শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
সেবার ঈদ আসি আসি করছে। হঠাৎ বাবা নিখোঁজ হয়ে গেলেন। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না দেখে মা চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিন দিন পার হবার পরও বাবার কোনো হদিস নেই। অবশেষে তিনদিন পর বাবার বাড়ি থেকে বেশ অদূরে এক আবর্জনার ডোবায় বাবার লাশ পাওয়া যায়। বাবার এই আকস্মিক মৃত্যুতে সেবার আমাদের ঈদ আনন্দ মাটি হয়ে যায়।
বাবাকে খুন করা হয়েছে। আমার দাদাজান সন্ত্রাসী ভাড়া করে এনে বাবাকে খুন করিয়েছিলেন। বাবার অপরাধ তিনি আমার মাকে ভালোবেসে বিয়ে করে ঘরে তুলেছেন। কিন্তু দাদাজানের সেই প্রকান্ড ঘরে ঠাঁই হয়নি আমার মায়ের। দাদাজানের অগাধ সম্পত্তি আছে বলে তার এত বড়াই। মায়ের অপরাধ তিনি অতি দরিদ্র ঘরের মেয়ে। সেই মেয়েকে ঘরের বউ করলে দাদাজানের নাকি সমাজে মান যাবে বলে দাদাজান আমার মায়ের পাশাপাশি বাবাকেও তার বিশাল বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে সমস্ত বিষয় সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছেন।
নিঃস্ব হলেন আমার বাবা। স্ত্রীকে নিয়ে কষ্টের জীবন শুরু হল তার। কি একটা বিদেশী কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে বাবার কষ্টের জীবনের ইতি ঘটতে থাকে। ছোট্ট একটা জমি কিনে সেখানে বাড়ি করেন। সুখের ঘর বাঁধেন। সে ঘরে জন্ম হয় আমার। দিনে দিনে বাবা চাকরিতে ভালো আয় পেয়ে সংসারের উন্নতি হতে থাকে। কিন্তু সে দৃশ্য আমার দাদাজানের চোখে বিষের মত লাগে। একদিন তিনি হিংস্র হয়ে সন্ত্রাসী ভাড়া করে এনে নিজ পুত্রকে খুন করান। অকাল বিধবা আমার মা পড়েন মহা সাগরে।
জ্ঞান হবার পর মায়ের মুখে প্রায়ই বাবার এই খারাপ পরিণতির গল্প শুনি। আমরা এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত। বাবার মৃত্যুর পর আমার সুশিক্ষিতা মা বিভিন্ন বড় বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরির ইন্টারভিউ দেন। শেষে ব্যাংকে চাকরি পেয়ে যান। বর্তমানে আমার মা ব্যাংকের ম্যানেজার পদে আছেন। নিজের জীবন থেকে অভাবের গল্প শেষ হলেও স্বামী বিয়োগের ব্যথা এখনো তাকে কুরে কুরে খায়। ২. সেদিন ছিল ঈদের সকাল। ঈদগাহ থেকে বাড়ি এসে দেখি আমাদের উঠোনে একজন ভিক্ষুক দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে তার জীর্ণ ছেঁড়া পাঞ্জাবি। -দুটো টাকা হবে ভাইজান?
-হবে না কেন? অবশ্যই হবে। আপনাকে বেশ রোগাটে দেখাচ্ছে। ছেলেমেয়ে নেই আপনার? -না ভাই। আমার কেউ নেই। আজ আমি বড় নিঃস্ব। অথচ একদিন সব ছিল আমার। আমি ভিক্ষুকের গল্প শুনতে আগ্রহী হয়ে উঠতেই মা ঘর থেকে দরাজ গলায় আমাকে ডাকলেন, বাবু, এই লোককে একটাকাও দিবি না বলছি। ঘরে চলে আয়৷ ওই ভিক্ষুককে তাড়িয়ে দে।
আমার মা চিরকাল দানশীল। প্রতিবার ঈদে সুবিধা বঞ্চিত যারা আমাদের বাড়িতে কিছু চাইতে আসে, মা কখনো তাদের খালি হাতে ফেরান না। অন্যকে দান করার শিক্ষা মা আমাকে বাল্যকারেই শিখিয়েছেন। কিন্তু আজ মায়ের ভাষণ উল্টো কেন? ঘরে এসে মাকে প্রশ্ন করি।
মা, ওই ভিক্ষুকটাকে টাকা দিতে তোমার আপত্তি কেন? বেশ অসহায় দেখাচ্ছিল লোকটাকে। ওই লোকটাকে আর কখনো দেখা হলে ভিক্ষা দিবিনা। ওর অসহায় চেহারা দেখতে আমার ভালো লাগছে। একদিন আমি আর তোর বাবা ওই লোকটার কাছে কতই না অসহায় ছিলাম।
মানে? কি বলছো?
বাবু, ওই ভিক্ষুকটিই তোর দাদা। খুব অহংকারী স্বভাবের ছিল বলে আল্লাহ আজ তার এই পরিণতি করেছেন। একদিন সে তোর বাবাকে নিঃস্ব করে পথে বসিয়েছে। আজ আল্লাহ তাকে নিঃস্ব করেছেন।
মায়ের কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। একি শুনছি! উঠোনের ভিক্ষুকটি আমার দাদাজান? একদৌড়ে উঠোনে গেলাম। না, দাদাজানকে পাওয়া গেল না। কোন ফাঁকে তিনি চলে গেলেন!
ঘরে ফিরে দেখি মা ব্যাকুল হয়ে কাঁদছেন। মায়ের কান্না কখনো আমার ভালো লাগে না। তরল গলায় বললাম, তুমি না বলতে ঈদের দিন আনন্দের দিন! তাহলে কাঁদছো কেন? কথা শুনে মা অবুঝের মত আমার দিকে ভেজা চোখে তাকিয়ে রইলেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।