Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন | প্রকাশের সময় : ১৭ জুলাই, ২০২২, ১২:০২ এএম

চীন-ভারত-পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে ঘিরে আবর্তিত হয় দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি। কেননা, এ চারটি রাষ্ট্রে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের বসবাস। তাছাড়া অর্থনৈতিকভাবেও ভারত ও চীনসহ দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্র এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী এক দশকেই বিশ্বের নেতৃত্ব চলে আসবে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায়। এর জন্য অবশ্য এ অঞ্চলের শান্তি বজায় রাখতে হবে। এটা অনেকটাই নির্ভর করে চীন ও ভারতের ওপর।

চীন এক বিস্ময়কর দেশ। বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতার একটি। চীনে দীর্ঘকাল ধরে এককেন্দ্রিক কমিউনিস্ট শাসন বিদ্যমান। ১৯২১ সালে জুলাই মাসে সাংহাইয়ে জন্ম নেয় চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)। চেয়ারম্যন মাও জেদংয়ের নেতৃত্বে বিরাট চ্যালেঞ্জ, পর্বতপ্রমাণ প্রতিবন্ধকতা ও অভ্যান্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিরোধ মোকাবিলা করে চীন সামনে এগিয়েছে। কার্যত সিপিসির নেতৃত্বেই চীন আজো অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও শক্তিশালী একটি দেশ। চীন বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতিতে নিজের জায়গা করে নিয়েছে।

সিপিসির সঠিক ও যোগ্য নেতৃত্বের কারণেই চীন আজ এ পর্যায়ে এসেছে। মনে হয়, আগামী দশকে চীন পৃথিবীতে এক অন্যরকম বিস্ময় হয়ে আবির্ভূত হবে। ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে চীন বদলে দেবে পৃথিবীর চিরাচরিত নিয়ম নীতি। একটা ত্রিশ তলা ভবন নির্মাণ করবে মাত্র ১৫ দিনে, যেখানে প্রায় এক হাজার মানুষের থাকার জায়গা হবে। একটা ১ হাজার কিলোমিটারের রাস্তা নির্মাণ করবে মাত্র কয়েক মাসে, সেটা যত দুর্গম অঞ্চল দিয়েই হোক। বলাবাহুল্য দুর্গম ও দুর্ভেদ্য অঞ্চল দিয়ে চীন প্রায় ২৫ হাজার কিলোমিটারের একটা রাস্তা নির্মাণ করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে, যেটি মহাচীনকে একই সুতায় গেঁথেছে। আমরা চাই, চীন আরও সামনে এগিয়ে যাক, বদলে দিক পৃথিবীকে। এর জন্য চীনকে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার শান্তি ও স্থিতি অব্যাহত রাখতে পালন করতে হবে নিয়ামকের ভূমিকা।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী দেশ ভারত। জন্মলগ্ন থেকেই ভারতে গণতান্ত্রিক শাসন বিদ্যমান। ভারতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটেই সরকার গঠিত হয়। স্বাধীনতার ৭৪ বছরের ইতিহাসে কংগ্রেসই ভারত শাসন করেছে প্রায় ৫০ বছর। গণতান্ত্রিক শাসনের হাত ধরেই ভারত সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। ভারতের উত্থানও চীনের চেয়ে কম নয়। ধীরে ধীরে একটা শিল্পোন্নত দেশের পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। জিডিপি অকল্পনীয়ভাবে ধরে রেখেছে দীর্ঘ এক দশক ধরে। এ অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতি অব্যাহত থাকলে ভারতও চীনের সমান তালে এগিয়ে যাবে। এর জন্য ভারতকেও দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি বজায় রাখতে পালন করতে হবে বিশেষ ভূমিকা।

দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত রাষ্ট্র বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে দেশটি পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়। অধিক জনসংখ্যা নিয়ে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ১৯৯১ সালে এখানে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা শুরু হয়। এর পর থেকে ঘুরে-ফিরে আওয়ামী লীগ-বিএনপিই বাংলাদেশ পরিচালনা করে আসছে, যদিও জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীসহ আরও বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এখানে রয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার হাত ধরে বাংলাদেশ অকল্পনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটির উপরে মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্প। প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিক এ শিল্পে কাজ করছে। কৃষি উৎপাদনেও বাংলাদেশ ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। নারী শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশুমৃত্যু, মাতৃগর্ভকালীন মৃত্যু, সুপেয় পানি, স্যানিটেশন ও জন্ম নিয়ন্ত্রণে উপমহাদেশে বাংলাদেশ একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। চলমান ধারা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশে প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, যেটা ব্যাহত হয়েছে। এটা কাটিয়ে উঠতে পারলে, বাংলাদেশের উন্নতির ধারাও অব্যাহত থাকবে; বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে তার নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

‘স্ট্যাটেজিক’ কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের তিন দিক জুড়ে ভারতের অবস্থান। সরাসরি ভূমি-যোগাযোগ না থাকলেও চীন বাংলাদেশের নিকটমত দেশ। তাছাড়া দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার মধ্যবর্তী দেশ বাংলাদেশ। এই অঞ্চলে প্রায় ৩০০ কোটি মানুষের বসবাস। বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ রয়েছে। তাই ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর দৃষ্টি বাংলাদেশের দিকে নিবদ্ধ। এখানে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যাচ্ছে।

চীন ও ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিতে অত্যন্ত তৎপর। এ দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের পাহাড়সম বাণিজ্যিক বৈষম্য রয়েছে। তারা শত শত কোটি ডলারের বাণিজ্য করছে বাংলাদেশে। ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে। ভারত কিন্তু বিনিময়ে বাংলাদেশকে কিছু দেয়নি। ভারত গঙ্গা, তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশকে আজও দেয়নি। ভারতের কাছ থেকে এসব আদায় করতে একটি শক্তিশালী সরকারের উপস্থিতি বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য। তাছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি প্রসারিত করতে এবং বাংলাদেশকে উন্নয়নের সর্বোচ্চ শিখরে নিয়ে যেতে চট্টগ্রাম-কুনমিং রেল ও সড়ক যোগাযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই যোগাযোগ ব্যাবস্থার সূত্রধরে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারে অনেক দূর। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য তৈরি হতে পারে অবারিত সুযোগ। ৩০০ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারে বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য। বিস্ময়করভাবে অগ্রগতি হতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির। বাংলাদেশে এখন বিশ্বমানের পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বিশ্বে একটি অন্যতম ব্র্যান্ড। তাছাড়া আরও অন্যান্য ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ বিশ্বমানের পণ্য উৎপাদন করছে, যার ক্রেতা হতে পারে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার মানুষ।

চীনকে ঘিরে বিশ্ব রাজনীতির নতুন মেরুকরণকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব ভালো চোখে দেখছে না। এর ফলে দুনিয়ায় আমেরিকা ও পশ্চিমাদের প্রভাব কমে আসবে বলে তারা মনে করছে। এ জন্য তারা ভারতেকে নিয়ে চীনকে মোকাবিলা করার ফন্দিফিকির করছে। এতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অশান্ত হয়ে উঠতে পারে।

চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের রয়েছে বিশাল সীমান্ত। আর বাংলাদেশের তিন দিক জুড়ে রয়েছে ভারতের সীমান্ত, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ কোনো কারণে অশান্ত হলে, অশান্ত হবে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়া। এর প্রভাব পড়বে দুই অঞ্চলের অর্থনীতিতে। কাজেই দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার শান্তি ও স্থিতি বজায় রাখতে চীন ও ভারতের অগ্রবর্তী ভূমিকা অনস্বীকার্য। এটি বিশেষভাবে অনুধাবন করতে হবে দু’ দেশকে।

লেখক: কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব
আরও পড়ুন