শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
সৈয়দ কামাল হুসাইন
তুমি কি মানুষকে বিশ্বাস করতে পারো না, আলম?’
‘তারপর থেকে মানুষ কে আর বিশ্বাস হয় না। মানুষ দেখেই মনে হয় বিশ্বাসঘাতক প্রাণী। তাদের বিশ্বাস করলেই ছোবল খেতে হয়,এইটুকু মনে হয়।’ আলম মিটমিট করে তাকালো আখতারের দিকে।
‘খুব কি দুঃখ হয় তোমার?’ আখতার তালগাছের পাতা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আলমের মাথার দিকে তাকালো। মাঝখানের বেশকিছু চুল খাড়া হয়ে আছে আলমের।
জবাবে আলম বললো, ‘আমি কেমন যেন হয়ে গেছি, বহু চেষ্টা করেও কাঁদতে পারি না, কখনো হো হো করে হাসতে পারি না। আমি যেন আবেগশূন্য। আমি কোন কিছুতে দুঃখ পাই না, সুখ অনুভব করতে পারি না। যেন বিশাল পাহাড়ের মধ্যে লোহার তৈরি এক রোবট আমি।’
আখতার সিগারেট ধরিয়ে ম্যাচ পকেটে ভরতে ভরতে বলল, ‘শিউলিকে এতোটা বিশ্বাস করা বড় ভুল তোমার।’
আলম চোখ পিটপিট করে তাকালো ঝুলন্ত বাবুইপাখির বাসার দিকে। তারপর বললো, ‘মানুষকে বিশ্বাস করলে ভুল হয় আগে জানতাম না।’
আখতার কিছু বলল না, চুপচাপ পুকুরের জলের দিকে তাকাল, তারপর দৃষ্টি সরিয়ে বাবুইপাখির বাসা দেখতে লাগলো।
পুকুরধারের পূর্বকোণে তালগাছে কয়েকটা বাবুইপাখির বাসা। দমকা বাতাসে বাসাগুলো যখন দুলে মনে হয় এই বুঝি পড়ে যাবে। চৈত্র মাসের শেষের দিকে প্রচ- ঝড়ে দেখা যায় এক দুটো বাসা মাটিতে পড়ে এদিকে ও দিক তাকাচ্ছে। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেরা খুব আগ্রহ নিয়ে এরমধ্যে ডিম খুঁজে। তালগাছটি থেকে সামান্য দক্ষিণে একটি কবর। এই কবরটি আলমের দাদার। আলমের যখন জন্ম হয়নি তখন তার দাদা মারা যায়। কবরের সামনেই হরিণধরা বিল। কবরটি থেকে খানিক দূরে মাদ্রাসা। ছোট ছোট শিশুরা ভোরে পড়তে আসে, আলিফ বা, বাংলা স্বরবর্ণ বা ইংরেজি বর্ণ শিখে। ছোটসময় কিছুদিন আলমও এ মাদ্রাসায় পড়েছিল। মাদ্রাসার উত্তর কোণে আলমের বাড়ি। তার বর্তমান বয়স পঁয়তালিশ। বিয়ে করেছে সতেরো বছর আগে। একটি ছেলে আছে নাম আনু। বাবার নামের প্রথম অক্ষরের সাথে মিলিয়ে রাখা নাম। আলমের বড্ড সুখী থাকার কথা থাকলেও মোটেও সুখী নেই। আনু এমন যে বাবার একটি কথাও মানে না, মুখের উপর কথা বলে যায়। আলমের মনে হয়, পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ বহন করার চেয়েও ভারী কষ্ট হচ্ছে সন্তানের কথা না শুনা। আলম তো এমন ছিল না, বাবার কথা সে অক্ষরে অক্ষরে শুনতো। বাবা যদি বলতেন স্কুল ছুটির পর চোখ বন্ধ করে সোজা বাড়িতে আসবে, কারো সাথে কথা বলবে না, কোথাও দাঁড়াবে না আলম তাই করতো। সেই দিনগুলোর কথা আলম খুব ভাবে। স্কুল ছুটির পর বাড়িতে না আসা, কোথাও আড্ডা দেওয়া, খেলা করা এসব আলমের মধ্যে ছিল না। বাবার কথা মেনে আলম বন্ধুহীনও ছিল। এই কারণে গ্রামের মানুষেরা তাকে গোপনে গোপনে মন্দ বলতো। কেউ বলতো বোকা, কেউ একগুয়ে, কেউ হিংসুক কেউবা বলতো অসামাজিক। মাঝে মাঝে হয়তো এসব সে বুঝতে পারতো, কিন্তু এ কারণে তার মন রুক্ষ হতো না। সে তার মতোই, নিজস্ব গতিতে চলতো। নিজের ছেলেটি এমন বিপদে যাচ্ছে দেখেও আলম কিছু করতে পারছে না, ভাবে এটি ব্যর্থতা। কিন্তু আলম তো কখনো এমন ছিল না। বিয়ের বছরখানেক পরে আলম জানতে পারে শিউলির সাথে দুজন ছেলের সম্পর্ক ছিল। এমনকি বিয়ের পরের দিন দুটো ছেলের মধ্যে একজন থানায় অভিযোগ লিখে যে, ‘আমার বউকে জোর করে বিয়ে দিয়েছেন উসমান সাহেব।’ উসমান সাহেব অধিক ক্ষমতাশালী না হলেও কম ছিলেন না। থানা তার কথায় উঠে না বসলেও তার বিরুদ্ধে কিছু করার স্পর্ধা নেই। ভোরের হাওয়া জানার আগেই অতি প্রচ্ছন্নতায় উসমান সাহেব বিষয়টি সমাধান করেন। কিন্তু আলম কীভাবে যেন বিষয়টি জেনে যায়। এ বিষয়ে শিউলিকে প্রশ্ন করলে সে নিরুত্তর থাকে। আলমও আর কিছু বলেনি কিন্তু তার হৃদয়ের গভীরে উচ্ছৃঙ্খল তরঙ্গের মতো সমুদ্রের জল বইতে থাকে। একদিন সন্ধ্যেবেলায় ঘরের কাজ সেরে আলমের পাশে বসতে বসতে শিউলি বললো, ‘অতীতে আমার ত্রুটি ছিল, একথাটি মোটেও মিথ্যা নয়। সেসব দিনের স্মৃতিগুলো মুছে ফেলেছি। তুমি কি আমায় ক্ষমা করতে পারোনি?’ আলম ভীষণ খুশি হলেও হাসলো না। আনুর বইয়ের দিকে লক্ষ্য করে বললো, ‘মূর্ধন্য কোনটি বলো তো?’ তারপর বইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ক্ষমার কথা বলা মানেই ভুল উপলব্ধি করতে পারা, তুমি পেরেছ তাই যথেষ্ট। ক্ষমা তো কবেই হয়ে গেছে।
আনু মূর্ধন্য দেখাতে গিয়ে দন্ত্যন দেখাল, শিউলি সে দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এটা দন্ত্যন, বাবা। তারপর আনুর মাথায় হাত রেখে বললো, ‘আনুর এখন চার বছর, তাকে শহরে ভালো স্কুলে না পড়ালে হয় কি করে?’
আলম বলল, ‘আরো পরে গেলেও হবে।’
‘বাবার সাথে একটা জায়গা নিয়ে কথা বলেছিলাম, তিনি মূল্য ঠিক করে রেখেছেন, খুব ভালো জায়গা।’
কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় আলম, ইনস্ট্যান্ট কি বলবে বুঝতে পারে না। আনুর স্টে-এর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আঙুল একটু ঘুরিয়ে লিখো দন্ত্যস।’ অতপর শিউলির দিকে তাকিয়ে কোমল কণ্ঠে বললো, ‘আমার মা-বাবা রেখে আমি শহরে যাবো না। বাবা-মাকে রেখে কি করে যাই? আমি তো তাদের একমাত্র সন্তান।’
শিউলি খানিক সময় ভাবলো, আনুর মাথায় হাত রেখে বললো, ‘তুমি তো একেব্বারে যাচ্ছো না, আসবে দেখবে। শুধু ছেলেটির ভালোর জন্যই না হয় একটু ত্যাগ করলে।’
শেষ পর্যন্ত মা-বাবা থেকে বিদায় নিয়ে আলম শহরে এলো। স্ত্রী-সন্তানের দিকে চেয়ে মা-বাবা থেকে একটু দূরে গেল। যদিও মা-বাবা অনেক কষ্ট পেলেন, তবুও বুঝতে দেননি। পিতামাতার কাছে সন্তানের সুখ বড়, তার সুখের জন্য একটু দুঃখ না হয় সহ্য করলেন মা-বাবা। আলম জায়গা কিনলো, বাড়ি করলো। খুব দ্রুত হয়ে গেলো সব। ছেলেও বড় হলো, প্রায় পনেরো বছর। কিন্তু যে কারণে আলমের গ্রাম থেকে আসা সেই আনু একটুও লেখাপড়া করে না। স্কুলে তো যায়ই না, আড্ডা, খেলা নিয়েই দিন যায়। আনুর মামারা বা নানা তারা কেউ লেখাপড়ার দিকে আগ্রহও দেখায় না। আনু আনুর মতোই বেপথে চলতে থাকে।
একদিন রাতে শিউলি বললো, ‘হাসপাতালের ডান পাশে বিশ শতাংশ জমি কিনে রাখি। এখন জমির দাম কম। পনেরো লাখ হলেই হবে।’
আলম এ কথার সাথে একমত, জমি কিনে রাখলে কাজে আসবে। শিউলির কথায় সে খুশি হয়ে বললো, ‘কিন্তু এতোটাকা একসাথে কি করে দেবো?’
শিউলি বললো, ‘আস্তে আস্তে দাও। প্রয়োজনে পাঁচ বছরে দাও। তিনি বাবার বন্ধুমানুষ, মেনে নিবেন’।
প্রতি মাসে মাসে সে শিউলির কাছে টাকা রাখে। চাকরির বেতন যা পায় খরচের টাকা রেখে বাকিটা শিউলির হাতে দেয়। এভাবে বারো লাখ জমা হলো। তারপর তিন লাখ সুদের উপর ভিত্তি করে এনে দেয়া হলো। যখন টাকা দেওয়া শেষ হলো তখন ঘটলো এক অদ্ভুত ঘটনা। আকাশ থেকে চাঁদ নেমে এসে মাটিতে হাঁটছে এমন আশ্চর্য ঘটনাও বটে। আলম শুনলো উসমান সাহেবের বন্ধুর হাসপাতালের পাশে কোন জমি নেই। তবে সে কার জমি কিনতে টাকা দিলো? কেয়ামত আরম্ভ হওয়ার সময়ে ইসরাফিল যেন শিঙ্গায় ফুঁ দিচ্ছে। পৃথিবী যেন উল্টে যাচ্ছে, ভয়ঙ্কর শব্দ হচ্ছে চারপাশে। কোথাও কোন পাখি নেই, বৃক্ষ নেই। আলম কোথায় দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পারছে না।
চোখ কপালে তুলে শিউলি বললো, ‘জমি? টাকা? তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? এখনই পাগলের ডাক্তারের কাছে যাও।’
আলমের মনে হলো সে উড়ে যাচ্ছে দূর থেকে দূরে, কোথায় যাচ্ছে জানে না। অনেক পরে সে বললো, ‘কী বললে?’
শিউলি আবার বললো, ‘আমাকে তুমি কোন টাকা দাওনি, কি হয়েছে তোমার?’
চারপাশ ঝাপসা হয়ে এলো। কিছু দেখতে পাচ্ছে না সে। এই অন্ধকারের ভিতর দিয়ে হেঁটে এলেন উসমান সাহেব। তাকে দেখে মনে হচ্ছে ধোঁয়ায় তৈরি মূূর্তি। যার মাথা নেই চোখ মুখ নেই। তাকে স্পর্শ করলে নির্ঘাত মৃত্যু। আলম সে দিকে তাকালো না, তবুও মনে হলো উসমান সাহেব আলমের দিকে আসছেন। তীব্র ঝাঁঝালো কণ্ঠের আওয়াজ শুনলো আলম, অনেক পরে সে বুঝতে পারে তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হচ্ছে। ‘তোমাকে তো সভ্য মানুষ হিসেবে জানতাম, আলম। বিয়ের এতোদিন পর যৌতুক চাও কোন সাহসে?’
আলম দেখতে পেলো এ যেন উসমান সাহেব নয়, অন্য জগতের ভয়ঙ্কর কেউ, তার দু চোখভর্তি আগুন, তার মুখভর্তি আগুন, তার দিকে তাকানো যায় না, কথা বলা যায় না। পাশে দাঁড়ানো এই মহিলা তার স্ত্রী নয়, সে তার সাথে সতের বছর নয় সতের সেকেন্ডও সংসার করেনি, সে তাকে চিনে না, কখনো দেখেনি। আলম নীরব দাঁড়িয়ে থাকে, কেউ যেন স্কচটেপ দিয়ে আটকে রেখেছে তার মুখ, কিছুতেই কথা বলতে পারে না। বেশ খানিক মুহূর্ত অতিক্রম হওয়ার পর আলম মিনমিনে কণ্ঠে বললো, ‘কী বলছেন, বাবা! আপনিও তো জানেন?’
উসমান সাহেব খরখরে কণ্ঠে বললেন, ‘কী ভাবো নিজেকে? এত বেশি চালাক তুম?, দেশে কি পুলিশ নেই?’
আলম সে প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না। ঝরঝর করে চোখ থেকে জল নামতে শুরু করে। চারপাশ শুধু অন্ধকার নয়, মহা অন্ধকার। সে দাঁড়িয়ে আছে অন্য জগতে, এখানে কেউ তার নেই। আরোও কিছু সময় মুহূর্ত অতিক্রম হবার পর আলম বললো, ‘মা-বাবা কে একা রেখে এই প্রতিদান পেলাম?’
সে প্রশ্নের জবাব দিলো না কেউ। আলম নিঃশব্দে ঘরে এসে শুয়ে থাকে।
‘এখন তাহলে সম্পর্ক শেষ করে দাও, আর যাই হোক শিউলির সাথে তো আর সম্পর্ক রাখতে পারো না।’ সরাসরি আলমের দিকে তাকিয়ে আখতার বলল।
‘এতো সোজা নয়, যৌতুকের মামলা দিয়ে জেলে দিয়ে দিবে, উসমান সাহেব কম ভয়ঙ্কর নয়।’ বলে থেমে আলম আবার বললো, ‘মামা, আসলে মা-বাবাকে একা ফেলে যাওয়ার পাপ এটা।’ টপটপ করে জল পড়তে থাকে তার চোখ থেকে।
আখতার অচঞ্চল কণ্ঠে বললো, ‘শহরে ওদের সাথে থাকলে তো তোমাকে খুনও করতে পারে।’
‘তা খুন করতে আর বাকি কোথায়, মামা? মরণে আর ভয় নেই।’ বলে আলম রেইনট্রি গাছের দিকে তাকালো। কয়েকটি পাখি কিচকিচ করছে। একটা পাখি হঠাৎ উড়ে গেলো। সেদিকে আলম তাকিয়ে থাকে। সে তো আর পাখি নয়, পাখি হলে দূর বহুদূর চলে যেতো উড়ে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।