Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তালেবানের প্রতিষ্ঠা : ভূরাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের আভাস

মুনশী আবদুল মাননান | প্রকাশের সময় : ১৮ জুলাই, ২০২১, ১২:০৩ এএম

প্রায় ২০ বছরের যুদ্ধে কোনো রকম ফায়দা ছাড়াই বিশ্বের শীর্ষতম পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তান ত্যাগ করতে হচ্ছে। সৌজন্যের খাতিরে ‘ত্যাগ করতে হচ্ছে’ বলা হলেও আসলে বলা উচিৎ, ‘ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে’। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ত্যাগ তার শোচনীয় পরাজয়েরই নামান্তর। পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় দোহাচুক্তির আড়ালে যুক্তরাষ্ট্র তার চূড়ান্ত সামরিক পরাজয় এড়িয়ে যেতে পারছে মাত্র। একইসঙ্গে সহযোগী ন্যাটোর সৈন্যরাও আফগানিস্তান থেকে সরে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ঘোষণা অনুযায়ী এ বছরের ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই তার দেশের সৈন্যদের আফগানিস্তান ত্যাগ করার কথা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তার আগেই তারা আফগানিস্তান ছেড়ে যাবে। ২ জুলাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাগরাম ঘাঁটি ছেড়ে গেছে মার্কিন বাহিনী। ঘাঁটিটি আফগান সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলা হলেও আসলে আনুষ্ঠানিক হস্তান্তর ছাড়াই মার্কিন বাহিনী বিদ্যুৎ বন্ধ করে রাতের আঁধারে পালিয়ে গেছে। মার্কিন সৈন্যরা আফগানিস্তানে কতটা অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছে, কতটা ভীতি ও আতঙ্কের মধ্যে আছে, এভাবে পালিয়ে যাওয়া থেকেই সেটা অনুমিত হয়।

জাতি হিসাবে আফগানরা যে অপরাজেয়, সেটা আরো একবার প্রমাণিত হলো। ১/১১’র হামলার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে হামলা চালায় ও তালেবান সরকারকে হটিয়ে দখল প্রতিষ্ঠা করে। তখন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকে এই অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন যে, একদা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি এবং কিছুদিন আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তানে যে পরিণতি বরণ করতে হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও সেই একই পরিণতি বরণ করতে হবে। এর আগে ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন বাহিনীকে যেভাবে পালিয়ে আসতে হয়েছিল, অনুরূপভাবে আফগানিস্তান থেকেও পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে হবে।

অনেকেরই জানা, ঊনিশ শতকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির দ্বারা আফগানিস্তান আক্রমণ ও দখলের শিকার হয়েছিল। সে আগ্রসন ও দখল স্থায়ী হয়নি। ১৮২৪ সালে প্রথম ব্রিটিশ-আফগান যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর এতটাই করুণ পরিণতি হয়েছিল যে, আড়াই হাজার সৈন্য এবং ১২ হাজার সাধারণ কর্মচারীর কেউ বেঁচে ফিরতে পারেনি। বেঁচে ছিলেন একমাত্র আগ্রাসী বাহিনীর অ্যাসিসট্যান্ট সার্জন উইলিয়াম ব্রাইডেন। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তিকে আফগানিস্তান থেকে হাত গুটাতে বাধ্য হতে হয়েছিল এক অনিঃশেষ যুদ্ধ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য।

সোভিয়েট ইউনিয়নের তখন প্রবল প্রতাপ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধে সামনে সমান। এইসঙ্গে কমিউনিজম রফতানিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। প্রভাবলয় বিস্তারে শক্তিপ্রয়োগও পিছপা নয়। এমনই এক সুযোগে ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তান দখল প্রতিষ্ঠা করে সোভিয়েট ইউনিয়ন। ১০ বছরের যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত নাকে খত দিয়ে আফগানিস্তান ছাড়তে বাধ্য হতে হয় সোভিয়েট আগ্রাসী বাহিনীকে।

সোভিয়েট বাহিনীর আফগানিস্তানে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে আফগান মুজাহিদদের মুখোমুখি হতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সউদী আরব, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশ মুজাহিদদের সর্বপ্রকার সহায়তা দিতে থাকে। মুজাহিদদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে সোভিয়েট বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং অবশেষে নিশ্চিত পরাজয় জেনে বিনাশর্তে আফগানিস্তান ত্যাগ করে মুখ রক্ষা করে। আফগানিস্তানে এই পরাজয়ের পটভূমিতেই সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙে যায়। পরবর্তী কালে মুজাহিদ গ্রুপগুলোর পরস্পরের মধ্যকার যুদ্ধের এক পর্যায়ে ১৯৯৪ সালে মোল্লা ওমর কান্দাহারের ৫০ জন মাদরাসা ছাত্রকে নিয়ে তালেবান সংগঠন গড়ে তোলেন। ওই সময় পাকিস্তানের আফগান শরণার্থীদের মধ্যকার মাদরাসা ছাত্রদের অন্তত ১৫ হাজার তালেবানে যোগ দেয়। ১৯৯৬ সালে তালেবান আফগানিস্তানের অধিকাংশ এলাকা দখল করে নেয় এবং ‘ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তান’ প্রতিষ্ঠা করে। এই তালেবান সরকারকে হটিয়েই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে তার জবরদখল কায়েম করে।

ইতিহাসের নির্মম পরিহাস এই যে, সেই তালেবানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তির বদৌলতেই মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তান ত্যাগ করতে পারছে। এতদিন তাঁবেদার আফগান সরকারের সুরক্ষায় নিয়োজিত থাকলেও সেই সরকারকে পথে ফেলেই যুক্তরাষ্ট্র ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ নীতি অনুসরণ করছে। বোধহয় একেই বলে, ‘বড়র পীরিতি বালির বাঁধ’। ভিয়েতনামেও ঠিক এ রকমই করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। অবশাম্ভাবী পরাজয় এড়াতে মার্কিন বাহিনীকে দেশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন সরকার। মিত্রদের ভবিষতের তোয়াক্কা না করেই একতরফাভাবে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ও তা বাস্তবায়ন করা হয়। পরবর্তীতে ভিয়েতনামের গৃহযুদ্ধে অন্তত ৮০ হাজার সামরিক-বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। সম্পদের ক্ষতি হয় বেশুমার। অতঃপর আফগানিস্তদের পরিস্থিতি কী হয়, তা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কমতি নেই।

আফগান সরকারি বাহিনীর সঙ্গে তালেবানের তুমুল-লড়াই চলছে। ইতোমধ্যে অন্তত ৮৫ শতাংশ এলাকায় তালেবানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআই’র মতে, ৬ মাসের মধ্যে কাবুল সরকারের পতন ঘটবে। অনেকটা বিনাযুদ্ধেই জেলার পর জেলা তালেবানের নিয়ন্ত্রণে আসছে। শত শত আফগান সেনা সপক্ষ ত্যাগ করে তালেবানের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে। ওদিকে হাজার খানেক তাজিক-আফগান সৈন্য তাজিকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আফগান বাহিনীর এই অবস্থা বিশ্ববাসীকে বিস্মিত করেছে। আফগান সরকারের সঙ্গে তালেবানের ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে কোনো সমঝোতা বা চুক্তি না থাকায়, আফগান সরকারের পরাজয় বা পতনের মধ্য দিয়েই এ পর্যায়ের যুদ্ধের অবসান হতে পারে তালেবানের বিজয় সময়ের ব্যাপার মাত্র।

ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধে একেবারে খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে। সামরিক আগ্রাসন ও রাষ্ট্রদখলের পরিণতি শেষ পর্যন্ত বুমেরাং হয়ে দেখা দেয়। সোভিয়েট ইউনিয়ন তো আফগানিস্তান দখলের খোসারত দিয়েছে ভেঙেচুরে ছত্রখান হয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের হয়তো এই রকম কোনো মূল্য দিতে হবে না। তবে এই যুদ্ধে তার ক্ষতি কিন্তু মোটেই কম হয়নি। যুদ্ধে তাকে ২ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়েছে। সৈন্য হারাতে হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার। এছাড়া অন্তত ২০ হাজার সামরিক-বেসামরিক মানুষ আহত হয়েছে। তবে তুলনামূলকভাবে সৈন্য ক্ষয় কম হয়েছে। কম হওয়ার কারণ ২০১৫ সালে সম্মুখযুদ্ধ বন্ধ ঘোষণা করা। অথচ এ সময় কমপক্ষে ২৮ হাজার আফগান সেনা-পুলিশ নিহত হয়েছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে ৫৮ হাজারেরও বেশি মার্কিন সৈন্য নিহত হয়েছিল। এ অভিজ্ঞতা আফগান যুদ্ধে মাকির্নীদের সতর্ক করে থাকতে পারে। আফগান যুদ্ধে যেমন তেমনি ইরাক যুদ্ধেও বিপুল অর্থক্ষয় ও লোকক্ষয় করে যুক্তরাষ্ট্রের তেমন কোনো লাভ হয়নি। সামরিক আগ্রাসন ও রাষ্ট্রদখল যে একালে মোটেই লাভজনক নয়, সেটা আফগানিস্তান ও ইরাক দখল করে যুক্তরাষ্ট্র হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে।

তালেবানের দখল প্রতিষ্ঠিত হলে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি কেমন হবে, তা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে। তালেবানের মধ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠী রয়েছে। ক্ষমতা নিয়ে তাদের মধ্যে দ্ব›দ্ব ও লড়াই হওয়ার আশঙ্কা অনেকেই উড়িয়ে দিচ্ছেন না। তবে এ কথা তালেবানের নিশ্চয় স্মরণ আছে, আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েট ইউনিয়নের বিদায়ের পর মুজাহিদের মধ্যকার গৃহযুদ্ধে বিপুল প্রাণ ও শক্তিক্ষয় হয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটেই মার্কিন আগ্রাসন ঘটেছিল। অন্যান্য দেশের ইতিহাসও এমন নজির কম নেই। নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিরোধ বাড়িয়ে আখেরে লাভ হয় না। ক্ষতি হয় দেশের ও দেশের মানুষের।

তালেবানের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশসমূহের সম্পর্ক কেমন হবে, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। আফগানিস্তানের সঙ্গে ৫টি দেশের সীমান্ত রয়েছে। পূর্ব ও দক্ষিণে পাকিস্তান, পশ্চিমে ইরান, উত্তরে তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান ও চীন। চীনের সঙ্গে সীমান্ত বড় না হলেও যতোটুকু আছে তা ভূকৌশল গত দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তালেবান-মার্কিন চুক্তির মধ্যস্থতাকারী হিসাবে পাকিস্তানের সঙ্গে তালেবানের সম্পর্ক যে সবচেয়ে গভীর, সেটা সহজেই আন্দাজ করা যায়। ইরান, তুর্কমেনিস্তান ও তাজিকিস্তানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রয়েছে তালেবানের। চীনের সঙ্গেও সুসস্পর্ক রয়েছে। সম্প্রতি চীনকে বন্ধুরাষ্ট্র হিসাবে উল্লেখ করেছে তালেবান কর্তৃপক্ষ। তালেবান মুখপাত্র সুহাইল শাহীন চীনের ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’ পত্রিকাকে বলেছেন: আমরা চীন বিনিয়োগকে স্বাগত জানাই। যদি তারা আফগানিস্তানে বিনিয়োগ করে, অবশ্যই আমরা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করব। তিনি আরো বলেছেন: আমরা বহুবার চীনে গিয়েছি এবং তাদের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক আছে। চীন আমাদের বন্ধুদেশ। আফগানিস্তানের উন্নয়ন ও পুনর্গঠনে আমরা তাদের স্বাগত জানাই।

রাশিয়ার সঙ্গে তালেবানের সম্পর্ক খারাপ নয়। ‘ইসলামিক স্টেট অব খোরাসান’ নামের একটি সশন্ত্র সংগঠনকে আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারে বাধা দেয়ার জন্য ২০১৫ সালে রাশিয়া ও ইরান তালেবানকে সহায়তা দিতে শুরু করে। এভাবে এ দু’দেশের সঙ্গে তালেবানের সম্পর্ক উত্তরোত্তর ঘনিষ্ঠ হয়। ফলে তালেবান সরকার গঠিত হলে প্রতিবেশী এসব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরো গভীর ও সম্প্রসারিত হবে বলে ধারণা করা যায়। অন্যান্য দেশও তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে এগিয়ে আসবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ব্রিটেন তালেবান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে তার আগ্রহের কথা ব্যক্ত করেছে। এমনকি ভারতও তালেবানের সঙ্গে সস্পর্ক স্থাপনে তৎপর রয়েছে বেশ আগে থেকেই।

অতীতে তালেবানের সাথে ভারতের সম্পর্ক খুব একটি ভালো না থাকায় সঙ্গতকারণেই কাবুল সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর ও স্থায়ী করার জন্য ভারত বরাবরই তৎপরতা দেখিয়ে এসেছে। এখন পর্যন্ত এটা অব্যাহত আছে। তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আফগান সরকারকে অস্ত্রসহ সামরিক সহায়তা অতি সম্প্রতিও দিয়েছে ভারত। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ভারতের প্রধান মিত্রে পরিণত হওয়ার কারণে মার্কিন ও কাবুল সরকারের নীতি অবস্থানকেই সে সমর্থন করে থাকে। এটা তালেবান ও প্রতিবেশী দেশগুলোর অজানা নয়। তবে তলে তলে তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার আগ্রহও তার একেবারে কম দেখা যায়নি। ২০১১ সালে আফগানিস্তানে কয়েকজন ভারতীয় প্রকৌশলী অপহৃত হওয়ার পর তাদের মুক্তির জন্য ভারতীয় গোয়েন্দারা তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। মূলত তখন থেকেই তালেবানের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে ভারতীয় গোয়েন্দাদের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতের সঙ্গে তালেবানের যোগাযোগের কথা তালেবানের তরফেও স্বীকার করা হয়েছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে দোহায় অনুষ্ঠিত আন্তঃআফগান শান্তি বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শংকরসহ ভারতীয় কয়েকজন কর্মকর্তা যোগ দেন। এ বৈঠকের পর থেকে ভারত-পাকিস্তান ও ইরানবিরোধী তালেবান গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য তার ক‚টনীতিক ও গোয়েন্দাদের বিশেষভাবে নিয়োজিত করে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, তালেবানের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ভারত তার সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলেনি। আসলে তালেবানের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিরোধ সৃষ্টি এবং পাকিস্তান ও ইরানবিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে স্বীয় স্বার্থে ব্যবহার করার জন্যই সে এটা করেছে। ভারতের এই অপনীতি এবং ক্ষতিসাধনের অসৎ উদ্দেশ্য ধরা পড়ে যাওয়ায় সে এখন বেকায়দায় পড়ে গেছে। আফগানিস্তানে তালেবানের বিজয় ও ক্ষমতা লাভ ভারতকে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলে দেবে বলে অনেকে মনে করেন। ভারতের শংকার বড় কারণ, মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তান ত্যাগ করলে তাদের ও আফগান সরকারি বাহিনীর ব্যবহার্য অস্ত্রশস্ত্র তালেবানের হাতে পড়বে। সেই অস্ত্রেসজ্জিত তালেবানের অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে জম্মু ও কাশ্মীরে। সে ক্ষেত্রে কাশ্মীর পরিস্থিতি ভারতের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

এখন পর্যন্ত এটা প্রতীয়মান হচ্ছে, আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় এলে, সেটা হবে ভারতের জন্য ব্যাপক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণ। শুধু তার নিরাপত্তার ঝুঁকিই এতে বাড়বে না, সেইসঙ্গে আফগানিস্তানে তার বিপুল বিনিয়োগ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। ইতিমধ্যেই আফগানিস্তানে অবস্থানকারী ভারতীয়দের নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তার প্রমাণ হিসেবে দুটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। কিছুদিন আগে কান্দাহারের ভারতীয় কন্স্যুলেট থেকে ক‚টনীতিকদের রাতারাতি দিল্লিতে ফেরৎ নিয়ে গেছে ভারত। অন্যান্য কন্স্যুলেটও কার্যত বন্ধ। কূটনীতিকদের ফিরিয়ে নেয়ার এ সিদ্ধান্তের আগে ভারতের বিনিয়োগে আফগানিস্তানে নির্মাণাধীন একটি বাঁধে তালেবান হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে ১০ জন নিরাপত্তাকর্মী নিহত হয়েছে। আফগানিস্তানে ভারতীয় বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ যে অন্ধকারাচ্ছন্ন, সেটা শেষোক্ত ঘটনা থেকে আন্দাজ করা মোটেই কঠিন নয়। আফগানিস্তানে মার্কিন দখল কায়েম হওয়ার পর ভারত আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তার করে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় সেই থেকে ভারত সেখানে আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন প্রকল্পে কয়েকশ’ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। এছাড়া সাংস্কৃতিক উন্নয়নেও বিপুল বিনিয়োগ করেছে। এসব বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভারত বাস্তবিক কারণেই শংকিত। এই রকম নানা কারণে ভারত তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ ও নৈকট্য বাড়ানোর জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

আফগানিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছে। এ ছাড়া তার কোনো উপায় ছিল না। এতে যুক্তরাষ্ট্র কেবল আফগানিস্তানকেই হারায়নি, সেইসঙ্গে দীর্ঘদিনের মিত্র পাকিস্তানকেও হারিয়েছে। পাকিস্তান সম্প্রতি জানিয়ে দিয়েছে, সেখানে কোনো মার্কিন ঘাঁটি করার অনুমতি দেয়া হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি তার পরম মিত্র ভারতকেও আফগানিস্তান থেকে ‘লোটা কম্বল’ ফেলে আসার অবস্থা হয়েছে।

গত কয়েক দশক ধরে এ অঞ্চলে বিরাজমান ভূরাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরির হয়েছে। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর বিদায় এবং তালেবানের প্রতিষ্ঠায়। এ অঞ্চলে ভারত বাদে মার্কিন প্রভাব অতঃপর হ্রাস পাবে। ভারত আরো কোণঠাসা হয়ে পড়তে পারে। এর বিপরীতে অঞ্চলজুড়ে চীনের প্রভাব বাড়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়েছে। কারো কারো মতে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিপক্ষ চীনের প্রভাববলয়ের মধ্যে আফগানিস্তানকে স্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে বিদায় নিচ্ছে। এটা যে কেবল কথার কথা নয়, সেটা তালেবান মুখপাত্রের চীন সম্পর্কিত বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়। এখন চীন-পাকিস্তানের অর্থনৈতিক করিডোরে আফগানিস্তানের শামিল হওয়ার বিষয়টি সময়ের ব্যাপার মাত্র। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে আফগানিস্তানের অন্তর্ভুক্তি প্রায় অবশ্যম্ভাবী। অবকাঠামো ও যোগাযোগ উন্নয়নে চীনের সহযোগিতা তাকে যে একটা নতুন মাত্রায় উন্নীত করবে তা, সহজে অনুধাবন করা যায়। আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানসহ প্রতিবেশীদের এবং রাশিয়ার সম্পর্ক স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হবে। ভ‚রাজনীতির নতুন বিন্যাসে চীনেরই থাকবে নিয়ামক ভূমিকা ও কর্তৃত্ব। এর বিপরীতে চীনের আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ ভারত প্রায় বন্ধুহীন হয়ে পড়ায় আশঙ্কার মধ্যেই নিক্ষিপ্ত হবে। চীন বরাবরই নানাভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তার সর্বসাম্প্রতিক একটি উদ্যোগ হলো- চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্র নির্মূল ও সমবায় উন্নয়ন চালু করা। এ উদ্যোগ সার্কের বিকল্প বলে অনেকে মনে করেছেন। এতে ভারত, ভুটান ও মালদ্বীপ নিজের অনুপস্থিতির দ্বারা তাদের অবস্থান নিশ্চিত করেছে। বাকি দেশেগুলো এই উদ্যোগের এর সঙ্গে আছে। পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, যখন ভারতের কারণে সার্ক স্তিমিত, তখন এই উদ্যোগ নিয়েছে চীন, যাতে দক্ষিণ এশিয়া তার প্রভাব শক্তিশালী হয়। এর গুরুত্বপূর্ণ ভূকৌশলগত তাৎপর্য তো অবশ্যই রয়েছে।



 

Show all comments
  • Dedarul Alam ১৮ জুলাই, ২০২১, ১:১৪ এএম says : 0
    যাদের দেশ তারা তাদের মতো করে শ্বাসন করবে এবং ভালো না লাগলে তারাই সরকার পরিবর্তন করবে।অন্য দেশের নাক গলানো উচিত নয়।
    Total Reply(0) Reply
  • M. O. Bahar ১৮ জুলাই, ২০২১, ১:১৪ এএম says : 0
    তালেবান একটি রাজনৈতিক দল, যাদের সমরিক শক্তির কাছে ন্যাটো ও আমেরিকা নাস্তানাবুদ হয়ে এখন পালাচ্ছে। তাদেরকে আর জঙ্গি বলার সুযোগ নেই কারণ আমেরিকা তাদেরকে আফগানিস্তানের বৈধ একটা শক্তি মনেকরেই তাদের সাথে শান্তি চুক্তি করেছে। তালেবান আফগানিস্তানে সরকার গঠন করলে সেখানে সত্যিকরের শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়া সময়ের ব্যাপার। তারাই হতে পারে মুসলিম বিশ্বের রোল মডেল।
    Total Reply(0) Reply
  • Mohi Uddin ১৮ জুলাই, ২০২১, ১:১৪ এএম says : 0
    মার্কিনীরা চায় তালেবান হঠাতে. ভারত চায় তালেবানের সঙ্গ দিতে. তাদের দেশের লোক তারা তাদের দেশ দখল করবে শাসন করবে এতে সমস্যা কি.
    Total Reply(0) Reply
  • Akhter Jahid ১৮ জুলাই, ২০২১, ১:১৫ এএম says : 0
    আমেরিকা এবং ন্যাটো বাহিনী তালেবানদের ক্ষমতাচ্যুত করে দেশ দখল করছে এবং তালেবানদের সাথেই চুক্তি করে যুদ্ধের সমাপ্তি করে আফগান ছাড়ছে চুক্তি অনুযায়ী। আমেরিকার অন্যতম শর্ত: তালেবান বাহিনী আফগানিস্তান এর ভূমি আল-কায়েদাকে ব্যবহার করতে দিবে না। তালেবানদের অন্যতম শর্ত: ১. তালেবানদেরকে স্বীকৃতি দিতে হবে ২. সকল বিদেশী সৈন্যদের আফগানিস্তান ত্যাগ করতে হবে ৩. শরিয়তের বিধান এর পরিবর্তে মানব রচিত কোন আইন মানবে না বা ছাড় দিবে না ৪. ইত্যাদি আমার প্রশ্ন হচ্ছে, স্বীকৃতি প্রাপ্ত তালেবান বাহিনী পুনরায় ক্ষমতা নিলে এবং চুক্তি মেনে চললে উদ্বেগ প্রকাশের সুযোগ কোথায়?
    Total Reply(0) Reply
  • আশরাফুল ইসলাম ১৮ জুলাই, ২০২১, ১:১৫ এএম says : 0
    ভালই হয় পুতুল সরকার না থাকলেই আফগানে সহিংসতা কমবে
    Total Reply(0) Reply
  • রাসেল আহম্মেদ ১৮ জুলাই, ২০২১, ৮:৫৪ এএম says : 0
    সাম্রাজ্যবাদের পতন হোক
    Total Reply(0) Reply
  • মো: আবুল কালাম আজাদ ২০ জুলাই, ২০২১, ৮:২৭ পিএম says : 0
    সত্যের জয় অবধারিত
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: তালেবান

১০ ডিসেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন