা স্বাধীনতা পদকের জন্য মনোনীতদের তালিকা দেখলেই এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে। বিশেষ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বা ক্ষমতাসীনদের নেকনজরে না থাকলে এমনকি মৃত্যুর পরেও গুনী ব্যক্তিরা যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় সম্মান ও মযার্দা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। জাতীয় মেধা, মননশীলতা ও অবদানের স্বীকৃতির এমন একচোখা নীতি বিশ্বের আর কোন রাষ্ট্রে আছে কিনা আমার জানা নেই। যদিও স্বীকৃতি বা পুরস্কারের প্রত্যাশায় কোন শিল্পী-সাহিত্যিক কাজ করেননা। তবে শিল্পী-সাহিত্যিকের নিজস্ব অন্তর্গত অনুপ্রেরণার উপাদানের মধ্যে নিজের পরমার্থিক বোধ ও নান্দনিক আনন্দময়তার পাশাপাশি সামাজিক-রাজনৈতিক কমিটমেন্টের সমন্বয় থাকতে হয়। চলমান রাজনৈতিক চিন্তাধারা, অবক্ষয়, সংকট ও সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলোকে শিল্পী,লেখক সাহিত্যিক গতানুগতিক চিন্তার অনেক ঊর্ধ্বে উঠে বৃহদ ও কালোত্তীর্ণ ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলেন। ক্লাসিক সাহিত্যের স্বার্থক রচয়িতারা প্রচীন ইতিহাসের উত্তরাধিকারের সাথে বর্তমান ও ভবিষ্যতের একটি সেতুবন্ধ রচনা করেন। হোমার, ফেরদৌসী, শেক্সপিয়র, আলাউল, মীর মশাররফ, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্যের এলেক্স হ্যালি বা চিনুয়া আচেবে’র রচনায় প্রায় একই প্রকার সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া যায়। স্বার্থক কøাসিক লেখকরা অতীতের সুতোয় বর্তমানের রঙ লাগিয়ে ভবিষ্যতের গালিচা নির্মান করেন। আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতার পেছনে যে সামাজিক-অর্থনৈতিক চিন্তা-দর্শন কাজ করেছিল, অথবা অতীত ও বর্তমানের নিরীখে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ দর্শনের ভবিষ্যতের লক্ষ্য কেমন হবে তার রূপরেখা এ দেশের সাহিত্যিক-দার্শনিকরাই নির্মান করবেন। অগ্রপথিক রাজনৈতিক নেতারা তা থেকে রসদ নিয়ে জনগনের চেতনায় সুখী-সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের সৌধ নির্মান করেন। লড়াই-সংগ্রাম করে আমরা একটি রাষ্ট্র অর্জন করেছি বটে, এই রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রদর্শনের উপাদান সমৃদ্ধ সাহিত্য আমরা এখনো পাইনি। উপরন্তু এক ভয়ানক আত্মবিস্মিৃতির অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে আমাদের আগামীর সকল সম্ভাবনা।
একুশের বইমেলাকে জাতির মননশীলতার প্রতীক বলে দাবী করা হয়ে থাকে। বেশ কয়েক দশক ধরে ফেব্রæয়ারিতে বাংলা একাডেমীর আয়োজনে রমনায় একুশে বইমেলা প্রতিবছরই ক্রমে বিস্তৃত হচ্ছে। বইমেলায় মূলত দেশের নবীন ও তরুন লেখকদের হাজার হাজার গ্রন্থ প্রকাশের ঘটনায় আমরা এখন আর উচ্ছসিত-উদ্বেলিত হতে পারছিনা। বাংলা একাডেমি বইমেলাকে ঘিরে নতুন বই প্রকাশের জন্য দেশের তরুন কবি-সাহিত্যিক ও লেখকদের মধ্যে যে প্রতিযোগিতা দেখা যায় তা এখন এক ধরনের অনৈতিক, অহেতুক প্রতিযোগিতায় পরিনত হয়েছে। এর ফলে প্রতিবছর বইমেলা উপলক্ষে নানা প্রকার হাজার হাজার নতুন বই প্রকাশিত হলেও মননশীল পাঠকের প্রত্যাশিত বইয়ের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল-বিরল। বইমেলা উপলক্ষে তরুণ নবীন প্রবীণ লেখকরা কে কয়টা বই প্রকাশ করছে তা নিয়ে চলমান প্রতিযোগিতা মেধা, সময় ও অর্থের অনেক বড় অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। বই মেলার একমাসে চার পাঁচ হাজার বইয়ের মধ্যে বেশীরভাগই নিম্নমানের কাব্যগ্রন্থ, গল্প ও উপন্যাস। তরুন লেখক-সাহিত্যিকদের কেউ কেউ মেলায় এমন ১০-২০টি বই প্রকাশ করে আত্মতুষ্টিতে ভুগলেও হাজার খানেক কাব্যগ্রন্থের মধ্য থেকে ১০-২০টি মানোত্তীর্ণ কবিতা খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। অন্যদিকে ফেব্রæয়ারি মাস এলেই ভাষাশহীদ ও আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে জাতীয়ভাবে এবং নাগরিক সমাজে এক ধরনের আঁতলামির চর্চা বেড়ে গেলেও হিন্দি চ্যানেলের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সম্পর্কে প্রায় সব পক্ষকেই বিষ্ময়করভাবে নিরব থাকতে দেখা যায়। কেউ যদি এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে আমাদের একশেনীর গণমাধ্যম যেন পাল্টা শোরগোল তুলে সেই সা¤্রাজ্যবাদি স্বার্থের নিগড়ে সেই কণ্ঠ রুদ্ধ করে দেয়। আমাদের প্রতিটি জাতীয় দিবসকে ঘিরে কর্পোরেট মুনফাবাজি ও আঞ্চলিক আধিপত্যবাদি শক্তির কৌশলগত ষড়যন্ত্রের নীলনকশা বাস্তবায়িত হতে দেখা যাচ্ছে। আমাদের পহেলা বৈশাখ, আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারী, ষোলই ডিসেম্বরসহ প্রায় প্রতিটি দিবসকে ঘিরেই রাজনৈতিক -ঐতিহাসিক বিভক্তি ও বিজাতীয় সংস্কৃতির ডামাঢোল ক্রমে গগন বিদারি হয়ে উঠছে। এদেশের কোমলমতি শিশুরা ও সরলপ্রাণ সাধারণ মানুষ সেই বিজাতীয় সংস্কৃতির গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে আধিপত্যবাদি শক্তির লক্ষ্য হাসিলে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করছে। বৃটিশ উপনিবেশোত্তর সাত দশকের রাজনৈতিক ইতিহাস এবং তার পশ্চাদপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯০৫ সালের পর বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন থেকে শুরু করে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তি রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামে যে সাংস্কৃতিক ও বৃদ্ধিবৃত্তিক চেতনা সক্রিয় ছিল তার নেপথ্যে একটি সুদূর প্রসারি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থান্বেষী মহলের সক্রিয় তৎপরতা ছিল। আজকে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের গর্বিত নাগরিক হয়েও সাংস্কৃতিকভাবে দেউলিয়া ও পরমুখাপেক্ষি করে তোলার একটি ভ‚-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পড়েছি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের চরমসীমা অতিক্রম করছে। ৫২ সালে আমাদের বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজ রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পাকিস্তানীদের সাথে কোন আপসে প্রস্তুত ছিলেননা। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশের গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী শ্রেনী আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির উপর হিন্দী ও হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসন বিনাবাক্যে মেনে নিচ্ছেন। আমাদের প্রতিটি জাতীয় দিবসে অধিকাংশ গণমাধ্যমের ভ‚মিকা ইতিহাসের চর্বিত চর্বন এবং রাজনৈতিক আবেগের আতিশয্যসর্বস্ব। আমাদের ঐতিহ্যের অন্যতম উৎসব পহেলা বৈশাখের বর্ষবণের সাথে মোঘল শাসনে ইসলামি ক্যালেন্ডারের পাশাপাশি কৃষিপ্রধান বাঙালী হিন্দু-মুসলমানের লৌকিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্বন হিসেবে বিবেচিত হলেও এ নিয়ে আমাদের একশ্রেনীর গণমাধ্যম ও বৃদ্ধিজীবীর যে ভ‚মিকা দেখা যায় তা’ রীতিমত ভয়াবহ, উদ্বেগজনক।
দেশের মানুষ যদি তার সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং ভিন্ন কোন রাজনৈতিক-অথনৈতিক শক্তির উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মগজধোলাইয়ের শিকার হয়, তবে সে জাতির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভবিষ্যত নি:সন্দেহে অন্ধকার। আমরা এখন এমনই এক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তির ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জাতির এই অবস্থাকে একটি চরম আত্মবিস্মৃতি বা স্মৃতিবিলুপ্তি বলে আখ্যায়িত করেছেন। কোন আত্মবিস্মৃত জাতির মধ্যে কোন সুস্থ্য ও লক্ষ্যাভিসারী অর্জন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যতের সেতুবন্ধন ধসে পড়তে বাধ্য। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শত্রæমিত্র চিহ্নিত করার বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলার পর যে কোন জনগোষ্ঠি অপেক্ষাকৃত সচেতন ও সুসংহত জাতির পদানত জাতি হিসেবে টিকে থাকা ছাড়া বিকল্প কোন অস্তিত্ব থাকেনা। আমাদের চলমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতার শেকড় সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের গর্ভে বেড়ে উঠেছে। পিতৃপুরুষের গৌরবময় উত্তরাধিকার ও সাংস্কৃতিক সম্পদের বিষ্মরণ আমাদেরকে একটি দুর্বল ও পদানত জাতিতে পরিনত করছে। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতাকে একটি সম্ভাবনার সোপানে নিয়ে যেতে হলে বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে মুক্তিও মূলধারার শেকড় সন্ধানী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের সম্পদকে সমুন্নত রাখতে হবে।

[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাজনৈতিক


আরও
আরও পড়ুন