Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গুম-খুনের আতঙ্ক : বিচারহীনতা ও বিচারের প্রহেলিকা

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২২ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ঢাকা-নারায়নগঞ্জের লিঙ্ক রোডে চলন্ত বাস থামিয়ে ২০১৫ সালের ২রা আগস্ট নারায়নগঞ্জের ব্যবসায়ী নুরুল ইসলামকে বুকে গুলি করে হত্যার পর দুই বছর পেরিয়ে গেলেও নুরুল ইসলামের এতিম সন্তানরা এখন পিতৃহত্যার বিচার নিয়ে হতাশ ও সন্দিহান হয়ে পড়েছে। প্রকাশ্য বোমা ফাঁটিয়ে বাস থামিয়ে বাসে উঠে নূরুলকে খুঁজে বের করে তার হাতের ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে বুকে গুলি করে বন্দুক উঁচিয়ে নির্ভয়ে চলে গিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। ওদের মুখে কোন মুখশ ছিলনা, প্রকাশ্য আলোতে খুন করে নির্বিঘেœ পালিয়ে যাওয়ার এই সাহস ও নিশ্চয়তা তারা কোথায় পেয়েছিল? অত:পর যথারীতি মামলা হয়, মরহুমের স্ত্রী বাদি হয়ে নারায়নগঞ্জ সদর থানায় মামলা করেছিল। মামলার এজাহার ও প্রাথমিক তদন্তে অভিযুক্তদের সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। এরা পেশাদার সন্ত্রাসী, ভাড়াটিয়া খুনী, এদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালী ও ভূমিদস্যুরা। তেমন একজন পৃষ্ঠপোষক ভ‚মিদস্যুও মামলার এজাহারভুক্ত আসামী প্রকাশ্য ঘুরে বেড়ালেও গত দুই বছরেও পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেনি যারা গ্রেফতার হয়েছিল তারাও জামিন পেয়ে সর্দপে ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে জানা যায়। বাদিপক্ষের ধারনা তারা কোর্ট এবং পুলিশকে ম্যানেজ করতে লাখ লাখ টাকা খরচ করে দিব্যি প্রকাশ্য ঘুলে বেড়াচ্ছে। তবে পুলিশ বাহিনীতে এখনো অনেক পেশাদার লোক আছেন, যারা যে কোন প্রলোভন এড়িয়ে আইন ও পেশাদারিত্বের প্রতি আস্থা রাখতে চান। নুরুল ইসলাম হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে করা দুই মামলার অন্যতম আসামী ভূঁইগড়ের ভ‚মিদস্যু শাহাদাত মান্নানকে গত সপ্তাহে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে পুলিশের হাতে হত্যা মামলার আসামী আটক হওয়ার পর থেকে মামলার বাদি ও তার পরিবার চরম নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছে। গ্রেফতারের পর আসামীর প্রভাব প্রতিপত্তি সম্পর্কে আন্দাজ পাওয়া গেল। একটি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার তদন্তের জন্য নারায়নগঞ্জের দায়রা জজ আদালতে গ্রেফতারকৃত আসামীর সাত দিনের রিমান্ড চেয়েছিল পুলিশ। কিন্তু বাদির আইনজীবীর রহস্যজনক ভ‚মিকার কারণে আদালত রিমান্ড নামঞ্জুর করেছে। যেখানে ভিত্তিহীন মামলায় রাজনৈতিক নেতাদের যত্রতত্র রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে. সেখানে একটি নৃসংশ হত্যা মামলার অন্যতম আসামীকে রিমান্ডে নিতে ব্যর্থ হল পুলিশ। আইনজীবীর রহস্যজনক ভ‚মিকায় মামলার বাদি ক্ষুব্ধ ও হতাশ। দেশে প্রতিমাসে এমন অসংখ্য খুন, গুম, অপহরণ ও অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনার বেশীরভাগই মামলা হলেও বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আসামীরা পুলিশের হাতে ধরা পড়েনা। ধরা পড়লেও তদন্তের দুর্বলতা, উকিলের বিশ্বাসঘাতকতা, বাদির নিরাপত্তাহীনতা এবং নেপথ্যের প্রভাবশালী ও লাখ লাখ টাকার কারসাজিতে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও ভাড়াটিয়া খুনিরা পার পেয়ে যায়। বিচারের বানী আর্তনাদ হয়ে ভয়ে আতঙ্কে একসময় মুক বধির হয়ে থেমে যায়।
সারাদেশে এমন হাজারো ঘটনার সাক্ষ্য পাওয়া যায়। সব ঘটনার প্রতিবেদন পত্রিকার পাতায় উঠে আসেনা। এমন হাজারো ঘটনায় সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বা রাজপথে প্রতিবাদের ঝড় ওঠেনা। কোন কোন ঘটনার ভুক্তভোগিরা অনেক কিছু হারিয়েও চুপ থাকতে বাধ্য হন নিজের জীবন ও পরিবারের অন্যদের নিরাপত্তার কথা ভেবে। এমন আতঙ্কের কাল এমন দমবন্ধ অবস্থাকে উন্নয়ন অগ্রগতির কাল হিসেবে মেনে নিতে পারেনা। অথচ সরকারের মন্ত্রী এমপি আমলারা দেশে ব্যাপক উন্নয়নের সাফল্যের দাবী করছেন। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে মন্দা, কর্মসংস্থানে স্থবিরতা, বৈদেশিক রেমিটেন্স ও রফতানী বাণিজ্যে মন্দা, ক্রমবর্ধমান সামাজিক অবক্ষয়, অপরাধ প্রবণতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মত নেতিবাচক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রবণতার মধ্যেই বেড়ে চলেছে গুম-অপহরণ ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি জাতিকে বিপন্ন বিপর্যস্ত করে তুলেছে। রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও সংগঠন, শিক্ষাঙ্গণ, বিচারাদালত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ রাষ্ট্রের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান মানুষের আস্থার সংকটে পড়েছে। সর্বস্তরের মানুষের নিরাপত্তাহীনতা ও আস্থার সংকট নিয়ে কোন দেশ সামনের দিকে এগুতে পারেনা। এমনকি উন্নত বিশ্বেও কখনো কখনো সামাজিক-অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। লন্ডনে, প্যারিসে বা নিউইয়র্কের মত শহরেও অন্তর্ঘাত সাবোট্যাজে সাধারণ মানুষ হতাহত হওয়ার ঘটনা মাঝে মধ্যেই ঘটতে দেখা যাচ্ছে। এমন সব ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধিদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে দেরি করেনা। এ কারণেই এ ধরনের ঘটনার যত্রতত্র পুনরাবৃত্তি ঘটেনা। আর সন্ত্রাসের মত অপরাধমূলক ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তার তার তদন্ত করে অপরাধিদের দ্রুত শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। সেখানকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে নিয়োগ ও পদায়ণের ক্ষেত্রে প্রার্থীর ব্যক্তিগত ফিটনেস, দক্ষতা ও পেশাদারিত্বই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হিসেবে স্বীকৃত। এরপরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের অপরাধি সদস্যদের নিয়ে ব্যাপক সামাজিক প্রচারনা রয়েছে। হলিউডের অনেক ছবিতে লসএঞ্জেলেস বা ডেনভারের পুলিশ বাহিনীর একশ্রেনীর সদস্যের অপরাধের চিত্রায়ণ ঘটেছে। মাতাল হয়ে বেপরোয়া গাড়ী চালনা, মিথ্যা অভিযোগে সাধারণ মানুষকে হেনস্তা করার মত অপরাধগুলোই মূলত: পশ্চিমা বিশ্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুরুতর অপরাধ হিসেবে মনে করা। বর্ণবাদি সন্ত্রাসী গ্রুপ কেকেকে(কু ক্লাক্স ক্লান)এর এক সদস্য টেক্সাসের পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়ে ৬ জন আফ্রো-আমেরিকানকে মাদক পাচারকারির মিথ্যা অভিযোগে আটক করে শাস্তির জন্য কোর্টে চালান করার মত ঘটনা সেখানে অনেক বড় দৃষ্টান্ত। অপরাধি পুলিশ সদস্যরা নি:সন্দেহে পুলিশ বাহিনী বা তাদের মূল কাজের প্রতিনিধিত্ব করেনা। তবে তাদের কাজের দ্বারা পুরো বাহিনী তো বটেই সামগ্রিকভাবে দেশ ও জাতির যে ক্ষতি হয় তা সহজে পুরণ হবার নয়। এ কথা স্বীকার করতেই হবে, সবদেশেই পুলিশের মধ্যে কমবেশী অপরাধি সদস্য আছে। লাখ লাখ পুলিশ সদস্যের মধ্যে ১০-২০জন অপরাধি সদস্য থাকা অসম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতা হচ্ছে- দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে পুলিশ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা অনেক কম হলেও পুলিশ বাহিনীতে অপরাধি বা অপরাধপ্রবণ সদস্যের সংখ্যা হাজার হাজার। গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, নানা ধরনের অরাধের দায়ে গত ৭ বছরে প্রায় ৭৫ হাজার পুলিশ সদস্যকে বিভাগীয় শাস্তি দেয়া দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে তিরস্কার, পদন্নোতি আটকে দেয়া,অর্থদন্ড, বদলি, সাময়িক বরখাস্ত এবং চাকুরীচ্যুতির মত শাস্তি রয়েছে। পেশাগত দায়িত্বহীনতা ও অসততার পাশাপাশি পুলিশের অপরাধি সদস্যরা ছিনতাই, অপহরণ, মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করে হয়রানি, মাদক ব্যবসা, ডাকাতি, চাঁদাবাজি এমনকি ভাড়াটিয়া খুনি হিসেবে কাজ করে থাকে। নিজেরা সরাসরি অপরাধের সাথে জড়িত হয় এবং সংঘবদ্ধ চোর-ডাকাত, ছিনতাইকারী ও মাদক চোরাচালানিদের সাথে যোগ সাজশ রেখে তারা মোটা অংকের মাসোহারা পেয়ে থাকে বলে অভিযোগ আছে। গুম-অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় এবং ভাড়াটিয়া খুনি হিসেবে একসাথে সাতজনকে হত্যা করার মত অভিযোগও সাম্প্রতিক সময়ে প্রমানীত হয়েছে।
পুলিশ ও র‌্যাবের একাধিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীর নিকটাত্মীয়সহ অন্তত ১৮ জনের বিরুদ্ধে ফাঁসি, যাবজ্জীবনসহ গুরুদন্ড হয়েছে নারায়নগঞ্জের সাতখুন মামলায়। এনসিসি’র প্রভাবশালী একজন কাউন্সিলর, সিনিয়র আইনজীবীসহ সাতজনকে আদালত পাড়া থেকে প্রকাশ্য দিবালোকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার পর তাদেরকে ঠান্ডা মাথায় খুন করে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেয়ার ২ দিন পর লাশ ভেসে উঠলে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি আঙুল উঠার পর গোমর ফাঁস হয়ে গেলে র‌্যাবের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অভিযুক্ত হয়। প্রধান আসামীর ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বিচারের ভবিষ্যত নিয়ে বাদিপক্ষ ও জনমনে সংশয় দেখা দিলেও অবশেষে বিচারে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হওয়া আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপরাধি সদস্যদের জন্য একটি বড় দৃষ্টান্ত হয়েছে। নারায়নগঞ্জের সাতখুনের আগেও পরে এমন আরো অনেক ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযুক্ত হলেও নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় র‌্যাব-পুলিশ সদস্যদের গুরুদন্ডের বিষয়টি যেন একটি বিচ্ছিন্ন বাস্তবতা। পুলিশের অপেশাদার ও গুরুতর অপরাধের বিচার না হওয়াই দেশের আইন-শৃঙ্খলার অবনতি তথা জননিরাপত্তা ভেঙ্গে পড়ার জন্য দায়ী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রভাবশালীদের গুরুতর অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত না হলে সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। পুলিশ কর্তৃপক্ষ যদি অপরাধের প্রকৃতি ও মাত্রা অনুধাবন করতে ও স্বীকার করতে ব্যর্থ হন তাহলে অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন সুদুরপরাহত। এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে উটপাখির মত বালিতে মাথাগুঁজে নিজেকে লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। ‘গুম-অপহরণের মত অপরাধ সব সময়ই ছিল’ পুলিশ মহাপরিদর্শকের এমন মন্তব্য থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে তিনি বাস্তব অবস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা মেনে নিতে নারাজ। রাজধানীতে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যাকান্ড, ইলিয়াস আলী ও তার ড্রাইভারসহ বিএনপি শতাধিক বিএনপি নেতাকর্মী অপহরণ, অসংখ্য বিচারবহির্ভুত হত্যাকান্ড, যুদ্ধাপরাধ মামলার বিচারসহ চাঞ্চল্যকর মামলার সাক্ষিরা আদালতপাড়া থেকে নিখোঁজ হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব ঘটনার সাথে জড়িতদের খুঁজে বের করতে না পারায় এসব ঘটনার দায় মূলত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপরই পড়ছে। তবে সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যতই দোষারোপ করুন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের তাতে যেন ‘কুছ পরোয়া নেহি’। অতএব দেশে জনমনে আতঙ্ক এবং আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দা ও চাপ সত্বেও গুম-অপহরণের মত ভয়ঙ্কর অপরাধ বন্ধ হচ্ছেনা। গত সোমবার একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে গত পৌনে ৯ বছরে দেশে ৩৯৫ জন নিখোঁজ হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। নিখোঁজ হওয়ার পর ৫২ জনের লাশ পাওয়া গেছে, এবং ১৯৫জন ফিরে আসলেও এই তালিকার ১৪৮ জন এখনো নিখোঁজ রয়েছে। প্রতিদিনই এই তালিকার আকার বাড়ছে। গত তিনমাসে শুধু ঢাকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ব্যাংক কর্মকর্তা, পুস্তক প্রকাশক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ীসহ অন্তত ১২জন নিখোঁজ হয়েছেন। তাদের মধ্যে আইএফআইসি ব্যাংকের কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ ফিরে আসলেও ড. মোবাশ্বার হাসানসহ অন্যদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। গত ২৭ আগস্ট গুলশানে ইউনিয়ন ব্যাংকের একটি মিটিং থেকে বের হওয়ার পর ৭ বারের সিআইপি এবং বেলারুশের অনারারি কনসাল অনিরুদ্ধ রায়কে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায় অপহরণকারিরা। এরপর দীর্ঘ ৮১ দিন তাকে অজ্ঞাত স্থানের একটি কক্ষে আটক রাখার পর গত বৃহষ্পতিবার গুলশানের বাসায় ফিরে আসার পর অনিরুদ্ধ রায় অপহরণের পেছনে তার ব্যবসায়ীক অংশিদারের হাত রয়েছে বলে দাবী করেছেন। তবে ৮১ দিন যে প্রক্রিয়ায় আটকে রাখা হয়েছিল তাতে তিনি এটা বুঝতে পেরেছেন যে তারা খুবই পেশাদার। অনিরুদ্ধ বাবু ফিরে এসে তার ব্যবসায়ীক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আঙুল তুলে অভিযুক্ত করতে পারলেও দেশে গুম-অপহরণের শিকার হওয়া শত শত মানুষ এ সুযোগ পায়নি, পাচ্ছেনা।
গুম হওয়ার ৮১দিন পর একজন অনিরুদ্ধ রায় আপনজনের কাছে ফিরে এসেছে এটা আনন্দের সংবাদ। গত কয়েক বছরে যে সব নাগরিক গুম হয়েছে তাদের বেশীরভাগই ফিরে আসেনি। অনেকে লাশ হয়ে কেউ কেউ বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে কবরের মাটিতে ঠাঁই পেয়েছে। হয়তো অনেকের লাশের সন্ধ্যান এখনো পরিবারের আপনজনরা পায়নি। তাদের ভাগ্যে যা’ই ঘটুক পিতার ফিরে আসার জন্য সন্তানের, সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের, স্বামীর জন্য স্ত্রী ও ভাই-বোন, বন্ধুদের অপেক্ষার কোন শেষ নেই। সবাই প্রত্যাশায় বুক চেপে বসে আছে একদিন হয়তো কোন এক সকালে অনিরুদ্ধ রায়ের মত বাড়ির দরজায় কড়া নেড়ে বলবে আমি ফিরে এসেছি। যারা গুম হচ্ছেন তাদের অনেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাকে অথবা পরিচয়ে কোন সাদা মাইক্রোবাসে চেপে এসে কোন সাক্ষি না রেখে ওয়ারেন্ট না দেখিয়ে বলছে আপনাকে থানায়-ডিবি অফিসে যেতে হবে। এরপর তার কোন খোঁজ নেই, কোন বাহিনীই আটকের কথা স্বীকার করছেনা। গতমাসে কক্সবাজারে ডিবি’র ৭ সদস্য জনৈক ব্যবসায়ীকে আটক করার পর তাকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে তার পরিবারের কাছ থেকে ১৭ লাখ টাকা নিয়ে মুক্তি দেয়ার পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বরত সেনাসদস্যদের হাতে টাকাসহ ধরা পড়েছে। অভিযুক্ত ডিবি সদস্যদের চাকুরীচ্যুত করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনগত প্রক্রিয়াও চলছে। যদি সেখানে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি না থাকতো, তাহলে স্থানীয় থানা পুলিশ এতেরকে ধরার কোন উদ্যোগ নিত কি? অথবা নারায়নগঞ্জের সেভেন মার্ডারের মত ডিবি পুলিশ যদি কোন প্রতিপক্ষ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে কক্সবাজারের সেই ব্যবসায়ীকে হত্যা করে মেরিণ ড্রাইভে ফেলে যেত অত:পর পুলিশ, র‌্যাব বা গোয়েন্দা বিভাগের পক্ষ থেকে অস্বীকার করা হত যে তাদের কোন টিম এ কাজ করেনি, তাহলে তার সত্যাসত্য উদঘাটনের দায়িত্ব কার? মোটা দাগে বলতে গেলে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সে দায়িত্ব পালনে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হচ্ছে। তার চেয়েও দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে পুলিশ কর্তৃপক্ষ অবস্থার ভয়াবহতা সম্পর্কে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। গুম-অপহরনের সাথে বিচার বহিভর্’ত হত্যাকান্ডের সাথে যে বাহিনীর সদস্য বা অপরাধি চক্রই জেড়িত থাক, তাদেরকে ধরে আইনের আওতায় আনা পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব। র‌্যাব, পুলিশ, ডিবি’র অপরাধপ্রবণ সদস্যদের গুরুতর অপরাধে লঘুদন্ডে অবস্থার কোন পরিবর্তন হচ্ছেনা। সাত, বছরে ৭৫ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তির পর এসব পুলিশ সদস্যের পেশাগত বা নৈতিক চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটেছে কি? ঘটলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অপরাধপ্রবণতা অনেক কমে আসত। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতে বিপুল সংখ্যক অপেশাদার ও অপরাধি সদস্য রেখে এবং অপরাধের তদন্তে ঘাটতি রেখে দেশে আইনের শাসন বা জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। দেশে আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে পুলিশ, আইনজীবী এবং বিচার বিভাগের অপরাধপ্রবণ সদস্যদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনতে একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী দুর্নীতি ও অপরাধদমন গোয়েন্দা ইউনিট গঠন করা আবশ্যক। গুম-খুনের আতঙ্ক ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির পথ চিরতরে রুদ্ধ করাই হবে কাঙ্খিত সমৃদ্ধ ও নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। দেশে কার্যকর গণতন্ত্র ও সুশাসন না থাকলে এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্ভাবনা অতীব ক্ষীন।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: খুন

৩১ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ