Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তালেবান কি বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে?

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ২৭ আগস্ট, ২০২১, ১২:০৪ এএম

একটি দেশ কিভাবে পরিচালিত হবে তা সে দেশের জনগণের মতামত ও সমর্থনের ওপর নির্ভর করে। ক্ষমতায় কে থাকবে, কে বসবে তা তারাই নির্ধারণ করে। বিশ্বের প্রতিটি সরকারই কম-বেশি দেশের জনগণের সমর্থন নিয়ে পরিচালিত হয়। এই পরিচালনার ধরনের মধ্যে রয়েছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, কর্তৃত্বতন্ত্র মৌলবাদীতন্ত্র ইত্যাদি। যে দেশের জনগণ যে তন্ত্র সমর্থন করে সাধারণত সে তন্ত্র অনুযায়ী সরকার পরিচালিত হয়। চীন, রাশিয়া, কিউবা, উত্তর কোরিয়াসহ আরও দেশ সমাজতন্ত্রকে ধারণ করে পরিচালিত হচ্ছে। সউদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রাজতন্ত্র প্রচলিত। পশ্চিমা দেশগুলোর বেশিরভাগ গণতন্ত্রকে ধারণ করেছে। তবে সব দেশে যে শতভাগ জনগণের মতামত নিয়ে সরকার পরিচালিত হয়, এমন নয়। অনেক দেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামত উপেক্ষা করে পরিচালিত হয়। তারপরও সেসব দেশে সরকার টিকে থাকে। এর কারণ, সরকারের চন্ডনীতি, প্রশাসনিক দমন-পীড়ন ও বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোর সমর্থন এক্ষেত্রে নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো যেভাবে জনগণের সমর্থন নিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হয়, তৃতীয় বিশ্ব বা অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গণতন্ত্র সেভাবে পরিচালিত হয় না। ক্ষমতাধর দেশগুলো এসব দেশের অর্থনৈতিক দুর্বলতাকে পুঁজি করে তাদের দেশের মতো নয়, তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী আরোপিত ও খন্ডিত তন্ত্র দিয়ে দেশগুলো পরিচালনার তত্ত্ব দিয়ে থাকে। কারণ, তাদের দেশের মতো পূর্ণ গণতন্ত্রের মাধ্যমে পরিচালিত হলে তাদের খবরদারি ও আধিপত্য বলে কিছু থাকে না। তারা মুখে মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও বাস্তবে তা মেনে নিতে চায় না। এ সুযোগটি গ্রহণ করে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকার। তারা নিজ জনগণের সমর্থন নয়, ক্ষমতাধর দেশগুলোর সমর্থনের ওপর অধিক নির্ভর করে সরকার পরিচালনা করে। তবে একটা সময় যখন জনগণ আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটায়, তখন ক্ষমতাধর দেশগুলো তাদের মদদপুষ্ট সরকারের উপর থেকে ছাতা সরিয়ে নেয়।

দুই.
আফগানিস্তানে তালেবানের আগমন ঘটেছে। এক্ষেত্রে বলা যায়, তাদের প্রতি দেশটির জনগণের সমর্থন ছিল এবং আছে। তা নাহলে, বিনা বাধায় তালেবানের পক্ষে আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণে নেয়া সম্ভব হতো না। ব্যাপক সংঘর্ষ ও রক্তপাতের সূচনা হতো। এখন আফগানিস্তানে তালেবান শাসন কায়েম হওয়া নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বগুলো নানা কথা বলছে। আফগানিস্তানে আবার মৌলবাদের সূচনা হবে। দেশটি উগ্র জঙ্গী গোষ্ঠীর চারণভূমি হবে। জনগণের মৌলিক অধিকার বলে কিছু থাকবে না। এমন নানা ধরনের নেতিবাচক কথা প্রচার করছে। তাদের এসব কথা শুনে মনে হচ্ছে, দেশটিতে যেন জনগণ নেই। থাকলেও তারা কি চাচ্ছে, তা বিবেচনায় নিতে চাচ্ছে না। যেন তারাই ঠিক করে দিতে চাচ্ছে, দেশটি কিভাবে পরিচালিত হবে। পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়াগুলো দেশটির এ চিত্রই বেশি করে প্রচার করছে যে, দেশটি থেকে হাজার হাজার মানুষ চলে যাওয়ার জন্য এয়ারপোর্টে ভিড় করছে এবং বিমানে চড়ার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে। এ চিত্র বারবার প্রকাশের মধ্য দিয়ে তারা প্রমাণ করতে চাচ্ছে, আফগানিস্তানে তালেবান ফিরে আসায় দেশটি একেবারে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যাচ্ছে বা যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে বিমানবন্দরে এত মানুষের ভিড় এরা দেশটির জনসংখ্যার কত শতাংশ? তারা কেন দেশ ছেড়ে যেতে চাইছে? এসব প্রশ্নের উত্তর সহজ। যেসব আফগান দেশ ছেড়ে যেতে চাইছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রকে গত ২০ বছর ধরে নিজ দেশে দখলদারিত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখতে সহায়তা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের তল্পিবাহক সরকারকে সমর্থন দিয়েছে। কোলাবরেটরের ভূমিকা পালন করে সুবিধা নিয়েছে। বিদেশী আগ্রাসী শক্তিকে নিজ দেশে আস্তানা গাড়তে সহযোগিতা করেছে। স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের বিদায় নেয়ার সাথে সাথে তারা নিজ দেশে পরবাসী হয়ে পড়েছে। নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে বিদেশ যাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে পড়েছে। অথচ তালেবান আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণে নিয়েই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে। তারপরও তারা দেশ ছেড়ে যেতে চাইছে। এর কারণ হচ্ছে, এসব আফগান জানে, তারা নিজ দেশে আগ্রাসী শক্তিকে জায়গা করে দিয়ে দখলদারিত্বের রাজত্ব কায়েম করতে সহায়তা ও সুযোগ দিয়েছিল। তাদের দেশ ছেড়ে যাওয়া দেখে এখন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন, ‘দৌজ হু উড গিভ আপ এসেনসিয়াল লিবার্টি টু পারচেজ আ লিটল টেম্পোরারি সেফটি, ডিজার্ভ নাইদার লিবার্টি নর সেফটি।’ সাময়িক সুবিধা ও নিরাপত্তার জন্য যারা স্বাধীনতা বিকিয়ে দেয়, তারা স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার যোগ্য নয়। দেশ ছেড়ে যাওয়া বা যেতে চাওয়া এই আফগানরা কি তাদের সাময়িক সুবিধার জন্য নিজ দেশের স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়ে আগ্রাসী শক্তিকে দখল করতে সহায়তা করেনি? এটা কি তাদের দেশপ্রেমের পরিচয় ছিল? তারা যদি মনে করে থাকে, নাইন ইলেভেনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক অভিযুক্ত আল কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে তৎকালীন তালেবান সরকার আশ্রয় দিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে গায়ের জোরে তৎকালীন সরকার উৎখাত করে আফগানিস্তান দখল করে, সেক্ষেত্রে তাদের কি যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করা উচিৎ ছিল? যেকোনো দেশের সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের নানা অভিযোগ থাকতেই পারে। তার মানে এই নয়, আগ্রাসী শক্তির কাছে দেশের স্বাধীনতা তুলে দিতে হবে।

বিশ্বে এমন কথা প্রচলিত, যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু তার শত্রুর প্রয়োজন নেই। বন্ধু সেজে বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে সরকার হটিয়ে কিংবা একনায়কদের সহযোগিতা করে যুক্তরাষ্ট্র সেসব দেশকে কিভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে, তার নজির ইতিহাসে রয়েছে। লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার কিছু অংশে স্বৈরশাসকদের ক্ষমতায় বসিয়েছিল এই যুক্তরাষ্ট্র। আশির দশকে রোনাল্ড রিগ্যানের আমলে প্রক্সি যুদ্ধের মাধ্যমে মধ্য আমেরিকাকে ছারখার করে দিয়েছিল। ১৯৭৯ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশনীতির নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছিল। আফগান যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ৪২ বছর আগে। ১৯৭৯ সালে জিমি কার্টার প্রশাসন সেখানকার সোভিয়েত মদদপুষ্ট সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ইসলামি জিহাদিদের ফাঁদে ফেলে গোপনে সমর্থন দিয়েছিল, তার স্বার্থে। ফলে এক দীর্ঘ সংঘাত ও রক্তপাতের পথে ঢুকে পড়ে আফগানিস্তান। কথিত গণবিধ্বংসী অস্ত্রের মজুতের অজুহাত দেখিয়ে ইরাকে হামলা চালিয়ে দেশটিকে ধ্বংস করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্র তার সাম্রাজ্যবাদী নীতি দিয়ে একের পর এক দেশ ধ্বংস ও অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। অনেক সমৃদ্ধ দেশকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। সন্ত্রাস দমনের নামে গত ২০ বছর ধরে আফগানিস্তান দখলে রেখে দেশটির শান্তি, শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে দিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রে দুই ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করেছে। আড়াই হাজারের বেশি সৈন্য খুইয়েছে। তার পরিণতি শোচনীয় পরাজয়। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফরি ডি স্যাক্স সম্প্রতি এক নিবন্ধে অফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় নিয়ে একটি হিসাব উল্লেখ করেছেন। হিসাবে উল্লেখ করা হয়, আফগানিস্তান পুনর্গঠনে ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ৯৪৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এক ট্রিলিয়ন ডলারের এই বিনিয়োগ কেবল গুটিকয়েকের মন-প্রাণ জয় করে নিতে পেরেছে। ৯৪৬ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৮১৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে মার্কিন সেনাদের জন্য, যা মোট বিনিয়োগের ৮৬ শতাংশ। আফগানিস্তানের জন্য ১৩০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে, যার ৮৩ বিলিয়ন ডলারই গেছে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর পেছনে। ১০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে মাদক নির্ম‚ল অভিযানে। ১৫ বিলিয়ন খরচ করা হয়েছে আফগানিস্তানে নিযুক্ত বিভিন্ন মার্কিন সংস্থার পেছনে। মোট বিনিয়োগের ২ শতাংশেরও কম আফগানিস্তানের জন্য ব্যয় হয়েছে। জেফরি ডি স্যাক্স মন্তব্য করেন, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া ও পূর্ববর্তী যুদ্ধগুলোয় লাখো কোটি ডলার ব্যয় করে কিছুই দেখাতে পারেনি আমেরিকা। শুধু বালুতে রক্তের দাগটাই তারা রেখে যেতে পেরেছে।

তিন.
আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়কে তার ভিয়েতনাম থেকে পালিয়ে আসার চেয়েও খারাপ বলে অভিহিত করা হচ্ছে। যদিও জো বাইডেন বলেছেন, যে দেশের সরকার নিজেই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নামে না, সেখানে তাদের কিছু করার ছিল না। তার এ মন্তব্য থেকেই পরাজয়ের বিষয়টি ফুটে উঠেছে। এটাও বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে যে, জনগণের সমর্থন যদি না পাওয়া যায়, তবে দখলদার বাহিনী যতই শক্তিশালী হোক না কেন তারা টিকে থাকতে পারে না। জোরজবরদস্তি করে কিছু সময় টিকে থাকা গেলেও চিরস্থায়ীভাবে টিকে থাকা সম্ভব নয়। আফগানিস্তানের মার্কিন সমর্থিত সরকার জনগণের সমর্থন পায়নি বলেই তাকে বিদায় নিতে হয়েছে। অন্যদিকে, তালেবান যেভাবে বিনা বাধায় দেশ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে তাতে জনগণের সমর্থন না থাকলে তা সম্ভব হতো না। জনসমর্থন নিয়ে তালেবানের এই ফিরে আসা পশ্চিমা দেশগুলো সহ্য করতে পারছে না। তারা নানাভাবে তালেবানের উগ্র মৌলবাদী এবং আফগানিস্তানে আবার মৌলবাদের উত্থান হবে বলে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে যে এসব অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। আবার তাদের এই জ্বালার বিপরীতে তালেবানকে সমর্থন দেয়ার জন্য আরও অনেক প্রভাবশালী দেশ দাঁড়িয়ে গেছে। চীন তো সবার আগে তালেবানকে সর্থন দিয়ে তার সাথে কাজ করার ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে। রাশিয়া, তুরস্ক, পাকিস্তান, ইরানসহ অন্যান্য দেশ ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। কিভাবে আফগানিস্তান পুনর্গঠনে সহায়তা করা যায়, এ নিয়ে পরিকল্পনা করছে। বাস্তবতা হচ্ছে, আফগানিস্তানের ভৌগলিক অবস্থান এমনই যে দেশটি মধ্য এশিয়া থেকে দক্ষিণ এশিয়াসহ অন্যান্য দেশের প্রবেশদ্বার হয়ে রয়েছে। ফলে দেশটিকে কারো পক্ষেই উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, এখন তালেবান কিভাবে আফগানিস্তানের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করবে? তারা কি ২০ বছর আগের ধ্যান-ধারণা নিয়ে নাকি পরিবর্তিত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে পরিচালনা করবে? বিশেষ করে নারী অধিকার, গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়ে তাদের রক্ষণশীলতার কারণে এসব প্রশ্ন উঠেছে। তবে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণার পর আমরা যদি বিগত কয়েক মাসে তালেবান মুখপাত্রদের কথা শুনি, তাহলে দেখব তাদের কথাবার্তায় যথেষ্ট পরিবর্তনের আভাস রয়েছে। আধুনিক ও পরিবর্তিত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলা এবং সব দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে তাদের আগ্রহের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। কাতারের রাজধানী দোহায় তালেবানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের মুখপাত্র ড. মুহাম্মদ নাইম ওয়ারদাক সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমাদের লক্ষ্য হলো, আফগানিস্তানের পরিস্থিতিকে আমরা স্থিতিশীল ও উন্নত করা। আফগান জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে এগিয়ে যেতে চাই। আফগান জাতি হিসেবে আমরা একটি স্বাধীন ইসলামি নেতৃত্বের ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ হতে চাই। তিনি বলেন, মূলনীতি বা আদর্শের কখনো পরিবর্তন হয় না। তবে অভিজ্ঞতার আলোকে সময়ের সঙ্গে চলার ছন্দে পরিবর্তন আসতে পারে। এটি জীবন ও প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। তাই স্থান-কালের পরিবর্তনে এবং যুগের চাহিদার প্রেক্ষাপটে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলার নিয়মে কিছু পরিবর্তন হতেই পারে। তিনি এ কথাও বলেছেন, আফগান সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও ঐহিহ্যগুলো এমনই যে সেগুলো ইসলামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমরা কারও এমন কোনো অধিকার হরণ করতে চাই না, যা ইসলাম তাদের দিয়েছে এবং যা আফগানিস্তানের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিরোধী নয়। আফগানিস্তানের ভূমি ব্যবহার করে অন্য কোনো দেশের নিরাপত্তা বা স্থিতিশীলতা নষ্ট করার মতো কোনো কার্যকলাপ আমরা হতে দেব না বলেও তিনি উল্লেখ করেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি বলেছেন, সব প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আমরা সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাই। এটা কেবল আঞ্চলিক পর্যায়ে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও। আঞ্চলিক পর্যায়ে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের যোগাযোগ এবং সম্পর্ক উন্নয়নে আমরা মিলনকেন্দ্র হতে চাই। ড. ওয়ারদাক এবং ইতোমধ্যে তালেবানের অন্যান্য মুখপাত্র যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে এটা স্পষ্ট, তালেবান তার দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইসলামী মূল্যবোধ বজায় রেখে এবং যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আফগানিস্তানকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য ইসলামী দেশগুলো যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তারাও সেভাবে দেশ পরিচালনা করবে। আফগানিস্তানকে বিশৃঙ্খলা থেকে রক্ষা করার জন্য ইতোমধ্যে তালেবান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে। এতে সংখ্যাগরিষ্ঠ আফগান ঐক্যবদ্ধ হয়ে তালেবান শাসনকে মেনে নিয়েছে। তালেবানের উচিৎ হবে মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য ইসলামিক দেশগুলো যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে, ইসলামিক বিধিবিধানের মধ্যে থেকে সেভাবে দেশ পরিচালনা করা।

চার.
তালেবান সরকার গঠিত হওয়ার পর তার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে আফগানিস্তান পুনর্গঠন। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করতে সরকারকে ব্যাপক কাজ করতে হবে। আপাত দৃষ্টিতে অর্থনৈতিকভাবে আফগানিস্তান পর্যুদস্ত অবস্থায় থাকলেও সরকার গঠিত হওয়ার পর এ অবস্থা থাকবে না বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। কারণ, আফগানিস্তানে ৩ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি খনিজ সম্পদ রয়েছে। এসব খনিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে, কোবাল্ট, লিথিয়াম ও রেয়ার আর্থ ম্যাটেরিয়াল। এসব সম্পদের কারণে পেন্টাগনের এক প্রতিবেদনে আফগানিস্তানকে বলা হয়েছে, লিথিয়ামের ‘সউদী আরব’। এসব খনিজ এতটাই মূল্যবান যে এর উপর যার নিয়ন্ত্রণ থাকবে, আগামী দিনে ভূরাজনীতির কেন্দ্রে তারাই থাকবে। কারণ, নিকট ভবিষ্যতে এসব খনিজ তেল, সোনা বা রূপার চেয়েও মূল্যবান হিসেবে বিবেচিত হবে। জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত বিপর্যয় এড়াতে বিশ্বে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে শুদ্ধ জ্বালানির দিকে সরে আসার যে পরিকল্পনা তার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদ। আগামী দিনে বিশ্বের অনেক দেশ তেলচালিত গাড়ি থেকে সরে ব্যাটারিচালিত গাড়ির দিকে ঝুঁকবে। ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, থেকে শুরু করে অফ-গ্রিড জ্বালানিখাতে ব্যবহৃত ব্যাটারির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান লিথিয়াম। আফগানিস্তানে রয়েছে, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম লিথিয়ামের মজুত। এসব অতি মূল্যবান খনিজ সম্পদের যথাযথ উত্তলন এবং ব্যবহার করতে পারলে আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্র বদলে যাবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, আফগানিস্তানের সাথে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সীমা থাকায় এটি বৃহৎ একটি বাণিজ্যিক বন্দর বা ট্রানজিটের দেশে পরিণত হয়েছে। তালেবান সরকার এর মাধ্যমে ব্যাপক ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসার করতে পারবে। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র যে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে অবকাঠামো নির্মাণ করেছে তাও দেশটির অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তালেবান সরকারের উচিৎ, সরকার গঠনের পর বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এবং প্রতিবেশী ও আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক সৃষ্টির মাধ্যমে নিজ দেশকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে মনোযোগ দেয়া।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: তালেবান

১০ ডিসেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন