Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাইডেনের সঠিক সিদ্ধান্ত, তালেবানের দায়িত্ব

| প্রকাশের সময় : ১৮ আগস্ট, ২০২১, ১২:০২ এএম

অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে এবং কোনো ধরনের সহিংসতা ছাড়া আফগানিস্তান দখল করে নিয়েছে তালেবান। এ এক বিস্ময় জাগানিয়া ঘটনা। যেখানে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ও প্রশিক্ষিত আফগান সামরিক বাহিনীর প্রায় তিন লাখের বেশি সৈন্য রয়েছে, সেখানে মাত্র ৭৫ হাজারের মতো সদস্য নিয়ে তালেবান বিনা যুদ্ধে আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। বিশ্বের তাবৎ শক্তিধর দেশগুলোও তালেবানের এই বিস্ময়কর বিজয় দেখে অবাক হয়েছে। এ নিয়ে বিশ্লেষকরা নানা বিশ্লেষণ করছেন এবং করবেন। তবে যুদ্ধ জয়ের ক্ষেত্রে যে সবসময় অধিক সৈন্য সংখ্যা এবং সমরাস্ত্র প্রয়োজন, তা অনেক সময় কাজে আসে না প্রতিপক্ষের যুদ্ধ কৌশলের কারণে। এক্ষেত্রে কম সদস্য নিয়ে তালেবানের সমর কৌশল, তার যথাযথ প্রয়োগ এবং ডেডিকেশন যে তার সাফল্যের মূল চাবিকাঠি তা সমরবিদরাও স্বীকার করেছেন। স্বল্প সংখ্যক সৈন্য ও অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ জয়ের এমন অনেক নজির বিশ্বে রয়েছে। তবে তালেবানের যুদ্ধ এবং বিজয়ের ক্ষেত্রে প্রধানত দুটি বিষয় নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। প্রথমত নিজ দেশের জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন। কারণ, জনগণের সমর্থন ছাড়া কোনো শক্তির পক্ষেই বিজয় অর্জন সম্ভব নয়। জো বাইডেন নিজেই বলেছেন, মার্কিনরা এমন একটি যুদ্ধে অকাতরে প্রাণ দিতে পারে না, যেখানে আফগানরাই নিজেরাই লড়াইয়ে নামতে ইচ্ছুক নয়। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, তালেবান আফগান জনগণের কাছ থেকে কি পরিমান সমর্থন পেয়েছে! দ্বিতীয়ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে তালেবানের শান্তি চুক্তি এবং পরবর্তীতে আফগানিস্তান থেকে জো বাইডেনের সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা। যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণার মধ্যে নিজের উপলব্ধির বিষয়টিও জড়িয়ে আছে। ২০ বছর আগে নাইন ইলেভেনের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র ন্যাটো বাহিনী তৎকালীন ক্ষমতাসীন তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে আল কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেয়ার অভিযোগে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে যেভাবে আফগানিস্তানে হামলা চালিয়ে তছনছ করে দিয়েছিল, তা ছিল বিরল ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্র তার তল্পিবাহক সরকার প্রতিষ্ঠা করে ২০ বছরে তালেবান নির্মূলে একের পর এক হামলা চালিয়েছে। তালেবানও তা প্রতিরোধ করে এগিয়েছে। এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যেমন বিপুল অর্থ ব্যয় হয়েছে, তেমনি তার অনেক সৈন্যও প্রাণ হারিয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে ২ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। তার সৈন্য নিহত হয়েছে ২ হাজার ৩০০ এবং আহত হয়েছে ২০ হাজারেরও বেশি। লাখ লাখ আফগানও নিহত হয়েছে। দুই দশক ধরে আফগানিস্তান দখলে রেখে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষতি ছাড়া কিছুই অর্জন করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণও এর বিরোধিতা করেছে। ফলে আত্মপোলব্ধি থেকে যুক্তরাষ্ট্র সৈন্য প্রত্যাহার করে একটি ভাল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তালেবান বিনা বাধায় আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বলেছে, আজ আফগান জনগণ এবং মুজাহিদিনদের জন্য একটি মহান দিন। তারা ২০ বছর ধরে তাদের প্রচেষ্টা এবং ত্যাগের ফল দেখেছে। মহান আল্লাহকে ধন্যবাদ, দেশে যুদ্ধ শেষ হয়েছে।

আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারকে যুক্তরাষ্ট্রের শোচনীয় পরাজয় হিসেবে বিশ্লেষকরা অভিহিত করেছেন। অবশ্য সুদূর অতীতকাল থেকে যারাই আফগানিস্তান দখল করেছে, কোনো না কোনো সময় তাদের শোচনীয় পরাজয় নিয়েই বিদায় নিতে হয়েছে। ১৯ শতকে ব্রিটেন এবং ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে দখলদারিত্ব কায়েম করলেও শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেনি। তারও আগে অনেক আধিপত্যবাদী শক্তি আফগান দখল করে টিকতে পারেনি। আফগানিস্তানের ইতিহাসই এমন এখানে কোনো আগ্রাসী শক্তি স্থায়ীত্ব অর্জন করতে পারেনি। ব্যর্থতার গøানি নিয়ে ফিরতে হয়েছে। প্রবল পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র ন্যাটো বাহিনীকেও একইভাবে পরাজিত হয়ে ফিরে যেতে হয়েছে। যদিও জো বাইডেন এর পরিপ্রেক্ষিতে বলেছেন, ‘আমরা কেবল ক্ষমতার উদাহরণ দিয়ে নয়, আমরা উদাহরণের শক্তিতে নেতৃত্ব দেব। আমরা শান্তি, অগ্রগতি এবং নিরাপত্তার জন্য একটি শক্তিশালী এবং বিশ্বস্ত অংশীদার হব।’ তার এ বক্তব্যে আফগানিস্তান থেকে পরাজয়ের ব্যথাতুর হৃদয়ের কথাও ফুটে উঠেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র একটি ক্ষয়িষ্ণু পরাশক্তির দিকে ধাবিত। বিশ্ব রাজনীতিতে যেমন কোনঠাসা হয়ে পড়ছে, তেমনি নিজের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে হিমশিম খাচ্ছে। প্রয়োজনীয় অর্থ সংকটে ভুগছে। এ অবস্থায় তার পক্ষে দখলদারিত্বের মাধ্যমে যুদ্ধ চালিয়ে ট্রিলিয় ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় ও সৈন্য হারানোর মতো সক্ষমতা নেই। এ প্রেক্ষিতে, আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে বাইডেন সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। এ কথাও স্মরণযোগ্য, আফগানিস্তানে দখলদারিত্বে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় লবি যেমন কাজ করেছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনও ত্রæটিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আফগানিস্তান থেকে তার প্রবল প্রতিপক্ষ রাশিয়ার শোচনীয় পরাজয়ের মাধ্যমে বিদায় নেয়ার নজির সামনে থাকা সত্তে¡ও একটি ভুল পদক্ষেপ নিয়েছিল। এখন যুক্তরাষ্ট্রের সম্মান খোয়ানোর পাশাপাশি ভারতও ক্ষতির মুখে পড়েছে। তালেবানের আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতায় আসা নিয়ে ইতোমধ্যে চীন, পাকিস্তান, রাশিয়া ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। চীন বলেছে, সে তালেবানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে প্রস্তুত। পাকিস্তান আফগানিস্তানকে সহযোগিতার কথা বলেছে। রাশিয়াও ইতিবাচক অবস্থানে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রও তালেবানকে স্বীকৃতি দিতে পারে বলে আভাস দিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি বিøঙ্কেন ¯পষ্ট করে বলেছেন, ভবিষ্যৎ আফগান সরকার তার জনগণের মৌলিক অধিকার সমুন্নত রাখলে ও সন্ত্রাসীদের আশ্রয় না দিলে তার সঙ্গে আমরা কাজ করতে পারি এবং সরকারকে স্বীকৃতি দিতে পারি। অর্থাৎ, শর্ত সাপেক্ষে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিতে রাজি বাইডেন প্রশাসন। তালেবানও বিশ্বস্বীকৃতি পেতে কূটনৈতিক কৌশল জোরদার করার পাশাপাশি আফগানিস্তানকে একটি সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করার ঘোষণা দিয়েছে। তালেবান মুখপাত্র মোহাম্মদ নাঈম বলেছেন, আমরা সব দেশ ও সংস্থাকে যেকোনো সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের সঙ্গে বসার আহŸান জানাচ্ছি। তালেবান উপপ্রধান মোল্লা বারাদার আখুন্দ এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, আমাদের জাতিকে আমরা সবচেয়ে ভালো সেবা দেব, গোটা জাতির জন্য প্রশান্তি নিয়ে আসব, তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য যা করা দরকার তাই করব। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী, সমস্যা সমাধান এবং সেবা প্রদান করা হবে। তালেবান মুখপাত্র এ কথাও বলেছেন, নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং শরিয়া আইনের মধ্যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা হবে। পর্যবেক্ষরা মনে করছেন, তালেবান তার কথা মতো কাজ করলে আফগানিস্তান একটি উদার ও আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে। আফগানিস্তানের এমন একটি মুসলমান রাষ্ট্র হওয়া উচিৎ যার মডেল হতে পারে সউদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের মতো। এক্ষেত্রে কোনো জঙ্গী গোষ্ঠীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। অবশ্য তালেবান মুখপাত্র বলেছেন, আফগানিস্তানের মাটি কোনো বাইরের শক্তি বা গোষ্ঠীকে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না।

আফগানিস্তানের ভৌগলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার প্রবেশদ্বার হিসেবে গণ্য করা হয়। ফলে দেশটির শান্তি ও স্থিতিশীলতার ওপর প্রতিবেশী দেশসহ এশিয়ার শান্তি এবং ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ নির্ভর করছে। তালেবানকে এ গুরুত্ব অনুধাবন করে আফগানিস্তানের পুনর্গঠনের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। আশার কথা, তালেবান কাবুল নিয়ন্ত্রণে নেয়ার সময় একটি মানুষকেও হত্যা করেনি এবং বিশৃঙ্খল আচরণও করেনি। যুক্তরাষ্ট্রসহ কোনো দেশের স্থাপনায় হামলা বা আক্রমণ করেনি। বরং তাদের লোকজন সরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে নির্বিঘœ পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এ থেকে প্রতীয়মাণ হয়, তালেবান আফগানিস্তানকে একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করে সুশাসনের মাধ্যমে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিতে চায়। ইতোমধ্যে তারা যে ইতিবাচক ও গ্রহণযোগ্য বক্তব্য এবং ভবিষ্যতনীতি তুলে ধরেছে, তা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে স্বীকৃতি পাচ্ছে। তালেবানকে এ নীতি ও পরিকল্পনা ধরে রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও দেশটিতে অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ অন্যান্য খাতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে। চীনা বিনিয়োগসহ অন্যান্য দেশ বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠছে। আফগানিস্তানে বিপুল খনিজ সম্পদ রয়েছে। বলা হচ্ছে, ৩৭ ট্রিলিয়ন ডলারের খনিজ সম্পদ মজুদ আছে। তালেবানের উচিৎ হবে, আফগানিস্তানকে একটি উদার মুসলিম দেশে পরিণত করার পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগ ও নিজস্ব সম্পদ কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন ও অগ্রগতির দিকে মনোযোগী হওয়া।

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: তালেবান

১০ ডিসেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন