Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্মের অনুসরণেই জীবনের প্রশান্তি

প্রকাশের সময় : ১৬ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

॥ সাত ॥
হজের শাব্দিক অর্থ সংকল্প করা। এর আরেকটি অর্থ কোনোকিছুর উপর আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা করা। প্রচলিত অর্থে হজ বলতে কা’বা ঘর তওয়াফ, সাফা-মারওয়া সাঈ, আরাফাত-মুযদালিফা ও মিনায় অবস্থান করাকে বুঝায়। বস্তুতপক্ষে হজের অর্থ আরো ব্যাপক ও বিস্তীর্ণ। মুসলমানদের ধর্মীয় দায়িত্বাবলীর মধ্যে হজের স্থান তৃতীয়। পূর্ণবয়স্ক ও সামর্থবান প্রতিটি মু’মিন মুসলমানের জন্য হজ ফরয। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেককেই তার জীবদ্দশায় একবার মক্কায় যেতে হয়। হজ পালনের মধ্যে দিয়েই সে নিজের অহংবোধক নির্মূল করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। নিজের সত্তাকে একাকার করে ফেলে আল্লাহর ইচ্ছার সঙ্গে। আর যাদের হজে যাওয়ার মতো আর্থিক সঙ্গতি নেই তারা এ দায়িত্ব থেকে মুক্ত। কিন্তু এমন কোনো মুসলমান কি আছে যে, আল্লাহর ঘর কা’বায় হাজির হওয়ার সামর্থ্য লাভের আশায় অল্প অল্প করে প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় না করবে?
কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : মানব জাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাতো বাক্কায় (মক্কায়), তা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারী (৩ : ৯৬)। হজরত আদম (আ.) প্রথমে যে ঘর নির্মাণ করেছিলেন, পরবর্তীতে হজরত ইবরাহীম (আ.) কেবলমাত্র তা পুনর্নির্মাণ করেন। কেউ যদি কেবলমাত্র ইবরাহীম (আ.)-এর সময়কালকে হিসাবে আনে, তাহলেও কা’বাই হবে সবচেয়ে পুরানো ঘর। হজরত সুলায়মান (আ.) নির্মিত যেরুজালেমের ইবাদতগাহর চেয়েও কা’বা অধিক পুরাতন। কা’বা ঘরের চেয়ে পুরান কোনো ইবাদতখানা দ্বিতীয়টি আর নেই।
এখানে সংক্ষেপে হজের আচার-অনুষ্ঠানগুলো উল্লেখ করা যেতে পারে। পবিত্র মক্কার সীমানায় মীকাত আসার সঙ্গে সঙ্গে নিত্যদিনের পোশাক খুলে ফেলতে হয়। তাকে পরিধান করতে হয় নির্ধারিত ইহরামের দুখ- কাপড় যা সিলাইবিহীন। একখ- কোমর থেকে নিচ পর্যন্ত এবং অন্যটি কাঁধ আবৃত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এ পোশাক কেবলমাত্র পুরুষদের জন্য। মহিলাদের জন্য ভিন্ন পোশাক। এ সময় পুরুষের মাথাকে অনাবৃত অবস্থায় রাখতে হয়। তাছাড়া হজের দিনগুলোতে সে নিজের সত্তাকে সম্পূর্ণরূপে ভুলে যেতে চেষ্টা করে।
মক্কার অদূরে একটি স্থানের নাম আরাফাত। ইহরামের পোশাক পরিহিত অবস্থায় তাকে সেখানে যেতে হয়। সেখানে সে দিনটি অতিবাহিত করে গভীর ধ্যান-মগ্নতার মধ্য দিয়ে। দিবাবসানে সে আরাফাতের ময়দান থেকে প্রত্যাবর্তন করে। রাতটি অতিবাহিত করে মুযদালিফায়। পরদিন প্রত্যুষে সে পৌঁছে যায় মক্কার সীমান্তবর্তী অঞ্চল মিনায়। তাকে এখানে তিনদিন থাকতে হয়। প্রতিদিন সকালে সে শয়তানকে লক্ষ্য করে কঙ্কর ছোড়ে, একটি পশু কুরবানী দেয়। এক সময়ে সে ক্ষণিকের জন্য চলে আসে কা’বায়। এখানে কা’বার চতুষ্পার্শ্বে চক্কর দিয়ে সাতবার তওয়াফ করে এবং কা’বা ঘরের পার্শ্বে অবস্থিত সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সাতবার দৌড়ে সাঈ পালন করে।
বস্তুতপক্ষে এধরনের আচার-অনুষ্ঠান প্রতিপালনের একটি প্রতীক প্রেক্ষাপটও রয়েছে। বেহেশত হতে বের হয়ে আসার পর হজরত আদম (আ.) এবং বিবি হাওয়া (আ.) পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। এরপর শুরু হয় একে অপরকে অনুসন্ধানের পালা। অবশেষে আল্লাহর অসীম রহমতে তাঁরা মিলিত হলেন আরাফাতের ময়দানে। হজরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়ার বংশধরগণ আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আরাফাতের ময়দানে এসে সমবেত হয়। নিজেদের অস্তিত্ব ও সত্তাকে ভুলে গিয়ে আল্লাহকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। এভাবেই সে অতীতের ভুলত্রুটির জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং আগামী দিনগুলোর জন্য তাঁর হিদায়েত ও সাহায্য কামনা করে।
শয়তানের প্রতি কংকর নিক্ষেপ করা প্রসঙ্গে হজরত ইবরাহীম (আ.)-এর ঘোষণাটি স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তিনি দুনিয়ার যে কোনো জিনিসের চাইতে আল্লাহকে বেশি ভালোবাসেন। তাঁর এ দাবি যে সত্য তা প্রমাণ করার জন্য আল্লাহ তা’আলা তাঁকে প্রাণ দিয়ে পুত্র ইসমাঈলকে কুরবানী করতে বললেন। ঠিক তখনই শয়তান এসে সেখানে হাজির হয় এবং ইসমাঈলকে কুরবানী দেয়া থেকে বিরত থাকার জন্য হজরত ইবরাহীম (আ.)-কে প্ররোচিত করার চেষ্টা করে। প্রতিবারই ইবরাহীম (আ.) শয়তানকে তাড়িয়ে দেন এবং তাকে লক্ষ্য করে কংকর ছোড়েন। অতঃপর শয়তান বিবি হাজেরার কাছে যায়। সবশেষে যায় ইসমাঈল (আ.)-এর কাছে। তাঁদেরকেও ঠিক একইভাবে প্ররোচিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু তাঁরা প্রত্যেকেই শয়তানকে তাড়া করেন। প্রতীকী আচরণ হিসাবে এখনো আমরা এর পুনরাবৃত্তি করে থাকি। এভাবেই মনের শয়তানী ও কুপ্রবৃত্তিগুলোকে প্রতিহত করার চেষ্টা করি।
আল্লাহর ঘর কা’বায় হাজির হওয়ার ঘটনাটি ব্যাখ্যা করে বলা অনাবশ্যক। আনুগত্য প্রকাশের নজির হিসাবেই একজন মু’মিন কা’বা ঘরে যায়। তখন তার মধ্যে বিরাজ করতে থাকে পূর্ণ শ্রদ্ধা এবং বিনম্রতা। তাছাড়া যে জিনিসের প্রতি কারো অনুরাগ থাকে, যাকে কেউ অন্তর দিয়ে ভালোবাসে, যতœ করে, তার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার নজির হিসাবে তার চারপাশে প্রদক্ষিণ করে। এ রেওয়াজটি সুদৃঢ় অতীতকাল থেকে চালু রয়েছে। অনুরূপভাবে একজন মু’মিন কা’বা ঘরে এসে নির্দিষ্ট নিয়মে কা’বা ঘর তাওয়াফ করে।
হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথরকে ঘিরে অনেক বিভ্রান্তি রয়েছে। আর সে কারণেই বিষয়টির উপর সামান্য আলোকপাত করা আবশ্যক। এটা কোনো জাদুকরী বা মহাকাশ থেকে আসা বিশেষ পাথর নয়। বরং সত্যিকার অর্থেই এটা একটা কালো পাথর। পাথরটির একটি ব্যবহারিক উপকারিতা রয়েছে। কালো হওয়াতে পাথরটি দূর থেকে সহজেই দৃশ্যমান এবং কোন স্থান থেকে তাওয়াফ শুরু করতে হবে কালো পাথর তা বলে দেয়। তাছাড়া পাথরটিকে কেউ পূজা করে না অথবা মুসলমানরা এটাকে লক্ষ্য করে সেজদাও করে না। বরং তারা সেজদায় যায় কা’বা ঘরকে লক্ষ্য করে এবং সেটা কা’বা ঘরের যে কোনো দিক বা প্রান্ত থেকে হতে পারে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ৩৩৮ হিজরী মোতাবেক ৯৩০ সালে কারামতীরা মক্কা নগরীতে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। সে সময়ে তারা কালো পাথরটিও স্বদেশে নিয়ে যায়। দীর্ঘ ২১ বছর পাথরটিকে নিজেদের আয়ত্তে রাখে। সে সময়েও মুসলমানরা কা’বা ঘরের দিকে মুখ করে দাঁড়াত। এমনকি কখনো যদি কা’বা ঘরের সংস্কার অথবা কোনো কারণে নতুনভাবে আরেকটি ঘর নির্মাণের লক্ষ্যে বর্তমান ঘরটি ভেঙ্গে ফেলতে হয়, তখনো মুসলমানরা ঐ স্থানটির দিকে মুখ করে দাঁড়াবে। কালো পাথরসহ কা’বা ঘরটি সেখানে আছে কি নেইÑ সে বিষয়টি গৌণ হিসাবেই থেকে যাবে।
সাফা-মারওয়ার পাদদেশ দিয়ে ৭ বার দৌড়ানোর যোগসূত্র রয়েছে বিবি হাজেরার সঙ্গে। বর্ণিত আছে যে, হজরত ইবরাহীম (আ:) তাঁর স্ত্রী হাজেরা এবং দুধের শিশু ইসমাঈল (আ:)-কে মক্কার জনমানব শূন্য একটি নির্জন স্থানে রেখে আসেন। অল্পসময়ের মধ্যে তাঁদের খাবার পানি নিঃশেষ হয়ে যায়। মাতৃস্নেহ মা হাজেরাকে অস্থির চঞ্চল করে তোলে। পিপাসায় কাতর শিশুর জন্য এক ফোটা পানির অন্বেষণে তিনি ছুটাছুটি করতে থাকেন। অতঃপর নির্গত হলো যমযম। মা হাজেরা যে স্থান বরাবর পানির জন্য ছুটাছুটি করেছিলেন, মুসলমানরা এখনো সেখানে গিয়ে এর পুনরাবৃত্তি করে থাকেন। এটা তারা করে থাকেন মাতৃ-ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং আল্লাহর অনুগ্রহের প্রতি শুকরিয়া জানানোর উদ্দেশ্যে।
হজের সামাজিক তাৎপর্যও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। হজ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই মুসলিম উম্মাহর মধ্যকার ভ্রাতৃত্ববোধ অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। বর্ণ ভাষা গোত্র স্থান ও আভিজাত্যের তারতম্যের কথা ভুলে গিয়ে সকল মু’মিন মুসলমান কা’বা ঘরে আসার জন্য তীব্র তাকিদ অনুভব করে। এখানে তারা পরস্পরের সাথে মিলিত হয় আন্তরিক ও সাম্যের ভিত্তিতে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ