Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শিক্ষার মানহীনতা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক সঙ্কট

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১৩ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০৩ এএম

আমাদের জাতীয় ইতিহাস শত বছরের শোষণ বঞ্চনার ইতিহাস। দুইশ’ বছরের বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে শুরু হওয়া বৈষম্য ও নিপীড়নের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পথপরিক্রমা সাতচল্লিশ এবং একাত্তুরের স্বাধীনতা, মানচিত্র ও পতাকা বদলের পরও শেষ হয়নি। মূলত একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজের মধ্যে যেসব মৌলিক শিক্ষা ও মানবিক-মানসিক চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ প্রয়োজন তার অনুপস্থিতির কারণে আজও আমরা একটি সর্বব্যাপী সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ যন্ত্রে বন্দী হয়ে আছি। ভাষা ও জাতিগত ভাবাবেগকে অগ্রাহ্য করে পাকিস্তানী শাসকদের সংকীর্ণ শিক্ষানীতি অত:পর স্বাধীন বাংলাদেশে শতকরা ৯০ ভাগ মানুষের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক লক্ষ্য বিসর্জন দিয়ে বস্তুবাদী, সেক্যুলার শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের উদ্যোগের মধ্য দিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কার্যত জনবিচ্ছিন্ন শিক্ষাব্যবস্থায় পরিনত হয়। আজকে আমাদের সমাজে যে অবক্ষয়, সহিংসতা, অসহিষ্ণুতা, রাজনৈতি-অর্থনৈতিক বৈষম্য, গণতন্ত্রহীনতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ক্রমবিস্তৃতি লাভ করছে, তা পেছনের মূল কারণটি হচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার শোচনীয় ব্যর্থতা ও বিশৃঙ্খলা। বিশেষত শিক্ষাকে বস্তুগত প্রাপ্তিযোগ এবং ভোগবিলাসের উপলক্ষ্য হিসেবে দাঁড় করিয়ে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থাকে ভোগবাদের অবলম্বন করে তোলা হয়েছে। ইংরেজের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদেরকে শৈশবে শিখিয়েছে, ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে’। আজকের সমাজে ও রাষ্ট্রে যে অন্যায় অবিচার, সম্পদ লন্ঠুন, সম্পদ পাচার এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে চলেছে তার পেছনে রয়েছে তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিত, ক্ষমতাধর আমলা ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ক্ষমতার অপব্যবহার ও ‘বাড়ি-গাড়ীর’ অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা। আমাদের রাষ্ট্রে রাজনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্রিক সুযোগসুবিধার ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠিগত অপব্যবহার ও অপচয় বন্ধ করা না গেলে বৈষম্য ও মানবিক বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব নয়। মূলত শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই তা সম্ভব হতে পারে। দেশের ৯০ ভাগ মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষাকে অগ্রাহ্য করে তথাকথিত আধুনিক, সেক্যুলার ও বিজ্ঞানভিক্তিক বস্তুবাদী শিক্ষা আমাদের সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারেনি। এ ধরণের শিক্ষাব্যবস্থায় সমাজে নতুন একটি উচ্চ শিক্ষিত লুটেরা-লুম্পেন শ্রেণী গড়ে উঠেছে।

সুলতান-মোঘলদের ৮০০ বছরের শাসনামলে এ দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নের রেখাচিত্র খুব বেশি স্পষ্ট না থাকলেও বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে ভারতে দারিদ্র্যবৃদ্ধি ও দুর্ভীক্ষের চিত্র ইংরেজ ঐতিহাসিকদের জবানিতেই উঠে এসেছে। মুসলমানদের আগমনের পর গোঁড়া হিন্দু বর্ণবাদী সমাজের চাপিয়ে দেয়া সংস্কারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ বর্ণহিন্দুরা সহজেই ইসলামের পতাকাতলে সামিল হয়েছিল বলেই খৃস্টীয় দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতকের মধ্যেই এই ভাটিবাংলায় মুসলমানের সংখ্যাধিক্য ঘটেছিল। ইখতিয়ারুদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি মাত্র ১৭ জন অগ্রগামি ঘোড়সওয়ারকে নিয়ে বিনাযুদ্ধে সহজেই বাংলা জয় করে নিয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। শত শত বছর ধরে বাংলা শাসন করা সেন রাজারা রাজপ্রাসাদ ছেড়ে নৌপথে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছিলেন। এরপর বাংলার মুসলমান শাসকরা এদেশের মানুষকে আপন করে নিয়ে অসাম্প্রদায়িক ঐক্যের অনন্য সাধারণ গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস গড়েছেন। পঞ্চদশ- ষোড়শ শতকে বাংলার স্বাধীন বারো ভূঁইয়াদের বেশিরভাগই ছিল মুসলমান। তারা নিজেদের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক ঐক্য, সংহতি ও সাহসিকতায় দীর্ঘদিন দিল্লীর প্রবল প্রতাপশালী শাসকদের অগ্রযাত্রা ঠেকিয়ে বাংলার স্বাধীন সত্তা অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। আটশ’ বছরের মুসলমান শাসনে এ উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল তাই বৃহত্তর শক্তিশালী ভারত রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার বিভেদ, অবিশ্বাস, অনাস্থা, সহিংসতা ও দাঙ্গার ইতিহাস ইংরেজের ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতির ফল। শত শত বছর ধরে সংখ্যালঘু মুসলমানদের দ্বারা হিন্দুদের শাসিত হওয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসকে একটি শক্তিশালী ইনকাম্বেসি ফ্যাক্টরে পরিনত করে স্থানীয় দুই প্রধান ধর্মীয় সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে দ্ব›দ্ব-সংঘাতের বীজমন্ত্র কাজে লাগিয়ে ইংরেজরা তাদের বেনিয়া শাসনকে দুইশ’ বছর প্রলম্বিত করতে সক্ষম হয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের যবনিকা টানতে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন সংগ্রামে মুসলমানদের অবদান ও আত্মত্যাগ ভারতের হিন্দুদের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ থেকে শুরু হওয়া ভারতের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসে হাজারো মুসলমান বীরের নাম মুছে দেয়ার চেষ্টা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তবে ১৭৫৭ সাল থেকেই মুসলমান বিদ্রোহীদের বৃটিশ বিরোধি তৎপরতা শুরু হয়েছিল। সে ইতিহাসে সূর্যসেন, লক্ষীবাঈ, প্রীতিলতা, ক্ষুদিরামদের সহিংসতা ও ত্যাগের কাহিনীকে যেভাবে বীরত্ব দেয়া হয়েছে পাশাপাশি সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করা হাজারো মুসলমান শহীদের মধ্যে আহমদ উল্ল্যাহ শাহ, শের আলী আফ্রিদি বা বেগম হজরত মহলের নাম উঠে আসেনি। শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের কারণে একটি জাতি কিভাবে বিভক্ত ও দুর্বল হয়ে বিশ্বসভার আসন থেকে বিচ্যুত হয়, ভারত তার শ্রেষ্ঠ উদাহরন হতে পারে।

ভারতের সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনাবলীর প্রভাব উপমহাদেশের অন্য দেশগুলোতেও পড়ছে। বিশেষত ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রভাবে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের টানপোড়েন দেখা দিয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতায় গণতন্ত্রহীনতা, আঞ্চলিক বাণিজ্য, অর্থনীতি, কর্মসংস্থান থেকে শিক্ষাব্যবস্থা পর্যন্ত পরোক্ষভাবে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আর এই প্রভাব আমাদের সামগ্রিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে জটিল করে তুলেছে। সেক্যুলার সংবিধান ও হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্যের ভারতে প্রায় ২৫ কোটি মুসলমানের বসবাস। এটি ভারতের ডায়াসপোরায় বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মুসলিম জনগোষ্ঠি। এই জনগোষ্ঠিকে দ্বিতীয় সারির নাগরিকে পরিনত করাই যেন ভারতের চলমান হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অন্যতম লক্ষ্য। জায়নবাদী চক্রান্তে পশ্চিমাবিশ্বে ইসলামোফোবিয়া বিস্তার ঘটানো হয়েছিল। ইসলামোফোবিয়ার সেই লক্ষ্য পশ্চিমাবিশ্বে কার্যত বুমেরাং হলেও সবচেয়ে অস্বাভাবিক ও অকল্পনীয়ভাবে ভারতে তা চরম আকারে বিস্তার ঘটানো হচ্ছে। এ কারণে নোয়াম চমস্কি, জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা গ্রেগরী স্ট্যান্টনসহ পশ্চিমা সমাজত্বাত্তি¡ক , দার্শনিক ও বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা ভারতে একটি মুসলমান জেনোসাইডের আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। ভারতীয় শাসকদের সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, প্রতিবেশিদের প্রতি আধিপত্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তারা উপমহাদেশে কাযর্ত বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। চীনের সাথে সাম্প্রতিক উত্তেজনা ও সীমান্তযুদ্ধের সময় নেপাল, ভূটানের মত দেশকেও ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে দেখা গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইন, কাশ্মিরীদের উপর অন্যায় নিয়ন্ত্রণের বিরোধি হওয়া সত্তে¡ও বাংলাদেশের সরকার ভারতের সাথে একতরফা বন্ধুত্ব অক্ষুন্ন রাখতে সচেষ্ট রয়েছে। গত একযুগে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টসহ এমনসব সুযোগ সুবিধা আদায় করে নিয়েছে যা বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের পরিপন্থী। চলমান বিশ্বব্যবস্থায় চীন-মার্কিন-রাশিয়া কেন্দ্রিক মেরুকরণের টানাহেঁচড়ার মধ্যেও বাংলাদেশ ভারতের নিয়ন্ত্রণের বলয় থেকে বের হয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে আমাদের আমলাতন্ত্র এবং ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রভাব লক্ষ্যনীয় হয়ে উঠেছে। গত কয়েকদিনের কয়েকটি ঘটনায় তা অনেকটা স্পষ্ট।

ভারতের কর্ণাটকে একজন কলেজছাত্রী হিজাব পড়ে কলেজে যাওয়ায় গেরুয়াধারী যুবকদের আক্রমণের শিকার হওয়া মুসকান খানের আল্লাহু আকবার ধ্বনির ভিডিও সারাবিশ্বে ভাইরাল হয়েছে। এ নিয়ে ভারতে বড় ধরণের সামাজিক-রাজনৈতিক আলোড়ন হয়েছে। তবে বাংলাদেশে একটি স্কুলের ছাত্রীরা হিজাব পড়ে স্কুলে যাওয়ার কারণে বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা আমোদিনী পাল ২০ জন ছাত্রীকে পিটিয়েছেন। তবে ইতিবাচক দিক হচ্ছে, ছাত্রীদের অভিভাবক ও স্থানীয়দের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হলেও তা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ায়নি। হিজাব পড়ার কারণে ২০ ছাত্রীকে বেধড়ক পেটানোর ঘটনায় দেশের তথাকথিত সুশীল সমাজের তেমন কোনো মাথাব্যথাও নেই। তবে শ্রেণীকক্ষে বিক্রমপুরের স্কুলশিক্ষক হৃদয় মন্ডলের ইসলাম বিদ্বেষী বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় পুলিশ যখন সেই শিক্ষককে আটক করেছিল তখন দেশের সব হাই-প্রোফাইল বুদ্ধিজীবী সেলিব্রেটিরা হৃদয়মন্ডলের মুক্তির দাবিতে শুধু বিবৃতি দিয়েই বসে থাকেন নি, কেউ কেউ শাহবাগে মঞ্চ সাজিয়ে বসেছিলেন। কপালে টিপপরা নিয়ে একজন পুলিশ সদস্যের কথিত কটুক্তির জন্য গণমাধ্যমে যতটা আলোড়ন পড়তে দেখা গেল, হিজাব পড়ে স্কুলে যাওয়ায় ২০ ছাত্রীকে বেধড়ক পিটানোর বিরুদ্ধে তার সিকিভাগ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি! গত দুইদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রলীগ নেতার একটি বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হতে দেখা গেল। প্রসঙ্গ হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় নামাজের জায়গা দাবি করেছে মুসলমান ছাত্রীরা, এর প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন নাকি বলেছেন, ‘মোল্লাতন্ত্রের কাছে বলি হতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি নাই, মোল্লাতন্ত্রের কবর রচনার জন্যই আমাদের আসা’। রমজান মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ে নামাজের জায়গা চাওয়া যদি মোল্লাতন্ত্র হয় তাহলে দেশের সব মুসলমানের ঘর এবং মসজিদ-মাদরাসায় কি মোল্লাতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে? মোল্লাতন্ত্রের কবর রচনা করতে কি আমরা মসজিদ এবং নামাজের স্থানগুলো বন্ধ করে দেব? আমার ধারণা আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের সমর্থকদের শতকরা ৯০ ভাগ তার এ বক্তব্য সমর্থন করবে না। তাহলে এরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন? কাদের স্বার্থে এমন বক্তব্য দিয়েছেন? এদের হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও ছাত্র রাজনীতি নিরাপদ কিনা সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী মুসলমান। একইভাবে হলগুলোতে অন্যন্ন ধর্মালম্বীদেরও প্রার্থনার স্থান রয়েছে। টিএসসিতে ছাত্রীদের জন্য নামাজের স্থান বরাদ্দ করা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এখতিয়ার ও দায়িত্ব। এখানে মোল্লাতন্ত্রের গন্ধ খোঁজা অবান্তর। এটা ইসলাম বিদ্বেষের বহি:প্রকাশ।

আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয় সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। উচ্চ শিক্ষিত নৈতিক অধ:পতিত দুর্নীতিবাজ ও শাসকশ্রেণীর বিপথগামিতা ও লুটেরা মানসিকতাই এর জন্য দায়ী। জনগণের ভোটের চেয়ে যদি সমাজের উপর সন্ত্রাসী-মাস্তানদের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা কায়েম করা যায়, তাহলে ক্ষমতার জন্য ভোটের রাজনীতিতে জনগণের জবাবদিহিতা বা তাদের কাছে ধর্ণা দেয়ার প্রয়োজন হয় না। এ কারণে যে যত বড় সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, লুটেরা, দখলবাজ-গডফাদার, সে ততবড় নেতা। সমাজে ও রাজনীতির মাঠে মানুষ ততবেশি তাকে সমীহ করে চলে। যদিও ক্ষমতার মসনদ উল্টে গেলে লোকচক্ষুর অন্তরালে আত্মগোপন করা ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা থাকে না। লোকলজ্জার ভয়ে নয়, এতদিন যাদের উপর আধিপত্য-নির্যাতন চালিয়েছিল তাদের পাল্টা অ্যাকশন থেকে বাঁচতেই এই পালিয়ে বাঁচার প্রয়াস। অপরাধ বিজ্ঞান বলে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরাধি নিজেই অপরাধের স্বাক্ষর রেখে যায়। আর সামাজিক-রাজনৈতিক নেতৃত্বের অবক্ষয় ও অপরাধ প্রবণতার শুরু হয় ছাত্র রাজনীতি তথা ছাত্রজীবন থেকে। একদিকে পরিবারে পিতামাতাদের ব্যর্থতা, অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোতে নিজেদের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের বেপরোয়া অপরাধ প্রবণতা রুখতে মূল নেতৃত্বের ব্যর্থতা এ অবস্থার জন্য অনেকাংশে দায়ী। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ উঠে তার খুব কম সংখ্যকেরই সাংগঠনিক ব্যবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। সেই খুব কম সংখ্যাটিও কিন্তু খুব কম নয়। ২০২০ সালে করোনা লকডাউনের সময় সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনার জন্ম দিয়েছিল কতিপয় ছাত্রলীগ কর্মী। সে ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে ছাত্রলীগের আর কোনো নেতাকর্মী এ ধরনের ঘটনার সাহস পেত না। গত সপ্তাগে গাজীপুরের এক ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে থানায় অভিযোগ করেছে এক তরুনী। প্রথমে থানা অভিযোগ গ্রহণ না করলেও তরুনী ফেইসবুক লাইভে গিয়ে ধর্ষনের বিচার দাবি করা ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর কালিয়াকৈর থানা পুলিশ মামলা নিতে বাধ্য হয়। সরকারি দলের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী হলে অপরাধের মামলা না নেয়া না বা পক্ষপাতিত্বের এই সংস্কৃতির নামই বিচারহীনতার সংস্কৃতি।

দেশে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ রাজনৈতিক মামলায় আটক আছেন। কয়েকদিন আগে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে লিফলেট বিলি করতে গিয়ে বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন ঢাকায় গ্রেফতার হয়েছেন। বিতর্কিত আইসিটি আইনে দেশের প্রথিতযশা সাংবাদিক-মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের আটক করে মাসের পর মাস জেলে বন্দি রাখা হলেও তথাকথিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের কোনো প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। স্কুলের বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয়মন্ডল দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকতা করছেন। পবিত্র রমজান মাসে হঠাৎ করে কেন অপ্রাসঙ্গিকভাবে তাকে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে বিতর্কিত বক্তব্য দিতে হল? আর তাকে আটক করার পর দেশের নামকরা সব বুদ্ধিজীবীরা কেন এতটা হইচই শুরু করলেন? আদালতের স্বাভাবিক আইনী প্রক্রিয়ায় একমাসের মধ্যেই হৃদয় মন্ডলের জামিন হয়েছে। অন্য অনেকের বেলায় এটা হয়নি। সত্তুর বছর বয়েসী অসুস্থ সাংবাদিক নেতা রুহুল আমীন গাজীকে আইসিটি মামলায় বিনা বিচারে ১৭ মাস জেলে থাকতে হয়েছে। দেশে সত্যিকার অর্থে আইনের শাসন থাকলে, মিথ্যা মামলায় বছরের পর বছর ধরে জেলে রাখা সম্ভব হতো না। বিচারবিভাগের স্বাধীনতার কথা বলা হলেও নি¤œ আদালতের বিচারকদের শিক্ষা-দীক্ষা, নৈতিক মান, সমাজের প্রতি ও ন্যায়দন্ডের প্রতি কমিটমেন্টের ঘাটতি প্রকারান্তরে বিচারহীনতাকেই প্রতিষ্ঠিত করছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সংকট, শিক্ষার মানহীনতা, শিক্ষা নিয়ে অনৈতিক মুনাফাবাজির প্রতিযোগিতা জাতি ও সমাজকে একটি নিকষ অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে বৃহত্তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যত্রতত্র ইসলাম বিদ্বেষীদের আস্ফালন সেই বাস্তবতাকেই তুলে ধরে। দেশের মানুষ এ অবস্থার পরিবর্তন চায়।

[email protected]



 

Show all comments
  • jack ali ১৩ এপ্রিল, ২০২২, ১১:৫৪ এএম says : 0
    ইসলামে শিক্ষার প্রচন্ড গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং গবেষণার পর প্রচন্ড গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ইসলামের শিক্ষা ব্যবস্থা হচ্ছে কারিগরি ও বিজ্ঞানভিত্তিক অতীতে মুসলিমরা পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে বড় বিজ্ঞানী ছিলেন শুধু তাই নয় মুসলিমরা পরাশক্তি ছিল কিন্তু যখন মুসলিমরা আল্লাহকে ভুলে গেল তখন কাফেররা মুসলিমদেরকে পিপড়ার মত মারতে মারতে পায়ের তলায় রেখে দিল
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন