Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামিক স্টেট মসুল ও রাক্কা হারালেও নিশ্চিহ্ন হবে না

| প্রকাশের সময় : ১ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মিডল ইস্ট মনিটর ও ভোয়া : ইসলামিক স্টেট যদি মসুল ও রাক্কা হারায়ও তবু তারা নিশ্চিহ্ন হবে না। খিলাফত ভেঙ্গে গেলেও ভবিষ্যতে আইএসের তৎপরতা অব্যাহত থাকতে পারে। যোদ্ধা সংগ্রহ, অস্ত্র নিরাপত্তা, অর্থ সংগ্রহ ও বিদেশে হামলা চালানোর সক্ষমতা রয়েছে তাদের। তাই ইরাক ও সিরিয়ায় এলাকা হারালেও বিদেশে তারা হামলা অব্যাহত রেখেছে।
ইরাকি কর্মকর্তারা ঘোষণা করেছেন, দায়েশের (ইসলামিক স্টেট বা আইএসের সংক্ষিপ্ত আরবি নাম) খিলাফতের বিলুপ্তি ঘটেছে। কয়েক মাসের যুদ্ধ ও মার্কিন বিমান হামলার পর ২৯ জুন ইরাকি সেনাবাহিনী বলেছে যে তারা মসুলের সর্বশেষ ঘাঁটি থেকে আইএসকে বিতাড়িত করার শেষ পর্যায়ে আছে। একজন ইরাকি জেনারেল রাষ্ট্রীয় টিভিকে বলেন, ইরাকি সৈন্যরা প্রতীকী গুরুত্বপূর্ণ মসুলের বড় মসজিদ দখল করেছে যদিও তিনি দাবি করেন যে আইএসই মসজিদটি ধ্বংস করে দেয়ায় মসজিদের স্থানে ধ্বংসাবশেষ ছাড়া কিছু নেই। তিনি বলেন, আইএসেরর কল্পিত রাষ্ট্রের পতন ঘটেছে। ইরাকি কর্তৃপক্ষ বলেছে, ২১ জুন আইএস যোদ্ধারা ঐতিহাসিক আল নূরী গ্র্যান্ড মসজিদটি ধ্বংস করে দেয়। তিন বছর আগে আইএস প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদি শুক্রবার এ মসজিদ থেকে ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
সিরিয়া ও ইরাকে আইএসের নিয়ন্ত্রণে থাকা সর্বশেষ দু’টি শহর রাক্কা ও মসুলের আশু পতনের সাথে আইএস তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকার অধিকাংশই হারিয়েছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত মসুল বড় মসজিদ ইরাকি বাহিনীর দখলে যাওয়ার অর্থ ইসলামী খিলাফতের অবসান ঘটার প্রকাশ্য নিদর্শন। ইরাক ও সিরিয়ায় অধিকাংশ এলাকা আইএসের হাতছাড়া হওয়ার ফলে তাদের বিদেশী যোদ্ধাদের স্বঘোষিত খিলাফতে পৌঁছনোর পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু তা সত্তে¡ও আইএসের যোদ্ধা সংগ্রহ, অস্ত্র নিরাপত্তা, অর্থ সংগ্রহ ও বিদেশে হামলা চালানোর সক্ষমতা রয়েছে। তাই ইরাক ও সিরিয়ায় এলাকা হারালেও বিদেশে তারা হামলা অব্যাহত রেখেছে।
দায়েশ সিরিয়া ও ইরাকে তাদের খিলাফত অবসান ও শীর্ষ নেতাদের সম্ভাব্য হারানোর আশু ক্ষতির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। মধ্য জুনে রাশিয়া বলে যে তারা রাক্কার কাছে বিমান হামলা চালিয়ে আল-বাগদাদিকে হত্যা করেছে বলে মনে করে। তবে এখন পর্যন্ত তার মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এদিকে আইএসের যুদ্ধ অব্যাহত রাখা ও নতুন হামলা চালানো থেকে মনে হয়, তাদের শীর্ষ নেতা হারানোর ক্ষেত্রে গ্রæপটির আপৎকালীন পরিকল্পনা রয়েছে।
এটা পরিষ্কার যে দায়েশ ‘নেতাহীন জিহাদ’- এর পন্থা গ্রহণ করেছে । এক বছরেরও বেশী সময় ধরে আইএস পাশ্চাত্যে ‘লোন উল্ফ’ পদ্ধতিতে হামলাকে উৎসাহিত করছে। উগ্রপন্থায় দীক্ষিত ব্যক্তিরা দায়েশ নেতাদের আহবানে সাড়া দিয়ে তাদের হাতের নাগালে যা পেয়েছে- ট্রাক, গাড়ি, ছুরি ও কুঠার নিয়ে একাকী অবস্থায় হামলা চালিয়ে সংগঠনের অস্তিত্ব প্রদর্শন করেছে। দায়েশ সংঘবদ্ধ হামলা চালানোর পামাপাশি কখনো কখনো শিথিল সমন্বয়হীন ও এলোমেলো হামলাও চালিয়েছে।
এ সব হামলা আইএসের রণাঙ্গনে পরাজয় ঢাকা দেয়ার চেষ্টায় নিজের শক্তি প্রদর্শনের ঘটনা। তারা এমন ইঙ্গিতও দিয়েছে যে তারা তাদের জিহাদি লড়াইয়ের শিকড়ে ফিরে যাবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এলাকা হারানো আইএসকে দুর্বল করেছে এবং তাদের অনেক অভিযান ব্যর্থ হয়েছে।
দায়েশ নেতারা উপলব্ধি করছেন যে তারা মসুল ও রাক্কায় তাদের রাজধানী দু’টি হারাচ্ছেন। তার অর্থ যে আইএসের খিলাফত তছনচ হয়ে গেছে যা অন্য জিহাদি সংগঠন থেকে তাদের আলাদা বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করেছিল। এ কারণেই তারা বিশ^ সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়েছিল ও বহু বিদেশী জিহাদিকে তাদের পতাকাতলে সমবেত করতে পেরেছিল। তবে স্বেচ্ছায় উগ্রপন্থায় দীক্ষিত এক ব্যক্তি ভিত্তিক ‘লোন উল্ফ’ হামলার উপর নির্ভরশীলতা ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানসিক অস্থিতিশীল লোকদের দ্বারা হামলা পরিচালনা করে দায়েশ তারা যা নয় তার চেয়েও বৃহত্তর কিছু প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়। খিলাফত ভেঙ্গে গেলেও ভবিষ্যতেও আইএসের তৎপরতা অব্যাহত থাকতে পারে।
বস্তুত ইসলামিক স্টেট (আইএস) যদি বর্তমানে পতনের সম্মুখীন তাদের স্বঘোষিত জোড়া রাজধানী মসুল ও রাক্কা হারায়ও তবু তারা নিশ্চিহ্ন হবে না। এ বিষয়টি ইউরোপীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের ক্রমেই উদ্বিগ্ন করে তুলছে। তারা হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, গ্রæপটি ইউরোপকে লক্ষ্যবস্তু করে লড়াইকে সরাসরি পাশ্চাত্যে নিয়ে যেতে সতর্কতার সাথে নিজেদের পুনঃসজ্জিত করছে।
ইউরোপোলের ইউরোপীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্রের প্রধান ম্যানুয়েল নাভারেটি সম্প্রতি ওয়াশিংটন সফরকালে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে ইসলামিক স্টেটের সাম্প্রতিক বিপর্যয় সত্তে¡ও গ্রæপটি সক্ষমতার নতুন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। তিনি বলেন, আইএস ইচ্ছামত যে কোনো সময় তাদের মনোনীত যে কোনো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার সক্ষমতা প্রদর্শন করেছে।
নাভারেটির মতে, পরিস্থিতির আরো শংকাজনক দিক হচ্ছে আইএস নতুন নিয়োগ করা যোদ্ধাদের আগের চেয়ে আরো দ্রæত হামলাকারীতে পরিণত করতে সক্ষম। তিনি বলেন, আমরা আগে এটা দেখিনি।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন সন্ত্রাস দমন সমন্বয়কারী জিলেস দ্য কারচোভ বলেন, যোদ্ধাদের অধিকাংশই মাত্র আগের দিন আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করে।
বহু ইউরোপীয় কর্মকর্তা এ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। তাদের কেউ কেউ তাদের মার্কিন প্রতিপক্ষের কাছে সরাসরি তাদের বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন।
নেদারল্যান্ডসের নিরাপত্তা ও সন্ত্রাস দমন বিষয়ক সমন্বয়কারী ডিক শুফ বলেন, আইএস নিজেকে অব্যাহতভাবে পুনর্গঠন ও আধুনিকায়ন করছে।
অনলাইনে ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। শুফের মতে, গ্রæপের সমর্থক ও নতুন সংগৃহীত যোদ্ধারা আরো বেশী করে পেশাদার হয়ে উঠছে এবং টুইটার,ফেসবুক ও ইউটিউবের মত সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফরম ছাড়িয়ে যাচ্ছে। শুফ হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, তারা ইন্টারনেটের গোপন অংশ ডার্ক ওয়েবে আরো বেশী প্রভাবশালী। তারা ইতোমধ্যে শক্তিশালী ও কার্যকর মিডিয়া সরঞ্জাম ও বিপণন উপকরণ তৈরী করেছে।
ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের জন্য আরো উদ্বেগজনক হচ্ছে এসব অনলাইন প্রচেষ্টার অনেকগুলোই ক্রমবর্ধমানভাবে আই এসের উগ্রপন্থী ইসলামী মতাদর্শ এবং এমনকি ইসলামকেও ক্রমবর্ধমান ভাবে গুরুত্বহীন বলে আখ্যায়িত করছে।
মার্কিন কর্মকর্তারা অনেকদিন ধরে সন্ত্রাসী প্রবাসীদের ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আসছে যার অর্থ আইএসের পক্ষে লড়াই করা বিদেশী যোদ্ধারা স্বদেশে ফিরে, বিশেষ করে পাশ্চাত্যে নিজ দেশে ধ্বংসাত্মক কাজ করবে।
এফবিআই-র সাবেক পরিচালক জেমস কোামি ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন আইন প্রণেতাদের বলেছিলেন, তথাকথিত খিলাফত ধ্বংস করা হবে। চালেঞ্জ হচ্ছে যে এ দমনের আঙ্গুলের ফাঁক গলে শত শত অত্যন্ত বিপজ্জনক লোকের আগমন ঘটতে চলেছে।
এ বিপদ দমন করার চেষ্টা না করে ইউরোপীয় সন্ত্রাস দমন কর্মকর্তারা বলেছেন , এ ধরনের পিদ তাদের দেশগুলোতে এখনো দেখা দেয়নি।
দ্য কারচোভ বলেন, আমি যতই বিষয়টি দেখছি , ততই আমার বিশ^াস হচ্চে যে আমাদের বড় রকমের কোনো প্রত্যাবর্তন দেখতে হবে না। আমাদের এখানে বেশী পরিমাণ লোক ফিরবে না।
ইউরোপীয় কর্মকর্তারা বলেন, ইউরোপ থেকে ৫ হাজারের মত লোক ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের সাথে যোগ দিতে গেছে, তাদের অর্ধেকেরও বেশী নিহত হয়েছে। তারা মনে করেন, আরো অনেকেই আইএসের জন্য শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে অথবা পাশ্চাত্যের বাইরে অন্য কোনো দেশে চলে যাবে যেখানে তারা লড়াই করতে পারবে।
দ্য কারচোভ বলেন, আমি মনে করি, তাদের বেশির ভাগই মারা যাবে। তিনি বলেন, অভিবাসীদের সাথে মিশে এ সব যোদ্ধাদের ইউরোপে প্রবেশের বিয়য়টি তত গুরুত্বপূর্ণ নয়।
সবার ধারণা যে আইএসের পক্ষে যেসব ইউরোপীয় লড়াই করতে গেছে তাদের প্রায় সবারই কথা বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জানা । ইইউ-র শেংজেন তথ্য ব্যবস্থায় তাদের পরিচিতি প্রবেশ করানো রয়েছে যে কারণে স্থানীয় পুলিশ বা সীমান্ত সংস্থাগুলোর কাছে তারা সহজেই সনাক্তযোগ্য।
তবে তারপরও উদ্বেগ রয়েছে। ইউরোপে এখনো দুর্বলতা আছে। একজন ইউরোপীয় কূটনৈতিক কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন, কিছু বিদেশী যোদ্ধা ফিরে আসছে। এবং অনেকেই সাফল্যের সাথে দেশে ফিরেছে।
ইইউর হিসাব মতে, লড়াই করতে যাওয়াদের এক তৃতীয়াংশ প্রায় ১৪০০ যোদ্ধা ইতোমধ্যে নিজ নিজ দেশে ফিরেছে। তাদের অনেকেই নারী ও শিশু যারা হবু জিহাদিদের সঙ্গে ছিল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসলামিক স্টেট


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ