Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামিক স্টেটের খিলাফত ভেঙ্গে পড়ছে কিন্তু থাকছে তার মতাদর্শ

| প্রকাশের সময় : ৩০ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আল জাজিরা : বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, সামরিক পরাজয়ের প্রান্তে পৌঁছা সত্তে¡ও আইএস-র ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া মতাদর্শ মুছে ফেলা অনেক কঠিন হবে এবং অন্যান্য কর্মকান্ডের মধ্যে তার পুনরুদ্ভাস ঘটতে পারে। অর্থাৎ আইএসের খিলাফত ভেঙ্গে পড়ছে, কিন্তু তার মতাদর্শ থেকে যাচ্ছে।
তিন বছর আগে, ২০১৪ সালে ২৮ জুন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদি মসুলের বড় মসজিদ আল নূরী মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে জুমআর নামাজের আগে খুৎবা দিয়েছিলেন এবং সুন্নী খিলাফত প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেছিলেন। গত সপ্তাহে আইএসের মধ্যে অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ে মসজিদটি ধ্বংস হয়ে গেছে বলে ইরাক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
আইএস যখন ফুলে ফেঁপে উঠেছিল অর্থাৎ তাদের খিলাফতের সোনালি সময়ে তারা ইরাক ও সিরিয়ায় যুক্তরাজ্যের আয়তনের প্রায় সমপরিমাণ এলাকা দখল করেছিল। কিন্তু নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা পর্যবেক্ষক আইএইচএস মারকিট কর্তৃক কনফ্লিক্ট মনিটর অনুযায়ী গত জানুয়ারি থেকে আইএস তার নিয়ন্ত্রিত এলাকার ৪৭ শতাংশ হারিয়েছে।
বৈরুতের আমেরিকান বিশ^বিদ্যালয়ের সিনিয়র ফেলো ও অধ্যাপক রামি খুরি বলেন, আইএসের কাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে, কিন্তু এর নি¤œাবস্থিত শক্তি নয়। এটা ক্ষতিকর হচ্ছে। তিনি বলেন, আইএসের উত্থান গভীরতর সমস্যার এক লক্ষণ।
যদিও এটা স্পষ্ট নয় যে আইএস কিভাবে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবে, তবে কেউ কেউ মনে করেন যে অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং নাজুক যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকাগুলোই হচ্ছে আইএসের মত গ্রæপগুলোর উত্থানের ভিত্তি। খুরি বলেন, কর্মসংস্থানের অভাব, মানবাধিকার লংঘন এবং রাজনৈতিক নিপীড়নের মত আঞ্চলিক বিরাজমান সমস্যাগুলোর সুরাহার ব্যবস্থা না নেয়া পর্যন্ত এ গ্রæপের মতাদর্শ সুবিধাবঞ্চিত ও রাজনৈতিক ভাবে বর্জিতদের আকৃষ্ট করা অব্যাহত রাখবে।  
স্বঘোষিত ইসলামী খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা সংগঠনটি হচ্ছে আল কায়েদা ইন ইরাক এর একটি শাখা যা ইসলামিক স্টেট অব ইরাক (আইএসআই) নামে ২০০৬ সালে আত্মপ্রকাশ করে। ইরাকে আল কায়েদার প্রধান নেতাদের নেতৃত্বাধীন এ সংগঠনটি ইরাকে গোষ্ঠিগত লড়াইয়ে ইন্ধন যোগাতে বিরাট ভুমিকা পালন করে।
২০০৩ সালে মার্কিন আগ্রাসন ইরাকের অর্থনীতি ও সমাজ কাঠামোর উপর ধ্বংসকর প্রভাব ফেলে।  সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর যুক্তরাষ্ট্র ইরাকি সেনাবাহিনী ভেঙ্গে দেয়ার নির্দেশ দেয় এবং বাথ-মুক্তকরণ আইনের আওতায় সুন্নী বাথ পার্টিকে সরকারে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে।
বাথ পার্টি ইরাকে ৪০ বছর ক্ষমতায় ছিল। এ আইনের কারণে বাথ পার্টির সদস্য বহু ইরাকি চাকুরি হারায়। পরিণতিতে প্রায় ৪ লাখ সুন্নী ইরাকি সমাজে প্রান্তিকীকৃত পরিস্থিতির শিকার হয়।
নূরী আল মালিকিেেক প্রধানমন্ত্রী করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ইরাককে গোষ্ঠিগগত লড়াইয়ের দিকে ঠেলে দেয়। এ শিয়া রাজনীতিক সুন্নী ও কুর্দিদের কোণঠাসা করে ফেলেন। এর পরিণতিতে ২০০৬ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে ১০ লাখেরও বেশী ইরাকি গৃহচ্যুত হয়।
আইএসআইকে বাগদাদের বাইরে তাড়িয়ে দেয়া হয়। তারা ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী মসুলসহ দিয়ালা ও আনবার প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। মসুলে তারা সামরিক সেল প্রতিষ্ঠা ও নগরকে তাদের কেন্দ্রে পরিণত করে। পরবর্তী বছরগুলোতে তারা বাগদাদ ও আশেপাশে পশ্চিমা মিত্র গোত্র নেতা ও মার্কিন সেনা চৌকিতে বেশ কিছু ভয়াবহ হামলা চালায়।
২০১০ সালে পূর্বসূরীর মৃত্যুর পর বাগদাদি আইএস-র প্রধান হন। ২০১২ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের মধ্যে তিনি সেখানকার উত্তরপূর্ব অঞ্চলে তার সংগঠনের একটি শাখা প্রতিষ্ঠা অনুমোদন করেন। আবু মোহাম্মদ আল জুলানির নেতৃত্বাধীন এ শাখাটি প্রথমে জাবহাত আল-নুসরা নামে পরিচিত ছিল।
বাগদাদি যখন জাবহাত আল নুসরা বিলোপ করেন ও এর সদস্যদের ইসলামিক স্টেটের অন্তর্ভুক্ত করার কথা ঘোষণা করেন তখন জুলানি সে নির্দেশ মানতে অস্বীকৃতি জানান। কয়েক দফা দলত্যাগের ঘটনার পর সংগঠনটি স্পষ্টভাবে দু’টি গ্রæপে বিভক্ত হয়ে যায়।
গত তিন বছরে সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ দের এজ জোর থেকে ইরাকের মসুল পর্যন্ত স্বঘোষিত ইসলামী খিলাফত বিভিন্ন পৌরকেন্দ্রসহ কার্যত একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।
ইরাক ও সিরিয়ার গোলযোগের মধ্যে বঞ্চনার শিকার, অরক্ষিত ও যুদ্ধ কবলিত এলাকাগুলো নিয়ে আইএস-র উত্থান ঘটে। এসব এলাকার বিরাজমান  পরিস্থিতিতে গ্রæপটি অধিকতর সামরিক শক্তি অর্জন করে।
খুরি বলেন, যে খিলাফত কাঠামো এখন ভেঙ্গে পড়ছে তা কখনোই একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা ছিল না। এটি ছিল একটি প্রাচীন মতাদর্শের পুনঃপ্রবর্তন।
আইএইচএম মারকিট-এর সিনিয়র মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক কলাম্ব স্ট্রাক মনে করেন যে আইএস হচ্ছে কয়েক দশক ধরে বিদ্যমান একটি মতাদর্শের একটি মাত্র প্রকাশ। তিনি আল জাজিরাকে বলেন, একই মতাদর্শ অনিবার্যভাবে উদ্ভূত হবে। তিনি বলেন, ইরাক ও সিরিয়ার গোষ্ঠিগত যুদ্ধ ইরান ও সউদি আরবের প্রতিদ্ব›িদ্বতার কারণে আরো জোরদার হয়েছে এবং তা সুন্নী জিহাদি মতাদর্শকে শক্তিশালী করছে।
সিরিয়ার ৬ বছরের গৃহযুদ্ধে সাড়ে ৪ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে, ৫০ লাখ  বেসামরিক মানুষ দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে এবং অভ্যন্তরীণভাবে ৬০ লাখ মানুষ গৃহচ্যুত হয়েছে।
রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মত বিদেশী শক্তিগুলোর এ যুদ্ধে অস্ত্র সহায়তা বাস্তব পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করেছে। এ লড়াই বন্ধে কূটনৈতিক চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে এবং আইএসের সম্প্রসারণের পথ সুগম করেছে।
স্ট্রাক বলেন, ইসলামিক স্টেট সামরিক ভাবে পরাজিত হলে অন্যান্য গ্রæপগুলো, প্রধানত আল কায়েদার শাখাগুলো সে শূন্যস্থান পূরণ করবে যা হবে ইরাকের সুন্নী আরবদের জন্য আকর্ষণীয় বিকল্প যারা ইরাকের শিয়া সরকার ও ক্রমবর্ধমান ইরানি প্রভাবে প্রান্তিকীকৃত হয়ে পড়ছে।
কনফ্লিক্ট মনিটর অনুযায়ী আইএস বিরাট এলাকা হারিয়েছে। তারা ২০১৪ সালে যে  পরিমাণ এলাকা দখল করেছিল বর্তমানে তার অর্ধেকেরও কম এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে।
আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই বর্তমানে চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আইএস এখন ইরাক ও সিরিয়ার সর্বশেষ দু’টি শহরে কেন্দ্রীভূত, তা হচ্ছে মসুল ও তাদের স্বঘোষিত রাজধানী রাক্কা।
স্ট্রাকের মতে, এ বছরের শেষদিকে আইএস সামরিকভাবে পরাজিত হবে। ইরাকে এখনো তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকাগুলো ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন পকেটে পরিণত হয়েছে এবং সিরিয়ার দের এজ জোর-এ সংকীর্ণ শহর ও গ্রামীণ ভূমিখন্ডে রূপ নিয়েছে।
তিনি খিলাফতের উত্থান ও পতনকে খুব দ্রæত বৃদ্ধি ও তারপর অবিরাম ক্ষয় বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, ২০১৫-তে আইএস-র রামাদি ও পালমিরা পুনর্দখল ছিল এক মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা যা ছিল কৌশলগত সাফল্য। তিনি বলেন, রামাদি ও পালমিরা পুনর্দখলে আইএস-র চেষ্টা তুরস্ক থেকে রাক্কার প্রবেশ পথ  কৌশলগত তাল আবিয়াদ সীমান্ত পথকে প্রহরাধীন করে এবং তার ফলে আইএস তুরস্কের সাথে সিরিয়ার উত্তর সীমান্তের অধিকাংশ এলাকা হারায়।
সিরিয়ার কুর্দি গ্রæপ ওয়াইপিজি এ সুযোগ গ্রহণ করে নিজেদেরকে শক্তিশালী লড়াকু বাহিনী বলে প্রমাণ করে এবং আইএস বিরোধী লড়াইয়ে দ্রæত যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান স্থল অংশীদারে পরিণত হয়।
আইএসের অস্ত্র সংগৃহীত হয়েছিল গ্রæপের দ্রæত ইরাকের বিস্তীর্ণ এলাকায় পরিচালিত অভিযানে। তারা অরক্ষিত সামরিক গুদামগুলো নিয়ন্ত্রণে নেয়।
অ্যামনেস্টি’র অস্ত্র কর্মসূচির পরিচালক অলিভার স্প্রেগ বলেন, কয়েক দশক ধরে ইরাকে অস্ত্রের অবাধ প্রবাহের ফলে আইএস যখন এসব এলাকা দখল করে তখন তাদের অবস্থা দাঁড়ায় মিষ্টির দোকানে শিশুর মত। গত মাসে মার্কিন সরকারের অডিটে বলা হয়, মার্কিন সামরিক বাহিনী ইরাক ও কুয়েতে ১শ’ কোটি ডলারেরও বেশী অস্ত্র হস্তান্তর মনিটর করতে ব্যর্থ হয়েছে।
স্ট্রাক বলেন, প্রাপ্ত অস্ত্র ভান্ডারের সাথে আইএসের নিজস্ব গোলাবারুদ উৎপাদন যুক্ত হয়। এটা অনেকটা ছিল দালালের মাধ্যমে বেআইনি অস্ত্র বাজার থেকে অস্ত্র কেনার মত ব্যাপার।
জাতিসংঘের মতে, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে আইএসের বিজয়াভিযান শুরু হওয়ার পর তাদের বিস্তীর্ণ এলাকা দখলের ফলে সৃষ্ট সংকটের কারণে ২৬ লাখ ইরাকি দেশ থেকে পালিয়েছে।  দেশের অভ্যন্তরে গৃহহারা ৩০ লাখ মানুষ বর্তমানে বাড়ি থেকে দূরে শিবিরে বসবাস করছে।
আইএস-র পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে সে ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন।  তারা সিরিয়ার আরো পূর্ব দিকে তেল সমৃদ্ধ দের এজ জোর প্রদেশের বিভিন্ন শহরে স্থানান্তরিত হয়ে সক্রিয় রয়েছে।
রাক্কা আইএস মুক্ত করার মার্কিন সমর্থিত অভিযান সফল হতে পারে। কিন্তু আইএস তাদের বর্তমান অবশিষ্ট শক্ত ঘাঁটিগুলোর বাইরের এলাকা শাসন অব্যাহত রাখবে।
দোহার ব্রæকিংস ইনস্টিটিউটে ভিজিটিং ফেলো প্রফেসর রানজ আলাদিনের মতে, এ পর্যায়ে যা চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে তা হল আইএসের কাছ থেকে পুনর্দখলকৃত এলাকাগুলো শাসনে স্বীকৃত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা। তিনি বলেন, তথাকথিত খিলাফতের অবসান মানে আইএসের  শেষ নয়। আইএস নানা ভাগে ভাগ হয়ে যেতে পারে অথবা অন্য সন্ত্রাসী গ্রæপগুলোর সাথে জোটবদ্ধ হতে পারে। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে আইএস পরবর্তী দিনগুলোর জন্য কোনো রাজনৈতিক ও মানবিক কৌশল বা কাঠামো নেই।
আলাদিন বলেন, ইরাক ও সিরিয়ায় ধ্বংস হওয়া কাঠামো পুননির্মাণে পর্যাপ্ত সম্পদ ছাড়া দেশে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা, সুশাসনের উদ্যোগ বাস্তবায়ন, কর্মসংস্থান ও মৌলিক সেবা প্রদান চ্যালেঞ্জিং বিষয় হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ^ব্যাপী তাদের সেলের ভিত্তিতে আইএসের গুপ্ত ও বিক্ষিপ্ত হামলা চালানোর জন্য লোক সমাবেশ ও পরিকল্পনাা করার সক্ষমতা থাকবে। কিন্তু খুরি বলেন, আইএস এ অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নয়। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন যে মধ্যপ্রাচ্যে অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অভাব এ অঞ্চলের আসল সমস্যা। তিনি প্রশ্ন করেন, নতুন সরকার ব্যবস্থাও কি একই রকম খারাপ হবে? সেটাই হল আসল চ্যালেঞ্জ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসলামিক স্টেট


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ