শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
আহমদ রাজু
চায়ের দোকানে যেয়ে যখন জানতে পারি কেউ একজন বস্তায় ভরে তিনটি কুকুর ছানা রেললাইনের পাশে ফেলে রেখে গেছে তখনই আমার মনটা বিষাদে ভরে ওঠে। কে করলো এমন কাজ? এও কি সম্ভব! যদি তার সন্তানদের এভাবে কোলশূন্য করা হয় তাহলে তার মনের অবস্থা কি হবে? তার মনে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আর কোন আশা অবশিষ্ট থাকবে? আমার মনে হয় তার শরীরে যদি সামান্যতম মনুষ্য রক্ত থাকে তাহলে সন্তান হারানো বেদনা সহ্য করতে পারবে না।
আমি সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে দোকানের পেছনে রেললাইনের পাশে যাই। একটি কালো আর একটি লাল বাচ্চা তখন রেললাইনের পাথরের ওপর খুনসুটিতে মগ্ন। অপেক্ষাকৃত ছোট বাচ্চাটা একটু দূরে শুয়ে আছে মাটিতে মুখ লাগিয়ে; দৃষ্টি তার আমার দিকেই। তার করুণাভরা চোখে চোখ পড়তেই আমার চোখ দু’টি ছল ছল করে ওঠে। মুখ থেকে অজান্তে বেরিয়ে আসে- আহারে, এতটুকু দুধের বাচ্চাকে তার মায়ের কোলছাড়া করলো কোন পাষাণ! এক গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমার কর্মস্থলের দিকে রওনা হই। বাচ্চাগুলোকে দেখে আমি চা পান করার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। যখন মনে আসে তখন আর ইচ্ছে হয় না চা পান করার। আমি ফিরে আসি কর্মস্থলে।
বসুন্দিয়া মোড় বাজার ইদানীং বেশ জমজমাট। সকাল থেকে গভীর রাত অবধি চলে বেচাকেনা। যশোর-খুলনা-নড়াইলের সংযোগ সড়ক হওয়ায় এখানকার গুরুত্ব অনেক বেশি। তাছাড়া আশপাশের ব্যাঙের ছাতার মতো গজানো শিল্প কারখানার অবদান অনেক বেশি। রাস্তার দু’ধারে দোকানপাট আর পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বুড়ি ভৈরব নদী। রেললাইনটার অবস্থান বাজারের দক্ষিণ-পশ্চিমে। তীরের মতো এক জায়গায় গোটা তিরিশেক দোকানঘর। দোকানের সামনে যশোর-খুলনা মহাসড়ক আর পেছনে রেললাইন। সন্ধ্যার পর রেললাইনে সারিবদ্ধভাবে বসে উঠতি বয়সী তরুণ-যুবকেরা আড্ডা দেয়, নেশা করে। তবুও কোন অঘটন ঘটেনি কোনদিন। এদিক দিয়ে এখানকার গুরুত্ব একেবারে কম নয়।
হেকমত ইলেকট্রিক বাস রাস্তার দক্ষিণে। আমি এই দোকানেরই কর্মচারী। দোকানের মালিক হেকমত ভাই নেহাত ভাল বলে মাঝে মাঝে চা বিরতি দেয়; আমিও লুফে নিই সেই মুহূর্ত। কর্মচারী বলে সে কখনও বর্তমানে দেশের এনজিও কর্মীদের মতো আমার ওপর স্টিমরোলার চালায় না। সেদিক দিয়ে আমাকে ভাগ্যবান বলতে হয়। তাই বলে এই নয় যে, আমি আমার অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করি।
সন্ধ্যা ঘোর ঘোর। আমি অভ্যাসবশত চায়ের দোকানে যাই। বাচ্চা তিনটির কথা মনে পড়তেই তাদের খুঁজতে থাকি। না, কোথাও নেই। মুহূর্তে মনটা খারাপ হয়ে যাই। কোথায় গেল বাচ্চাগুলি? তাদের সাথে খারাপ কিছু হলো না তো? উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে আমি চায়ের দোকান লাগোয়া সাইকেল ভ্যানের গ্যারেজ মালিক বিলায়েত কাকাকে জিজ্ঞাসা করি, বাচ্চাগুলোকে সে দেখেছে কিনা।
বিলায়েত কাকা তখন ভ্যানের পাংচার হওয়া চাকা সারতে ব্যস্ত। প্রশ্নটা শুনে সে এগিয়ে আসে আমার দিকে। বলল, হ্যাঁ বাপ। এই দিকে আয়; বলে আমাকে নিয়ে যায় পাশের পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা গোলাকার একটা বড় ফুলের টবের কাছে; যা উবুড় হয়ে আছে। উপরের ভাঙা জায়গাটা বস্তা দিয়ে ঢাকা। আমি কোন কিছু ভাবার আগেই সে বস্তা উঁচু করে বলে, এই দ্যাখ।
আমি উবু হয়ে তাকিয়ে দেখি বাচ্চা তিনটি জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে তার ভেতর। মুহূর্তে মনটা আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে ওদের ভালভাবে থাকতে দেখে। সামান্য গ্যাজের মিস্ত্রির এমন পশুপ্রীতি দেখে গরিব এই মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি আমার অনেকাংশে বেড়ে যায়। জিজ্ঞাসা করি- কিছু কি খেতে দিয়েছিলেন কাকা। আমার কথার উত্তরে বলে, রুটি কিনে দিছিলাম। বড় দুডো খাইচে। ছোটডা একবার মাত্র শুহে দেহে আর খায়নি। দুধের বাচ্চা, ও দুধ ছাড়া আর কিছু খাতি শিহিনি।
-কাকা আমি কি একটু দুধ এনে দেখবো খায় কি না?
-ও চিষ্টাকি আমি এরিনি? আনে দিহিলাম। খায়নি।
-তাহলে কি হবে এখন? না খেতে পারলেতো মারা যাবে?
-কি এরবো ক? যারা এই দুধির বাচ্চা এহানে ফেলিছে তারাতো মানুষ না, জানোয়ার। বড় দুডো বাঁচলিও ছোটডারে বাঁচানো যাবে না।
-কাকা জানোয়াররা কি এ কাজ করে?
-তা করে না বাপ। দুনিয়ার সবচাইতে নিকৃষ্ট গালি দিলিও তাগের সঠিক দিয়া হবে না।
-আমি আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারি। কিন্তু মানুষতো এমনই হয় কাকা।
কাকা আর কথা বাড়ায় না। তার কাজের দিকে অগ্রসর হয়। আমি বাচ্চা তিনটির মাথায় হাত বুলিয়ে বস্তাটা দিয়ে ঢেকে ফিরে আসি।
তিনদিন অতিবাহিত হয়েছে। ছোট বাচ্চাটা কিছুই মুখে দেয়নি। সে সময় বাড়ার সাথে সাথে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। আমি অনেকবার খাওয়ানোর চেষ্টা করেছি, পারিনি। মাঘ মাস। দেশে প্রচ- শৈত্যপ্রবাহ চলছে। প্রথম দিন তিনজনই টবের ভেতরে যেতে পারলেও পরের দুই দিন ছোটটা তার ভেতরে যেতে পারেনি। সে টবের বাইরে শুয়ে ছিল। আমি সন্ধ্যার পর যেয়ে তাকে টবের ভেতরে দিয়েছিলাম বরাবরই। আজ বিকেলে যখন ওদের দেখতে যাই তখন ছোট বাচ্চাটাকে দেখে আমার মনের অবস্থা কি হয়েছিল তা লিখে বোঝাতে পারবো না। একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে মাটির সাথে। চোখ দুটি তার আমার দিকে। দু’টি মাছি ঘোরাফেরা করছে; চোখের মনির ওপর দিয়ে- পাপড়ির ওপর দিয়ে। তাতে কোন অনুভূতি নেই- তাড়াবার ক্ষমতা নেই বাচ্চাটার। হাতদুয়েক দূরে অন্য বাচ্চা দুটো মাটিতে শুয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি সেখানে যেতেই তারা আমার কাছে ছুটে আসে। যেন বলছে, আমাদের ছোট ভাইটার অপরাধ কি? সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবেরা তোমরা এভাবে মারছো কেন? এই কি তোমাদের শ্রেষ্ঠত্ব! আমি ওদের চোখের ভাষার কোন জবাব দিতে পারি না। বাচ্চাটার গায়ে হাত দিই। হ্যাঁ, এখনও জানটা আছে। তবে নড়াচড়া বলতে কিছুই নেই। পাশের টিউবওয়েল থেকে পানি এনে বাচ্চাটার মুখে দিই এক, দুই তিন। একবার শুধু ঢোক গিলতে দেখি; তারপর সব শেষ। যেন সে আমার হাতে পানি খাবার জন্যে এতক্ষণ বেঁচে ছিল। বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসছিল আমার। পারি না। কারণ, আমরা যে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। আমাদেরতো পশুপাখিদের যথেচ্ছা মারার অধিকার আছে! তাদের জন্যে আমাদের দুঃখ পাওয়া সাজে না!
বিলায়েত কাকাকে ডাক দিই। কাকা ছুটে আসে আমার ডাকে। বাচ্চাটা আর বেঁচে নেই জেনে বেলায়েত কাকার মনটা বিষাদে ভরে যায় বুঝতে পারি। বলল, তরু আমি জানতাম, এই বাচ্চাডাকে বাঁচানো যাবে না। আমার কতাডাই শেষপর্যন্ত সত্যি অলো।
কাকা লুঙ্গির খুট দিয়ে চোখ মোছে যা আমার চোখ এড়ায় না। ক্ষণেক নীরব থেকে আমাকে উদ্দেশ করে সে আবারো বলে ওঠে, দেখদি বাপ পারিস কিনা বাকি দুডো বাচ্চারে বাড়ি নিয়ে যাতি।
-ইচ্ছে হয় কাকা। পারিনাতো। আমাদের বাড়ির পাশে অনেকগুলো কুকুর রয়েছে। বাচ্চাদুটোকে নিয়ে গেলে তারা আর আস্ত রাখবে না। দেখামাত্র মেরে ফেলবে।
-তা ঠিক। হ্যানেও জ্বালা। মাঝে মাঝে আশপাশের কুকুর আসতেছে। আমাগের সবার চোহির সামনে আছে বলে তাড়াতি পারি।
-এই কারণে আমি বাচ্চাগুলোকে বাড়িতে নিতে পারিনি। তা না হলে প্রথমদিনই নিয়ে যেতাম। বছর পাঁচেক আগে একটা বাচ্চা নিয়ে গিয়েছিলাম। পরের দিন পাশের বাড়ির বড় একটা কুকুর এসে এক কামড়ে তার মাজা ভেঙ্গে দিয়েছিল। তারপর ক’দিন ভুগে সে মারা যায়। স্থানীয় ডাক্তারের চিকিৎসায় কাজ হয়নি সেদিন।
অতুল দাসকে সবাই মাতাল বলে জানে। তবে মাতলামির কারণে সে কারো ক্ষতি করেছে এমন নয়। কিংবা কারো সাথে দুর্ব্যবহার করেছে তাও নয়। তবে তাকে কেন মাতাল বলা হয় জানি না। মাতালের আভিধানিক ব্যাখ্যা কি তা জানা নেই। অতুল দাস কোনো ব্যাখ্যায় পড়ে কিনা বুঝতে পারি না। সবচেয়ে বড় কথা, অন্তত আমি তো তাকে কোনদিন মাতাল অবস্থায় দেখিনি।
লোকটা একেবারে ভাল নয়। একটা মাতাল লোক। এমন মাতাল লোক এ তল্লাটে আর একটাও নেই। কথা উঠলে অনেকে বলে, তার কথা বাদ দাও; সে একটা মাতাল। লোকটাকে যদি প্রশ্ন করা হয় সেকি আপনার কোন ক্ষতি করেছে? উত্তরে সে বলবে, ক্ষতি করুক আর নাই করুক, তবু সেতো একটা মাতাল- বাজে লোক।
লোকের মুখের কথায় আমার অল্প অল্প বিশ্বাস হয় সে মদ খায়। তাকে আমি অনেকদিন থেকে চিনি, জানি। তাকে মদ খেতেতো দূরে থাক তার কাছ থেকে মদের গন্ধও পায়নি। তবুও লোকে বলে তাই...। সব কথার পর অতুল দাসের ওপর আমার আত্মবিশ্বাস আছে শতভাগ। অন্তত সে মাতাল নয়।
সকাল নয়টা। গতকাল বাচ্চাটার বিয়োগ আমাকে মর্মাহত করেছে। মনটা ব্যথাতুর খুব। কিছুক্ষণ আগে দোকানে হাজিরা দিয়ে যাই চায়ের দোকানে। চা খাওয়া হবে আর বাচ্চাদুটোকে দেখা হবে। চায়ের দোকানদার মোদাচ্ছের কাকাকে চা বানাতে বলে দোকানের পেছনে বাচ্চা দুটোকে দেখতে যাই। ফুলের টবের দিকে তাকিয়ে দেখি ঢেকে রাখা বস্তাটা অপেক্ষাকৃত দূরে পড়ে আছে; যা সাধারণত থাকে টবের পাশেই। আমার হৃদয়টা মোচড় দিয়ে ওঠে। তবে কি খারাপ কিছু! এক বুক হতাশা নিয়ে নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাই; কোথাও বাচ্চা দুটোকে দেখা যায় না। পাশে বিলায়েত কাকা ভ্যান সারতে ব্যস্ত। তাকে জিজ্ঞাসা করতেই সে মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল, অতুল দাস বাচ্চা দুডোরে তার বাড়ি নিয়ে গেছে।
-কখন?
-সকাল সাতটার দিকি।
-সত্যি, কাকা!
-হ্যায়।
-কিভাবে নিয়ে গেল?
-বস্তায় ভরে।
গতকাল বাচ্চাটার মৃত্যুতে যতটা ব্যথা পেয়েছিলাম ঠিক ততটাই আনন্দিত হই কথাটা শুনে। বললাম, বাচ্চাদুটো নিশ্চিত বেঁচে গেছে। এখানে থাকলে একদিন না একদিন তারা মারা পড়তোই; হয়তো ট্রেনে কেটে নয়তো বাসচাপায়।
বিলায়েত কাকা বলল, যারে আমরা সবসময় মাতাল বলে জানিছি সেই আজ যে দিষ্টান্ত স্থাপন করলো তা আমরা সভ্য মানুষগুলোকি দেহাতি পারিচি?
-সত্যি কথা বলেছেন, কাকা। আমরা তার মহত্ত্বের কাছে কিছুই না।
অতুল দাসের প্রতিবেশী ছবেদ গোলদার বেঞ্চে বসে ছিল। আমাদের কথা শুনে বলল, দেহিচো মাতালের কা-। বাজারের কুকুরির বাচ্চা বাড়ি নিয়ে উঠোইছে। বাড়িরতে আসার সময় দ্যাখলাম, টিউবওয়েলের নিচে বাচ্চা দুডোরে শ্যামফু দিয়ে গা ধুয়াচ্চে! তার মুখে বিদ্রƒপের হাসি।
অতুল দাস একটা মাতাল সেটা শুনেছি অনেকবার। তবে সে যে তথাকথিত সভ্য মানুষের চেয়ে একেবারে অন্য মাতাল সেটা আজই জানলাম। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে আমার অতুল দাসের প্রতি। যদি সমস্ত দেশ এমন মাতালে ভরে যেত তবে কতই না ভাল হতো। এ দেশ-এ ঘুণেধরা সমাজে এমন মাতালদের প্রয়োজন। অতুল দাসের এমন মাতলামি দেখে আমারও মাতাল হতে ইচ্ছে করে। অতুল দাস, আমাকে তোমার মতো মাতাল বানাবে? আমিও তোমার মতো মাতাল হবো।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।