Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ছোট গল্পে রবীন্দ্রনাথ

জোবায়ের আলী জুয়েল | প্রকাশের সময় : ৫ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন জমিদার পরিবারের ছেলে। নগর জীবনে বৈদগ্ধস্নাত রবীন্দ্রনাথ ১৮৯১ সালে জমিদারী কাজকর্ম দেখার জন্য শিলাইদহে বাস করতে আসেন। এই ঠাকুর বাড়ির জমিদারী ছিল কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ও নওগাঁর পতিসরে। এই তিনটি অঞ্চলে পৌঁছাতে সেকালে নদীপথ, বিল ও বর্ষার বিশাল জলাভূমি অতিক্রম করতে হতো। রবীন্দ্রনাথ কার্যব্যপদেশে পালকিতে গ্রামান্তরে যেতেন। জমিদার পুত্র হিসেবে প্রজা সাধারণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার সুযোগ না থাকলেও কাজে কর্মে তিনি তাদের সাহচর্য পেয়েছেন এবং তাঁর শিল্পীমন এসব অবহেলিত লোকের আচার আচরণে, কথাবার্তায় ভরে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ প্রথম গল্প লিখেন ১৮৭৭ সালে। গল্পটি ভারতী পত্রিকায় “ভিখারিনী” নামে ছাপা হয়। তাঁর মন তখন নতুন কিছুর আশায় সদা চঞ্চল ছিল। কিন্তু ছোট গল্পের রূপ নির্মিত ও তার সাফল্য নিয়ে তাঁর মনে সন্দেহ ছিল। আত্মবিশ্বাসের অভাব লক্ষ্য করা যায় রবীন্দ্রনাথের মনে।
রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় গল্পের জন্যে পাঠকদের দীর্ঘ ৭ বছর অপেক্ষা করতে হয়। দ্বিতীয় গল্প “ঘাটের কথা” ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত হয়। এরপর “রাজপথের কথা” ও “মুকুট” প্রকাশ পায়। অনেক সমালোচকরা ১৮৭৭-১৮৮৫ সাল পর্বকে ছোট গল্পের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের প্রস্তুতি পর্ব ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্ব বলে উল্লেখ করেছেন। ১৮৯১ সালে সাপ্তাহিক “হিতোবাদী” পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পেয়ে রবীন্দ্রনাথ ৬ সপ্তাহে ৬টি গল্প রচনা ও প্রকাশ করেন।
রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প গুলিতে প্রকৃতি ও মানুষ, নর-নারীর জীবনের সংসার ধর্ম, প্রেম-ভালোবাসা, সুখ-দুঃখ, হতাশা ও ব্যর্থতা ইত্যাদি প্রকাশ পেয়েছে। “অতিথি” গল্পে কিশোর তারাপদের চোখে দেখা গ্রাম নিসর্গ তারই ব্যক্তিগত আনন্দ উচ্ছাসের রস মধুর প্রতিমুর্তি হয়ে ধরা দিয়েছে।
নর-নারীর হৃদয় অরণ্যে প্রেমের যে বিচিত্র প্রকাশ তা’ রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলির মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। তাঁর অনেকগুলি গল্প আছে, যেগুলিতে সামাজিক জীবনের সম্পর্ক বৈচিত্র শিল্পরূপ লাভ করেছে, যেমন- পোষ্ট মাস্টার, অতিথি, আপদ, কাবুলীওয়ালা, ঠাকুরদা, মেঘ ও রৌদ্র, দান-প্রতিদান, পণ রক্ষা, রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা, উলুঘরের বিপদ, শাস্তি, রামমনির ছেলে দিদি, হালদার গোষ্ঠি, হৈমন্তি, সমাপ্তি, দেনাপাওনা ইত্যাদি নানা দিক থেকে এই পর্যায়েরই গল্প।
আমাদের সমাজের নারীরা নানা রূপে নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। নেশাগ্রস্থ জ্ঞানপাগল স্বামীর উপেক্ষা, “হৈমন্তী” গল্পে শ্বশুরের অর্থলিন্সার শিকার হৈমন্তী। “দেনা-পাওনা” গল্পে স্বীকৃত পণ পরিশোধে অক্ষমতা নিরুপমার মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছে। “দিদি” গল্পের প্রসঙ্গটি অন্যরকম। শশীকলা ছিল পিতার একমাত্র সন্তান, পিতৃকুলের উত্তরাধিকারিনী। বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতার ঘরে একটি ভাইয়ের জন্মকে খুব আনন্দের বলেও মনে করে নি, কিন্তু পিতার মৃত্যুতে ভাইয়ের প্রতি তার আকর্ষণ স্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে স্বামী জয়গোপাল ভাইয়ের সম্পত্তি কৌশলে আত্মসাৎ করার চেষ্টা করলে স্বামীর সাথে তার বিরোধ বাঁধে। শশীকলা শেষ পর্যন্ত সুবিচারের কারণে শিশু ভাইটিকে ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে তুলে দিলে অজ্ঞাত কারণে আকষ্মিকভাবে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। শৈশবে রবীন্দ্রনাথ এক শিক্ষকের অমানবিক আচরণ দেখে স্কুল ছেড়েছেন। সারাজীবনে তাঁর সেই বদমেজাজী শিক্ষককে ভুলতে পারেন নি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে লেখেন “গিন্নি” গল্পটি।
রবীন্দ্র ছোট গল্পে নর-নারীর বাইরের আবেষ্টন ও আচরণে চেয়ে অধিকতর গুরুত্ব পেয়েছে তাদের অন্তলোকের রহস্য। অসুখী পোস্ট মাস্টারের প্রত্যাশিত নগর প্রত্যাবর্তনের সময়, বুকের ভেতর নৈঃসঙ্গের একতারা বাঁজে, অপত্য স্নেহে আপ্লুত রাইচরণ এক কথায় পিতৃত্বের অধিকার ত্যাগ করে, রহমত কাবুলী ওয়ালা ছোট্ট মিনির দর্পণে নিজের পিতৃ সত্ত্বার ছায়া দেখে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এদের বিত্ত-ঐশ্বর্যের কথা বলেন নি। তাঁর প্রতিপাদদ্য বিষয় এইসব মানুষের অন্তরের বিভিন্ন বৃত্তি-দেবত্ত ও পশুত্ব। অন্তরের এই বৃত্তির লীলা যে কত ঐশ্বর্য্যময় তা পূর্ণাঙ্গ ছবি এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছে পদ্মাতীরের মানুষ নায়ক, পদ্মা প্রতিনায়ক। গল্পগুচ্ছকে সমালোচকগণ বলেছেন “গীতিকাব্য”।
তঃকালীন সামন্ত্রশ্রেণীর চরিতে আমরা দেখতে পাই “শাস্তি” গল্পে। সামন্ত কুসংস্কারে নিগুঢ়ে বাঁধা সমাজে নারীর স্থান কোথায় তা’ এখানে দেখানো হয়েছে। চন্দনা জানতো বড় বউকে কে খুন করেছে কিন্তু সবাই যুক্তি করে তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিল, আশা ছিল চন্দনার মনে সবাই তাকে মুক্ত করতে আসবে। কিন্তু অভিমানী চন্দনা নিজেই সে আশার মুখে ছাই দিয়েছে। সমগ্র নারী-নির্যাতনের প্রতীক চন্দনা।
সতীনের সংসারে কলহের ঝড়-ঝাপটা লেগেই থাকে কিন্তু “মধ্যবর্তনী” গল্পে স্বামী স্বেচ্ছায় দ্বিতীয় বার গ্রহণ করেনি, করেছিল অসুস্থ স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে। কিন্তু সেই সংসারেও ভাঙ্গন ধরেছে, সতীনের তিরোধানে তা আর পূর্বাবস্থা ফিরে পায়নি। এ রকম অনেক বাস্তব চিত্র দেখতে পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পে। সুক্ষè জীবনবোধ, সংযত প্রকাশ ভঙ্গি ও ভাবের তীব্র একমুখিতা তাঁর শ্রেষ্ঠ ছোট গল্প গুলো এ সকল গুণেই সমৃদ্ধ।
“জীবিত ও মৃত” গল্পের পরিবেশ আবহময় রহস্যে করুণ। মৃত্যুর পরপার আমাদের কাছে অপার রহস্যাচ্ছন্ন, জীবনের এপারও তার চেয়ে খুব কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই এপার থেকে ওপারে উঁকি-ঝুঁকি দেবার কৌতুহল মানুষের চিরন্তন প্রবৃত্তিরই একটি সহজাত অংশ। কাদম্ববিনীর মৃত্যুতুল্য অসাড়তায় বাস্তবতার অভাব নেই, কোথাও, বরং বর্ষণকুল নির্জণ শ্মশানের অন্ধকারে সদ্য জেগে ওঠা কাদম্বিনীর মধ্যে যে ব্যাকুল জিজ্ঞাসা জেগেছিল তাতেও স্বাভাবিকতা নেই কোথাও। শ্মশানে জ্ঞান ফিরে পেয়ে কাদম্বিনীর প্রথম মনে হয়েছিল সে ভুত হয়ে গিয়েছে। দিনের আলোকে লোকালয় তার পক্ষে অতি ভয়ঙ্কর স্থান বলে বোধ হলো। মানুষ ভুত কে ভয় করে। ভুতও মানুষকে ভয় করে। মৃত্যু নদীর দুই ধারে দু’জনের বাস।
“নিশীথে” গল্পটিতে কবি মনোধর্ম সফল রূপ পেয়েছে। এই গল্পের পেছনে যে প্রাকৃত, মানবিক অনুভব রয়েছে “মধ্যবর্তীনি” গল্পটিতে তার একই সুন্দর ভাব প্রকাশ পেয়েছে। দুটি গল্পের প্লটের মধ্যে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
“কংকাল” গল্পটি আসলে বিবৃতিমূলক প্রেমের গল্প। কিন্তু তার চারপাশে কবি রোমাঞ্চকর রহস্য পরিবেশ অবতারণা করেছেন। গল্পগুচ্ছে রবীন্দ্রনাথ সাধারণ মানুষের কথা বলেছেন বলে তিনি মহৎ শিল্পী হননি বরং হয়েছেন এই জন্যে যে, পদ্মা তীরের সংগ্রামী মানুষের জীবন-যন্ত্রণা এবং সংগ্রাম অত্যন্ত সহানুভূতি, নিপুণতা ও দক্ষতার সাথে তুলে ধরেছেন বলে যা আমাদের সংবেদ কে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে নাড়া দেয়।
বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথই প্রথম সাধারণ মানুষের কথা লিখেছেন। জমিদারী দেখতে তাঁকে কলকাতা ছেড়ে আসতে হয় পদ্মা তীরে। সেখানে দেখেছেন গ্রাম-বাংলার সহজ-সরল প্রকৃতির সাধারণ মানুষকে। তাদের অস্বাস্থ্য, অসৌন্দর্য, দারিদ্র, অবহেলা তিনি দেখেছেন উপলব্ধি করেছেন হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছেন দরদ দিয়ে।
ছোট গল্পকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ কে বিশ্বের টলস্টয়, মোপাসাঁ ও চেকভের পাশেই স্থান দিতে হবে। রবীন্দ্রনাথ শুধু বাংলা ছোট গল্পের স্রষ্টা নন, ছোট গল্পকে তিনি বিশিষ্ট আঙ্গিকে রূপ দিয়েছেন। ফুলে ফলে শোভিত করেছেন। শিল্পমূর্ত রূপে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এদিক থেকে বাংলা ছোট গল্পে তাঁর অসাধারণ দক্ষতার সার্থক পরিচয় পাওয়া যায়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ছোট গল্পে রবীন্দ্রনাথ
আরও পড়ুন