লিবিয়ায় ইসলামিক স্টেটের সম্প্রসারণ রুখতে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলা
প্রকাশের সময় : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম
ইনকিলাব ডেস্ক : সাম্প্রতিককালে লিবিয়ায় ইসলামিক স্টেটের (আইএস) শক্তি বৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশে^র উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ প্রেক্ষিতে ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের শক্তি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় খর্ব হওয়ার পর লিবিয়ায় আইএসের সম্প্রসারণ রুখতে তৎপর হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র। জানা গেছে, পশ্চিমা পর্যটকদের উপর হামলার সাথে জড়িত এক জঙ্গি কমান্ডারকে হত্যার জন্য আমেরিকার জঙ্গি বিমানগুলো শুক্রবার ভোরে লিবিয়ার একটি সমুদ্র তীরস্থ শহরে বিমান হামলা চালিয়েছে।
আমেরিকান কর্মকর্তাদের হিসাব যে ইরাক, সিরিয়া ও তিউনিসিয়া থেকে বহু যোদ্ধা আসার ফলে লিবিয়ায় আইএসের যোদ্ধা সংখ্যা সাড়ে ৬ হাজারে পৌঁছেছে যার ফলে গ্রুপটি গত বছর সমুদ্র উপকূল বরাবর ১৫০ মাইল বিস্তৃত এলাকা দখল করে নিয়েছে। তারা লিবিয়ার অধিকাংশ সম্পদের উৎস তেল স্থাপনাগুলোর উপর হামলা চালিয়েছে।
সাবরাছার একটি প্রশিক্ষণ শিবিরে এ মার্কিন বিমান হামলা চালানো হয়। গত বছর পশ্চিমা পর্যটকদের উপর বড় ধরনের দু’টি হামলা পরিকল্পনার সাথে জড়িত একজন তিউনিসীয় জঙ্গি নেতাই ছিলেন এর লক্ষ্য। এ থেকে দেখা যাচ্ছে, লিবিয়া আইএসের নতুন ঘাঁটি হয়ে ওঠায় যুক্তরাষ্ট্র ক্রমেই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে এবং আইএস কমান্ডারগণ ও তাদের অবকাঠামো ধ্বংসে বিমানশক্তি ব্যবহারে ইচ্ছুক। এ পদক্ষেপ একটি গোলযোগ কবলিত অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনতে আমেরিকার সামরিক অভিযান ও কূটনৈতিক উদ্যোগের মধ্যকার ফারাককে তুলে ধরেছে।
কয়েক সপ্তাহ ধরে আমেরিকা ও তাদের মিত্র পশ্চিমা কর্মকর্তারা লিবিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে সিরতে-তে তাদের কার্যত সদর দফতরের চারপাশে সম্ভাব্য বিমান হামলার পরিকল্পনা করছিলেন। লিবিয়ার কর্মকর্তারা ও সংবাদ মাধ্যমগুলো সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে দেশে আমেরিকান, ব্রিটিশ, ফরাসি ও ইতালীয় বিশেষ বাহিনীর ইউনিটগুলোর উপস্থিতির খবর দিয়েছেন। আপাতদৃষ্টিতে তারা তথ্য সংগ্রহ মিশন ও স্থানীয় মিলিশিয়াদের সাথে যোগাযোগ রক্ষার কাজ করছে বলে দেখা যায়।
তবে আমেরিকার কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলেছেন যে শুক্রবারের বিমান হামলা তাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু নয়, বরং তা লক্ষ্যবস্তুভিত্তিক অব্যাহত হামলা যার উদ্দেশ্য হচ্ছে আইএসকে এ অঞ্চল বা ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপে হামলা চালানোর জন্য স্প্রিংবোর্ড হিসেবে লিবিয়াকে ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখা।
গত জুনে এ ধরনের বিমান হামলার লক্ষ্য ছিলেন আলজেরীয় জিহাদি নেতা মোখতার বেলমোখতার। অন্যদিকে নভেম্বরে অনুরূপ হামলা চালিয়ে লিবিয়ায় আইএসের শাখা প্রধান বিসাম নাজম আবদ জায়েদ আল জুবায়দি নামে পরিচিত ইরাকি নাগরিক আবু নাবিলকে হত্যা করা হয়।
শুক্রবার ত্রিপোলি থেকে ৫০ মাইল পশ্চিমে তিউনিসীয় জিহাদি ৩৫ বছর বয়স্ক নুরুদ্দিন শুশানকে লক্ষ্য করে সমুদ্র তীরবর্তী শহরটিতে হামলা চালানো হয়। পেন্টাগন এ হামলার সত্যতা স্বীকার করে বলে, তিনি আইএস যোদ্ধাদের লিবিয়ায় পৌঁছতে সাহায্য করতেন। যে কম্পাউন্ডে হামলায় শুশান সম্ভবত নিহত হয়েছেন সেখানে ৬০ জন পর্যন্ত জিহাদিকে একটি সন্ত্রাসী অভিযানের জন্য সক্রিয় ভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছিল।
তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিসে গত মার্চে ন্যাশনাল বারদো জাদুঘরে এবং গত জুনে সুসে-তে সমুদ্র তীরস্থ অবকাশ কেন্দ্রে হামলা চালাতে সহায়তা করা জন্য শুশানকে অভিযুক্ত করা হয়। এ দু’টি হামলায় নিহতের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২২ জন ও ৩৮ জন। তিনি ইরাক ও সিরিয়ায় ১৫০০-র মত আইএস যোদ্ধা প্রেরণেও সাহায্য করেন বলে মনে করা হয়।
আইএস লিবিয়ায় প্রবেশ অব্যাহত রেখেছে। কূটনীতিকরা বলেন, ছড়িয়ে পড়া বহুমুখী যুদ্ধের একটা সমাধান টানতেই এটা করা হচ্ছে।
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে প্রতিটি বিজয়ই সে সব দেশগুলোর প্রতি আমেরিকান পদক্ষেপের সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করেছে যে দেশগুলোতে আইএস শক্তিশালী। কিন্তু মূল রাজনৈতিক সমস্যাগুলো নিরসনে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার সাথে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের উপর গুরুত্ব দেয়া সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
লিবিয়ায় একটি ঐক্য সরকার গঠনের চেষ্টায় সামান্যই অগ্রগতি হয়েছে। ইরাকে সুন্নী অসন্তোষ নিরসনে অল্প সাফল্য দেখা গেছে। আর সিরিয়ায় বৈরিতা বন্ধের ঘোষণা বাস্তবায়িত হয়নি।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি জোর দিয়ে বলেছেন, এ সব দেশের প্রত্যেকটিতে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চলছে এবং অগ্রগতি সম্ভব। তবে তিনি স্বীকার করেন যে বিভিন্ন কারণে সব কিছুই দুর্বল।
সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটকে হীনবল করার মার্কিন প্রচেষ্টা পরিমিতভাবে সফল প্রমাণিত হয়েছে। মার্কিন ও মিত্রদের বিমান হামলা, পাশাপাশি স্থলে যোদ্ধাদের প্রতি সামরিক সমর্থনের পরিণতিতে আইএস এলাকা হারাচ্ছে। শুক্রবার মার্কিন সমর্থিত কুর্দি নেতৃত্বাধীন বাহিনী পূর্বাঞ্চলীয় সিরীয় শহর শাদাদি দখল করেছে।
কিন্তু এ শুক্রবারই যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও আরো একডজনেরও বেশি দেশের ঘোষিত বৈরিতা বন্ধ কার্যকর হওয়ার দিন ছিল। পরিবর্তে যুদ্ধবিরতি টাস্ক ফোর্সের নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করা হয় ও সিরিয়াজুড়ে সহিংসতা অব্যাহত থাকে।
ইরাকের ছবিও একই রকম। সেখানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট জিহাদিদের কাছ থেকে ভূখ- দখলে ইরাকি ও কুর্দি বাহিনীকে সাহায্য করেছে। দেশের সুন্নীদের সাথে সমঝোতার জন্য বাগদাদের শিয়া সরকারের উপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ব্যর্থ হয়েছে।
লিবিয়াতে দেশের লড়াইরত উপদলগুলোকে একটি ঐক্য সরকারের মধ্যে আনার জন্য জাতিসংঘের উদ্যোগে পিছনে যুক্তরাষ্ট্র তার সমর্থন প্রদান করেছে। লিবিয়ার অসংখ্য রাজনৈতিক ও সামরিক উপদলগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে এ প্রক্রিয়া বিপর্যস্ত হয়েছে এবং ইতিমধ্যে লিবিয়ায় আইএসের নাটকীয় সম্প্রসারণ পাশ্চাত্যের আতংক সৃষ্টি করেছে।
গত ২ ফেব্রুয়ারি রোমে ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে ২৩ জাতি জোটের এক বৈঠকে কেরি হুঁশিয়ার করে বলেন, আমরা শেষ যে জিনিসটি চাই তা হচ্ছে তেল থেকে শত শত কোটি ডলার রাজস্ব আয়কারী একটি অলীক খিলাফতের অবসান।
লিবিয়ার রাজনৈতিক নেতারা বর্তমানে রাজধানী ত্রিপোলি ও পূর্বাঞ্চলীয় শহর তবরুক ভিত্তিক দু’টি প্রতিদ্বন্দ্বী পার্লামেন্টকে কেন্দ্র করে শিথিল রাজনৈতিক জোটবদ্ধ। কিন্তু জার্মান কূটনীতিক মার্টিন কবলারের নেতৃত্বে একটি ঐক্য সরকার গঠনে জাতিসংঘের চেষ্টা উপদলীয় বিভক্তির কারণে সফল হয়নি।
ডিসেম্বরে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী একটি ঐক্য সরকারের প্রতিষ্ঠা ত্রিপোলি নিয়ন্ত্রণকারী উপদল কর্তৃক জোর বিরোধিতার শিকার হয়। তারা এমনকি জানুয়ারির শুরু থেকে কবলারের বিমানকে রাজধানীতে নামতে দিতেও অস্বীকার করেছে। পূর্বাঞ্চলে প্রাধান্য বিস্তারকারী জেনারেল খলিফা হিফতারের কোনো ভবিষ্যত ভূমিকার ব্যাপারেও উত্তেজনা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র এখন জাতিসংঘের সমস্যাকবলিত প্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থন দানের পাশাপাশি লিবিয়ায় লক্ষ্যবস্তুতে সুযোগমত হামলা চালানো অব্যাহত রাখবে বলে মনে হয়। প্রেসিডেন্ট ওবামা মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত থাকবে। একই সাথে লিবিয়ায় একটি সরকার গঠনের ব্যাপারে আমরা জাতিসংঘের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি। এটা একটা সমস্যা হয়ে আছে।
এখন পর্যন্ত মন্থরগতি রাজনৈতিক আলোচনা আইএসের সম্প্রারণের মুখে বিপন্ন হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
এ সপ্তাহে কায়রোতে এক সাক্ষাতকারে জাতিসংঘ দূত কবলার একটি ম্যাপ বের করেন যাতে ২০১৫ সালের শুরুতে লিবিয়ায় আইএসের তুলনামূলক স্বল্প উপস্থিতি ও এক বছর পর তাদের বিস্ফোরণমূলক সংখ্যা বৃদ্ধি প্রদর্শিত হয়েছে। তিনি বলেন, এটা এমন কিছু রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা শূন্যতার মধ্যেই শুধু যার বিকাশ হতে পারে। সে কারণেই কিছু একটা অবশ্যই করতে হবে।
সিরিয়ায় কূটনীতি থেকে সীমিত মানবিক সাহায্য ছাড়া বেসামরিক লোকজন কিছু লাভ দেখতে পেয়েছে।
বিশ্লেষকরা হুঁশিয়ার করে বলেন, যে ব্যাপক সমস্যার কারণে আইএসের উত্থান ঘটেছিল সেগুলোর প্রতি দৃষ্টি না দেয়া হলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের পরাজিত করার আশা করতে পারে না।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের সাথে সংশ্লিষ্ট এক সিরীয় বিশেষজ্ঞ নোয়াহ বনসি বলেন, এটা স্পষ্ট যে ওয়াশিংটন এখন আগামী বছর আইএসকে কৌশলগতভাবে দুর্বল করে তুলতে সহায়ক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতি অগ্রাধিকার প্রদান করছে।
তিনি বলেন, যুদ্ধের অবসান ঘটাতে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া হচ্ছে নিম্নঅগ্রাধিকার এবং তাতে অগ্রগতি কমই হয়েছে। তিনি বলেন, এ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া যদি পথ না পায় তাহলে এটা সুস্পষ্ট যে আর কোন বিকল্প পরিকল্পনা নেই। সূত্র দি নিউইয়র্ক টাইমস।