পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে ব্যাপক হারে বন ও বনজ সম্পদ ক্ষয় হচ্ছে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা (এফএও) ২০১৮ সালের ৯ জুলাই বনবিষয়ক এক প্রতিবেদনে (দ্য স্টেট অব গ্লােবাল ফরেস্ট-২০১৮) বলেছে, বাংলাদেশের মোট ভূখন্ডের সাড়ে ১৩ শতাংশ বনভূমি। তবে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দাবি, দেশের মোট আয়তনের ১৭ শতাংশ বনভূমি অর্থাৎ বন ও বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা। বনভূমি পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লােবাল ফরেস্ট ওয়াচ (জিএফও) ও ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউট (ডব্লিউআরআই) ২০১৮ সালে তাদের প্রকাশ করা এক প্রতিবেদনে বলছে, গত সাত বছরে বাংলাদেশে ৩ লাখ ৩২ হাজার একর বনভূমি উজাড় হয়েছে। জিএফও এবং ডব্লিউআরআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বনভূমি উজাড় হওয়ার দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চল। ২০১০ সালে দেশের মোট বৃক্ষসম্পদের ৬০ শতাংশ ছিল এই এলাকায়। গত সাত বছরে তা কমে প্রায় ১০ শতাংশ হয়েছে।
বন ও বনজসম্পদ ক্ষয়ের কারণ বহুবিধ। দ্রুত বন উজাড়ের কারণগুলির মধ্যে রয়েছে জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য। বিভিন্ন উপায়ে বন ধ্বংস হচ্ছে, যথা অনিয়ন্ত্রিত হারে বনউজাড়, নতুন নতুন জনবসতি স্থাপন, অবৈধ বৃক্ষনিধন, গাছের পাতা ও ডালপালা হরণ, জ্বালানির জন্য বনের কাঠের ওপর নির্ভরশীলতা, গবাদি পশু চারণ, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বন পোড়ানো, জুমচাষ, কতিপয় শস্য ও ফলমূলের বাণিজ্যিক চাষাবাদের জন্য বনভূমিকে কৃষি জমিতে রূপান্তর, অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ গাছপালা অধিক হারে সংগ্রহ, যেমন, ঔষধি গাছগাছড়া, গবাদি পশুর খাদ্য, রং, ইটের ভাটা ও অন্যান্য ক্ষুদ্রশিল্পের জ্বালানি হিসেবে কাঠের ব্যাপক ব্যবহার, গৃহস্থালির প্রয়োজনে ভূমিস্থ সবুজ আচ্ছাদনের সম্পূর্ণ বিনাশ এবং বনজ দ্রব্যের অতিরিক্ত ব্যবহার।
এছাড়াও ব্যাপক বৃষ্টিপাত, ভূমিধ্বস, ভূমিক্ষয়, বন্যা, সাইক্লোন, টর্নেডো, লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং কিছু জটিল রোগও যেমন গাছের আগামরা রোগ বনভূমি ও বনজ সম্পদ হ্রাসের উল্লেখযোগ্য কারণ। এছাড়া উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ ও সচেতনতার অভাব, উদ্ভিদ ও জীবজন্তুর স্বাভাবিক লালনক্ষেত্র ও সম্পদ পুনরুৎপাদন সম্পর্কে গবেষণা কর্মকান্ড ও উন্নয়ন কর্মসূচির অপ্রতুলতা, পরিবেশ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাব ইত্যাদিও বাংলাদেশের বন ও বনজ সম্পদ ক্ষয়ের অন্যতম কারণ। কখনও কখনও বনের ধরন ও ভৌগোলিক অবস্থানভেদে বন উজাড়ের মাত্রা ও প্রকৃতির মধ্যে পার্থক্য ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের মধ্য ও উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত শালবনগুলি বহুলাংশে শুষ্ক ও সমতল ধরনের। ভৌগোলিক অবস্থান ও পরিবেশগত কারণে সহজে প্রবেশসাধ্য এবং বসতি স্থাপনের যোগ্য বলে এগুলি বিনাশের সুযোগ অপেক্ষাকৃত বেশি।
বাংলাদেশের বনাঞ্চল সুষম অর্থনীতির জন্য প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্ত অপ্রতুল হলেও এসব বনাঞ্চল দেশের অর্থনীতি ও সার্বিক কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এজন্যই জনগণের অস্তিত্ব ও টেকসই উন্নয়নের জন্য বনসম্পদ সংরক্ষণ অত্যাবশ্যক। বাছাইকৃত বৃক্ষ কর্তন ও স্বাভাবিক বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে পার্বত্য বনে সরকারি ব্যবস্থাপনার সূচনা ঘটে। পরবর্তী সময়ে সম্পূর্ণ বনভূমির কর্তন এবং কৃত্রিম বংশবিস্তার বা বৃক্ষরোপণ পদ্ধতি চালু হয় এবং সেসঙ্গে বাছাইকৃত বৃক্ষ কর্তন-বনাম-উন্নয়ন পদ্ধতি অব্যাহত থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এসব বনাঞ্চলের ওপর অত্যধিক চাপ পড়ে এবং বনজ দ্রব্যের বর্ধিত চাহিদা মেটাতে আহরণ বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীতে দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি বনায়ন এবং সেসঙ্গে সংরক্ষণ ব্যাপকহারে চালু করা হয়।
বঙ্গোপসাগরের উপক‚লীয় অঞ্চলের মুখ্য উপাদান সুন্দরবন। ১৮৭৯ সালে সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই সুন্দরবনের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে বন বিভাগ। প্রধান প্রজাতির কর্তনযোগ্য গাছের বেড়ের নির্দিষ্ট মাপ ও ৪০ বছর মেয়াদ বন পরিচর্যায় অনুসরণ করা হয়। পরবর্তীকালে সময়সীমা কমিয়ে ২০ বছর পর পর গাছ কাটার ব্যবস্থা চালু করা হয়। পার্শ্ববর্তী জলাভূমিসহ সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ বন হলো দীর্ঘস্থায়ী বহুমুখী ব্যবহার ও সমন্বিত সংরক্ষণ পদ্ধতির জন্য এক বিপুল সম্ভাবনাময় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ বাস্তুসংস্থান। প্রাকৃতিক বনাঞ্চল সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৯৮৯ সাল থেকে সকল প্রাকৃতিক বনভূমিতে বৃক্ষ কর্তনের ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রয়েছে।
বাংলাদেশের নিবিড় ভূমি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম হিসেবে কৃত্রিম বনায়ন ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমানে বনায়ন প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে দেশের সামগ্রিক বৃক্ষসম্পদ বৃদ্ধি, বনজ সম্পদ হ্রাস প্রতিরোধ, চিহ্নিত সংরক্ষিত এলাকার বনভূমি সংরক্ষণ জোরদার এবং স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বনসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা। উপক‚লীয় অঞ্চলে বনায়ন কার্যক্রম ও ‘উপক‚লীয় সবুজ বেষ্টনী’ হিসেবে একটি গাছপালার বেষ্টনী গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা বহু পূর্বেই স্বীকৃত হয়েছে। উপক‚লীয় সবুজ বেষ্টনী প্রকল্পের অধীনে ব্যাপক বনায়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন উপক‚লীয় বাস্তুসংস্থানের সংরক্ষণ ও উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখবে। প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন ২০১৭ সালে ফরেস্ট অ্যান্ড ওয়াটার শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলেছে, বনভূমি শুধু জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের আধারই নয়, সুপেয় পানি ধরে রাখে বৃক্ষ। ফলে কোনো এলাকায় বনভূমি কমে গেলে সেখানে মরুকরণ, ভূমিধস ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় বেড়ে যায়।
১৯৭৯ সালে দেশের প্রথম জাতীয় বননীতি প্রণীত হয়। সময়ের চাহিদা ও বন খাতের বিদ্যমান সার্বিক অবস্থার নিরিখে ১৯৭৯ সালের জাতীয় বননীতি সংশোধন করে ১৯৯৪ সালে একটি নতুন জাতীয় বননীতি গৃহীত হয়। এ নতুন বননীতি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বাস্তুসংস্থানিক ভারসাম্য রক্ষায় বনভূমির সংরক্ষণ ও বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। এই বননীতি বাংলাদেশের বনাঞ্চল বৃদ্ধি, রিজার্ভ বন সংরক্ষণ করা এবং বনায়ন ও কৃষি বনায়নে বিনিয়োগে উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল সংরক্ষণের প্রস্তাব করা হয়। প্রাকৃতিক সম্পদ ও এসব সম্পদের অনুক‚ল বাস্তুসংস্থানের সুরক্ষা ও ব্যবস্থাপনার ওপর টেকসই উন্নয়নের নির্ভরতা উপলব্ধি থেকে ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংরক্ষণ কৌশল গৃহীত হয়।
বন ও বনসম্পদ, অর্থাৎ মাটি, পানি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা হয় কার্যত বাস্তুসংস্থান ও প্রজাতি পর্যায়ে। বাস্তুসংস্থানিক পর্যায়ে বনভূমি সংরক্ষণের কৌশল নিম্নরূপ: ১. সংরক্ষিত অঞ্চলের ব্যবস্থাপনা, ২. বনভূমি থেকে বৃক্ষ কর্তনের জন্য সংরক্ষণধর্মী পদ্ধতি গ্রহণ বা বনাঞ্চল থেকে পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বনজসম্পদ আহরণ। বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, জাতীয় পার্ক ও শিকারের জন্য নির্ধারিত বনাঞ্চল সংরক্ষিত অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ (সংশোধনী) আইনে সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণার শর্তসমূহ ও আইনগত অবস্থান উল্লিখিত হয়েছে। সরকার উক্ত অনুচ্ছেদের শর্তানুসারে সরকারি গেজেটে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, জাতীয় পার্ক ও শিকারভূমি ঘোষণা করতে পারে।
বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) (সংশোধনী) আইন-এর শর্তসমূহ হল অভয়ারণ্যে কোন ব্যক্তির প্রবেশ বা বসবাস, উদ্ভিদের ক্ষতি বা ধ্বংস সাধন, বন্যপ্রাণী শিকার, বহিরাগত প্রাণী প্রবর্তন, গৃহপালিত পশুচারণ, অগ্নিসংযোগ ও পানিদূষণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও জাতীয় পার্কগুলির সীমানার এক মাইলের মধ্যে প্রাণী শিকার, হত্যা বা ধরা নিষিদ্ধ। অবশ্য সরকার বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রয়োজনে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি কিংবা সংরক্ষিত অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য এসব বিধিনিষেধ আংশিক বা সম্পূর্ণ শিথিল করতে পারে এবং সংরক্ষিত অঞ্চলে রাস্তাঘাট, বিশ্রামাগার ইত্যাদি নির্মাণের অনুমতি প্রদান করতে পারে। সরকার কিছু শিকারভূমিতে বন্যপ্রাণীর সর্বোচ্চ সংখ্যা, শিকারের নিদির্ষ্ট স্থান ও সময় উল্লেখপূর্বক বন্যপ্রাণী শিকারের বিশেষ অনুমতি দিতে পারে।
বাংলাদেশ বিশ্বের বিপন্ন বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতির আন্তর্জাতিক ব্যবসা সংক্রান্ত কনভেনশন, আন্তর্জাতিক গুরুত্বসম্পন্ন জলাভূমি, বিশেষত জলচর পাখিদের আবাস সম্পর্কিত কনভেনশন/রামসর কনভেনশন, বিশ্ব সংস্কৃতি ও প্রাকৃতক ঐতিহ্য সংরক্ষণ সম্পর্কিত কনভেনশন/বিশ্ব ঐতিহ্য কনভেনশন, জীববৈচিত্র্য সম্পর্কিত কনভেনশন, মরুকরণ প্রতিরোধ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক কনভেনশন এবং বিশ্ব ব্যাঘ্র ফোরাম ইত্যাদির মতো কয়েকটি পরিবেশ সংক্রান্ত কনভেনশনের সঙ্গে যুক্ত। এসব কনভেনশন বাস্তুসংস্থানিক ও প্রজাতিগত উভয় পর্যায়ে বনাঞ্চল সংরক্ষণে সহায়তা করে। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ও এ বনাঞ্চলের বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য যথাক্রমে কনভেনশনের বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমির তালিকায় এবং বিশ্ব ঐতিহ্য কনভেনশনের বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এসব কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী হিসেবে বাংলাদেশ কনভেনশনের অন্তর্ভুক্ত স্থানসমূহের প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণে অঙ্গীকারবদ্ধ।
লেখক: সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।