হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মাহমুদুর রহমানের মতো বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের ওপর ছাত্রলীগের কর্মীরা আদালত প্রাঙ্গনে যেভাবে বর্বরোচিত আক্রমন করেছে, রক্তাক্ত করেছে, তাতে সবাই বিস্মিত হয়েছেন। গত ২২ জুলাই কুষ্টিয়ার আদালত প্রাঙ্গনে ঘটে যাওয়া সে ন্যাক্কারজনক ঘটনা এখন সবার মুখে মুখে। শুধু তাই নয়, তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সুবাদে তা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন কর্নার থেকে উঠেছে নিন্দা-ধিক্কারের ঝড়।
কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি ইয়াসির আরাফাতের দায়ের করা একটি মানহানি মামলায় জামিনের জন্য হাজিরা দিতে ওইদিন সেখানে গিয়েছিলেন মাহমুদুর রহমান। সেখানে কী ঘটেছিল তা এখন আর কারো জানতে বাকি নেই। তাই তার পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন মনে করছি। তবে, মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলা, প্রশাসন ও পুলিশের ভূমিকা ইত্যাদি আলোচনার দাবি রাখে। ছাত্রলীগ সভাপতি মামলাটি করেছিল একটি অনুষ্ঠানে মাহমুদুর রহমান বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ‘কটুক্তি’ করেছিলেন- এই অভিযোগে। অভিযোগটির ব্যাপারে কথা বলা এ মুহূর্তে সমীচীন মনে করছি না। কারণ বিষয়টি বিচারাধীন। মাহমুদুর রহমান আদতেই তেমন কোনো কটুক্তি করেছিলেন কীনা সেটা তদন্তে প্রমাণিত হবে। হয়তো তিনি তার স্বভাবজাত তীর্যক ভাষায় সমালোচনা করেছিলেন। সেই সমালোচনাকেই হয়তো ছাত্রলীগ নেতা ‘কটুক্তি’ হিসেবে ধরে নিয়ে মামলা ঠুকে দিয়েছে।
গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতার এই সময়ে (সরকার যেহেতু বলে দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতা বিদ্যমান) বাংলাদেশের নাগরিকদের যে কোনো বিষয়ের যৌক্তিক সমালোচনা করার অধিকার রয়েছে। তবে, তা অবশ্যই হতে হবে শালীনতা ও শিষ্টাচার রক্ষা করে। মাহমুদুর রহমান যদি বঙ্গবন্ধু বা তাঁর কন্যা ও নাতনি সম্বন্ধে কোনো অশোভন উক্তি করে থাকেন, তার বিচারের দায়িত্ব তো বর্তেছে আদালতের ওপর। আর ছাত্রলীগ সভাপতি স্বয়ং শরণাপন্ন হয়েছে আদালতের। তাহলে কেন সে আবার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মাহমুদুর রহমানের ওপর? তাহলে কি এটাই ভেবে নিতে হবে যে, ছাত্রলীগ নেতা আদালতের ওপর ভরসা করতে না পেরে মাহমুদুর রহমানকে শায়েস্তা করার দায়িত্ব নিজের হাতেই তুলে নিয়েছে?
গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ ও সংবাচিত্রে দেখা গেছে, ছাত্রলীগ কর্মীরা যখন মাহমুদুর রহমানের ওপর লাঠিসোটা নিয়ে হামলা চালাচ্ছিল, তাকে বহনকারী প্রাইভেট কারটি ভাঙচুর করছিল, পুলিশ তখন ঘটনাস্থলেই নির্বিকার দাঁড়িয়েছিল। যেন তারা কোনো রাস্তার মোড়ে ‘ভোজবাজি খেলা’ বা ‘বাঁদর নাচ’ উপভোগ করছে। দেশের একজন বিশিষ্ট নাগরিককে কতিপয় সশস্ত্র ব্যক্তির দ্বারা আক্রান্ত হতে দেখার পরও তাদের বিবেক কর্তব্য পালনে সজাগ হয়ে ওঠেনি। ছাত্রলীগ কর্মীদের আক্রমণে আহত হওয়ার পর মাহমুদুর রহমান কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপারকে বলেন, ‘আপনি আমাকে মার খাওয়ালেন।’ তিনি ওই হামলাকে পারকল্পিত বলেও অভিযোগ করেন। তার এ অভিযোগের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলোর অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। কেননা, সংবাদ মাধ্যেমের খবরে বলা হয়েছে, মাহমুদুর রহমান আদালতে প্রবেশ করার পর পরই ছাত্রলীগ কর্মীরা এসে জড়ো হয় এবং একরকম ঘেরাও করে রাখে আদালত ভবন। আর সেজন্যই আক্রান্ত হতে পারেন- এ আশঙ্কায় তিনি জামিন পাওয়ার পরও আদালত ভবন থেকে বের হচ্ছিলেন না। পরবর্তীতে কুষ্টিয়া সদর থানার ওসি এবং কোর্ট ইন্সপেক্টর তাকে একটি সাদা গাড়িতে তুলে দেন। গাড়িটি কয়েক গজ যেতে না যেতেই ছাত্রলীগের কর্মীরা ঝড়ের গতিতে এসে হামলে পড়ে মাহমুদুর রহমানের গাড়ির ওপর।
পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মাহমুদুর রহমানের কুষ্টিয়ার আদালতে হাজিরা দিতে যাওয়ার বিষয়টি আগেই জানিয়েছিলেন। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মাহমুদুর রহমানের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য বলেছিলেন। পরবর্তীতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সে কথা স্বীকারও করেছেন। বলেছেন, ‘বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আমাকে ফোন করে জানিয়েছিলেন, মাহমুদুর রহমান কুষ্টিয়ার আদালতে যাচ্ছেন, তাকে যেন নিরাপত্তা দেয়া হয়। এরই মধ্যে শুনতে পাই তাকে ঘেরাও করা হয়েছে। তখনই আমি কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এস এম মেহেদী হাসানকে জানাই, কুষ্টিয়ার একটি মানহানি মামলায় মাহমুদুর রহমান জামিন নিতে গেছেন, তাকে যেন নিরাপত্তা দিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু তারপরও এ হামলার ঘটনা ঘটল। যারা তাকে জখম করেছেন তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কীনা এখনই বলা যাবে না। তবে, নিকট অতীতের দৃষ্টান্তসমূহ এ ব্যাপারে দেশবাসীকে খুব একটা আশ্বস্ত করতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ, বিগত কয়েক বছরে এমন অনেক ঘটনাই দেশে ঘটেছে এবং এ ধরনের ‘কঠোর ব্যবস্থা’ নেয়ার ঘোষণাও অনেক শোনা গেছে। কিন্তু সেসব ঘোষণা আর বাস্তবায়িত হয় নি। তাছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে একটু ফাঁক রয়েছে, যেটা কুষ্টিয়া জেলা পুলিশের জন্য রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করতে পারে। তিনি বলেছেন যে, তিনি পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন মাহমুদুর রহমানকে নিরাপত্তা দিয়ে একটি গাড়িতে তুলে দিতে। পুলিশ সুপার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। তিনি মাহমুদুর রহমানকে নিরাপদেই গাড়িকে তুলে দিয়েছিলেন। ছাত্রলীগ হামলা করেছে মাহমুদুর রহমান গাড়িতে ওঠার পর। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি পুলিশকে নির্দেশ দিতেন মাহমুদুর রহমানকে পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে দিতে, তাহলে হয়তো এ ঘটনা নাও ঘটতে পারত।
এদিকে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, মাহমুদুর রহমানের মতো একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি, যিনি প্রতিমন্ত্রীর মর্যদায় রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেছেন, একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সমপাদক (পত্রিকাটি সরকারের রোষানলে পড়ে এখন বন্ধ রয়েছে), তার ওপর হামলা চালানোর সাহস জেলা লেভেলের ছাত্রকর্মীরা পেল কোথায়? এর পেছনে উঁচু পর্যায়ের কারো কোনো ইশারা ইঙ্গিত ছিল কি? সে রকম একটি আভাস পাওয়া যায় সিনিয়র সাংবাদিক সোহরাব হাসানের একটি মন্তব্যে। গত ২৪ জুলাই প্রথম আলো’তে প্রকাশিত বিশেষ নিবন্ধে তিনি মন্তব্য করেছেন, “শোনা যায়, কুষ্টিয়ার একজন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা নাকি মাহমুদুর রহমানকে ‘হালকা নাশতা’ করানোর কথা বলেছিলেন। সেই হালকা নাশতা ‘ভারী’ হয়ে যাওয়ায় এখন আওয়ামী লীগ বিব্রত।” ঘটনার পেছনের ঘটনা যদি সত্যিই এমনটি হয়ে থাকে, তাহলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তৃক হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘেষণা যে অনন্তকাল ইথারে ভেসে বেড়াবে, বাস্তবের মুখ দেখবে না, তাতে সন্দেহের কিছু নেই।
ছাত্রলীগের কর্মীদের সাম্প্রতিক কর্মকান্ড নিয়ে যত কম বলা যায় ততই ভালো। এদের তৎপরতা দেশবাসীর মধে যুগপৎ বিস্ময় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। দেশবাসী বিস্মিত এই ভেবে যে, এমন একটি ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা এমন বল্গাহীন উচ্ছৃঙ্খলতা প্রদর্শন করে কীভাবে? এরা কী এদের অভিভাবক সংগঠন আওয়ামী লীগ ও সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে? তারা আরো বিস্মিত এ ভেবে যে, যে দল এবং সরকার নিজেদেরকে গণতান্ত্রিক বলে দাবি করে, তাদের ছাত্র সংগঠন এমন বেপরোয়া হয়ে ওঠে কী করে! এমন কি তাদের লিগ্যাল গার্জেন প্রধানমন্ত্রীর ‘ধমক’ও তাদেরকে নিরস্ত করতে পারছে না। সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ২১ জুলাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণসংবর্ধনার পর ছাত্রলীগ নেতারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে এলে তিনি তাদেরকে বলেছেন- কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে ছাত্রলীগের বাড়াবাড়ির খবর তিনি জানেন। আর যেন এ ধরনের বাড়াবাড়ির খবর তিনি না শোনেন। গণমাধ্যমকে এ কথা জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। কিন্তু বিস্ময়কর সংবাদ হলো, প্রধানমন্ত্রীর ‘শাসনে’র চব্বিশ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই রাজধানীতে ছাত্রলীগের ‘বীর সৈনিকেরা’ কোটা আন্দোলনকারীদের কয়েকজনকে বেধড়ক পিটিয়েছে! পাশাপাশি মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলা করে কুষ্টিয়ার ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাও তাদের শক্তিমত্তার জানান দিয়েছে। আর দেশবাসী এসব দেখেশুনে আতঙ্কিত নিজেদের জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে। কখন কোন অজুহাতে ছাত্রলীগের ছেলেরা কার ওপর হামলে পড়বে তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই।
মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলার ঘটনা বিবেকমান মানুষ মাত্রকেই বেদনাহত করেছে। তার ওপর ছাত্রলীগের হামলায় তারা যেমন বিস্মিত, ততোধিক বিস্মিত হয়েছেন তিনি যাদের পক্ষে ভূমিকা রাখছেন তাদের ভ‚মিকা দেখে। মাহমুদুর রহমান জাতীয়তাবাদী ঘরানার বুদ্ধিজীবী। বিএনপির গত সরকারের সময় প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের রোষানলে পড়েছেন বিএনপির পক্ষে ভূমিকা রাখার কারণেই। তিনি কুষ্টিয়ায় ছাত্রলীগ কর্তৃক আক্রান্ত হলেন। অথচ সেখানকার বিএনপি নেতাকর্মীরা টু শব্দটি পর্যন্ত করলো না! বিএনপি মহাসচিব মাহমুদুর রহমানের নিরাপত্তার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন করলেন। কেন, তিনি কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সভাপতি-সেক্রেটারীকে বলতে পারতেন না, নেতাকর্মীদের নিয়ে আদালত প্রাঙ্গণে জমায়েত হতে? তারা যাদ সেদিন সেখানে সমবেত হতো, তাহলে দুই পক্ষের অবস্থানের কারণে প্রশাসন বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হতো। তাহলে আর মাহমুদুর রহমানকে অসহায়ের মতো মার খেতে হতো না। বিএনপি নেতাকর্মীদের এ ভাবলেশহীন অবস্থান সবাইকে ক্ষুব্ধ করেছে।
এদিকে একটি কৌতুককর ঘটনা ঘটিয়েছে কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের নেতারা। গত ২৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করে তারা মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলার বিচার দাবি করেছে। সংবাদ সম্মেলনে জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি বলেছে, ‘ওই ঘটনা ছাত্রলীগ ঘটায়নি। বিএনপি ও জামায়াত ঘটিয়েছে। পুলিশ খুঁজলেই দোষীদের ধরতে পারবে। সে আরো বলেছে, হামলাকারীরা মুখোশ পড়া ছিল। ছাত্রলীগ কখনো মুখোশ পড়ে হামলা করে না।’ কথা মিথ্যে বলেনি ছাত্রলীগ সভাপতি। তারা যে মুখোশ ছাড়াই হামলা করে তার প্রমাণের অভাব নেই। তবে, মাহমুদুর রহমানের ওপর বিএনপি-জামায়াত হামলা করেছে এ ধরণের উদ্ভট কথা কেউ বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না। কারণ শাক দিয়ে যে মাছ ঢাকা যায় না, এটা কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি বিস্মৃত হলেও এ দেশের মানুষ তা ভালোভাবেই জানে।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।