পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মুসলিম লীগের মধ্যে মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল পূর্ববঙ্গ। বিশেষ করে ঢাকা। ঐ সময়ই শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগের বিশাল কর্মী বাহিনীর মধ্যে অন্যন্য সাধারণ হয়ে উঠেছিলেন। জনপদের সাধারণের মধ্যে অনায়স বিচরণ, বাস্তব অভিজ্ঞান, স্মরণশক্তি ও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের গুণ ছিল তার। উনপঞ্চাশে যে আওয়ামী লীগ গড়ে উঠেছিল, সেই সংগঠনের হাল তৈরি হচ্ছিল আগে থেকেই। দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক রীতির প্রাধান্য, নেতৃত্বের মূল্যবোধ ও তার বিকাশ, সময়োচিত কর্মসূচী প্রণয়ন, জনগণের চিন্তা ও আকাক্সক্ষার প্রতিফলন-এসব কিছুই মুজিব ধাতস্থ করেছিলেন রাজনীতির শুরু থেকেই।
ঢাকার ১৫০ নং মোগলটুলিতে মুসলিম লীগের একটি শাখা অফিস ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই শাখা অফিসকে কেন্দ্র করেই পূর্ব পাকিস্তানের নাজিমউদ্দিন বিরোধী তরুণেরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। মুসলিম লীগকে নতুন করে সংগঠিত করার জন্য ‘ওয়ার্কাস ক্যাম্প’ কর্মী সম্মেলন আহবান করা হয়। শামসুল হক ও শেখ মুজিবর রহমান, সেই সময় মুসলিম লীগ সভাপতি আকরাম খাঁ সদস্য সংগ্রহ বই দিতে অস্বীকার করলে দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছে।
এমনি সময় হোসেন শহীদ সোহরওয়ার্দী ঢাকা হাইকোর্টে দবিরুল ইসলামের হেবিয়াস কার্পাস মামলাটি পরিচালনা করার জন্য ঢাকা আসেন। তখন বিরোধী বিক্ষুব্ধদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেন। ইতোমধ্যে তিনি মুসলিম লীগের বিপরীতে পশ্চিম পাকিস্তানে গণতন্ত্রের পক্ষে নতুন দল গঠন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। তিনি ঢাকার নেতা-কর্মীদের পরামর্শ দিয়েছিলেন, মুসলিম লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে নতুন রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলতে, যাতে করে পকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা য়ায় এবং একমাত্র গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলেই জনগণের ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন সম্ভব। আওয়ামী মুসলিম লীগ নামটিও তার দেয়া। এই পরিস্থিতিতে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন সকাল ১০টায় কেএম দাস লেনের বশির সাহেবের রোজ গার্ডেনের বাস ভবনে মুসলিম লীগ কর্মী, নেতা এবং অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সম্মেলন হয়। সম্মেলনে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৯ সালের ২৪ জুন আরমানিটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম জনসভা হয়।
বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়েছিলেন ১৯৪৯ সালের ১৭ জুলাই। জেল থেকে বেরিয়ে জেলায় জেলায় প্রথম যে কমিটিগুলো তিনি করেছিলেন বস্তুত সেই কমিটিগুলোই হয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সাংগঠনিক স্তম্ভ। এই দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের জন্ম এবং উত্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। দেশে তখন খাদ্য সংকট, চালের দাম হু হু করে বৃদ্বি পাচ্ছে। ১১ অক্টোবর ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ জনসভা করে এবং জনসভা শেষে একটি ভূখা মিছিল বের হয়। মিছিলটি নবাবপুর রেল ক্রসিং-এ পৌঁছালে পুলিশ লাঠি চার্জ করে এবং ভাসানী, শামসুল হকসহ অনেকে গ্রেফতার হন। ভাসানীর পরামর্শে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার এড়িয়ে পাকিস্তানে যান সোহরাওয়ার্দীর সাথে পাকিস্তানভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের আলোচনা করতে। কয়েক সপ্তাহ পকিস্তানে থেকে সোহরাওয়ার্দীসহ মামদতের নবাব, মানকি শরীফের পীর সাহেবের সাথে আলোচনা করে ডিসম্বরে ঢাকায় ফিরেন এবং ১ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে গ্রেফতার হন। একটানা ২৬ মাস কারাভোগ করেন।
১৯৫০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর লিয়াকত আলি খান মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করেন। সংবিধান রচনার ভিত্তি হিসেবে এই রিপোর্ট গ্রহণ করার কথা ছিলো; যার ভিতর ছিলো হাউজ অব ইউনিটস, হাউজ অব পিপলস নামে ২টি আইন সভা নিয়ে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট জাতীয় পরিষদ, ফেডারেল পদ্ধতির সরকার এবং উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এর প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় আন্দোলন গড়ে তোলেন।
কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারির আন্দোলন গড়ে তোলার কারণে এবং তার সমর্থনে অনশন করার জন্য তাকে ফরিদপুর জেলে পঠিয়ে দেয়া হলো। বঙ্গবন্ধু এবার মুক্তি পেলেন ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, তাও ফরিদপুর জেল থেকে। ওখানে তার বিরুদ্ধে একটা মামলা ছিল। তাঁকে ঢাকা জেল থেকে ফরিদপুর জেলে পাঠানো হয়েছিল ১৯৫২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। ১৯৫৩ সালে পূর্ববঙ্গের গভর্নর হয়ে আসেন চৌধুরী খালেকুজ্জামান। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকার পল্টনে এক সভায় বৃহত্তর গণ আন্দোলনের কথা বললেন। এ জনসভায় আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের কথা উল্লেখ করে বাঙালি জাতির অস্তিত্বের লড়াইয়ের জন্য বড় রকমের আত্মত্যাগের জন্য আহবান জানান। ১৯৫৩ সালের ১৪ নভেম্বর ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন হয়। এ অধিবেশনে মাওলানা আবদুল হামীদ খান ভাসানী সভাপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালের সেপ্টেম্বরে হক সাহেব অ্যাটর্নি জেনারেল পদ থেকে পদত্যাগ করেন। মুসলিম লীগে যোগদেন এবং কাউন্সিলে সভাপতি পদে পরাজিত হন। শেখ মুজিব তখন হক সাহেবকে আওয়ামী লীগে যোগদান করতে বলেন। উনি রাজি হন। চাঁদপুরে আওয়ামী লীগের জনসভায় বক্তৃতায় বলেন, যারা চুরি করবেন তারা মুসলিম লীগে থাকেন, যারা ভালো কাজ করবেন তারা আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। আমি বুড়া মানুষ, আর বলবো না, শেখ মুজিবের বক্তৃতা শোনেন। পরবর্তীতে হামিদুল হক চৌধুরী, মোহন মিয়া এদের প্ররোচণায় তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন নাই। যোগদান না করে কেএসপি গঠন করেন। অনেক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়।
যুক্তফ্রন্টে যে দলগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল সেগুলো হলো, আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি (১৯৫৩ সালের অক্টোবরে গঠিত), গণতন্ত্রী পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি, খিলাফতে রাব্বানী পার্টি ও কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯৫৩ সালের ১৪-১৫ নভেম্বর ময়মনসিংহে আওয়ামী লীগ কনফারেন্সে ৪২ দফা নির্বাচনী ইশতেহার গৃহীত হয়। পরে সেটাকেই ছোট করে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
’৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট পেয়েছিল ২২৩টি আসন, মুসলিম লীগ ৯টি এবং স্বতন্ত্র ৫টি। অন্যদিকে সংখ্যালঘু আসনে জাতীয় কংগ্রেস ২৫টি, কাস্ট ফেডারেশন ২৭টি, সংখ্যালঘু যুক্তফ্রন্ট ১৩টি, কমিউনিস্ট পার্টি ৪টি আসন এবং গণতন্ত্রী দল ৩টি আসন লাভ করেছিল। বাংলার জনগণের রায় থেকে এটাই বোঝা গিয়েছিল যে মুসলিম লীগকে তারা মনপ্রাণ থেকেই বর্জন করেছে। ১৯৫৪ সালের ২৫ মার্চ কর্ণফুলি পেপাার মিলে বাঙালি-বিহারী দাঙ্গায় ১০ জন প্রাণ হারায়। ১৯৫৪ সালের ২ এপ্রিল ঢাকা বার লাইব্রেরিতে যুক্তফ্রন্টের পার্লামেন্টারি দলের সভা বসে। পালামেন্টারি দলের নেতা মনোনীত হন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। চিফ মিনিস্টরের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি ঐ দিনই। সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া এবং আবু হোসেন সরকারও পরের দিন মন্ত্রিসভায় যোগ দেন এবং ১৯৫৪ সারের ৩ এপ্রিল আশরাফ উদ্দিন আহমেদকে নেয়া হয় মন্ত্রী হিসেবে। শেরে বাংলা কোলকাতায় সফরে গিয়ে তার ভাষণে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বকে আঘাত করে কী একটা কথা বলেছেন বলে মারাত্মক অভিযোগ ওঠে। শেরে বাংলা দেশে ফিরে ঐ অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা করা যায়নি। শেরে বাংলা কোলকাতা থেকে ফিরে ১৯৫৪ সালের ১৩ মে আতাউর রহমান খান, ইউসুফ আলী চৌধুরী, আবদুস সালাম খান, শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ মোয়াজ্জেম উদ্দিন হোসেন, আবুল মনসুর আহমেদ, হাশিমুদ্দিন আহমদ, কফিলউদ্দিন আহমদ চৌধুরী ও আবদুল লতিফ বিশ্বাসকে মন্ত্রী করেন। নতুন মন্ত্রীগণ গভর্নর হাউসে শপথ নেবার সময়ই ডেমরায় আদমজী পাটকলে বিহারী-বাঙালি দাঙ্গা বেঁধে যায়।
১৫ দিনের মাথায় ৩০ মে পাকিস্তান সরকার ৯২ ক ধারা মতে, প্রাদেশিক সরকার ভেঙ্গে দিয়ে গভর্নরের শাসন কায়েম করে। ঐ দিনই সকালে বঙ্গবন্ধ,ু আতাউর রহমান সাহেবসহ শেরে বাংলার বাসভবনে গিয়ে কেবিনেট মিটিং ডেকে প্রত্যাখান করার কথা বলেন। হক সাহেব কিছু না বলে উপরে উঠে যান। ১৯৫৪ সালের ৩১ মে প্রথমে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৫৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইত্তেফাক জননিরাপত্তা আইনে নিষিদ্ধ করা হয়।
ওদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশ ভেঙ্গে এক ইউনিট গঠন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯৫৪ সালের ১২ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পকিস্তান ফিরে আসেন। সোহরাওয়ার্দীর প্রচেষ্টায় ১৯৫৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর শেখ মুজিব ঢাকা জেল থেকে মুক্তি পেলেন। ভাসানীর উপর থেকেও নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। ১৯৫৪ সালের ২০ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আইনমন্ত্রী হিসাবে পকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারে যোগদান করেন।
১৯৫৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রূপমহল সিনেমা হলের সম্মেলনে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রাদায়িক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ রাতে পকিস্তান কেন্দ্রীয় পরিষদে সংবিধান গৃহীত হয়। পরিষদে সেদিন শেখ মুজিব বলেছিলেন, পূর্ববঙ্গের নাম পূর্ব পাকিস্তান রাখার অধিকার এ পরিষদের নেই এবং সংবিধানে তা বৈধ নয়, একটি দেশের নাম বদল করতে হলে সেদেশের জনগণের রায়ের প্রয়োজন। পূর্ববঙ্গ হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য মণ্ডিত একটি জনপদ। এ নামের সঙ্গে জনগণের জাতীয় পরিচয় অবিচ্ছেদ্য।
দুর্ভিক্ষ মোকাবেলার দাবিতে মাওলানা ভাসানী ১৯৫৬ সালের ২ মে থেকে অনশন শুরু করেন। ১৬ মে পরিস্থিতি যখন চরম পর্যায়ে শেখ মুজিব আরমানিটোলা ময়দানের জনসভায় গণ আন্দোলণনের কর্মসূচি দেবেন বলে ঘোষণা করেন। পশ্চিম পকিস্তান থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এসে মাওলানা ভাসানীর অনশন ভাঙ্গালেন। ১৯৫৬ সালের ১৯ ও ২০ মে মুকুল সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন সম্পন্ন হয়। ১৯৫৬ সালের ২৬ মে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা পূর্ব পকিস্তানের প্রেসিডেন্টের শাসন জারি করেন। কিন্তু ১৯৫৬ সালের ১ জুন আবার তা তুলে নেয়া হয়।
১৯৫৬ সালের ২৩ জুলাই পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন দাবি করলেন। অবিলম্বে ব্যবস্থাপক পরিষদের অধিবেশন ডাকা না হলে ঢাকা শহর অচল করে দেয়া হবে বলে তিনি চূড়ান্ত ঘোষণা দেন। ১৯৫৬ সালের ১৫ আগস্ট খাদ্য সরবরাহ তাদারক করার জন্য কেএসপি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর হাতে ক্ষমতা প্রদান করেন। কিন্তু প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনের কারণে ঢাকা শহরের অবস্থার অবনতি ঘটে মিছিল মিটিং আর বিক্ষোভে। ১৯৫৬ সালের ২২ আগস্ট কেন্দ্র ৩০ আগস্টের মধ্যে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন ডাকার নির্দেশ দিলে, ১৯৫৬ সালের ২৯ আগষ্ট যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী পরিষদ সদলবলে পদত্যাগ করে। আওয়ামী লীগ বুঝতে পারেন এটা কোন পাতানো নাটক। কিন্তু পরিস্থিতি অন্য রকম হল। ৩০ আগস্ট আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শহরে ভুখা মিছিল চলছিল। পুলিশ মিছিলে গুলি করে কয়েকজনকে হত্যা করে। সমস্ত শহর কেঁপে ওঠে। দুপুরের মধ্যেই সমস্ত অফিস-আদালত, দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। গভর্নর শেরে বাংলা মুষড়ে পড়েন। তিনি আওয়ামী লীগকে মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য অনুরোধ জানান। এ সময় কেন্দ্র এবং প্রদেশের রাজনীতি অতি দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছিল। কেন্দ্রের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলেন। এদিকে আওয়ামী লীগে ১৯৫৬ সালের ৫ এবং ১৯ সেপ্টেম্বর ১১ জন মন্ত্রী নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন চূড়ান্ত করে। চিফ মিনিস্টার আতাউর রহমান, শেখ মুজিবুর রহমান, আবুল মনসুর আহমদ, কফিলউদ্দিন চৌধুরী (কেএসপি), মাহমুদ আলী (গণতন্ত্রী পার্টি), মনোরঞ্জন ধর (কংগ্রেস) ও শরৎচন্দ্র মজুমদার (কংগ্রেস)। আওয়ামী লীগের সামনে ছিল দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করা। সরকার পরিচালনা এবং দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা ছিল আওয়ামী লীগের জন্য ছিল একটা নতুন অভিজ্ঞতা। আওয়ামী লীগ সরকার একটি বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্বান্ত নিয়েছিল তা হলো, সরকার এবং দলের অবস্থান নির্ধারন। ওদিকে কেন্দ্রের প্রধানমন্ত্রী তখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনিও পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নে আওয়ামী লীগ সরকারকে সহায়তা করেন। ১৯৫৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কাগমারীতে আফ্রো এশীয় সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এখানে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং সভায় শুধু কেন্দ্র নয়, প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সরকারকেও কঠোর ভাষায় সমালোচনা করা হয়।
আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে ১৯৫৬ সালের ২১ মে অভিযোগ তোলা হয়েছিল যে, দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কোন মন্ত্রী দলের সাংগঠনিক কমিটির দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। ১৯৫৬ সালের ২১ মে’তেই যারা মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন তাদের সকলেই দলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে পদত্যাগ করেন। একমাত্র জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৬ সালের ৩১ মে মন্ত্রিত্বের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। একই সাথে তিনি সাধারণ সম্পাদকের পদেই রয়ে গেলেন। তার ঐ সিদ্বান্ত যে কতটা জরুরি ছিল তা তখন না বোঝা গেলেও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি মুহূর্তে জাতি উপলব্ধি করেছে।
হঠাৎ করে মাওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ফলে একটি বড় রকমের ধাক্কা এল দলে। জেলা মহকুমা ও থানার শাখা কমিটিগুলোর অনেকেই চলে গেল মাওলানা বাসানীর সঙ্গে। কেউ কেউ আবার ফিরেও এলেন। সাতান্নতেই হাল ধরতে হল শেখ মুজিবকে, মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগিশ আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নিলেন। তখন থেকেই মুজিবের আওয়ামী লীগ বলে দলের পরিচিতি লাভ করেছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন ১৯৫৭ সালের ১১ অক্টোবর। অনেকেই ধারণা করছিল যে, পূর্ব পকিস্তান আবার গভর্নরের শাসনে চলে যাবে। নানা ধরনের ষড়যন্ত্র চলছিল। গভর্নর শেরে বাংলা এ সময় সরাসরি কেএসপিকে সমর্থন করে নতুন আইন জারি করেছিলেন পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিষয়ে। ১৯৫৮ সালের ৩১ মার্চ গভর্নর শেরে বাংলা আওয়ামী লীগ সরকারকে বরখাস্ত করে দিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই আবু হোসেন সরকারকে চিফ মিনিস্টারের দায়িত্ব প্রদান করলেন। কিন্তু এই অনাহুত কাজটি ছিল নিছক আইন বিরুদ্ধ। সোহরাওয়ার্দী বিষয়টি প্রেসিডেন্ট এবং প্রদানমন্ত্রীর গোচরে আনলেন। গভর্নর নিরপেক্ষ নয় বলে তিনি তাদের কাছে প্রমাণ রাখলেন। ১৯৫৮ সালের ৩১ মার্চ কেন্দ্রীয় সরকার শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হককে গভর্নরের পদ থেকে বরখাস্ত করে দেয়। আবু হোসেন সরকারের শপথ নেয়ার কথা ছিল কিন্তু তার পরিবর্তে আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান এসে শপথ নিলেন পরদিন ১ এপ্রিল।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বঙ্গবন্ধুকে কয়েকটি দেশে সফর করতে পাঠিয়েছিলেন। ওয়ার্কিং কমিটির সভায় তিনি বলেছিলেন, এ দেশের ভবিষ্যতের নেতৃত্বের ভার তাকেই নিতে হবে। কেএসপি সরকারের পতনের পরই কেএসপি সর্বত্রই জঙ্গী মনোভাব নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের উপর আক্রামণ চালাতে থাকে। হামিদুল হক চৌধুরী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে ১৯৫৮ সালের ৩ এপ্রিল এবং পল্টনে জনসভা করে ৪ এপ্রিল। ১৯৫৮ সালের ৫ এপ্রিল পরিষদের সভা বসে। সভায় অধিবেশন মূলতবি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পরিষদ কক্ষের মধ্যে হাতাহাতি-মারামারি শুরু হয়ে যায়। সেই মারামারির জের চলে শীতকালীন অধিবেশন পর্যন্ত। ১৯৫৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর অন্যান্য দিনের মত বিরোধীদল পরিষদ কক্ষে হৈচৈ-মারামরিতে এত বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ে যে, আওয়ামী লীগের ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীকে তারা আঘাত করে মারাত্মকভাবে। সেই আঘাতেই ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী ঢাকা মেডিকেলে ২৬ সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন। পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে। জেনারেল ইস্কান্দর মীর্জা পকিস্তানে মার্শাল ল’ জারি করেন ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর। জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর তাকে তাড়িয়ে নিজেই পকিস্তানের সর্বময় ক্ষমতা দখল করে বসেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৫৮ সালের ১২ অক্টোবর প্রথম ধাপেই গ্রেফতার হলেন, মুচলেকা দিয়ে অনেক নেতাই মুক্তি পেয়েছিলেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মেজাজে ঐ ধরণের কিছু কোনদিনই ছিল না। তিনি মুচলেকা দিলেন না, ফলে তিনি মুক্তি পেলেন ১৯৫৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর। আওয়ামী লীগের জন্য এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্য এটা ছিল সবচেয়ে গুরুতর সময়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সে সময় যে ঝুঁকিপূর্ন ভূমিকা রেখেছে, তা অবশ্যই ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়।
১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি হঠাৎ করেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করে আইয়ুব খান সরকার। বরিশাল, ঢাকা, কুমিল্লা সহ বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলাতেই ছাত্র-জনতা তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। বিরোধী দলের রাজনীতিকরাও ক্রমেই নড়েচড়ে ওঠেন। ১৯৬২ সালের ১ মার্চ আইয়ুব খান তার পক্ষে দেশের একটি শাসনতন্ত্র রচনা করেন। ওই শাসনতন্ত্রে দেয়া হয় প্রেসিডেন্টের অপার ক্ষমতা। উভয় ইউনিট থেকে ৪০ হাজার করে মৌলিক গণতন্ত্রীদের নির্বাচিত করে প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদ গঠন করা হল রাতারাতি। ১৯৬২ সালের ২৮ এপ্রিল জাতীয় পরিষদের এবং ১৯৬২ সারের ৬ মে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন দেয়া হয়। দেশের সবগুলো রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করে। (চলবে)
লেখক: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, কেন্দ্রীয় ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।