পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
করোনা মহামারির মধ্যে দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের ১৩ টি জেলায় বন্যা পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি হচ্ছে। এ যেন ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা।’ বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ দিশাহারা হয়ে পড়েছে। বন্যা শুধু তাদের বাড়ি-ঘর, ফসলি জমি, গবাদিপশু ভাসিয়ে নিচ্ছে না, তীব্র ভাঙনে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে বন্যা হওয়ার মতো বৃষ্টি না হলেও ভারতের বন্যা এবং সব বাঁধ-ব্যারেজ খুলে দেয়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে চলেছে। আসাম, সিকিম, বিহার, মেঘালয়, অরুণাচলসহ অন্যান্য অঞ্চলের বন্যার পানি বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছর নদীভাঙন ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। কুড়িগ্রাম থেকে শুরু করে গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ি, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, চাঁদপুর পর্যন্ত নদ-নদীর ভাঙন ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। এসব নদীবিধৌত এলাকার মানুষের বসতবাড়ি, জমিজমা, হাট-বাজার, মসজিদ, স্কুল-মাদরাসা, ক্লিনিকসহ সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ভাঙনে নদীগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকে শেষ সম্বল গবাদিপশু, হাস-মুরগী হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, থাকার জায়গা, চিকিৎসা সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। গবাদিপশুর খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর মতো তেমন কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। স্থানীয় প্রশাসন নামকাওয়াস্তে কিছু সহায়তা দিলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ব্যাপক কোনো পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
দেশে প্রতিবছরই বন্যা ও ভাঙন দেখা দিচ্ছে। বিগত বছরগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে এমন কোনো বছর নেই, যে বছর কম-বেশি বন্যা দেখা দেয়নি। এ বছরও দীর্ঘ বন্যার কবলে পড়েছে দেশ। গত বছর বন্যা ও নদীভাঙনে ঘর-বাড়ি, ফসলি জমি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ শত শত স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হতে দেখা গেছে। বছর ঘুরে আবারও একই অঞ্চলে বন্যা ও ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত বছর নিঃস্ব হওয়া এসব অঞ্চলের মানুষ ঘুরে না দাঁড়াতেই পুনরায় বন্যা-ভাঙনের শিকার হয়েছে। ফলে অসংখ্য মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবার বাড়ি-ঘর হারিয়ে দরিদ্র হয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবে বন্যাকবলিত এলাকায় প্রতিবছর গড়ে চার-পাঁচ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে সম্পদের কত ক্ষতি হয় তার হিসাব পাওয়া যায় না। সরকারের পক্ষ থেকেও ক্ষতির কোনো হিসাব দেয়া হয় না। বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা চেপে যায়। তবে এটা অনুমান করতে কষ্ট হয় না, বন্যায় শত শত কোটি টাকার ক্ষতি হয় এবং হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের এ ক্ষতি পোষানোর কোনো ব্যবস্থা থাকে না। সরকারের পক্ষ থেকেও তাদের স্থায়ী সহায়তা দেয়া হয় না। কেবল বন্যার সময় সাময়িকভাবে কিছু ত্রাণ দেয়া ছাড়া ভাঙনে বাড়িঘর হারানোদের পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা নেয়ার কথাও শোনা যায় না। বন্যা ও ভাঙনের সবচেয়ে বড় ক্ষতির দিক হচ্ছে, আভ্যন্তরীণ ভৌগলিক চিত্র বদলে যাওয়া। ফসলি জমি এবং বাড়ি-ঘর বিলীন হয়ে যাওয়ার পর তা আর ফিরে পাওয়া যায় না। নদ-নদীর ভাঙন রোধে প্রতিবছর সরকারের পক্ষ থেকে বাঁধ ও ড্রেজিংসহ অন্যান্য ব্যবস্থাপনা বাবদ হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, বাঁধ ও ড্রেজিং করা হয় ঠিকই, তবে তার সুফল পাওয়া যায় না। বন্যা ও ভাঙন ঠেকানো তো যায়ই না, উল্টো ফি বছর তা বৃদ্ধি পায়। প্রশ্ন উঠে, বাঁধ ও ড্রেজিংয়ের নামে বরাদ্দকৃত হাজার হাজার কোটি টাকা তাহলে কোথায় যায়? বাঁধ নির্মিত হচ্ছে ঠিকই; কিন্তু তা ভাঙন ঠেকাতে পারছে না কেন? এসব প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতির বিষয়টি জড়িয়ে আছে। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বহু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তাতে কোনো প্রতিকার হয়নি। নানা অজুহাত দেখিয়ে সংশ্লিষ্টরা পার পেয়ে গেছে। বিগত বছরগুলোতে বন্যা ও ভাঙনপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত হলেও তা রক্ষায় কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। ফলে এসব এলাকা প্রতিবছরই ভাঙনের শিকার হয়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সরকারের উচিৎ মেগা প্রকল্পের মতো গুরুত্ব দিয়ে বন্যা ও ভাঙনপ্রবণ এলাকার দিকে দৃষ্টি দেয়া। এসব অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ও ফসলি জমি রক্ষায় এগিয়ে আসা। প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট এবং লাখ লাখ মানুষের নিঃস্ব হওয়া অর্থনীতিতে যে ক্ষত সৃষ্টি করছে, তা থেকে পরিত্রাণে সরকারকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
বন্যা ও ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষের মধ্যে এখন হাহাকার চলছে। একদিকে করোনা তাদের জীবন স্থবির করে দিয়ে দরিদ্র করে দিয়েছে, অন্যদিকে বন্যা ও ভাঙনে সহায়-সম্বল হারিয়ে দরিদ্রসীমার নিচে চলে গেছে। অসংখ্য মানুষ ভূমি ও জীবিকাহীন হয়ে পড়েছে। বন্যা কবলিত এলাকায় এখন পর্যন্ত ত্রাণের ব্যাপক কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। গবাদিপশুর খাদ্য ক্রয়ের জন্য মাত্র ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। মানুষের খাদ্য, ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের উদ্যোগ নেই বললেই চলে। জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ কার্যক্রম চালানোর মতো অর্থ ও ত্রাণ দেয়ার সক্ষমতা দেখাতে পারছে না। সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে বন্যার্তদের মধ্যে যে মানবিক বিপর্যয় দেখা দেবে তা রোধ করা যাবে না। তাই অবিলম্বে সরকারকে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের টিকিয়ে রাখার জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করতে হবে। বন্যা পরবর্তী জীবিকা নির্বাহ ও পুনর্বাসনের পরিকল্পনা নিতে হবে। ক্ষতিগ্রস্তরা যাতে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, এ জন্য খাদ্যসহায়তাসহ নগদ আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে। বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা, সামাজিক সংগঠনসহ বিত্তবানদেরও বন্যার্তদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।