Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্মের অনুসরণেই জীবনের প্রশান্তি

প্রকাশের সময় : ২৬ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

॥ এক ॥
মানুষের জন্য একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান প্রদান করাই ইসলামের মূল লক্ষ্য। ইসলাম যেমন কাউকে অবজ্ঞা করে না, তেমনি মানুষের ব্যাপক কর্মকা-ে কোনোটিকে উপেক্ষাও করে না। বস্তুতপক্ষে মানুষের বহুমুখী কার্যকলাপের মধ্যে সমন্বয় সাধন করাই এর উদ্দেশ্য। তার সকল প্রকার আচার-আচরণ মূলত দেহ ও আত্মাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত।
আল্লাহর দেয়া বিধি-নিষেধ অনুসারে জীবন পরিচালিত হলেই জাগতিক কাজকর্মগুলো ইবাদতের মূল্য পায় এবং নৈতিক চরিত্র উন্নত ও পবিত্র হয়। অনুরূপভাবে আমরা যেগুলোকে আধ্যাত্মিক সাধনা বলি সেগুলোর মধ্যেও নিহিত রয়েছে বস্তুগত সুবিধা। আধ্যাত্মিক অথবা জাগতিক কাজের নিয়ম-নীতিগুলো উৎসারিত হয়েছে একটি অভিন্ন উৎস থেকে এবং তা’হলো কুরআন মজীদ। কুরআন মজীদ আল্লাহর কালাম। আধ্যাত্মিক এবং জাগতিকÑএ দুটো ধারার পরিপূর্ণ এবং অপরিহার্য বিকাশ ঘটেছে ইমাম শব্দটির মধ্য দিয়ে। ইসলামী পরিভাষায় ইমাম (মুসলিম রাষ্ট্রের সর্বাধিনায়ক) বলতে কেবলমাত্র মসজিদের অভ্যন্তরে নামাজের ইমামতি বুঝায় না। বরং তিনি মুসলিম রাষ্ট্রেরও নেতা।
ঈমান, ইসলাম ও ইহসান সম্পর্কে রাসূল করীম (সা.) যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, হাদীস শরীফে তার বিবরণ রয়েছে। ঈমান অর্থ বিশ্বাস, ইসলাম অর্থ আনুগত্য এবং ইহসান অর্থ উত্তম পন্থা। আলোচ্য বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যার শুরুতে নবী করীম (সা.)-এর একটি হাদীসের উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে। প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি : আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ্ নেই, হজরত মুহম্মদ (সা.) তাঁর বান্দা ও রাসূলÑএ কথার সাক্ষ্য দেয়া, সালাত (নামাজ) কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, বায়তুল্লাহর হজ করা এবং মাহে রমজানে রোযা রাখা (বোখারী ও মুসলিম)। ইতিপূর্বে ঈমান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। রাসূলে করীম (সা.) বলেছেন যে, সালাত হলো দীনের স্তম্ভ। কুরআন মজীদে একশতেরও বেশি জায়গায় সালাত সম্পর্কে বলা হয়েছে। এবং বিভিন্ন স্থানে সালাতের বিভিন্ন নামকরণও করা হয়েছে। যেমনÑদু’আ, যিকর, তাসবিহ, ইনাবাহ।
দৈনিক ৫ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের হুকুম রয়েছে। দুনিয়ার বুকে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের পরিবেশ সৃষ্টি করাই এর উদ্দেশ্য। এখানে একজনকে খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে হয় এবং সালাত আদায় করতে হয়। তাকে সালাত আদায় করতে হয় বিকালের প্রথম ভাগে, শেষ বিকালে, সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এবং রাতে বিছানায় যাওয়ার পূর্বক্ষণে। প্রতি ওয়াক্ত সালাত আদায় করতে কয়েক মিনিট সময়ের দরকার হয়। এ সময়ে নিজেকে যাবতীয় স্বার্থাদির চিন্তা থেকে বিরত রেখে একাগ্র চিত্তে আল্লাহর দিকে গভীর মনোনিবেশ করতে হয়। তাকে সালাত আদায় করতে হয় স্রষ্টা আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নজির হিসাবে। প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিটি নর ও নারীর জন্য সালাত আদায় করা ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য।
প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার যোহরের সালাতের স্থলে জুম’আর সালাত মসজিদে জামাতবদ্ধ হয়ে আদায় করতে হয়। সাপ্তাহিক এই সমাবেশে অত্যন্ত ভাবগম্ভীরতার সঙ্গে সালাত আদায় করা হয়Ñ সালাতের পূর্বে স্থানীয় ইমাম খুৎবা (ভাষণ) দেন। ইসলামে বছরে দুটি আনন্দ-উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। একটি অনুষ্ঠিত হয় মাহে রমজানুল মুবারক শেষে, অপরটি হজের মৌসুমে। আনন্দ-উৎসব দুটি আবার বিশেষ সালাতের সঙ্গে আদায় করা হয়। এই আনন্দ-উৎসবের একটি ঈদুল ফিতর, অপরটি ঈদুল আযহা নামে পরিচিত। ঈদের সালাত নিত্যদিনের পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের অতিরিক্ত। ঈদের সালাত ওয়াজিব। ছয় তকবিরের সঙ্গে এ সালাত আদায় করা হয়। এ সালাত সমবেতভাবে আদায় করতে হয়। এ উদ্দেশ্যে খুব সকাল থেকেই লোকেরা নির্দিষ্ট স্থানে সমবেত হতে শুরু করে এবং ইমাম তাদের উদ্দেশ্যে খুৎবা (ভাষণ) দেন। মৃত ব্যক্তিকে দাফন করার জন্য যে সালাত আদায় করা হয় তাকে জানাযার সালাত বলে। জানাযার সালাত ফরযে কিফায়া।
সালাতের অন্তর্নিহিত অর্থ এবং আধ্যাত্মিক তাৎপর্য আলোচনা করতে গিয়ে প্রখ্যাত সুফী শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবী (র.) বলেছেন যে, স্মরণ রাখবেন, কখনো কখনো মানুষ খারাতুল কুদস বা পবিত্র মঞ্জিল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তখন সে আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য লাভ করে। তার উপর অবতীর্ণ হয় পবিত্র জ্যোতি (তাজাল্লী)। সে নফসের উপর বিজয়ী হয় এবং এমন সব জিনিস অবলোকন করতে থাকে যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আবার যখনই তার উপর থেকে সেই পবিত্র জ্যোতি সরে যায় তখনই সে ফিরে আসে পূর্বাবস্থায়। ফলে তার মধ্যে সৃষ্টি হয় অদ্ভুত রকমের এক অস্থিরতা ও অস্বস্তি। অবশেষে সে বাধ্য হয়ে এ নিম্ন অবস্থাকে মেনে নেয়। তখন সে আল্লাহর ইশকে মাতওয়ারা হয়ে হারানো অবস্থায় ফিরে যেতে আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকে। আসলে এটা হলো কথা ও কাজের মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে আবেদন-নিবেদন ও কাকুতি-মিনতি করার নামান্তর মাত্র। সালাতের তিনটি মৌলিক বিষয় রয়েছে :
১। আল্লাহর মহিমা ও কুদরতের কথা মনে রেখে একাগ্রচিত্তে তাকে হাজির-নাজির জানা।
২। বিনয়ের সঙ্গে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা এবং উপযুক্ত শব্দে নিজের বিনম্রতা প্রকাশ করা। যেমন কারো প্রতি সম্মান দেখাতে গিয়ে আমরা সোজা হয়ে দাঁড়াই। তাঁর দিকে মুখ ফিরাই এবং তাঁর প্রতি পূর্ণ মাত্রায় মনোনিবেশ করি। কিন্তু যখন পরম শ্রদ্ধা সহকারে রুকুতে বা সিজদা করে তখন সেটা হয় আরো বড় ধরনের সম্মান প্রদর্শন।
৩। এই বিনম্রতাকে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যথাযথ সুনির্দিষ্ট ভঙ্গিমার মাধ্যমে স্থাপন করা এবং ভয় ও শ্রদ্ধায় অবণত হওয়া। তার চেয়ে বড় কথা এই যে, মুখম-ল হলো আমাদের শ্রেষ্ঠতম অঙ্গ। আমাদের আমিত্ব এবং আত্ম-সচেতনতার প্রকাশ ঘটে এই মুখম-লের মধ্য দিয়ে। সেই মুখম-লকে যখন আমরা নত করি, এমন পর্যায়ে নিয়ে আসি যা সম্মানিত বিষয়ের সম্মুখে ভূমিকেস্পর্শ করে তখন যে সম্মানের প্রকাশ ঘটে তা তুলনাহীন। মহান স্রষ্টা আল্লাহ তা’আলাকে মানুষ এভাবে স্মরণ করবে যাতে সে আলোকিত হবে পবিত্র জ্যোতিতে। এভাবেই সে হৃদয় দিয়ে আল্লাহর মহত্ত্বকে অনুধাবন করতে পারে। তার মধ্যে ফুটে ওঠে বিনয় নম্র ভাব। বস্তুতপক্ষে এটাই সৃষ্টির উদ্দেশ্য। মানব জীবনের একমাত্র সাধনা। মানুষ কেবলমাত্র ক্রমাগত সাধনার মাধ্যমে এই উন্নতর পর্যায়ে উপনীত হতে পারে। এধরনের আরোহণ কেবলমাত্র সম্মান সহকারে সোজা হয়ে দাঁড়ান, নত হওয়া এবং সিজদার মাধ্যমে হতে পারে এবং সর্বোত্তম ইবাদত সেটাই যার মধ্যে এ তিনটি কাজ বিরাজমান রয়েছে। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী (র.), প্রথম খ-, সালাতের রহস্য)।
কুরআন মজীদে বলা হয়েছে যে, “তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহকে সিজদা করে যা কিছু আছে আকাশম-লীতে ও পৃথিবীতে, সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্র ম-লী, পর্বতরাজি, বৃক্ষলতা, জীবজন্তু এবং সিজদা করে মানুষের মধ্যে অনেকে (২২ : ১৮)। আরো বলা হয়েছে যে, “সপ্ত আকাশ, পৃথিবী এবং তাদের অন্তর্বর্তী সব কিছু তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং এমন কিছু নেই যা তাঁর প্রশংসা, পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না। কিন্তু তাদের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা তোমরা অনুধাবন করতে পার না (১৭ : ৪৪)।
সমস্ত সৃষ্টিরাজির ইবাদত-বন্দেগীর একটি নির্দিষ্ট ধরন রয়েছে। এসব কিছুরই সমন্বয় ঘটেছে সালাতের মধ্যে। সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র নিয়মিত উদয় হয়, অস্ত যায়। এ যেন সালাতের এক রাকআতের পর আরেক রাকআত আদায় করার অনুরূপ। পাহাড় পবর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সালাতের শুরুতে মু’মিন-মুসলমানদেরও ঠিক এমনিভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। পশু-পাখিরা বশ্যতা স্বীকারের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে নত হয়। এর সঙ্গে সঙ্গতি রয়েছে সালাতের রুকুর। বৃক্ষরাজিকে আমরা মূলের সাহায্যে মাটি থেকে খাদ্য খাবার সংগ্রহ করতে দেখতে পাই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ