Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্মের অনুসরণেই জীবনের প্রশান্তি

প্রকাশের সময় : ২১ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

॥ আট ॥
নির্জন মরুভূমিতে তাঁরা ছাউনি ফেলে দিনযাপন করেন এবং হজের আরকান-আহকাম পালন করেন সমবেতভাবে এবং নির্দিষ্ট সময়ে। এমনিভাবে তাঁরা অতিবাহিত করেন কয়েকটি দিন। এসময়ের মধ্যে তারা নির্ধারিত নিয়মে কখনো সফরে থাকেন কখনো বিশ্রাম করেন, আবার তাঁবুর মধ্যে অথবা খোলা আকাশের নিচে রাত্রিযাপন করেন। বস্তুতপক্ষে এর ব্যাপকতা ও গুরুত্ব অনেক বেশি। এসব কিছুর মধ্য দিয়ে মূলত আল্লাহর সৈনিকগণ সুশৃঙ্খল জীবনের প্রশিক্ষণ লাভ করে।
নবী করীম (সা.) ইন্তেকালের মাত্র কয়েক মাস পূর্বে হজ পালন করেন। সে সময়ে তিনি জাবালুর রহমতের চূড়ায় দাঁড়িয়ে একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ইসলামের ইতিহাসে এই ভাষণ মুক্তি সনদ হিসাবে পরিচিত। সে বছর আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ১,৪০,০০০ লোক হজ উপলক্ষে মক্কায় আসেন। রাসূলে করীম (সা.)-এর ভাষণ শোনার জন্য তাঁরা সমবেত হন জাবালুর রহমতের পাদদেশে। তিনি তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে জগদ্বাসীকে ইসলামের মৌলিক বিষয় সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বলেন যে, (ক) এক আল্লাহর উপর অবিচল বিশ্বাস রাখতে হবে এবং কোনো মূর্তি বা বস্তু তাঁর প্রতীক হতে পারে না। (খ) সকল মানুষ সমান। ধর্ম বা কৌলিন্যের কারণে মানুষের মধ্যে কোনো রকম তারতম্য বা ভেদাভেদ হতে পারে না। কেউ দাবি করতে পারে না একজনের উপর আরেকজনের শ্রেষ্ঠত্ব। এখানে শ্রেষ্ঠত্ব বিবেচিত হবে কেবলমাত্র ব্যক্তির আল্লাহভীতি এবং আমলে সালেহ-এর নিরিখে। (গ) জীবন, সম্পদ এবং সম্মানের ব্যাপারে প্রত্যেক মানুষের রয়েছে মৌলিক অধিকার। (ঘ) সুদী কারবারকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করলেন। (ঙ) রহিত কররেন বংশগত বিরোধ এবং মানুষের তৈরি মতলবি বিচার ব্যবস্থাকে। (চ) নারী জাতির সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার নির্দেশ দিলেন। (ছ) সম্পদ মুষ্টিমেয় লোকের হাতে পুঞ্জীভূত না হয়ে অবিরত বণ্টন এবং হাত বদল হতে হবে। সে জন্য উত্তরাধিকার আইন ও উইল সংক্রান্ত বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হবে। (জ) তিনি আরো ঘোষণা দিলেন যে, আমাদের জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই আল্লাহর কালাম আল-কুরআনই হবে সকল আইনের উৎস।
জানা যায় যে, হজের ব্যাপারে জাহেলিয়াত যুগের কিছু আচার-অনুষ্ঠান ইসলামের আবির্ভাবের প্রথম যামানা পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। যেমনÑ বিশাল জনসমাবেশ উপলক্ষে এ সময়ে একটি বাৎসরিক সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করা হতো। এ সম্মেলনে কবিরা তাদের স্বরচিত কবিতা পাঠ করত। অনলবর্ষী বক্তারা উচ্চস্বরে বক্তৃতা দিয়ে তাঁদের মেধা প্রকাশ করত। পেশাদার কুস্তিগীরেরা দর্শকদের মাতিয়ে রাখত। আবার ব্যবসায়ীরা নিয়ে আসত হরেক রকমের বিক্রয় সামগ্রী। খলীফা হজরত উমর (রা.)-এর আমলে এ সমাবেশ প্রশাসনিক গুরুত্ব লাভ করে। তিনি এ সমাবেশকে ব্যবহার করেন একটি আপিল কোর্ট হিসাবে। এসময়ে জনসাধারণ গভর্নর ও সেনাপতিদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অভিযোগ তুলতে পারত। অভিমত পেশ করতে পারত সরকারের নতুন নতুন প্রকল্প সম্পর্কে।
পরিশেষে আবারো স্মরণ করা যেতে পারে যে, ইসলামে জাগতিক এবং ধর্মীয় জীবনের সাধারণ বিষয়গুলো সমানভাবে পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি এগুলোর মধ্যে রয়েছে চমৎকার সঙ্গতি ও সংযোগ।
সাধারণ অর্থে যাকাত বলতে মওজুদ অর্থ বা সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশকে বছরান্তে দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করাকে বুঝায়। এর মধ্যে রয়েছে কৃষি ফসল, ব্যবসা-বাণিজ্যের পুঁজি, গৃহপালিত পশু, মওজুদ অর্থ এবং অন্যান্য সম্পদের উপর ধার্যকৃত অর্থ। গোড়ার দিকে যাকাত হিসাবে পরিশোধযোগ্য সমস্ত অর্থ সরাসরি সরকারি তহবিলে জমা দিতে হতো। কিন্তু খলীফা উসমান (রা.)-এর খিলাফতকালে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, মওজুদ অর্থের উপর যে যাকাত হয় তা মুসলমানরা নিজেরাই ব্যয় করতে পারবে। তবে কুরআন মজীদে যে সমস্ত খাতে যাকাতের অর্থ ব্যয়ের অনুমোদন রয়েছে, এ ব্যয় কেবলমাত্র সে সমস্ত খাতে হতে হবে।
কুরআন মজীদে ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, সম্পদ হলো মানুষের বেঁচে থাকার জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় এবং মৌলিক উপাদান। ইসলামে যাকাত প্রদান করাকে ঈমানের একটি অঙ্গ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নামাজ, রোজা ও হজের ন্যায় যাকাতকেও দেয়া হয়েছে অবশ্য পালনীয় কর্তব্যের মর্যাদা। তবে স্মরণ রাখতে হবে যে, রাষ্ট্রপ্রধানের আরাম-আয়েশ বা শান-শওকতের জন্য কেউ যাকাত দেয় না। বরং ব্যক্তির উপর সমাজের বিশেষ করে অভাবগ্রস্ত মানুষের যে অধিকার রয়েছে তারই অংশ হিসেবে সে যাকাত দেয়। এভাবেই সে নিজের আত্মাকে পবিত্র এবং উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। বুৎপত্তিগত দিক থেকে বিবেচনা করলেও এটাই যাকাতের উদ্দেশ্য।
নবী করীম (সা.) বলেছেন যে, “রাষ্ট্রপ্রধান বা শাসক হলো মানুষের খাদেম”। আর নবীজী ছিলেন মুসলমানদের আধ্যাত্মিক নেতা ও রাষ্ট্রনায়ক। নবীজীর এ উক্তির যথার্থতা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর একটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে। তিনি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দিয়েছেন যে, “মুসলমানরা ট্যাক্স হিসেবে যে অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিবে তা তাঁর নিজের বংশের কোনো লোকদের জন্য নিষিদ্ধ।” আর এটা তো জানা কথা যে রাষ্ট্রপ্রধান যদি ন্যায়নীতির প্রতি নিষ্ঠাবান হয়, তাহলে অধস্তন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও তাদের কাজকর্মের ব্যাপারে অধিকতর দায়িত্বশীল হয়ে থাকে।
রাসূলে করীম (সা.) এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলে ইসলামী রাষ্ট্রের মুসলমান নাগরিকদের যাকাত ব্যতীত আর কোনো কর দিতে হতো না। উল্লেখ্য যে, যাকাতের সঙ্গে দান-খয়রাতের বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। মুসলমানগণকে নির্দিষ্ট পরিমাণ এবং বাধ্যতামূলকভাবে যে যাকাত পরিশোধ করতে হতো সেটাই বিবেচিত হতো রাজস্ব হিসাবে। রাসূলে করীম (সা.) যাকাতকে একটি ধর্মীয় দায়িত্ব বা ইবাদত হিসাবে ঘোষণা দিয়েছেন। একজন মুসলমানের অন্তরে যাকাত আদায়ের ব্যাপারে নিষ্ঠা এবং আগ্রহ সৃষ্টি করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। তাছাড়া এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, নামাজ, রোজা ও হজের মতো যাকাতও আল্লাহর প্রদত্ত বিধানের অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বাসকে যদি আধ্যাত্মিক ইবাদত এবং নামাজ, রোজা ও হজকে শারীরিক ইবাদত হিসাবে গণ্য করা হয়, তাহলে যাকাতকে বিবেচনা করা যেতে পারে অর্থ সংক্রান্ত ইবাদত হিসাবে। ফকীহগণ একে বলেছেন ইবাদতে মালিয়াহ, অর্থাৎ সম্পদের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত। এ কথা দ্বারা আবারো এটা প্রমাণিত হয় যে, ইসলাম সমগ্র মানব জীবনকে একটি সত্তায় বিকশিত করেছে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো দেহ ও আত্মার মধ্যে একটি সুন্দর সামঞ্জস্য বিধান করা। এখানে দেহ ও আত্মার মধ্যে একটি হেয় করে অপরটির প্রতি আনুকূল্য প্রদর্শনের অবকাশ নেই।
কুরআন-হাদীসে কর অর্থে মোটামুটি অনেকগুলো শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলো হলোÑ যাকাত, সাদকা, হক। কুরআনের অসংখ্য আয়াতে যাকাতের উল্লেখ রয়েছে। এর অর্থ সমৃদ্ধ এবং পবিত্রকরণ। যাকাত শব্দ দ্বারা এ কথাই বোঝান হয়েছে যে, সম্পদ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সম্পদের একটি অংশকে অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। সম্পদকে পবিত্র করার জন্য এটা আবশ্যক। এরপরে আসে সাদকা। সাদকা শব্দটি সততা এবং বদান্যতা উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ যারা পশ্চাৎপদ, যাদের ভাগ্য ততটা সুপ্রসন্ন নয়, মানবতার খাতিরে তাদের প্রতি সহৃদয়বান এবং দয়াপরবশ হওয়াটাই হলো সাদাকা। খাজনা বা কর হিসাবে ব্যবহৃত আরেকটি শব্দ হলো এক। ‘হক’-এর অর্থ ন্যায্য অধিকার। একজনের জন্য যেটা অধিকার সেটাই অপরের জন্য অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হিসাবে বিবেচিত হয়। অন্যভাবে বলা যেতে পারে যে, দায়িত্ব ও অধিকার পরস্পরের সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। এবং এটাই হলো সমাজের সকল প্রকার কাজকর্মের মূল ভিত্তি।



 

Show all comments
  • Moslem Uddin Ahmed ২২ আগস্ট, ২০১৬, ১২:১৭ পিএম says : 0
    Net connection is very slow.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ