Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইনকিলাব আজ যা ভাবে অন্যরা তা আগামীকাল ভাবে

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ১০ জুন, ২০২২, ১২:০২ এএম

দেশ ও জনগণের পক্ষের পাঠকপ্রিয় দৈনিক ইনকিলাব তিন যুগ পূরণ করে চার যুগে পদার্পণ করেছে। জন্মলগ্ন থেকেই পত্রিকাটির পাঠক আমি। তখন স্কুলে পড়তাম। সেলুনে গিয়ে প্রতিদিন সকালে একটি দৈনিক পড়তাম। যে পত্রিকাটি পড়তাম, তার পাশাপাশি একদিন ইনকিলাব পত্রিকাটি দেখি। প্রথম দেখায়ই ইনকিলাব বেশ নজর কাড়ে। সাদাকালো পত্রিকার যুগেও এর ঝকঝকে ছাপা এবং সংবাদ উপস্থাপন ও পরিবেশন দেখে বেশ মুগ্ধ হয়েছিলাম। পত্রিকাটির গঠনমূলক ও ব্যতিক্রমী সংবাদে আকৃষ্ট হয়েছিলাম। এমনসব এক্সক্লুসিভ সংবাদ প্রকাশিত হতো, যা ছিল চিন্তার বাইরে। সম্পাদকীয় পাতায় যেসব কলামিস্ট সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লিখতেন, তাদের মতামত খুবই সুখপাঠ্য এবং উচিৎ মনে হতো। একেক লেখকের কলাম পড়ার জন্য সপ্তাহজুড়ে অপেক্ষা করতাম। পত্রিকাটি একদিন পড়তে না পারলে পুরো দিনটি অসম্পূর্ণ থেকে যেত। বিচ্ছিন্ন দ্বীপবাসী মনে হতো।

৩৭ বছর ধরেই পত্রিকাটি পড়ছি এবং পাঠক থেকে এ পত্রিকার সাংবাদিক হয়েছি। নব্বই দশকে ফ্রিল্যান্সার বা কনট্রিবিউটর হিসেবে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি করলেও ’৯৬ সালে ইনকিলাব হাউসের সাপ্তাহিক পূর্ণিমা’র মাধ্যমে পুরোপুরি সাংবাদিকতা পেশার সাথে জড়িয়ে পড়ি এবং পেশা হিসেবে বেছে নিই। এ হাউসে লেখালেখির সুযোগ না পেলে আমার সাংবাদিক হয়ে উঠা হতো না। ফলে ইনকিলাব হাউসই আমার সাংবাদিকতার পাঠশালা। এ পাঠশালা থেকে শুদ্ধ সাংবাদিকতা কি এবং কেন করতে হয়, কোন সংবাদ কিভাবে লিখতে ও উপস্থাপন করতে হয়, কোন সংবাদের ক্ষেত্রে কী ধরনের শব্দ ও বাক্যের প্রয়োগ করতে হয়, তা কর্মরত গুরুজনরা হাতে-কলমে শিখিয়েছেন। কেন এ শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করেছি, তার মতামত জানতে চাইতেন। সম্পাদনা করে এ শব্দ ও বাক্য এভাবে না লিখে এভাবে লিখতে হবে বলে শিখিয়ে দিয়েছেন। এখনও শিখছি। এ কল্পনা কখনো করিনি, প্রিয় পত্রিকার একজন সাধারণ পাঠক থেকে সেই পত্রিকারই সাংবাদিক হয়ে ওঠার সুযোগ পাব। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমার মতো আরও অনেক সাংবাদিককে সাংবাদিক হয়ে উঠার সুযোগ করে দিয়েছেন অত্যন্ত দূরদর্শী, সুক্ষ¥দর্শী, বিচক্ষণ ইনকিলাব হাউসের সম্পাদক-প্রকাশক শ্রদ্ধেয় এ এম এম বাহাউদ্দীন। এ কথাও বলার অপেক্ষা রাখে না, ইনকিলাবের স্বপ্নদ্রষ্টা, প্রতিষ্ঠাতা, দার্শনিক শ্রদ্ধেয় আলহাজ মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) যদি ইনকিলাব প্রতিষ্ঠা না করতেন, তাহলে আমার মতো আরও অনেকের সাংবাদিক হয়ে উঠা হতো না। সে সময়ে ইনকিলাব হাউস প্রতিষ্ঠিত না হলে, এ দেশের সংবাদ মাধ্যম অসম্পূর্ণই থেকে যেত। আজ সংবাদপত্রের যে বিস্তৃতি, ইনকিলাব তার অন্যতম পুরধা।

দুই.
ইনকিলাব এমন এক সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যখন আমাদের দেশের গণতন্ত্র এবং মানুষের অধিকার বিপন্ন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে ইসলামী মূল্যবোধ ধারণ করে মানুষকে সচেতন করা, তাদের ইমান-আকিদা, অধিকার, রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কথা তুলে ধরার মতো গ্রহণযোগ্য কোনো মুখপাত্র ছিল না। রাষ্ট্র পরিচালক থেকে শুরু করে ক্ষমতাধরদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ন্যায়ভিত্তিক উচিৎ কথা বলার মতো সাহসী দৈনিক ছিল না। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনামূলক প্রতিবেদন ও মতামত তুলে ধরে জনমত সৃষ্টির মতো পত্রিকা ছিল না। এক ধরনের বিশাল শূন্যতা ছিল। দূরদর্শী ও দার্শনিক আলহাজ মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) তিনি এ শূন্যতা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। সাধারণ মানুষের হয়ে কথা বলার যে একটি প্ল্যাটফর্ম প্রয়োজন, তা তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাঁর এই উপলব্ধি থেকেই উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো আবির্ভাব ঘটে দৈনিক ইনকিলাবের। আমার কাছে মনে হয়েছে, ইনকিলাব কোনো লৌকিক শক্তির বলে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অলৌকিক ও আধ্যাত্মিক শক্তির বলে, যা মানুষকে সচেতন করবে, হেদায়াতের পথ দেখাবে, কল্যাণের পথ দেখাবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, সে সময়ে যে শূন্যতা ছিল, তা চিন্তা করার মতো ধীশক্তিসম্পন্ন মানুষ খুব কমই ছিল। আলহাজ মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) তাঁর বিচক্ষণতা ও দূরদর্শী চিন্তা দিয়েই সে সময় সংবাদপত্র প্রকাশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এ পদক্ষেপ তিনি না-ও নিতে পারতেন। তিনি তা নিয়েছিলেন, মানুষের কল্যাণকামী চিন্তায় নিজেকে নিঃস্বার্থভাবে উজাড় করে দেয়ার প্রেরণা থেকে। এই সময়ে এসে যখন দেখা যায়, দেশ ও বিদেশে ইসলাম ও মুসলমানদের ওপর নানা অপবাদ দিয়ে বদনাম দেয়ার নিরন্তর চেষ্টা চলছে, তখন মনে হয়, ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষে কথা বলার একটি মুখপাত্র হিসেবে ৩৬ বছর আগে আলহাজ মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) ইনকিলাব প্রকাশের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা ছিল যুগান্তকারী, সময়োপযোগী এবং অত্যন্ত সূ²দর্শী চিন্তার ফসল। ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষে কথা বলায় ইনকিলাব হয়তো দেশ ও দেশের বাইরের অনেকের কাছে চক্ষুশূল হয়েছে, তবে এর বিপরীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অকুণ্ঠ সমর্থন তার চেয়েও বড় হয়ে রয়েছে। ইনকিলাবের শক্তি এখানেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরাকে আক্রমণ ও আগ্রাসন চালায়, তখন একমাত্র ইনকিলাবই এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ করেছিল। এর প্রতিবাদে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে রাজধানীতে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ মিছিলটি করেছিল ইনকিলাব, যা সংবাদপত্র ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। শুধু ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থেই নয়, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি যেকোনো হুমকির বিপরীতে ইনকিলাব সবসময়ই সোচ্চার। অপরাজনীতি, স্বৈরনীতি, দুর্নীতি, দুঃশাসন, সামাজিক-পারিবারিক নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে ইনকিলাব রাডারের ভূমিকা পালন করে চলেছে। দেশের যেকোনো সংকটজনক মুহূর্তে কি করা উচিৎ এবং কি করতে হবে-এমন দিক নির্দেশনামূলক প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় প্রকাশ করে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। মানুষের মধ্যে সঠিক পথে চলার মাইন্ডসেট তৈরি করতে পেরেছে এবং পারছে। বাংলাদেশ যে একটি মডারেট মুসলমানের দেশ এবং হাজার বছর ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ থেকে পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সহবস্থানে বসবাস করছে, সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ধারণা প্রতিষ্ঠায় একমাত্র ভূমিকা রেখেছে ইনকিলাব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অবিচল থেকেছে। অর্থনৈতিক মুক্তি, সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের ভিত্তিতে স্বাধীনতার যে মৌলিক চেতনা প্রতিষ্ঠিত, তা ইনকিলাব মনেপ্রাণে ধারণ এবং তা প্রতিষ্ঠায় নিরন্তর কাজ করে চলেছে।

সংবাদপত্রকে চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সংবাদপত্রের বন্ধু বলে কিছু নেই। ভালো করলে তার পক্ষে, খারাপ করলে তার বিপক্ষে অবস্থান নিতে হয়। সংবাদপত্রের এই মৌলনীতি ইনকিলাব বরাবরই অবলম্বন করে চলেছে। তোষামদীর নীতি পরিহার করে প্রকৃত সংবাদপত্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালীদের রোষানলে পড়ে ইনকিলাব বন্ধ এবং অসংখ্য মামলা-মোকদ্দমার শিকার হয়েছে। তবে যারাই বন্ধ করেছে, তারাই শেষ পর্যন্ত তাদের ভুল বুঝে এবং ইনকিলাবই যে সঠিক এবং সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করেছে, তা স্বীকার করে খুলে দিয়েছে। ইনকিলাবকে দমিয়ে রাখার এই অপচেষ্টা তার জন্মলগ্ন থেকেই চলছে। ন্যায্য সরকারি বিজ্ঞাপন পাওয়ার ক্ষেত্রে বরাবরই ইনকিলাব বঞ্চিত হয়েছে। এখনো হচ্ছে। অথচ এ সময়ে নামমাত্র পত্রিকা, সাধারণ মানুষের কাছে যেগুলোর সংবাদমূল্য ও গ্রহণযোগ্যতা নেই বললেই চলে, শুধুমাত্র সরকারের পক্ষপাতিত্বের কারণে সেসব পত্রিকা ব্যাপক হারে সরকারি বিজ্ঞাপন পাচ্ছে। অথচ দেশ ও জনগণের কল্যাণে নিবেদিত ইনকিলাব তার প্রাপ্য বিজ্ঞাপন পাচ্ছে না। চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এতে ইনকিলাব আর্থিক সংকটে পড়লেও এর নীতি, আদর্শ ও দর্শনের প্রতি অনুরক্ত হয়ে কর্মরত সাংবাদিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারিদের আন্তরিকতা, ভালোবাসা, মায়া-মমতা এবং ত্যাগ শিকারের কারণে সচল রয়েছে এবং তা থাকবে ইনশাআল্লাহ। মনে রাখা দরকার, ইনকিলাব কোনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের দৈনিক নয়। ব্যক্তি স্বার্থ, দুর্নীতি থেকে মুক্ত থাকা কিংবা নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় স্বার্থে। ইনকিলাবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, জনগণ ও জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি, সম্ভাবনাকে সমর্থন দিয়ে যাওয়া। সম্ভাবনার বাংলাদেশের কথা বলা। বাংলাদেশের অমিত সম্ভাবনার বিভিন্ন দিক নিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করার পথটি ইনকিলাবই দেখিয়েছে। দেশের অফুরন্ত সম্পদ ও সম্ভাবনার চিত্র প্রতিনিয়ত তুলে ধরছে। সংবাদপত্র শিল্পে নতুন ধারা সৃষ্টির অগ্রপথিক ইনকিলাব। ৮ পৃষ্ঠার মূল পত্রিকার সাথে যে বিভিন্ন বিভাগ নিয়ে আলাদা ফিচার পাতা হতে পারে, যা কেউ কল্পনা করতে পারেনি, ইনকিলাব তা যুক্ত করে উদ্ভাবনী শক্তি দেখিয়েছে। আজ বিভিন্ন দৈনিকে নানা বিষয় নিয়ে যে ফিচার পাতা প্রকাশিত হয়, তা ইনকিলাবের উদ্ভাবিত আইডিয়ারই অনুসরণ ও ধারাবাহিকতা। বিভিন্ন সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক ম্যাগাজিনের বাইরে দৈনিক পত্রিকায়ও যে আলাদাভাবে সংস্কৃতি ও বিনোদন বিভাগ থাকতে পারে, তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। ইনকিলাবই সাপ্তাহিক বিনোদন বিভাগ চালু করে প্রথম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। সংবাদপত্রে নামাজের সময়সূচি, প্রতিদিন ধর্মদর্শন, ইসলামী জীবন নিয়ে আলাদা বিভাগ চালুর রূপকার ইনকিলাব, যা এখন অন্যান্য পত্রিকাগুলো অনুসরণ করছে। এছাড়া রম্য ম্যাগাজিন, ট্যাবলয়েড, অসহায় মানুষের জীবনকাহিনী, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, তথ্য-প্রযুক্তি, রাজনীতি, পাঠকের মতামত ইত্যাদি বিভাগ মূল কাগজের সাথে আলাদাভাবে যুক্ত করে সংবাদপত্র জগতে বিপ্লব ঘটিয়েছে ইনকিলাব। মানবজীবনের এমন কোনো ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা নেই, যা ইনকিলাব তুলে ধরছে না। অন্যান্য পত্রিকা থেকে ইনকিলাবের পার্থক্য এখানেই। ইনকিলাব আজ যা ভাবে, অন্যরা তা আগামীকাল ভাবে।

তিন.
ইনকিলাব যে ৩৭টি বছর ধরে চলছে, এটা কখনোই সম্ভব হতো না, যদি না এর সম্পাদক-প্রকাশক এ এম এম বাহাউদ্দিন ইনকিলাবের প্রতি নিজেকে উৎসর্গ না করতেন। এমন সম্পাদক আছে কিনা, যিনি একটি পত্রিকার জন্য নিজেকে নিঃস্বার্থভাবে উজাড় করে দিয়েছেন, তা আমার জানা নেই। সবচেয়ে বড় কথা, সুদীর্ঘ তিন যুগ ধরে শুধু একটি পত্রিকা নিয়ে এভাবে জীবন কাটিয়ে দেয়া সম্পাদক বাংলাদেশ তো বটেই বিশ্বে আর কেউ আছেন কিনা, তাও জানা নেই। তিনি এমনই এক সম্পাদক, যিনি আর্থিক ক্ষতি থেকে শুরু করে, ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালীদের রোষে পড়ে পত্রিকা বন্ধ হওয়া এবং অসংখ্য মামলা-মোকদ্দমার শিকার হয়ে একবারও ভাবেননি পত্রিকা আর চালাবেন না। এমন সহিষ্ণু ও ধৈর্যশীল মানুষ বিরল। অথচ তিনি পারতেন বছরের পর বছর ধরে চলা আর্থিক ও জীবনক্ষয় করা মানসিক ক্ষতি থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিতে। তাঁর পারিবারিক যে সহায়-সম্পদ তা দিয়েই শান্তিতে জীবন কাটিয়ে দিতে। হতে পারতেন, ব্যবসা-বাণিজ্য করে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতি। তিনি এসবের কিছুই করেননি। এমনকি বিভিন্ন সরকারের সময় মন্ত্রী-এমপি এবং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার প্রস্তাব পেয়েও অবলীলায় ফিরিয়ে দিয়েছেন। এসবের কোনো কিছুই তাঁকে প্রলুব্ধ করতে পারেনি। প্রলোভনের কাছে নীতি-আদর্শকে বিসর্জন দেননি। কোনো ধরনের চাপের কাছেও নতি স্বীকার করেননি। চরম বৈরী পরিস্থিতিতেও অন্যায়কে অন্যায়, ন্যায্যকে ন্যায্য বলতে দ্বিধা ও সংকোচবোধ করেননি, করছেন না। শত কষ্টের মধ্যেও শুধুমাত্র দেশ ও মানুষের কল্যাণ চিন্তা করে ইনকিলাবকে ধারণ করে আছেন। বাতিঘর হয়ে আছেন। এত ত্যাগ-তিতিক্ষা আর কোনো সম্পাদক ও প্রকাশক করেছেন কিনা, জানা নেই। পত্রিকা নিয়ে দিন-রাত ২৪ ঘন্টা চিন্তা-ভাবনায় ডুবে থাকা এমন সম্পাদক দ্বিতীয়জন খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাঁর চিন্তা, চেতনা ও ভাবনা যে, কোনো আত্মকেন্দ্রিক কিংবা ব্যক্তি স্বার্থে নয়, তা ইনকিলাবের পাঠকমাত্রই জানেন। দেশ তো বটেই প্রতি মুহূর্তে পৃথিবীর কোথায় কি ঘটছে, বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির কি পরিবর্তন ঘটছে, কোন দেশ কোন পরিস্থিতির মধ্যে আছে, মুসলিম বিশ্বে কি ঘটছে, কোথায় মুসলমানরা নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, মুসলমানদের নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের হীন রাজনীতি ও আগ্রাসন কোথায় চলছে, এসব খবর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করে তা ইনকিলাবে তুলে ধরছেন। এ কারণে অন্য পত্রিকার চেয়ে ইনকিলাবের সংবাদের গুরুত্ব আলাদা। ইনকিলাবের একটি সংবাদের গুরুত্ব এবং ওজন দেশ-বিদেশের পাঠকের কাছে চিন্তা ও ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এটি পাঠকদের মধ্যে এমন একটি আকাক্সক্ষা সৃষ্টি করেছে যে, তাদের চাহিদা মতো ইনকিলাব না পেলেও কোথাও একটি ইনকিলাব পাওয়া গেলে তা ভাগাভাগি করে পড়েন। ইনকিলাব এমন পত্রিকা নয় যে, বাস, ট্রেন কিংবা লঞ্চে উঠার সময় পাঁচটাকা দিয়ে কিনে চোখ বুলিয়ে সেখানেই ফেলে যেতে হয়। ইনকিলাব পড়ার জন্য পাঠককে সংগ্রহে রাখতে হয়। কেউ না পেলে ইনকিলাবের অত্যাধুনিক অনলাইন সংস্করণ খুঁজে নেয়। ইনকিলাবের বৈশিষ্ট্য এই, যে পথ দেখায়, সে পথে অন্যরা হাঁটে। ইনকিলাবের সংবাদ ও সম্পাদকীয় বিভাগ দেখলে পাঠকরা তা উপলব্ধি করতে পারেন।

সম্পাদকীয়কে বলা হয়, পত্রিকার মস্তিষ্ক। ইনকিলাবের সম্পাদকীয়তে দেশ, জাতি, সরকার, রাজনীতি, সমাজ, পরিবার, নীতি-নৈতিকতা, ন্যায়-অন্যায়, মানবিকতা, দুর্নীতি, মূল্যবোধের অবক্ষয়, ধর্ম-দর্শন, দেশবিরোধী চক্রান্ত, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি থেকে শুরু করে যাবতীয় বিষয়ে যেভাবে দিক-নির্দেশনা ও করণীয় সম্পর্কে তুলে ধরা হয়, তা অন্যসব পত্রিকা থেকে একেবারে আলাদা। দেশ ও স্বাধীনতাবিরোধী এবং আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের চেতনার বিরুদ্ধে যেসব বিষয় অন্য পত্রিকা এড়িয়ে যায়, ইনকিলাব তার প্রতিবাদ করে। ফলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারক থেকে শুরু করে সর্বত্র ইনকিলাবের সম্পাদকীয় গুরুত্ব পায়। এমনও শুনেছি, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ইনকিলাবে আজ কি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে এবং সম্পাদকীয়তে কি লেখা হয়েছে, তা মন্ত্রী-এমপিদের পড়তে বলা হয়, যাতে তারা দিক-নির্দেশনা পায়। এমনও দেখেছি, ইনকিলাবে যে দিক-নির্দেশনামূলক প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয় লেখা হয়, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে অন্যদের বক্তব্যেও তার প্রতিফলন ঘটে। ইনকিলাব এমনই একটি পত্রিকা যে, এর বিরুদ্ধবাদীরাও পড়তে বাধ্য হয়। ইনকিলাবে কি লেখা হলো, তা প্রতিদিন সবার আগে তা তারা পড়েন। ইনকিলাব এবং এর সম্পাদকের এখানেই সার্থকতা। ইনকিলাব শুধু একটি পত্রিকা নয়, এটি যেমন একটি দর্শন, তেমনি সাংবাদিক তৈরির ইনস্টিটিউটও বটে। এখান থেকে সাংবাদিকতা শিখে এবং সাংবাদিকতার সুযোগ পেয়ে অনেকে এখন দেশের নামকরা সাংবাদিক। কেউ কেউ পত্রিকার সম্পাদকও। এটা সম্ভব হয়েছে, এর সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দিনের দূরদৃষ্টির কারণে। তিনি এমনই যে, একজন নবিশ সাংবাদিকের সম্ভাবনা বিকাশে যথাযথ সুযোগ দিয়ে থাকেন। নতুন সাংবাদিক সৃষ্টি করেন। তিনি শুধু ইনকিলাবের সম্পাদকই নন, এতে কর্মরত সাংবাদিক-কর্মচারিদের অভিভাবকের দায়িত্বও পালন করেন। ইনকিলাবকে একটি পরিবারে পরিণত করে এর সদস্যদের কার, কি সমস্যা, মায়া-মমতা দিয়ে তার খোঁজ-খবর নেন, পাশে দাঁড়ান।

চার.
বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এবং অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে সংবাদপত্র টিকে থাকবে কিনা, এমন সংশয় অনেকের মধ্যে রয়েছে। এর কারণ, পাঠকদের এখন আর আগের দিনের খবর পরের দিন পড়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। মুহূর্তের খবর মুহূর্তে পেয়ে যাচ্ছে। এতে সংবাদপত্রের চাহিদা অনেকাংশে কমেছে। বিশ্বজুড়ে সংবাদপত্র চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তবে সংবাদপত্রের আবেদন ও গুরুত্ব ফুরিয়ে যায়নি এবং যাবেও না। অনলাইন নিউজ পোর্টাল তাৎক্ষণিক সংবাদ পরিবেশন করলেও, তাতে সংবাদপত্র পড়ার তৃপ্তি মেটে না। তাছাড়া, অনেক ক্ষেত্রে পোর্টালগুলো ভিউ কিংবা রেটিং বাড়ানোর জন্য এমনসব সংবাদ প্রকাশ করে কিংবা গুজব সৃষ্টিকারী সংবাদ পরিবেশন করে, যা পরবর্তীতে বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। একটি সংবাদের বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত এবং নেপথ্যের বিষয় পরিপূর্ণভাবেও তুলে ধরা হয় না। এমনকি টেলিভিশনের খবরেও তা তুলে ধরা সম্ভব হয় না। এ প্রেক্ষিতে, অনেক পাঠক এসব মাধ্যমের সংবাদের প্রতি পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারে না। সংবাদপত্রই একমাত্র মাধ্যম, যাতে দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে ভিন্নভাবে যেকোনো খবরের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়। অনুসন্ধানের মাধ্যমে এক্সক্লুসিভ সংবাদ পরিবেশন করা হয়। আবার সব সংবাদপত্রই যে সংবাদপত্রের মৌলিক কাঠামো, বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র বজায় রেখে নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তি এবং দূরদর্শী চিন্তার মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করে, তা নয়। বিগত এক দশক বা তারও বেশি সময় ধরে বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানকে বিশাল অর্থ বিনিয়োগ করে হাকডাক দিয়ে সংবাদপত্র প্রাকশ করতে দেখা গেছে। এখনও প্রকাশ করার উদ্যোগ নিচ্ছে। এসব পত্রিকা প্রকাশের অন্যতম উদ্দেশ্য থাকে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য ব্যবসা চালানোর ঢাল কিংবা স্বার্থ সংরক্ষণের রক্ষাকবচ হিসেবে। সংবাদপত্রের মৌলিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠার জন্য নয়। পাঠকদের তা ধরতে অসুবিধা হয় না। ফলে দেখা গেছে, কিছুদিন প্রকাশিত হওয়ার পর সেগুলো পাঠক হারিয়ে লোকসানের মুখে পড়ে বন্ধ হয়ে যায়। আবার কোনো কোনো পত্রিকা প্রকাশের আগেই বন্ধ হয়ে যায়। ইনকিলাব প্রতিষ্ঠার ৩৭ বছরে এমন অনেক ঘটনা দেখেছি। এর বিপরীতে কালের পরিক্রমায় স্বমহিমায় ইনকিলাব টিকে আছে এবং থাকবে, ইনশাআল্লাহ। এটা সম্ভব হয়েছে, যে মহৎ লক্ষ্য ও নিঃস্বার্থ উদ্দেশ্য নিয়ে পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এর যে ভিত্তি, তা চিরন্তন। ইনকিলাবের জন্মের সূচনা থেকেই এই চিরন্তন বিষয় অত্যন্ত দক্ষতা ও দূরদর্শিতা দিয়ে এগিয়ে নিচ্ছেন তাঁর সম্পাদক-প্রকাশক এ এম এম বাহাউদ্দীন। ইনকিলাব টিকে থাকার একক ও একমাত্র কৃতিত্ব তাঁরই। আমার মনে আছে, প্রায় ২০ বছর আগে ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা ও স্বপ্নদ্রষ্টা আলহাজ মাওলানা এম. এ. মান্নান প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এক অনুষ্ঠানে দোয়া করে বলেছিলেন, ইনকিলাব কেয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে। আমরাও এই দোয়া করি, ইনকিলাব যুগের পর যুগ অতিক্রম করে কেয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকুক।

[email protected]



 

Show all comments
  • বাবর ১০ জুন, ২০২২, ২:১২ এএম says : 0
    আমার প্রিয় পত্রিকা ইনকিলাব। বরাবর এ পত্রিকা সত্য খবর প্রকাশ করে। আমরা চাই ভবিষ্যতেও যাতে এ পত্রিকা জনগণের কথা বলে।
    Total Reply(0) Reply
  • আফ্রিদি ১০ জুন, ২০২২, ২:১৫ এএম says : 0
    ইনকিলাব এমন এক সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যখন আমাদের দেশের গণতন্ত্র এবং মানুষের অধিকার বিপন্ন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। আশা করি ভবিষ্যতেও এ পত্রিকা সবার পছন্দের তালিকায় থাকবে
    Total Reply(0) Reply
  • সালমান ১০ জুন, ২০২২, ২:১৫ এএম says : 0
    ইনকিলাব কেয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে। আমরাও এই দোয়া করি, ইনকিলাব যুগের পর যুগ অতিক্রম করে কেয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকুক।
    Total Reply(0) Reply
  • সালমান ১০ জুন, ২০২২, ২:২০ এএম says : 0
    সে সময়ে ইনকিলাব হাউস প্রতিষ্ঠিত না হলে, এ দেশের সংবাদ মাধ্যম অসম্পূর্ণই থেকে যেত। আজ সংবাদপত্রের যে বিস্তৃতি, ইনকিলাব তার অন্যতম পুরধা।
    Total Reply(0) Reply
  • সালমান ১০ জুন, ২০২২, ২:২২ এএম says : 0
    ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দিন। তিনি শুধু ইনকিলাবের সম্পাদকই নন, এতে কর্মরত সাংবাদিক-কর্মচারিদের অভিভাবকের দায়িত্বও পালন করেন। ইনকিলাবকে একটি পরিবারে পরিণত করে এর সদস্যদের কার, কি সমস্যা, মায়া-মমতা দিয়ে তার খোঁজ-খবর নেন, পাশে দাঁড়ান।
    Total Reply(0) Reply
  • আলিফ ১০ জুন, ২০২২, ২:২৩ এএম says : 0
    মানবজীবনের এমন কোনো ইচ্ছা-আকাক্ষা নেই, যা ইনকিলাব তুলে ধরছে না। অন্যান্য পত্রিকা থেকে ইনকিলাবের পার্থক্য এখানেই। ইনকিলাব আজ যা ভাবে, অন্যরা তা আগামীকাল ভাবে।
    Total Reply(0) Reply
  • আলিফ ১০ জুন, ২০২২, ২:২৪ এএম says : 0
    ইনকিলাব প্রতিষ্ঠা করেন মরহুম মাওলান মো. আবদুল মান্নান সাহেব। দোয়া করি মহান আল্লাহ যেন উনাকে জান্নাতের মেহমান বানিয়ে নেন।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইনকিলাব

২৭ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন